আচার ০২৫: বিচিত্রামচা

১।

প্রথম বিশ্ব হোক আর তৃতীয় বিশ্ব- সব বিশ্বের সরকারের অবস্থা একই। চরম রকমের ইনএফিসিয়েন্ট এরা। নিজের বাপ সরকারী চাকুরীজীবি, তারপরও এই কথা বললাম। বলার কারণ অবশ্য যথেষ্টই আছে, বিদেশে পড়তে আসার মাস দুয়েক আগে থেকে শুরু হইছে সরকারী অফিসে অফিসে কাগজপত্রের জন্য ধরনা দেওয়া। কানাডায় আইসাও তার ব্যতয় ঘটে নাই, এই কাগজ সেই কাগজের জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে হইছে গত দুইবছর। বাংলাদেশের সরকারী অফিস আর এই খানের সরকারী অফিসের মধ্যে পার্থক্য একটাই, ঘুষ দেওয়া লাগে না। এই বাদে সব এক। মুখ খারাপ করলাম না, রোজা-রমজানের দিন। এই এদের জন্যই আমার এই মাসের তিন তারিখে বাসায় ইফতারী করা হইল না। এখনও বিদেশ ছাড়তে পারি নাই, ঈদটাও পাবো কিনা সন্দেহ। মনটা এই কারণে বড়ই উচাটন, সিসিবিতে বেশি ঢুঁ মারা হয় নাই। জানতাম সিসিবি ইফতার নিয়ে ব্লগ আসবে, কিন্তু ওইগুলা পড়তে ইচ্ছা হয় নাই। কারণটা হিংসা। আজকে অবশ্য পড়েই ফেললাম কামরুল ভাই-এর লেখা আর তারিকের ছবি ব্লগ। অনেক মজা করছে সবাই। দেখে হিংসাও হইছে, আবার অনেক ভালোও লাগছে। আমাদের মিস করার কথা অনেকেই বলছেন। কিভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করবো জানি না, তাই রবিগুরু কবিন্দ্রনাথের ভাষায় বলি- মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি সিসিবিরই লোক। সিসিবির প্রতি অধিকারবোধ জন্মে গেছে অনেক। সেন্স অব বিলংগিং মনে হয় এইটাকেই বলে।

২।

গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাইলাম কিছুদিন আগে। তৌফিক মিয়া গরীব মানুষ, তাহার নিজের গাড়ি নাই। অন্যের গাড়ি ভাড়া করিয়া চালায়। গাড়ি ভাড়া করার ইচ্ছা ছিল না দেশে যাওয়ার আগে। আমার বউটারে বিধবা করতে চাই না এই কথা বললে ভুল হবে। আসলে প্রেমিকা হিসাবে অনেকদিন জ্বালানোর টাইম পাইলেও, বউ হিসাবে সেই তুলনায় বেশি টাইম পাই নাই। বউরে মনের সাধ মিটায়ে না জ্বালায়ে মইরা গেলে আত্নাটা অতৃপ্ত থাইকা যাইত। যাহোক, প্রসংগে ফিরে আসি। এক বন্ধু পরীক্ষা দিবে লাইসেন্সের, প্র্যাকটিসের জন্য গাড়ি দরকার। আমারে দিয়ে সে গাড়ি রেন্ট করতে চায়, বললো রেন্টের টাকা নাকি সেইই দিবে। আমি ভাবলাম পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খাওয়ার এই সুযোগ। দৌড়ের উপর বললাম আমি রাজী। রেন্টাল কোম্পানি থেকে একটা মাজদা ৩ ভাড়া করে আনলাম, ২০০৮ মডেল। গাড়িটা ভালোই। সবচেয়ে বড় কথা হইল গিয়া, গাড়ি ভাড়া করার দুই দিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও গাড়ির কিছু হয় নাই। ড্রাইভার হিসাবে এখন পর্যন্ত আমি সফল আছিই। হোসেন ভাইয়ের (আদনান ৯৪-০০) কথা মেনে চলব বলে ঠিক করছি। হাইওয়েতে আরো অভিজ্ঞ না হইলে যাব না। তবে গত দুইদিন বন্ধুর প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে আমি যে পরিমাণ গাড়ি চালাইলাম তাতে খরচের অর্ধেক শেয়ার না করলে হাক্কুল ইবাদের বড় রকমের বরখেলাপ হবে।

