আচার ০২৭: পিচ্চি মানুষ

সিসিবিতে প্রথম জয়েন করার ভেবেছিলাম ছদ্মনামে লেখব। যখনকার কথা বলছি তখনো সিসিবির প্রচলিত রীতি নীতিগুলো গড়ে ওঠে নাই, ছদ্মনামে লিখতেনও কয়েকজন। কি বলেন কাইয়ূম/ফৌজিয়ান ভাই? ;)) ছদ্মনাম হিসাবে পছন্দ হলো নন্দঘোষ নামটাকে। আমার কলেজ লাইফকে এই একটা শব্দ বেশ তাৎপর্যপূর্ণভাবে এক কথায় প্রকাশ করে দিতে পারে। ইতরামি-বানরামি যে করি নাই এমন না, কিন্তু গ্রুপ ফল্ট হইলেই আমারে কলেজ অথরিটি ঝুলায়ে দিত, আমি সেইখানে থাকি বা না থাকি। তাই কলেজে থাকতেই নন্দঘোষ হওয়ার কি দুঃখ বুঝে গেছিলাম। কলেজ থেকে বের হওয়ার পরও এই দুঃখ ঘুচে নাই আমার। এই তো কয়দিন আগে আমার এক খালাতো ভাই বাসায় প্রেম করে বিবাহ করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আমাদের এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলিতে এইসবের বালাই নাই, সবাই বাপ মায়ের পছন্দমত পাত্র-পাত্রীর গলায় মালা ঝুলায়ে দেয়। প্রেম ভালোবাসা নষ্ট ছেলে মেয়েদের জিনিস- এই ছিল আমার ফ্যামিলির মুরুব্বিদের ধারণা। কিন্তু নতুন দিনের জয়গান গাইতে গাইতে, মরিচা ধরা ধ্যান ধারণার পচে যাওয়া মূলে কুঠারাঘাত করে, লাফাঙ্গা কিন্তু বিপ্লবী প্রকৃতির ছেলে হিসাবে নিজেকে পরিচিত করে প্রেম করে বিয়ে করে ফেললাম। মুরুব্বিরা নাক মুখ কুঁচকাইলেন বটে, কিন্তু আমাদের আশীর্বাদ ঠিকই দিলেন। এখন পর্যন্ত আমাদের ফ্যামিলিতে এটাই একমাত্র ইয়ে করে বিয়ে। যে খালাত ভাইয়ের কথা বলছিলাম উনি আমার এক বছরের বড়। উনি বিবাহের ইরাদা খালা খালুকে বলার পর উনারা তাকে কিছুই বললেন না, পরামর্শ করার জন্য আমার মাকে ফোন করলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফোনটা তুললাম আমি। ঝাল ঝাড়ার মতো একজন নন্দঘোষকে পেয়ে খালা পুরা ঝাল আমার উপর তুললেন, “তুই প্রেম করে বিয়া করছিস, এখন সবাই প্রেম করে বিয়ে করবে। তুইই শুরু করলি, তুইই সবাইকে পথ দেখাইলি।” লে হালুয়া… বয়েসে বড় খালাত ভাই প্রেম করছেন আর দোষ হইছে আমার!!! দুইন্নাতে আসলেই ইনসাফ নাই। 🙁

আমার নন্দঘোষামি এইখানেই শেষ না, আরও আছে। আমার ভাগ্নে একটু চঞ্চল প্রকৃতির। সে জন্মাবার এক দিন পর তার হাত পা ছোঁড়া দেখে আমার শ্বশুর আব্বা ইংরেজি বা বাংলা না, একেবারে সংস্কৃত শ্লোক আওড়ে ফেলেছিলেন। নরনং মাতুলনং নমঃ (সংস্কৃতে আমার বুৎপত্তি আরবির মতো, কাইফা হালুকা ছাড়া আর কিছু জানি না। বিজ্ঞজনেরা ভুল হইলে ধরায়ে দিবেন)। অর্থ, ছেলেরা মামার মতো হয়। লে হালুয়া… বোনের বাচ্চা কুস্তি করে আর দোষ হয় আমার!!! দুইন্নাতে আসলেই ইনসাফ নাই। 🙁

