ব্লগরোল ০১

১।

সিসিবিতে আমার সিরিজ আছে দুইটা। পরবাসীর রোজনামচা আর আচার। নতুন প্রোগ্রামের ঠেলায় পড়ে এই দুই সিরিজেরই নতুন কোন পর্ব লেখার ম্যাটেরিয়াল পাচ্ছি না। স্মৃতিচারণ করা যায়, কিন্তু ক্যাডেট কলেজ বিষয়ক স্মৃতি আমার কাছে কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগে। পোলাপাইনের সাথে আড্ডায় বসলে মনের গভীর থেকে সেইগুলা উগলে আসে, জাবর কাটি। আড্ডা শেষে আবার ধোঁয়া।

নতুন একটা সিরিজ শুরু করুম ভাবতেছি। এইটা তার প্রথম কিস্তি। সিরিজের নাম ব্লগরোল। যদিও শাব্দিক অর্থ ভিন্ন, তবে ক্রিমরোল, মিটরোল, ভেজিরোল ইত্যাদির সাথে মিল রেখে ব্লগের সাথে শব্দের খেলায় নতুন নাম ব্লগরোল।

২।

সামি ভাই বান্ধাগরু লেখাটা লিখছিলেন অনেক আগে। সেইটা তখন ভালোমতই বুঝি নাই, এখন বুঝতেছি। কারণ নিজেই বান্ধাগরুতে রুপান্তরিত হইছি ইমিগ্রেশন কানাডার অশেষ কৃপায়। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যে ব্যাপারটা সেইটা হইল, বাসায় গিয়া বলা যায়, খিদা লাগছে, খাবার দাও। মাস্টার্সের সময় বাসায় যাওয়াটা একটা বিতৃষ্ণার ব্যাপার ছিল। খালি বাসায়, খালি ফ্রিজের কাছে ফিরতে ইচ্ছা করত না। ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফেরার পথে যে গ্যাস স্টেশনটা ছিল, সেইটাতে একটা ড্রাইভ থ্রু ম্যাকডোনাল্ডস ছিল। গাড়ি না থাকলেও সেই ড্রাইভ থ্রু ম্যাকে আমি ওয়াক থ্রু করে সস্তার বার্গার কিনতাম, গ্যাস স্টেশনের খালি পার্কিং লটের কোনায় বসে সেইটারে সাবাড় করতাম। কিন্তু এখন আর সেইদিন নাই, আমি এখন “ডেডলি ওয়ারিয়র” ;;; গ্রুপের গর্বিত সদস্য। মিলারে অনেক ধন্যবাদ। 🙂

৩।

নিজের গায়ে না লাগলে কোনকিছুই আমাকে স্পর্শ করে না। যেমন বিডিআর গণহত্যার সময় জিহাদ যখন প্রথম খবরটা দিল, অন্য দশটা খবরের মতোই ছিল সেটা। গ্যালারিতে দর্শকের আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম কি ঘটে সেটা দেখার জন্য। পরে যখন ড্রেন দিয়ে মানুষগুলোর লাশ বের হতে শুরু করল, যে মানুষগুলো আমাদেরই ভাই, বন্ধু, বাবা; তখন ব্যাপারটা খুব ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকটা মৃত্যু খবর নিশ্চিত করে ব্লগ আপডেট হচ্ছিল, আমি আমার অফিস ঘরে একলা বসে ছিলাম। ক্রোধ না দুঃখে চোখে পানি জমে উঠছিল বারবার বলতে পারব না। আমার বিশ্বাস, যাদের প্রিয়জন হারিয়ে গেছেন তাদের হারানোর গভীরতা এতো দূর থেকে তো নয়ই, কাছে থেকেও বোঝা সম্ভব ছিল না।

একইভাবে আদিবাসীদের অপ্রেশন নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনো, কারণ আমি তো ভালো আছি। সেটাও ব্যক্তিগত হয়ে গেল সুন্দরবন ঘোরার সময়। লঞ্চের ডেকে ইতুকী আপা যখন উনার পাহাড়ের অভিজ্ঞতা বলছিলেন, কি গভীর বিষাদ ছিল তার কন্ঠে! নিজেকে উনার জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে উনার একটা দিনের ভেতর দিয়ে যাওয়া কথা ভাবতেই বুঝেছিলাম সেটা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হতো না।

৪।

এতোক্ষণ মন খারাপ করা অনেক কথা বললাম। এবার মন ভালো করার একটু চেষ্টা করি। আমি কানাডা ফেরত আসি ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখে, বাসা ঠিক করা ছিল মার্চের এক তারিখ থেকে। মাঝের কয়টা দিন আশ্রয় দিয়েছিলেন অগ্রজপ্রতিম সাকিব ভাই আর সায়মন ভাবী। তাদের একটা মেয়ে আছে, নাম সাদিদা। ও যখন প্রথম কানাডায় আসে বয়েস ছিল দুই বছর। প্রায়ই নাকি তখন বায়না ধরত, একটা সি এন জি ডেকে দাও, আমি কলাবাগান চলে যাব। গত একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে ভাবী যখন বললেন, মামনি বলতো, আই লাভ বাংলাদেশ। ও বলেছিল, আই লাভ কলাবাগান।

