আচার ০১১: ভাবুক বিনে ভাব জাগে না

২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখ বোধ হয় সেইদিন। ১৮ ও হতে পারে, ঠিক মনে নেই। আমরা, মানে আই ইউ টি-র ০২ ইনটেকের সবার মনে তখন মিশ্র একটা অনুভূতি। পাস করার আনন্দ আর সেই সাথে সামনের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে শংকা। সবার বললে হয়তো ভুল হবে, কারণ কিছু বস পোলাপান পাস করার আগেই মোটা বেতনের চাকরী বাগিয়ে বসে আছে। আর আমার মতো ক্যাবলাকান্তরা কি হবে কি হবে মনে করে মাথার চুল পাকাচ্ছে। ব্যাচের ফূর্তিবাজ ছেলেপেলেগুলো তখন গ্র্যাজুয়েশন পার্টি নিয়ে ব্যস্ত। কত আয়োজন! টি শার্ট বানানো, কেক কাটা আর বারবিকিউ। চাদাঁ তুলে টি শার্ট বানানো হলো আর নিয়ে আসা হলো ইয়া বড় একটা কেক। পুরো ইউনিভার্সিটির জন্য। এতোই বড় ছিল কেকটা যে ইউনিভার্সিটির মাইক্রো লেগেছিল সেটা ঢাকা থেকে বয়ে আনতে। বারবিকিউ-এর দিন রাতে নিয়ে আসা হলো ৫-৬ টা ছাগল, কাবাব বানানো হবে তাদের। এদিকে কাবাব রেডি হচ্ছে আর আমরা গোল হয়ে বসে হলের সামনের রাস্তায় আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ শুরু হলো নেশা ধরানো একটা গান। সবাই মিলে চিৎকার করে গাইলাম সেটা।

ভাব জাগে না, ভাবুক বিনে ভাব জাগে না।
ভাব জাগে না, ভাবুক বিনে…ডাকি তোমায় ক্যামনে?
ভাব জাগাইয়া দাও আমার মনে।
ও মনরে, ভাব জাগাইয়া দাও আমার মনে।

ছয় চোরা সংগী তাহার,
চুরি শিক্ষা দেয় চমৎকার।
হৃদয়ে পড়েছে ঝংকার,
কুমন্ত্রসুরে…।।
(হায়রে দয়াল)

…………………………………………

সুরের নেশায় বুঁদ হয়ে গাইতেছিলাম সবাই। কেউ কেউ হয়তো সুরার নেশায়ও। এক গান শেষ হলে আরেকটা ধরি…আমি গান গাইতে পারি না। আহা! আমি গান গাইতে পারি না।

এরপর শুরু হলো সমেবত নাচ। কার যেন কম্পিউটারের সারাউন্ড সাউন্ড সিস্টেম নিয়ে আসা হলো নিচের লনে। সেখানে কি সব গান বাজছে, কেউ খেয়াল করছে না। সম্মিলিত পাগলামির চূড়ান্ত প্রদর্শনী, উদ্দাম নৃত্য। মাঝে মধ্যে গঞ্জিকার পুরিয়ায় বুক ভরে দম মারা। আজ রাতটা শুধুই আমাদের। ছাত্রজীবনের উদ্দামতার সমাপ্তি, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাড়াঁনো এই যুবকেরা ছেড়াঁ গেঞ্জি আর তাপ্পি মারা জিন্সকে বিদায় জানিয়ে গায়ে তুলে নেবে ফর্মাল শার্ট আর প্যান্ট। কর্মক্ষেত্রভেদে কেউ কেউ হয়তো সাহেবী একখানা টাইও। মনটা বড় কেমন কেমন করে। এতোদিনের, এতোপ্রিয় অনেক কিছু পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সামনে। বিষাদবিলাসে পাওয়া জোছনাহত যুবকবৃন্দ একসময় শান্ত হয়। মধ্যরাত্রির আশে পাশের কোন এক সময়ে বাবুর্চি এসে খবর দেন, কাবার আর পরোটা রেডি। আমরা খাওয়া শুরু করতে পারি।

আস্ত একটা ছাগল কাবাব করার কায়দা-কানুন জানা ছিল না আমাদের ক্যাফেটেরিয়ার বাবুর্চি মামার। তবু, আস্ত ছাগল দিয়ে আই ইউ টি-র কোন ব্যাচ আগে গ্র্যাজুয়েশন সেলিব্রেশন করেছে? কেউ না। প্রথম করলো ০২ ব্যাচ, দি গ্রেট ০২ ব্যাচ। ভালো হোক আর না হোক আস্ত ছাগল বলে কথা। আমিসহ আর কয়েকজন মিলে সবাইকে স্টিলের থালায় করে পরিবেশন করলাম পরোটা। সবাইকে বললাম পাঁচ ছয়জনের গ্রুপ করে বসতে। প্রত্যেক গ্রুপে সাপ্লাই হলো ছাগলের একটা রান অথবা অন্য বড় একটা টুকরা। সবার খাবার পরিবেশনের পর, আমাদের পরিবেশনকারী দল থেকে কে যেন হাঁক দিলো, “ওই পোলাপাইন, শুরু কর।” হামলে পড়ল সবাই কাবাবের উপর। কিন্তু একি, এতো বিস্বাদ কেন এতো সাধের বারবিকিউ? বাইরের দিকটা পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে আর ভেতরে হালকা কাঁচা। আমরা চুপচাপ চাওয়া চাওয়ি করছি একজন আরেক জনের দিকে। নীরবতা ভাঙলো জাকির।

“অই ছাগলগুলারে সেলাই কইরা মাঠে ছাইড়া দে।”

অতি দুঃখে হো হো করে হাসতে থাকে সবাই। সোডিয়াম লাইটের আলোয় সাদা দাতঁ হলুদ হয়ে জ্বলতে থাকে সবার। কেউ ছাগলগুলোকে সেলাই করার জন্য সুঁই সুতো নিয়ে আসে না।

(ভিডিওর গানটার একটা ঠান্ডা ভার্সন দিলাম। গায়ক আমাদের খুররম।)

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA
৩,৭২৩ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “আচার ০১১: ভাবুক বিনে ভাব জাগে না”

  1. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    আয় হায়!
    আমি দেখি ফার্স্ট হয়া যাইতেসি...