আজকে এই মাতুলনং নমঃ ছেলেটাকে নিয়েই কথা বলি বরং, আমার নন্দঘোষামির প্রসংগ থাক। এই ছেলের সাথে আমার দেখে হলো তার জন্মের এক বছর পর। সে সাধারণত নতুন লোকজনের সাথে ভাব জমাইতে একটু সময় নেয়। কিন্তু আমি বাসায় যাওয়ার পর পনের মিনিটের মধ্যে তার সাথে দোস্তি হয়ে গেল। আম্মা বললেন, রতনে রতন চেনে। (আবারও লে হালুয়া…) আমার অবশ্য একটু পূর্বপ্রস্তুতি ছিল ভাগ্নের সাথে প্রথম দেখার ব্যাপারে। সিসিমপুর নামক কি এক কার্টুন আছে, সেই কার্টুনের সিডি টিভিতে না ছাড়লে তিনি সাধারণত খাওয়া দাওয়া করেন না। সেই সিসিমপুরকে কানাডায় বলে সিসিমি স্ট্রিট। ক্যারেক্টারগুলা একই থাকায় কানাডা থেকে সিসিমপুরের একটা পুতুল নিয়ে গিয়েছিলাম ভাগ্নের জন্য। সেইটা ঘুষ দেওয়ার সাথে সাথেই সে আমার কোলে এসে পড়ল। কলিকাল আসলেই এসে গেছে, পিচ্চি বাচ্চারাও ঘুষ খাওয়া শিখে গেছে। দুইন্নাতে আসলেই ইনসাফ নাই। 🙁

বাসায় থাকলে অবসরে আমি আমার বড়বোনের পিছনে লাগি, বিরাট মজা। এখন বড় হয়ে গেছি, আগের মত লাগতে পারি না। কিন্তু আমার লেগেসি তো পাস করতে হবে, তাই ভাগ্নেকে সাগরেদ বানিয়ে ফেললাম। বয়েস এক বছর হলেও তার ফিচেল বুদ্ধি কম না, এই কয়দিন তাকে ট্রেনিং দিয়ে মাকে কিভাবে “গুঁতু” দিতে হয় শিখিয়ে ফেলেছি। 😀 সেও গুরু হিসাবে আমাকে ভালোই মান্য করে। সবসময় আমার সাথে সাথে থাকে। ওইদিন সে আমার রুমে লকপক করে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসল। আমি বিছানায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে ছিলাম। এই বস্তুটার দিকে তার আগ্রহ অসীম। বেচারার হাইট আড়াই ফুট বলে অনেক চেষ্টা করেও আমার বিছানায় সে উঠতে পারছিল না। আমার পাষাণ হৃদয়ে দয়া হল একটু, ওকে টান দিয়ে উঠিয়ে নিলাম। বদমাইশের ভাইগনা করল কি, সাথে সাথে হিসি করে আমার বিছানা ভাসিয়ে দিল। একটুর জন্য আমার ল্যাপটপটা মূত্রাহত (স্বপ্নাহতের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক :grr: ) হয় নাই। মাসুম বাচ্চা, তাই রাগ করতে পারলাম না।

রাগ করতে না পারলেও ভাবলাম ওরে একটু সবক দেওয়া দরকার, আরেকবার যেন আর না করে এই কান্ড। কোথায় যেন পড়ছিলাম ভালো কমিউনিকেশানের জন্য যার সাথে কমিউনিকেট করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তার লেভেলে নেমে কথা বলতে হবে। অতএব, আমি চিন্তা শুরু করে দিলাম কিভাবে এই মাসুম বাচ্চার লেভেলে পৌঁছে তার সাথে কমিউনিকেট করা যায়। বয়েস এক বছর, সুতরাং তার মধ্যে রেশনালিটি বেশি নাই। রিজন করে এর সাথে লাভ হবে না, হয়তো আমার কথা বুঝবেই না। ভয় দেখালে কাজ হতে পারে বলে আমার মনে হল।

ও ঘুমাবার আগে ওর রুমে গেলাম সবক দেওয়ার জন্য। বললাম, এই ব্যাটা তুই যে আমার বিছানা ভাসিয়ে দিয়ে আসলি, এখন যদি একই কান্ড আমি তোর বিছানায় করি, তোর অবস্থাটা কি হবে চিন্তা করছিস?? একদম স্ট্রেইট বানভাসি মানুষ হয়ে যাবি, হেলিকপ্টার থেকে ত্রানসামগ্রী ফেলতে হবে, বুঝতে পারছিস?? ও কি বুঝল কে জানে, আমার দিকে তাকিয়ে উপরের পাটির চার দাঁত আর নিচের পাটির চার দাঁত, সাকুল্যে আট খানা দাঁত বের করে হাসি দিল। হাসির অর্থ আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, আমার হুমকি সে বিশ্বাসই করে নাই। 🙁

(আগের পোস্টটা লিখে মনটা তেতো হয়ে ছিল। সেটা কাটাতেই এইটা লিখে ফেললাম। সিসিবিতে আজাইরা পোস্ট আরেকটা বাড়ায়ে দিলাম।)

৪,৫২৮ বার দেখা হয়েছে

৫৫ টি মন্তব্য : “আচার ০২৭: পিচ্চি মানুষ”

    • তৌফিক (৯৬-০২)

