প্রফেশনাল

লাস ভেগাস মাহমুদ ভাইয়ের লেখার একজন ভক্ত আমি। প্রথমে একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করাবেন, তারপর হাইপোথিসিসটাকে ঘিরে আর্গুমেন্ট ডেভলপ করবেন। পুরা গাণিতিক সমীকরণ মার্কা অবস্থা। এই পোস্টটা সেভাবে যদি লিখতে পারতাম, ভালো হইত। মিস্তিরি মানুষ, যুক্তিবিদ্যা পড়া নাই। হাইপোথিসিস টেস্টিং-এ আমার দৌড় পরিসংখ্যান পর্যন্ত, সুতরাং আমার স্টাইলেই লিখতেছি।

প্রফেশনাল মানেটা কি? বাংলা করলে দাঁড়ায় পেশাজীবি। যতোটুকু ইংরেজি জানি, তাতে মনে হয় শব্দটা পেশার প্রতি নিবেদিত হওয়াটাকে বুঝায়। বাংলাদেশে এর বড় অভাব, ক্রীড়াক্ষেত্রে আরো অভাব আছে। আমাদের মতো আমজনতারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতেছে, ক্রিকেটাররা যেন আরো একটু প্রফেশনাল হয়। আর সাকিব আল হাসান প্রথম আলো-র সাক্ষাৎকারে বলতেছে, বাংলাদেশের দর্শকরা কিছু বুঝে না, হুজুগে। মন চাইল দে তালি, মন চাইল দে গালি। সাকিব আল হাসানের কথায় দ্বিমত করতে যাব না, বাংলাদেশের দর্শকরা হয়তো আসলেই হুজুগে। কিন্তু উনি কি কখনো ভেবেছেন এই মানুষগুলো হুজুগে হওয়ার জন্যই তার রুটি রোজগারের বন্দোবস্ত হয়েছে। বাংলাদেশের কম প্রচলিত খেলাগুলা দেখুন, মানুষ কেয়ার করে না, তাদের খেলা দেখার জন্য কেউ ভিড়ও করে না। ভিড় না করায় মিডিয়াতে ছোট কলামে ১৫০ শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায় তাদের সাফল্য গাঁথা, কর্পোরেট স্পন্সররা ফিরেও তাকায় না তাদের দিকে। ক্রিকেটের দিকে তাকিয়ে দেখুন, এদের সাফল্যে সবাই খুশি হয়, ব্যর্থতায় মুখ খারাপ করে গালি দেয় মানুষ। কেন? কারণ, মানুষ ক্রিকেটের ব্যাপারে কেয়ার করে। মানুষ কেয়ার করে বলেই বিসিবি টিকেট বিক্রি করতে পারে, কর্পোরেট স্পন্সররা বেশি প্রচারের আশায় তাদের কাছে এন্ডোর্সমেন্ট ডিল করতে যায়। প্রিয় সাকিব, বাংলার মানুষ আপনাদের গালি দেয় বলেই যে আপনারা খেতে পরতে পারছেন, সেটা এই কথাটা বলার আগে চিন্তা করলেন না? আর তালি দেয়ার সময়ও তো মানুষ কিপটামি করে দেয় না। একবার কি চিন্তা করে দেখেছেন, আপনাদের একটা ইনিংস বা একটা জয় কতগুলো মানুষকে ছুঁয়ে দিতে পারে, কতগুলো মানুষকে বিশ্বাস করাতে পারে যে সব প্রতিকূলতার মাঝে মাথা উচুঁ করে লড়া যায়। যদি চিন্তা করে থাকেন কখনো তবে লাখো মানুষের মন ছুঁয়ে দেয়ার অবস্থান থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করতেন না, বিনীতভাবে ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চাইতেন- আমি নিশ্চিত।