    ওরে কে আছিস! অফচান্স মারতে হলে তাড়াতাড়ি আয়...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    আমি তোমার লেখা পইড়া খুব আরাম পাই...এতো সাবলীল প্রকাশভঙ্গি;প্লাস হিউমার এর টাচ, মনন এর টাচ...

    আর পাকা ব্যাটসম্যান এর জাত চেনানো স্ট্রোকের মত এরকম দুয়েকটা লাইন...

    বিষাদবিলাসে পাওয়া জোছনাহত যুবকবৃন্দ একসময় শান্ত হয়।

    :thumbup: :thumbup: :thumbup:


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. জিহাদ (৯৯-০৫)

    আমাদেরও তো বেশি দিন নাই। 🙁

    চাকরি বাকরির কথা শুনলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। 🙁

    কিন্তু আপনার লেখা পৈড়া কিছুক্ষণের জন্য মন ভাল হয়া যায় 😀


    সাতেও নাই, পাঁচেও নাই

    জবাব দিন
  4. ফয়েজ (৮৭-৯৩)
    ছাত্রজীবনের উদ্দামতার সমাপ্তি, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাড়াঁনো এই যুবকেরা ছেড়াঁ গেঞ্জি আর তাপ্পি মারা জিন্সকে বিদায় জানিয়ে গায়ে তুলে নেবে ফর্মাল শার্ট আর প্যান্ট।

    কি বল্লা ভাইডি, একে বারে উদাস করা মনের কথা।

    "যে যায়, একবারেই কি যায়, কিছুই কি থাকেনা বাকী"?

    থাকেনা রে পাগলা, থাকেনা


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  5. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)
    বিষাদবিলাসে পাওয়া জোছনাহত যুবকবৃন্দ একসময় শান্ত হয়

    ফয়েজ ভাই, বস্ একটুও কি থাকেনা?
    ভাবুক বানাইছে কিনা জানিনা, তবে মনটা খারাপ করা নস্টালজিক লেখা। ক্যাম্পাসে খুব অসামাজিক সময় কাটাইলেও খুব খুব মিস করি ওই সময়টা 🙁


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  6. শার্লী (১৯৯৯-২০০৫)

    ভাই জটিল লিখসেন। যাই করি নাই করি জীবনে মজা করা ছাইড়া দিলে তো মৃত মানুষের সাথে আমার কোন পার্থক্য থাকবে না। তাই ছাত্রজীবনই হোক আর উকিল জীবনই হোক মজা তো আমি করুমই,যা থাকে কপালে।

    জবাব দিন
  7. সামিয়া (৯৯-০৫)

    ইউনিভার্সিটি লাইফ নিয়ে কত মন উদাস করা লিখা পড়ি...শুনতে রূঢ় লাগলেও সত্যি, আমার কেন জানি নিজের ক্যাম্পাস নিয়ে এরকম প্রেম ভাব জাগে না, দোষ অবশ্য আমারই। সবাই তো কত মজাই করে।
    কি জানি দশ বছর পরেও এমন কথা বলব নাকি, কিন্তু আপাতত আমার মনোভাব এইরকমই, ক্যাম্পাসটাতে একটা বড় প্রজাতির ভূমিকম্প হলে আমি খুবই খুশি হতাম।

    জবাব দিন
  8. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    তৌফিক,
    তোমার লেখার আমি একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। তোমার লেখার একটা বিশেষ স্টাইল আছে যা আমাকে প্রচন্ড আকৃষ্ট করে। মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়, "ইস, আমিও যদি এরকম লিখতে পারতাম...।"
    তোমাদের মত ক্যাম্পাস লাইফ কখনো পাইনি। জীবনের কিছু অপূর্ণতার মাঝে এটি একটি। কিন্তু আজ তোমার লেখাটি পরে মনে হয়েছে এটি আমার জীবনের ঘটনা। আমার একটিবারের জন্যও মনে হয়নি যে আমি কখনোই এর অংশ ছিলামনা।
    ক্যাম্পাস হারানোর আশু বেদনায় আমার বুকটাও হু হু করে উঠেছে। প্রচন্ড নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম।
    সম্পূর্ণ অজানা একটা পরিবেশকে পাঠকের কাছে অতি আপন করে তোলার কাজটা একদমই সহজ না। কিন্তু তুমি অবলীলায় তা করেছ। :hatsoff: তোমাকে।
    এত সুন্দর একটি লেখার জন্য তোমাকে :salute:
    তোমার আরো ভক্ত হয়ে গেলাম।

    জবাব দিন
  9. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    এমআইএসটি থেকে বের হবার আগে সবাইকে দিয়ে ডায়রী লেখানোর ধুমে জুলির (এমজিসিসি, ৯৫-২০০১) ডায়রীটা হাতে আসলে লিখেছিলাম,

    ক্যাডেট কলেজে কাটানো আমার ছয় বছরের সময় যদি হীরক সময় হয় তবে এমআইএসটি'র চার বছর নিশ্চিত স্বর্ণোজ্জল সময়........।

    তৌফিক, তোমার লেখাটা পড়ে বাড়াবাড়ি রকম স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম।
    তোমাকে :hatsoff: :hatsoff: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : তৌফিক (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।