      ভাবী, আমার ব্লগে স্বাগতম। 🙂

      আমি সাধারণত বিভিন্ন শিক্ষামূলক বিষয় নিয়ে ব্লগিং করে থাকি। এই ব্লগের অনেকগুলা মোরালের ভেতর একটা মোরাল হল, দুইন্নাতে আসলেই ইনসাফ নাই।

      মেজাজ ভালো করতে পেরে অনেক ভালো লাগল। ভালো কথা, আপনার দেবরকে জিজ্ঞাসা কইরেন, চিনবে আমাকে। 🙂

      জবাব দিন
      • মেলিতা

        ঠিক আছে ওকে বলবো।আমার বর তো অবশ্য আগেই চিনেছে।আইইউটি এর সাব্বির(আজিমুদ্দিন)& ফিরোজ আমার কলিগ ছিলো।তুমি নিশ্চয় চেনো ওদের।(ব্যাচমেট তাই তুমি করে বল্লাম)
        আসলে লেখার প্রথম ৩ প্যারার শেষে ‘দুইন্নাতে আসলেই ইনসাফ নাই।‘ আছে। তাই ভাব্লাম শেষের ৩ টাতেও দিবে।

        জবাব দিন
  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    :))

    আইজকাইল্কার পিচ্চি পোলাপাইন বড়ই পোংটা। ছোডবেলায় আমরা এমুন আছিলাম না। 😛

    এইটা বেশি মজা হইছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    তুইই শুরু করলি, তুইই সবাইকে পথ দেখাইলি।

    ভাইয়া দেখি গাই উইথ দ্যা ল্যাম্প (ক.রা.- ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল)। যাউকজ্ঞা, ব্লগে এখনো কতিপয় গুরুজন আলো দেখিতে পান নাই, আপনি তাহাদের সহিত আমারেও কিছু আলো দেখান। 😛
    ভাগিনারে বড় পছন্দ হইছে, নিশ্চিত পরেরবার সে আর ভুল জায়গায় মিসাইল ফেলবে না, এক্কারে মনিটরের উপ্রেই ছাড়বে। :grr:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ভাগ্নারে সবসময় দৌঁড়ের উপর রাখবি... :grr:
    আহ্লাদ দিলেই মাথায় উঠব... :-B
    তখন খালি ইমোশনাল বিলাকমেইল করব কিন্তু... :no:


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. দিহান আহসান

    ভাইয়া এতদিন সিসিবিতে না থাকার ফলে পড়া বা মন্তব্য করা হয়ে উঠেনি,
    ভালো লিখেছো, এখন ভাইগ্না'র সাথে আর আমাদের এইখানে এসে ভাতিজা'দের সাথে থেকে কিছু টেরেনিং নিয়ে যেও, পরে কাজ়ে দিবে 😛

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    সিসিবিতে আমার রেজিস্ট্রেশন নিক দিয়ে 😀
    তবে নিকটা দখলে নিয়া ব্যাপক শান্তি পাইছিলাম B-)

    প্রথম প্রথম কমেন্ট এমনকি দুই তিনটা লেখাও মনে হয় নিক দিয়াই দিছিলাম। কিন্তু আস্তে আস্তে সিসিবি'র চরিত্রটা যখন ধরতে পারা শুরু করলাম তখন আর নিক ফিকে নাই 😀
    সিসিবিই একমাত্র ব্লগ আমার মনে হয় যেখানে বেশিরভাগ সদস্যই স্ব নামে লিখেন। দুই একজন হয়তো এখনো অন্য ব্লগের মতো নিক নিয়ে আছেন। হয়তো তারাও ভালোবাসার নিক ছেড়ে একে একে চলে আসবেন নিজ নিজ নামে, আমি এই স্বপ্নটাই দেখি 😉

    তৌফিকের একটানে লিখে যাওয়া এই ব্লগ গুলোর আমি একজন মুগ্ধ পাঠক। রিফ্রেশিং :hatsoff:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. লে হালুয়া…

    তৌফিক ভাই আমি ত হাসতে হাসতে শেষ! =))
    আর আজকালকার পিচ্চি গুলা এক একটা মাস্টার পিছ!আমার ভাগিনার বয়স আজ ২ বছর হল।কিন্তু আমি নিশ্চিত,আমি ২০ বছর চেস্টা করেও তার মত দুস্টামি শিখতে পারব না।ওর সবচেয়ে লেটেস্ট দুস্টামি হল হাতের কাছে কোন কিছু পেলেই জানালা দিয়ে ফেলে দিবে আর জিনিসের মালিকের কাছে এসে মাথাটা কাত করে মিস্টি একটা হাসি দিয়ে বলবে 'মঞ্জা মঞ্জা',যার বাংলা করলে দাড়ায় মজা মজা! তবে সে কিন্তু কখনই ভুলে তার নিজের কোন কিছু ফেলে না!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জেরিন

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।