আচার ০১৭: চার অংকের সংখ্যাগুলো

শৈশব, কৈশোর আর তারুণ্য- মানুষের বেড়ে ওঠার এই সময়টাকে একসাথে অনেকে ছোটবেলা বলে ডাকেন। আমিও ডাকি। কি সময় ছিল! কল্পনার লাগাম ছিল না কোন। চোখের পলকে হয়ে যেতে পারতাম অন্তরীক্ষের নভোচারী বা সাগরতলের ডুবুরী। বাস্তবতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চোখের পলকে নিজেকে পালটে নিতে পারতাম। কিন্তু আজ যৌবনে এসে কি থেকে কি হয়ে গেল, কল্পনাগুলো বাস্তবের চোখ রাঙানিতে চুপসে যায় নিমিষে। বাড়তে পারে না, বুক চেরা দীর্ঘশ্বাসই সম্বল।

শৈশবে আর কৈশোরে পড়তাম রকিব হাসানের তিন গোয়েন্দা, জুল ভার্নের বাংলা অনুবাদ, মার্ক টোয়েনের হাকল বেরি ফিনের অভিযান। এদিক সেদিকে ছড়ানো আরো অনেক কিছু। ট্রেজার আইল্যান্ড কিংবা ভবেশ রায়ের শত মনীষীর কথা। তিন গোয়েন্দা পড়তে পড়তে একসময় নিজেকে রবিন মিলফোর্ড মনে হতো। পড়ার টেবিল আর তার আশেপাশের এলাকাকে চোখ খোলা রেখেই বদলে দিতে পারতাম লস এঞ্জেলেসের এক জাংক ইয়ার্ডের জঞ্জালের নিচে পড়ে থাকা ট্রেলারে। একদম কষ্ট হতো না। কিংবা প্রশান্ত মহাসাগরের এক জনশূণ্য দ্বীপ অথবা আফ্রিকার গহীন জংগলে। নিজেকে তিন গোয়েন্দার একজন মনে করতে চেষ্টা করতে হতো না কোন। আমার শৈশবের চোখদুটোতে স্বপ্নীল সব জগত এসে উঁকি দিয়ে যেত। জুল ভার্ন পড়ে নিজেকে ভাবতাম ক্যাপ্টেন নিমো, সাগরতলে ভেসে বেড়ানো সাবমেরিন হয়ে যেত বাসার ডাইনিং টেবিলের নিচটা। চোখমুখ শক্ত করে সিন্ধান্ত নিতাম আমার ডুবোজাহাজের পরের মিশন কি হবে। হাকল বেরি ফিনের চুরি করা বেলুন হয়ে যেত বাসার আলমিরার উপরের জায়গাটা। হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে যেতাম। আমার চারফুটি শরীরের কাছে সাতফুটি আলমিরার উচ্চতাটাই আকাশ হয়ে ধরা দিত। ট্রেজার আইল্যান্ড পড়ে স্টিলের স্কেলটা হয়ে যেত তলোয়ার আর আমি হতাম ক্যারিবিয়ান কাঁপানো কুখ্যাত জলদস্যু। ভবেশ রায়ের শত মনীষীর কথা পড়তে পড়তে কতদিন কতভাবে কত মনীষীর মতো হতে চেয়েছি। মার্কো পলো বা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। কিংবা আমাদের সুভাস বসু। মনে হত, বড় হয়ে আমি এইরকম হবো।

বয়স বাড়লো, মানুষ আমাকে তরুণ বলে গণ্য করা শুরু করলো। রুচিতে পরিবর্তন আসলো, পড়া শুরু করলাম মাসুদ রানা, শীর্ষেন্দু, সমরেশ, সুনীল আর জাফর ইকবাল। জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাসগুলো তরুণ হয়েই পড়েছি। খুব ভালো লাগত। আমার বন্ধু রাশেদ পড়ে কেঁদেছিলাম। আমি রাশেদ হতে চেয়েছিলাম। মাসুদ রানা পড়ে মাসুদ রানা হবার শখ কখোনোই জাগেনি তবে কমান্ডো হতে চেয়েছিলাম। শীর্ষেন্দু ভালো লাগত, সুনীলও। কিন্তু উনাদের উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে নিজের মধ্যে ধারণ করার শখ জাগেনি। জেগেছিল সমরেশের কালবেলা পড়ে, আমি অনিমেষের মতো দিন বদলানোর স্বপ্ন দেখেছিলাম। কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সুকুমার বোধগুলো কিছুটা ভোঁতা হয়ে গেল। তবু ক্রিকেটের দুর্দান্ত একজন পেস বোলার দেখে তার মতো হতে চেয়েছি, কিংবা বাস্কেটবলে কোবে ব্রায়ান্টের মতো অসাধারণ ক্লাচ খেলা খেলতে চেয়েছি। হয়নি কিছুই।