৩।

বাসায় নতুন দুই পোলা আসছে। একটা মার্ক, ক্যালগারির ছেলে। এখানে মাস্টার্স করতে আসছে ক্লাসিক হিস্ট্রির উপর। আরেকটা মিগুয়েল, হিস্পানিক আমেরিকান। এখানে আর্কিওলজিতে আন্ডারগ্র্যাড করতে আসছে। বড় মায়ের বড় পোলা, মা WHO-র ডাইরেক্টর বা এইরকম কেউকেটা কেউ। দুইটা ছেলেই ভালো। মার্ক পোলাটার সাথে কথা বলে আমি চমৎকৃত। ছেলেটার পড়াশোনা অনেক। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক কিছু জানে। তবে সবচেয়ে মজা লাগছে যেটায় সেটা হল ওর আন্ডারগ্র্যাডের থিসিসের কথা শুনে। কলোনিয়াল ইউরোপের অধীনস্থ বিশ্ব ছিল শান্তিপূর্ণ বিশ্ব- এইটাই ছিল তার থিসিসের বিষয়। এটা সে বিভিন্ন ইতিহাসভিত্তিক রেফারেন্স দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ থেকে শুরু করে দুইটা ওয়ার্ল্ড ওয়ার- কিছুই বাদ রাখে নাই। ও যে ইউনিভার্সিটিতে এই থিসিসটা করছিল সেখানে থিসিস রিভিউ করে এক্সটার্নাল এক্সপার্টরা। তবু সে ১০০% মার্ক পাইছে থিসিসে। আমি কিছুটা অবাক হইছিলাম ওর থিসিসের মূল প্রতিপাদ্য শুনে। ওর সাথে কথা বলে আমার একদম মনে হয় নাই সে কলোনিয়ালিজম সমর্থন করে। কারণ প্রথম রাত্রেই খাওয়ার পর ঘন্টা দুয়েক সে আর আমি মিলে ব্রিটিশদের পিন্ডি চটকাইছি একসাথে। ব্যাটা মনে হয় আমার চোখ মুখ দেখে অবাক হওয়াটা টের পাইছিল। নিজে থেকেই বলল, থিসিস সে লিখলেও এর এক বিন্দুও সে বিশ্বাস করে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম তাইলে এই আর্গুমেন্টগুলা লিখলা ক্যান? সে বলে, পাবলিকে এই জিনিস খাবে এইটা সে নিশ্চিত ছিল। তাই লিখছে, আর ভালো গ্রেড পাওয়াটা দরকার ছিল। ফার্স্ট ইয়ার মাস্টার্সে রিসার্চ ইন্টেগ্রিটি আর এথিকস নিয়া একটা ওয়ার্কশপ টাইপ নন ক্রেডিট কোর্স করাইছিল। ওই কোর্সে যা যা শিখছিলাম, সেই বিদ্যায় মার্কের থিসিসটাকে কোনভাবেই আনএথিকাল বলে বিচার করতে পারলাম না। মার্কের ঘটনাটা থেকে বুঝলাম, মার্কেটেবিলিটি না থাকলে কোনকিছুরই দাম নাই।

৪।

কাইয়ূম ভাইরে অর্ডার দেওয়া ব্লগটা এই কিস্তিতে ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কপাল খারাপ হওয়ায় সেইটা পারলাম না। কিছু ছবি তুলছিলাম আমার পয়েন্ট এন্ড শ্যুট ক্যামেরাটায়। সেই ক্যামেরা খুঁজে পাইতেছি না, ক্যামেরা থেকে ছবিগুলা ল্যাপিতে নামানোও হয় নাই। ছবির অভাবহেতু সেই ব্লগটা দেওয়া গেল না। কাইয়ূম ভাইরে আরো অপেক্ষায় রাখার জন্য লুংগি পিরা লঙ্গাপ হয়ে থাকার ইচ্ছা ছিল। বিদেশ-বিভূইয়ে লুংগি নাই, তাই আর পারলাম না। দেশে গেলে সেইটা নিশ্চয় করতে হবে না। অনেকদিন পর দেশে যাইতেছি, আমার সেভেন মার্ডার পার্ডন হওয়ার কথা।

ল্যাপি উঁচা করলাম, আমার হাফ সেঞ্চুরি পুরা হইছে এই ব্লগ দিয়া।

৩,৩২৯ বার দেখা হয়েছে

৬২ টি মন্তব্য : “আচার ০২৫: বিচিত্রামচা”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    তোমার আচারগুলো পড়তে সবসময়ই ভালো লাগে তৌফিক। :thumbup:

    তোমাকে ফেইসবুকে দেখেছি কানাডিয়ান ইমিগ্রেশনের গোষ্ঠী উদ্ধার করে গালাগালি করতে, এখন ভালোভাবে বুঝতে পারছি কেন গালাগালি করেছিলা। 🙂

    যাই হোক, সুস্থভাবে দেশে আস, আরেকটা গেট-টুগেদার তো হবেই ইনশাল্লাহ্‌। 🙂

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    বেরাদার, মন খারাপ কইরেন না। ইনশাল্লাহ দ্রুত পাসপোর্ট হাতে পেয়ে যাবেন।
    অফটপিকঃ কানাডিয়ান ইমিগ্রেশনের *** **


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)
    মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি সিসিবিরই লোক। সিসিবির প্রতি অধিকারবোধ জন্মে গেছে অনেক। সেন্স অব বিলংগিং মনে হয় এইটাকেই বলে।

    :thumbup: :hatsoff: :hug:

    সব ঝামেলা শেষ করে ইনশাল্লাহ ঠিক ঠাক মতন দেশে চলে আসতে পারবি এই আশা করি এখন।
    তোদেরকে দেখতে মঞ্চায় 🙂


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  4. রায়হান আবীর (৯৯-০৫)

