আচার ০২৬: বাড়ির পথে

সুদীর্ঘ দুই বছর পর দুই সপ্তাহ পর দেশে ফিরে আসলাম। আসার পথে বিমানযাত্রাটা বেশ ঘটনাবহুল ছিল। সেইন্ট জনস থেকে উড়াল দিয়েছিলাম টরন্টোর উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে লন্ডনের ফ্লাইট ধরা হবে। ওখানে যাত্রাবিরতি ছিল তিন ঘন্টার মত। ব্লগ চাওয়ালা রকিবকে আগেই বলে রেখেছিলাম, ও এসে হাজির হয়েছিল এয়ারপোর্টে। ট্রানজিটের সময়টুকু আমরা কাটালাম ইতিহাস সৃষ্টি করে (সিসিবির প্রথম ওভারসিজ গেট টুগেদার করে)। লন্ডন পৌঁছার পর পরের গন্থব্য ছিল বাহরাইন। টিকিট ইকোনমি ক্লাসের হলেও সময়টুকু কাটালাম বিজনেস ক্লাসের মতো। আমার পাশের দুই সিট খালি থাকায় মাঝখানের আর্মরেস্টগুলো তুলে দিয়ে, তিন সিটের বিছানায় আমার দেহখানিকে কোনরকমে এলিয়ে দিয়ে বেশ আরামে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পৌঁছালাম বাহরাইনে। বাহরাইন থেকে এরপর সোজা বাংলাদেশ। বাহরাইন থেকে বাংলাদেশের ফ্লাইটটার অভিজ্ঞতা ছিল সবচেয়ে চমকপ্রদ।

ফ্লাইটের শতকরা নব্বই ভাগ লোক ছিলেন আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা। বাকিরা কানাডা বা ব্রিটেনে বসবাসরত বাঙালি। যে টার্মিনাল থেকে বোর্ডিং করা হবে সেখানে রিপোর্ট করলাম সময়মত। বেশ লম্বা লাইন ছিল। কিন্তু শ্রমিক ভাইয়েরা লাইনের তোয়াক্কা না করে বিমানে উঠার চেষ্টা করছিলেন, আমি ঝামেলায় না গিয়ে লাইনের পিছনের দিকে দাঁড়ালাম। এক প্রায় প্রবীন চাচামিয়া ছিলেন আমার সামনে। টুকটাক কথা চলছিল, পাঁচ মিনিটের মাথায় তিনি আমার রোজগার কত জিজ্ঞেস করে বসলেন। আমার বিরক্ত লাগেনি একটুও, ভালোই লেগেছিল সত্যি বলতে। এতদিন পর যেন দেশের স্বাদ পেলাম, মেকি ভদ্রতার খেতা পুড়ি। আমাদের দেশের প্রান্তজনেরা তো এরকমই, মুখ আর মনের মধ্যে কোন পর্দা তাদের থাকে না।

বিমানে উঠার পর যা দেখলাম তাতে একটু খারাপই লাগল। বিমানের এক কেবিন ক্রু নিজের টাই নাকে চেপে ধরে যাত্রীদের সিটে বসা তদারক করছিলেন। আমি কোন দুর্গন্ধ পেলাম না যাতে এরকম করতে হবে। নিজের সিটে বসে ওই ব্যাটার ভাবভংগি দেখে নিশ্চিত হলাম কি জন্য এরকম করছে। শুয়োরের বাচ্চা (ভদ্রজনেরা মাফ করবেন) এক নম্বরের একটা রেসিস্ট। তৃতীয় বিশ্ব থেকে ওদের দেশে শ্রম বিক্রি করতে আসা লোকগুলোর ছোঁয়া, শ্বাসের বাতাস- সবকিছুতে তার চরম ঘেন্না। মাথা কিঞ্চিত গরম হল। আরেক শ্রমিক ভাই কেবিন লাগেজ ওভারহেড কম্পার্টমেন্টে রাখতে গিয়ে সিটের হাতলের উপর দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি খাটো এয়ারহোস্টেসদের দেখেছি সিটের উপর দাঁড়াতে এই একই কাজ করার জন্য। কি এমন ক্ষতি হয়েছিল এতে আমি বুঝতে পারিনি। আরেক কেবিন ক্রু এসে তাকে বললেন নামতে, বেশ ভদ্রভাবেই বললেন। আমি ঠিক পাশেই ছিলাম ওই কেবিন ক্রুর, উনার শ্লেষভরা স্বগতোক্তিটা তাই শুনে ফেললাম। দাঁতের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারন করলেন তিনি “বা-ঙা-লি!” আস্তে বললেও পরিষ্কার শুনলাম কথাটা, উন্নাসিকতার বিষটুকুও কান এড়াল না। কানাডিয়ান আর ব্রিটিশ বাঙলিরাও খুব সূক্ষভাবে নাক উঁচু করছিলেন শ্রমিক ভাইদের দেখে, আমি দেখেছি।