গত দু’তিন বছর ধরে একটা জিনিস লক্ষ্য করি সবসময়। কারো কিছু ভালো লেগে লেগেই আমার মনের গহীনে তার মতো হওয়ার একটা বাসনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অন্তর্জালটা হাতের কাছেই থাকাতে তাদের সম্পর্কে তথ্য বের করে আনতে কোন অসুবিধা হতো না। এই তথ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেয়াল করি জন্মসালটা। দেখি হয়তো বয়সে আমার চেয়ে ছোট নইলে প্রায় সমবয়সী। চার অংকের সংখ্যাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসে। আমি বুঝতে পারি, আমার এদের কারো মতোই হওয়া হবে না। কেননা, সময় নেই। সময় থাকে না।

৩,২৯০ বার দেখা হয়েছে

৩৪ টি মন্তব্য : “আচার ০১৭: চার অংকের সংখ্যাগুলো”

  1. সামিয়া (৯৯-০৫)

    আমাদের জীবনের একটা বড় অংশ আমরা কাটিয়ে দেই অন্যের মত হতে চেয়ে এবং চেষ্টা করে, আমরা জানিই না আমাদের মনের ঘুড়িটা কত্ত উচুতে উঠতে পারে, কারণ আমরা আসলে ঘুড়িটাকে খুজেই পাইনা। নিজের ঘুড়িটাকে খুজে পেলেই কেল্লা ফতে, আরামসে উড়াতে থাকুন। :guitar: :guitar:

    মজার ব্যাপার কি জানেন তৌফিক ভাই, আপনার কথা শুনেই কিন্তু এই রিয়ালাইজেশনটা আমার হয়েছিল একদিন, আপনার কথাগুলোকেই শুধু অন্যভাবে আপনাকে ফিরায় দিলাম :grr:

    জবাব দিন
  2. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    তৌফিক খবর কী?
    পোস্টটা ভালো লেগেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তোমার লেখার সাথে সুর মিলিয়ে অনুনাদ করতে পারলাম না। কারণ আমি সারা জীবনে কখনোৈ কারো মত হতে চাইনি। আজ যা হয়েছি বা আগে যা ছিলাম কিংবা ভবিষ্যতে যা হবো, অর্থাৎ কিনা একজন অতি সাধারণ আমিন হয়েই থাকতে চেয়েছি এবং চাই।

    জবাব দিন
  3. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    "আমি বুঝতে পারি, আমার এদের কারো মতোই হওয়া হবে না।"

    - ওদের মতো হতে হবে কেনো? :grr: :grr: তুমি কত্তো 'ভালা একটা পোলা', তুমি তোমার মতোই থাকো, যাবতীয় সাধারণ+বিশেষ গুণে গুণাণ্বিত হয়ে।


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  4. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    একেবারেই আমার বইপড়ার লাইন লেংথ এইরকমই ছিল। সবারই কি তাই হয়? প্রথমে তিন গোয়েন্দা, কিশোর ক্লাসিক, এরপর মাসুদ রানার হাত ঘুরে সাহিত্য জগতে প্রবেশ। এই লেখা পড়ে নিজের বইপড়া নিয়ে একটা পোস্টাইতে ইচ্ছা করছে। যাই হোক পরে দিব নে।
    দোস্ত কত কিছু স্বপ্ন দেখতাম। নিজের মত হয়ে সন্তুষ্ট আছে কি নাই সেটা বড় কথা না কথা হল স্বপ্ন আর দেখতে পারি না। এইটাই কষ্ট দেয়।

    জবাব দিন
  5. রকিব (০১-০৭)
    নিজের ঘুড়িটাকে খুজে পেলেই কেল্লা ফতে, আরামসে উড়াতে থাকুন।

    সহমত :thumbup:

    বয়স খুব একটা বেশি হয়নি, তবুও কেন যেন নিজেকে বেশ পরিতৃপ্ত মনে হয়।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  6. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    তৌফিক,
    তোমার অনেকগুলা স্বপ্নের সাথেই নিজের স্বপ্নগুলার মিল খুঁইজা পাইলাম...আমি তো নিজেকে রীতিমত বাংলাদেশ টিমের দুর্দান্ত অলরাউণ্ডার বানায়া খাতার পিছনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে টেস্ট ম্যাচ খেলতাম...তাও বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়ার অনেক আগে থেকে; আমার সহখেলোয়াড় ছিল নান্নু, বুলবুল, ফারুক, আতাহার, প্রিন্স-এরা... :shy:
    আবার মাঝেমাঝে ঢালিউডেও ডেব্যু করে ফেলতাম মৌসুমী অথবা শাবনাজের সাথে... :dreamy:

    একটা স্বপ্ন অবশ্য এখনো ছাড়ি নাই...সেইটা হইলো বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার...কারণ, ওইটার এখনো বয়স আছে 😀


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : আমিন (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।