আচার ০২১: পরবাসীর রোজনামচা

ফ্যাকাল্টিতে মেশিন শপ দুইটা। একটা স্টুডেন্টদের জন্য। দুইটা মিল, কিছু লেদ, একটা গ্রাইন্ডিং হুইল, একটা শিট মেটাল বেন্ডিং মেশিন, গোটা দুয়েক পাওয়ার ড্রিল- স্টুডেন্টদের জন্য বরাদ্দ এইগুলাই। ইদানীং অবশ্য একটা সি এন সি লেদ ইনভেনটরিতে যুক্ত হইছে। আরেকটা মেশিন শপ হইলো টেকনিক্যাল সার্ভিসেস। মোটামুটি বেশ ভালো এদের যন্ত্রপাতি, অনেক কিছু আছে। এরা ইউনিভার্সিটির বাইরের ফরামায়েশি কাজ কর্ম বেশি করে। এবং এই কাজ করার জন্য অনেক টাকা চার্জ করে। স্টুডেন্টদের স্পেশাল যদি কিছু দরকার হয় তবে তাদের আবেদন পত্র অনেক লাল ফিতার পুলসেরাত পার হয়ে কখনো এপ্রুভড হয়, কখনো হয় না। আমি স্টুডেন্ট হইলেও রিসার্চ করি এক কোম্পানীর জন্য। তাই আমার জন্য লাল ফিতা নাই, সরাসরি কাজের অর্ডার, সরাসরি পেমেন্ট। ফেলো কড়ি মাখো তেল। কিন্তু মুশকিল হইল, এরা বুঝে বেশি। যেমন করে বলব আমার জিনিস মেশিনিং করে দিতে, এরা কখনোই করবে না সেইরকম করে। ফলাফল, নিজের ডিজাইন করা জিনিস বাজে ম্যানুফেকচারিং করার কারণে মনমতো হয় না। টাকা দেওয়ার পরও কথা না শুনার কারণে আমি নিজেই সাধারণত স্টুডেন্ট শপে নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এইখানে মুশকিলটা হইল গিয়া, মেশিনিস্ট হিসাবে আমি মোটামুটি নিম্নশ্রেণীর। মেশিনিস্টদের লাইসেন্স পরীক্ষা দিলে কখনো পাস করতাম বলে মনে হয় না। আমার এই দুরবস্থায় উদ্ধার করতে খোদা প্রেরিত দেবদূতের মতো হাজির হইলেন ডন টেইলর। স্টুডেন্ট শপের ফোরম্যান। ইংরেজিতে যারে বলে ড্যাম ফাইন মেশিনিস্ট, ইনি ঠিক তাইই। বিপদে পড়লে তারে গিয়া একটু মিষ্টি করে অনুরোধ করলেই সে আমার কাজ করে দেয়। মেশিন শপ আর আমার ল্যাব কাছাকাছি হওয়াতে তার সাথে গিয়ে আড্ডাবাজিও করি মাঝে মাঝে। বিভিন্ন জিনিস নিয়া আমাদের গপ্পোবাজি ভূগোল আর বয়েস ভেদ করে ঠিকই কিভাবে যেন এক সমতলে হাজির হয়। তো একদিন সে বলল বিভিন্ন ধরনের মিউজিকের প্রতি তার আগ্রহ, আমি যেন তারে কিছু বাংলাদেশি মিউজিক সাপ্লাই দেই। আমি কইলাম অবশ্যই। আমি বাংলা ছাড়া ইংরেজি শুনি, তবে কম। বাংলাও শুনি হাতে গোনা কয়েকজনের। তাই বিচিত্রতার অভাবে একটু বিপদে পড়লাম। তবু আতিঁপাতিঁ করে খুঁজে দিলাম কিছু গান। নিজের পছন্দ অবশ্য। ডন রে গান সাপ্লাই দিয়া কইলাম, দেখ, এই গানগুলা আমার রুচিকে রিপ্রেজেন্ট করে, আমার সংস্কৃতিকে না। সুতরাং ভালো না লাগলে, আমার রুচিকে খারাপ ভাইবো, আমার সংস্কৃতি সম্পর্কে কোন আইডিয়া পাইবা না এই গানগুলা থাইকা। ডন তার স্বভাবসুলভ ইজি ভংগিতে কইল, নো ওয়ারিজ।