    চমৎকার লেখা, সুন্দর, চ্রম লাগলো এই ধরণের মন্তব্য করবো না ভাবছিলাম- পাছে মানুষ ভাবে না পইড়াই মন্তব্য করছি।

    কিন্তু এই লেখাটা পড়ার পর বলতেই হচ্ছে জাস্ট চ্রম একটা লেখা হইছে। বিশেষ করে মার্কেটেবিলিটির পার্টটা।

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)

      চলে আসতেছি বাসা ছেড়ে, না হইলে এই ছেলেটার সাথে অনেক জমায়ে গল্প করা যাইত, অনেক কিছু শেখা যাইত। ওর পড়াশুনা আসলেই অনেক, গ্রিক আর ল্যাটিন- দুইটাই পারে। বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেকগুলা কথা বলছে যেগুলা যেকোন কানাডিয়ানের কাছ থেকে আন এক্সপেক্টেড। 🙂

      জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    তোর একটা পোস্ট দেখে জোড়া পোস্টের অপেক্ষায় ছিলাম 😛

    তোর আচার সবসময়ই টেস্টি... ভালয় ভালয় দেশে ফিরে আয়।

    ৫০ এর জন্য অভিনন্দন :clap: :clap: :clap:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  6. তোর কপালটা খ্রাপ রে দোস্ত ... আমার এখনো পর্যন্ত এদের সরকারি কাজকারবারের প্রতি বেশ সম্মানবোধ আছে ... কোন কাজ হইতে যত সময় লাগা স্বাভাবিক তারচেয়ে বেশি লাগে নাই ...

    ভালোয় ভালোয় দেশে যা ... তোর বউরে আমার হয়ে আর আমার বউরে তোর হয়ে হাই বলিস 😀

    জবাব দিন
  7. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    ওহ তৌফিক তোমারে কংগ্রেচুলেশন জানাইতে ভুইলা গেছিলাম।
    লেখাটা পড়ছি। আগে একটা মন্তব্য করছিলাম। হারায়া গেছে।
    আবার ২য় বার কইবার মঞ্চাইতাসে না। দেশে আসো , কথা হবে।

    জবাব দিন
  8. আহ্সান (৮৮-৯৪)

    তৌফিক,
    তোমার লেখার আমি একজন মহা অনুরক্ত। ব্রাবরের মত এবারো ভালো লাগছে...। ইফতার পার্টিতে সানাউল্লাহ ভাইয়ের সাথে বলতেছিলাম তোমার লেখার ব্যাপারে। তোমারে অবশ্যই মিস করছি আমরা সবাই...। দেশে আসো, ইনশাল্লাহ আবার হবে...।

    জবাব দিন
  9. দিহান আহসান

    ভাইয়া শেষ পর্যন্ত দেশে যাচ্ছ তাহলে, আমরা যা কবে যাবো? ( দীর্ঘশ্বাসের ইমো )। :dreamy: :dreamy:

    যাও গিয়া আরেকটা গেট টুগেদার করো, আমি আবার ফোন দিমু, তোমাদের লেখা পড়মু, আর হা-পিত্যেস করমু ... 🙁 🙁

    হেভ আ সেইফ জার্নি 🙂

    জবাব দিন
  10. সামি হক (৯০-৯৬)

    তৌফিক একটা কাজের কাজ করছো লাইসেন্স পাইয়া গেছো। আমি পড়ছি গ্যাড়াকলে শালার ওন্টারিও তে ড্রাইভিং এক্সামিনাররা স্ট্রাইকে গেছে কবে কাজে ফিরবে খোদা মালুম। 🙁

    লেখা সেরকম হয়েছে...দোয়া করি ঈদের দিন যেন মায়ের হাতের পোলাও আর বউয়ের হাতের পুডিং খেতে পারো।

    জবাব দিন
  11. কামরুলতপু (৯৬-০২)

    ৫০ এর অভিনন্দন।
    দেশে যাচ্ছিস শুনেই হিংসা লাগছে। তুই যে এত প্ল্যান করছিস দেশে গিয়ে এই করবি ঐ করবি তুই কি জীবনে গাজীপুর থেকে ঢাকায় এসে ডেটিং ছাড়া কিছু করছিস? ডেটিং এর জন্য কোথাও আসতে পারতি না সবার কাছেই শুনতাম তুই ডেটিং এ ব্যস্ত। দেশে গিয়েও বউ এর সাথেই ব্যস্ত থাকবি তাই সবাইকে আগেই বলছি যারা তৌফিকের সাথে দেখা করার চিন্তায় আছে সবাই হতাশ হবে।

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)

      ধন্যবাদ তপু। 🙂

      তুই তো সেঞ্চুরী কইরা ফেলছস... আমরা চুনোপুঁটি... 😛

      তোর অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমার প্রেস রিলিজঃ 😀

      আমার নামে এইরকম বানোয়াট এবং অসত্য অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ষড়যন্ত্র হাসিল করতে এই মিথ্যা প্রচার করছে।

      বউয়ের মাস্টার্স পরীক্ষা সামনে, ওরে নিয়া ঘুরাঘুরি বাদ। 😀

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।