আসার পরপরই ওকে ভাইয়া-ভাবী ডে-কেয়ারে দিয়েছিলেন। পড়াশোনা করা আর বাচ্চা সামলানো তো মুখের কথা না। ডে-কেয়ার তার ভালো লাগত না, কারণ টিচার নাকি কিছু পারে না, কিছুই জানে না। টিচারের অবশ্য কি দোষ, সাদিদা টিচারের সাথে গিয়ে বাংলায় গপ্পো জুড়ে দিত। বেচারা টিচার তো আর মাথা নাড়া ছাড়া আর কিছুই করতে পারত না। এখন অবশ্য অবস্থা অনেক ভালো। সে এখন ইংরেজি বলে ফটফট করে। মা-বাবাও তার সাথে ইংরেজিতে কথা বলে, বাইলিংগুয়াল বানানোর জন্য। তো আমরা যখন ওদের বাসায় ছিলাম, এক ছুটির দিনে ওর ডে-কেয়ারের টিচার ফোন করল সাদিদার সাথে কথা বলবে তাই। যে মেয়েটা সারাদিন বাসায় ইংরেজিতে কথা বলে, সেই মেয়ে ফোন ধরে খাস বাংলায় বলে, ম্যান্ডি, তুমি আমাদের বাসায় আসবে, তুমি আমাদের বাসায় আসো। অন্যরুমে বসে থাকা আমাদের দুজনের জন্য হাসি চেপে রাখা সত্যি কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল তখন।

৫।

কানাডায় পিচ্চি থাকলে বাসা খোঁজা একটু কষ্ট। কি আজব ব্যাপার, pets এলাউ করে, বাচ্চা না। এখানকার এক বাংগালি স্টুডেন্টের হাজবেন্ড আর বাচ্চা আসল কিছুদিন আগে। উনি আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও বাসা পেলেন না একটা। আমাদের বাসায় এক্সট্রা বেডরুম ছিল, উনারা সেইখানে উঠলেন। পিচ্চির নাম অভ্র। সে সারাদিন বাসায় ঘুরাঘুরি করে, নিজের বাপরে ইচ্ছামত অমিভাই বলে ডাকে। ভুল ধরায়ে দিলে বলে, আচ্ছা অমিবাবা, আর অমিভাই ডাকব না। =))

৩,২৩৪ বার দেখা হয়েছে

৭৪ টি মন্তব্য : “ব্লগরোল ০১”

  1. আন্দালিব (৯৬-০২)
    সে সারাদিন বাসায় ঘুরাঘুরি করে, নিজের বাপরে ইচ্ছামত অমিভাই বলে ডাকে। ভুল ধরায়ে দিলে বলে, আচ্ছা অমিবাবা, আর অমিভাই ডাকব না।

    :))

    ক্রিম রোলের মতোন ব্লগরোলের ভেতর তো অন্য জিনিস থাকার কথা, সেইটা ভাবছিস?

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)

      কি বুঝতে কি বুঝলা? 😕

      আমাদের কোন পিচ্চি নাই। 🙂

      ইচ্ছা আছে, ইনশাল্লাহ। মামুন ভাইরে নিয়া নিউফাউন্ডল্যান্ডে বেড়ানোর আমন্ত্রণ থাকল। নিউফাউন্ডল্যান্ডের সামার সিম্পলি অছাম। 🙂

      জবাব দিন
      • পোলাপানের সমস্যা কি? ৩৪ এমসিসি এর সবাই বেশি বুঝে 😛
        আমি অবশ্য কিছু মনে করে বলি নাই। তবে তোমার প্রতিক্রিয়া দেখে সন্দেহ হয়, ডাল মে কুচ কালা হে :grr:
        আমি বলতে চাইলাম অনেকদিন কোন বাংলাদেশী পিচ্চি দেখি না। এইখানকার পিচ্চি গুলাকে অনেক আদর লাগে, সমস্যা এক্টাই এদের জাপটায়ে ধরে আদর করা যায় না, তুই বললে বুঝে না, পিচ্চি বললে ক্ষেপে যায় বলে "I am not baby"।

        জবাব দিন
  2. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    ব্লগরোল সুস্বাদু হইছে। বাচ্চাকাচ্চার কাজকর্ম ইদানিং মনযোগ দিয়া দেখতেছিস মনে হইতেছে 😛
    তয় একখান মেশিন আছিলো ড়্যাপিড প্রটোটাইপিং নামে, মনে হয় একটা ইম্পোর্ট কইরা অইটার ম্যানুয়াল পইড়া হাউস মিটানি লাগবো 🙁


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ভালই এক্সপেরিয়েন্স গ্যাদ্যার করতেছিস দেখা যায় 😉

    লেখা বরাবরের মতই দূর্দান্ত হয়েছে, পরের রোল তাড়াতাড়ি ছাড়।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাব্বির (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।