বিমানে ওয়ারলেস কোন ডিভাইস ব্যবহার করা বারণ, যারা বিমানভ্রমণ করেছেন তারা জানেন নিশ্চয়ই। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই এই নিষেধাজ্ঞাটুকু দেয়া আছে। বিমানের সেনসিটিভ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বিকল হয়ে যেতে পারে ওয়ারলেস ডিভাইসের ট্রানসমিট করা সিগন্যাল যদি ওদের কাজে বাগড়া দেয়। মাইকে দুই তিনবার বলার পরও কেউই দেখলাম না তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ করেছেন। মেজাজ এবার গরম হলো দেশি ভাইদের উপর। বলে লাভ হবে না জানতাম, তাই তাদের অনুরোধ করিনি। কয়জনকেই বা করব। টেইক অফ করার সময় আল্লাহর নাম নিতে থাকলাম। মনে হচ্ছিল এতোগুলো মোবাইল সিগন্যাল রিসিভ আর ট্রানসমিট করছে, বিমানের যে কোন যন্ত্রপাতি যে কোন সময়ে বিগড়ে যেতে পারে। কেবিন ক্রুদের একতরফা দোষ দিয়ে লাভ নেই, আমরা নিজেরাও ওদেরকে খুব বেশি সুযোগ দেইনি ভালো ব্যবহার করার জন্য।

“ডিজএমবার্কেশন কার্ড” নামে এক বস্তু আছে যা প্রবাস থেকে ফেরা বাংলাদেশিদের পূরণ করতে হয়, ইমিগ্রেশানে জমা দেয়ার জন্য। পাসপোর্ট নাম্বার, নাম, অরিজিনাল পোর্ট অভ এমবার্কেশান ইত্যাদি কয়েকটা তথ্য লিখে দিতে হয় কার্ডটাতে। নিজেরটা পূরণ করলাম, তারপরের পয়তাল্লিশ মিনিট পূরণ করে দিলাম অগণিত লোকজনের। সময়টা দ্রুতই কেটে গেল এতে। তবে শেষে এসে কয়েক শ্রমিক ভাই যেভাবে বলছিলেন আমাকে উনাদের কার্ড পূরণ করে দেয়ার জন্য তাতে উনাদের দেশে ফেরার উৎকন্ঠাটুকু বেশ বুঝতে পারলাম।

সময়মতোই বাংলাদেশের আকাশসীমায় পৌঁছালাম। এই সময় নাক সিঁটকানো ভদ্দরনোক বাঙালিরা আর শ্রমিক বাঙালিরা এক সমতলে মিশে গেলেন যেন। সবাই ঘাড় ভেঙে উঁকি ঝুঁকি মারছিলেন জানলা দিয়ে, যদি একটুকরো বাংলাদেশও দেখা যায়!!

১,৮০৩ বার দেখা হয়েছে

৪২ টি মন্তব্য : “আচার ০২৬: বাড়ির পথে”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    কিরম ফাঁকিবাজ হইছে পোলাডা চিন্তা করেন সবাই!
    দেশে আসার একমাস পর 'বাড়ির পথে' পোস্ট দিছে x-(

    একটু অবসর পাইয়া নেই, তোদের জামাই-বউ দুইটারেই পাঙ্গামু ।

    আচ্ছা সত্যি সত্যি ক তোর রোজগার কত? 😉

    ভালো লাগছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)

      ফাঁকিবাজ না কামরুল ভাই, দাওয়াত আর কাউন্টার দাওয়াতের জ্বালায় কিছুই করতে পারি নাই এই কয়দিন।

      একটু অবসর পাইলে একটা গেট টুগেদার কল করেন না, ঈদের পর থেকে চাইয়া রইছি। আম্মারে বইলা রাখছি যেকোন দিন আমার ঢাকা যাওয়ার প্রয়োজন হইতে পারে।

      রোজগার আর কত। গরীব গ্র্যাড স্টুডেন্ট, দিন আনি দিন খাই। 🙁

      আমার সেল নাম্বার ০১৭২২৪৮৬০৪১, একটা এস এম এস দিয়ে আপনার নাম্বারটা দিয়েন। ;;)

      জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    মানুষ খালি সাদা চামড়ারে রেসিস্ট কয়। এই মধ্যপ্রাচ্যীয় শেয়ালমুখোগুলো দুইন্যার সবচেয়ে বড় রেসিস্ট।আমি ভার্সিটিতে একটার সাথে মহা গন্ডগোল বাধাইছিলাম। :gulli2:


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    শ্রমিক ভাইদের সাথে প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার। আমার কাছে কিন্তু ওদেরকে এতটা বিরক্তিকর মনে হয়নি। আমার পাশেই একজন শ্রমিক ভাইয়ের সিট পড়েছিল, আমি তাকে কোন আজেবাজে ব্যবহার করতে দেখিনি। আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণে লোকগুলোর বেশ সমস্যায় পড়তে হয়।

    তোমার লেখাগুলো সবসময়ই চমৎকার হয়! :thumbup:

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)
      আত্মবিশ্বাসের অভাবের কারণে লোকগুলোর বেশ সমস্যায় পড়তে হয়।

      একদম সঠিক অবজার্ভেশন।

      শ্রমিক ভাইদের কাজকর্মকে আমারও বিরক্তিকর মনে হয়নি, তাদের প্রতি একটা শ্রদ্ধা আমার সবসময়ই ছিল। তবে একদম সাদা চোখে দেখলে তাদের আচরণ পেসেঞ্জার সেইফটির জন্য খুব ভালো ছিল না। প্লেন থামার আগেই কেবিন লাগেজ নামানো শুরু করা, বিমানে হাঁটাহাঁটি করা শুধু শুধুই- এই কাজগুলো পেসেঞ্জারদের নিরপত্তাকেই বিঘ্নিত করে। আমি মনে মনে ভাবছিলাম উনাদেরকে দুই ঘন্টার একটা কোর্স করালেই তো হয়। তবে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপারটা মনে হয় ছেঁড়া জুতায় কালি লাগানোর মতোই হবে।

      অনেক ধন্যবাদ তানভীর ভাই। আপনার এনকারেজমেন্ট সবসময়ই গভীরভাবে এপ্রিসিয়েটেড। (কি বললুম!!!)

      🙂

      জবাব দিন
  4. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    নিজেরটা পূরণ করলাম, তারপরের পয়তাল্লিশ মিনিট পূরণ করে দিলাম অগণিত লোকজনের

    এই "অসভ্য,অমার্জিত" লোকগুলোর ঘামের টাকায় আমাদের দেশ চলে-আশির দশকের মত বিদেশের কাছে ভিক্ষা চাইতে হয়না।বিমানের কেবিন ক্রুদের টাকাও আসে এই এদের টাকা থেকেই।সাহিত্যিক আনিসুল হকের ভাষায়-দেশের অর্থনিতি চালাচ্ছে যারা,রেমিটেন্স নামের সাইলেন্ট রেভোলিউশনের মাধ্যমে ফকিন্নি এই দেশের(ভদ্রতা করে বলা হয় ডেভেলপিং কান্ট্রি) অর্থনিতির চাকা সচল রাখা এই লোকগুলোর ফর্ম পূরণসহ যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ করার জন্য সরকারের দশজন লোক দাঁড়িয়ে থাকবেনা কেন?

    জবাব দিন
    • মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

      তৌফিক ভাই,অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে এই লেখাটার জন্য।বিদেশি দূরে থাক-বিমানের সুন্দরী এয়ার হোস্টেসগুলোর কাজকর্ম দেখলে মনে হয় ঠাস করে বসিয়ে দেই একটা।

      জবাব দিন
      • তৌফিক (৯৬-০২)

        ভালো লাগল তোর ভালো লাগছে দেখে। রেমিটেন্সের একটা দিক আমার বউ আমারে শুনাইল ওইদিন। বিদেশ থেকে পাঠানো টাকা যখন ফ্যামিলির হাতে যায় তখন তারা সেই টাকা দিয়া মোবাইল কেনে, বাড়ি বানায়। সেই টাকাটা ঠিক ইনভেস্টমেন্টে যায় না। ফলাফল লাভ যতোটুকু হওয়া উচিত ছিল ততোটুকু হয় না। এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়ে ব্লগানোর জন্য যথাজায়গায় তদ্বির করা হইবেক। 🙂

        জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাব্বির (৯৫-০১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।