এই ঘটনার পর সপ্তাহখানেক পার হইল, স্টুডেন্ট শপের সামনে দিয়ে যাইতেছি, হঠাৎ শুনি কৃষ্ণকলি সোনারও পালংকের ঘরে কারে যেন লিখে রাখার কথা বলতেছে। আকাশ থেকে পড়লাম, কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ঢুকলাম মেশিন শপে। দেখি শপের কোণায় কোণায় স্পিকার বসানো, তাতে বাজতেছে বাংলা গান। ডনের অফিসে গেলাম ব্যাপার অনুসন্ধান করার জন্য। গিয়ে দেখি ডন আর তার এসিস্ট্যান্ট ক্যারোলাইন আমার দিকে তাকায়ে মুচকি মুচকি হাসতেছে। ওরা যা বলল, তার সারমর্ম এই- মেশিন শপের ভারী আবহাওয়াটাকে সহজ করার জন্য তারা স্পিকারগুলা বসাইছে। আর বৈচিত্র্য আনার জন্য বাংলা গানের ব্যবস্থা। আমি কৃতজ্ঞচিত্তে ধন্যবাদ দিলাম ওদের। ওরা কয়, উলটা তোমারে ধন্যবাদ এই নতুন ধরনের মিউজিকের সাথে পরিচয় করায়ে দেওয়ার জন্য।

মেশিন শপে গেলেই এখন আমি কান উচুঁ করে থাকি কখন একটা বাংলা গান শোনা যাবে। কম্পিউটারের র‌্যানডম নাম্বার জেনারেটার প্রোগামটার দয়া হলে কখনো শুনতে পারি, কখনো পারি না। তবে আই প্রটেক্টিভ গ্লাসের নিচে আমার চোখ দুইটা যে বাড়ির চিন্তায় কোমল হয়ে যায়, এটা বেশ বুঝতে পারি। ধন্যবাদ ডন টেইলর, লোহা লক্কড়ের ভেতর আমার জন্য একটুকরো বাংলাদেশের ব্যবস্থা করে দিয়েছো বলে।

২,৭৪৬ বার দেখা হয়েছে

৪৭ টি মন্তব্য : “আচার ০২১: পরবাসীর রোজনামচা”

  1. তানভীর (৯৪-০০)

    দারুণ!! অনেকদিন পর তোমার আচার।
    ইসসস...তোমাদের মত করে বাংলাদেশের জন্য টান কখনও অনুভব করা হইল না......অবশ্য এরকম অবস্থার মধ্য দিয়ে টান অনুভব না করাই ভাল।
    লেখাটার শেষ দিকে এসে কেন জানি মন খারাপ হয়ে গেল।

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    ভালো লেগেছে!! অসাধারণ লাগলো শেষ লাইনটা। :hatsoff: টু টেইলর মামু।
    অফটপিকঃ আগেরবার কি একই পোষ্ট আচার ০২১ নামে প্রকাশ করেছিলেন?
    পিকনিকের ঘটনা কই গেলো :(( ?


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  3. আন্দালিব (৯৬-০২)

    সকালে একটা কমেন্ট করছিলাম, কম্পু হ্যাঙ খেয়ে ওটা যায়নি দেখি!
    ===
    সাবাশ! তোরে আর টেইলর আঙ্কেলরে! :clap:
    আমার দুই বোন আমেরিকাতে থাকে, ওখানেই বড় হয়েছে। ২০০৪ সালে প্রথম দেশে আসলে কথায় কথায় আমি কিছু রক্‌ বাংলা ব্যাণ্ডের অ্যালবাম ওদের কিনে দিয়েছিলাম। শুনে তারা বেশ অবাক হয়েছিল। এবার দেশে আসার পরে দিলাম কৃষ্ণকলি আর অর্ণব। এবারে তারা রীতিমত তব্ধা। এমন মিউজিক বাংলাদেশে হচ্ছে যার কোয়ালিটি পাশ্চাত্যের মত এবং একই সাথে এখানকার সুরের প্রকৃতি বা চরিত্র ধরে রাখছে। এটা আমাদের জন্য আসলেই খুব আশার কথা।

    আমাদের এই অসম্ভব সুন্দর সুর ছড়িয়ে যাক সারা পৃথিবীতে! :thumbup:

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)

      আমাদের মিউজিক আসলেই অনেক অনেক সমৃদ্ধ। মুজতবা আলীর একটা গল্পে এই নিয়া কথা আছে, পৃথিবীর সব সংস্কৃতির ফোক সংগুলা হয় সিম্পল, সাদামাটা। আমাদের ভাওয়াইয়াতে সুরের যে কারুকাজ আছে সেটা শুনে এক জার্মান এটাকে ধ্রুপদী সংগীত ভাবছিলেন।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।