প্রফেশানলিজমের কথা যখন আসলই একটা প্রফেশনাল লিগের কথা বলি উদাহরণ হিসাবে। এন বি এ ফলো করি বলে অনে যেকোন প্রফেশনাল লিগের চেয়ে এটা সম্পর্কে বেশি জানি। খেলোয়াড়রা বাৎসরিক পঁচিশ মিলিয়ন থেকে এক মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত আয় করেন। ম্যাচের দিন শুধু এরিনাতে হাজির হয়েই এই টাকা আয় করেন না, সবকিছু ফেলে জিমে পড়ে থাকেন, নিজেদের স্কিল বাড়ানোর জন্য। যারা নিবেদিত না, তাদেরকে কেউ দলে ভেড়াতে চায় না। জ্বলন্ত উদাহরণ এলান আইভারসেন আর স্টেফন মারবুরি। এলান আইভারসেন গত বছরও ২৩ মিলিয়ন ডলার আয় করেছেন, যেকোন ম্যাচে বলে কয়ে ত্রিশ পয়েন্ট স্কোর করার ক্ষমতা তার আছে। কিন্তু কোন দল পাচ্ছেন না এ বছর, কারণ তার প্রফেশনালিজম নাই। কেউ তার উপর ভরসা করতে পারছেন না। স্টেফন মারবুরিও দল হারা হয়ে কম টাকায় ইউরোপে খেলার চিন্তাভাবনা করছেন। অন্যদিকে লিগ কাপাঁনো খেলোয়াড় কোবে ব্রায়ান্টের কথা ধরি। সামারের সময়, যখন লিগ বন্ধ থাকে, তখনো তিনি সকাল ছয়টায় বিছানা ছেড়ে জিমে চলে যান। তার ছবির মতো সুন্দর জাম্পারগুলোকে আরো কিভাবে ভালো করা যায়, সেজন্য ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যান। কাজই তো বটেই, কারণ তারা প্রফেশনাল। আমাদের ক্রিকেটাররা এরকম প্রফেশনালিজম দেখিয়েছেন কিনা আমার জানা নাই, রফিক কিছুটা এরকম ছিলেন। কিন্তু ব্যতিক্রম তো আর উদাহরণ হতে পারে না। ক্রিকেটারদের পক্ষে বলার মতো একটা যুক্তি আছে, যথার্থ সুযোগ সুবিধা নাই। কিন্তু ব্রাজিল থেকে যে বিশ্বসেরা খেলোয়াড়রা বের হন, তাদের খুব বেশি সুযোগ সুবিধা ছিল বলে তো মনে হয় না। কারও কারও বাম পায়ের শট ভালো ছিল, ছোটবেলায় শুধু ডানপায়ে বুট পরতেন বলে। সেই বুটকে বাঁচাতে ডান পায়ে শট নিতেন না, আর একজোড়া বুটের আরেকটা থাকত ভাইয়ের পায়ে। বাবার ক্ষমতা ছিল না দুই ভাইকে দু’জোড়া বুট কিনে দেয়ার। আমি যা বলতে চাইছি তা হলো, নিবেদিত থাকলে কোন বাধাই বাধা না, পরিশ্রম করলে ফল আসবেই। আমাদের ক্রিকেটাররা তা করেন বলে হয় না।

আরেকটা ব্যাপার যেটা আমাকে ভাবায় তা হলো ক্রিকেটারদের মধ্যে মোটিভেশনের অভাব। জাতীয় দলে খেলতে পারলেই তারা ধন্য হয়ে যান। যখন তাদের মধ্যে বিশ্বসেরা হবার তাগিদ জন্মাবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবস্থা এরকম থাকবে না।

৪,৮৭১ বার দেখা হয়েছে

৭৩ টি মন্তব্য : “প্রফেশনাল”

  1. রকিব (০১-০৭)

    লেখাটা দারুন সময়োপযোগী। :thumbup: নেন :teacup: ।
    একান্তই নিজস্ব মতামত দিচ্ছিঃ
    আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে পেশাদারীত্বের অভাব আছে। বয়সজনিত অনভিজ্ঞতা, সু্যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, দৃষ্টিভঙ্গিতে আনাড়িপনা। সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি না এর থেকে বেরুবার উপায় কি :bash: :bash:

    জুক্সঃ সিরিয়াস পোষ্টে জুক্স করবার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি ভাইয়া। ক'দিন আগে এক মেয়েকে কর্পোরেট ড্রেসে দেখে বলেছিলাম তাকে বেশ বেশ প্রফেশনাল (কর্পোরেট) লাগছে। আফামণি আমারে অগ্নিদৃষ্টি সম্পন্ন বান নিক্ষেপ করিয়া যা কহিল তার সারমর্ম হইল আমি একখান অভদ্র 😕 । পরে বুঝাইয়া কইতে তিনি জানাইলেন, তিনি মনে করছেন আমি তাকে নিশিকন্যা টাইপ কিছু একটা বলছি 😮 😮 কেম্নে কি!!!!


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. আন্দালিব (৯৬-০২)

    আমি মনে করি, সাকিব যেভাবে বলেছে, সেটাতেই তার আন-প্রফেশনালিজম প্রকাশ হয়ে গেছে। একজন 'প্রফেশনাল' প্লেয়ার কোন অবস্থাতেই মানুষ কী বলছে সেটাতে প্রভাবিত হবে না। তার কাজ, জীবিকা হলো খেলা। খেলার বাইরে সব কিছুই সেকেন্ডারি মূল্য পাওয়া উচিত। মানুষ গালি দিক বা তালি দিক, তাতে তার বেতনে বা চুক্তিতে হেরফের হবে না। হবে যখন সে ভালো বা খারাপ খেলবে। সুতরাং অযথা বকবক করার দরকার কী!

    এইগুলা এখনও 'বাচ্চা' রয়ে গেছে। কবে এরা বড়ো হবে (সবচে' অভিজ্ঞটা সবচে বড় শিশু)!

    জবাব দিন
  3. তানভীর (৯৪-০০)

    আমার কাছে কেন যেন মোটিভেশন আর প্রফেশনালিজম দুইটাকে রিলেটেড মনে হয়। মানে, মোটিভেশন থাকলে প্রফেশনালিজম জন্মাবে।
    বাংলাদেশের ক্রিকেট টিম নিয়ে আসলে আর কিছু বলার নাই। মাঝে মধ্যে মনে হয় ক্রিকেট খেলা দেখাই ছেড়ে দেই। কিন্তু যখনি বাংলাদেশের খেলা থাকে সুড়সুড় করে খেলা দেখতে বসে যাই। তবে আমারও মনে হয় বাংলাদেশ টিমের প্রফেশনালিজমে ঘাটতি আছে। কিংবা মোটিভেশনে। তারপরও আমি আশাবাদী ওদেরকে নিয়ে। 🙂

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আমাদের খেলোয়ারদের টাকা পয়সায় টান পড়া না পর্যন্ত তাদের ভিতরে কোন পরিবর্তন আশার সম্ভাবনা নেই... ম্যাচ প্রতি পারফর্মেন্স এর উপর ভিত্তি করে এদের বেতন কম-বেশি ব্যবস্থা করা উচিত।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • তৌফিক (৯৬-০২)

      এন বি এ-তে ডেনভার নাগেটস এর কোচ জর্জ কার্ল আর বেঞ্চ প্লেয়ার জে আর স্মিথের সাথে এইরকম একটা ইনটেনসিভ ভিত্তিতে চুক্তি করছিল তাদের জেনারেল ম্যানেজার। জর্জ কার্লকে অন্তত ৪২ টা গেম জিততে হবে, আর স্মিথকে খেলতে হবে কমপক্ষে ২০০০ মিনিট। স্মিথ খেলবে কতটুকু খেলবে এটা কার্লের সিদ্ধান্ত আর সবচেয়ে কন্ট্রিবিউটিং বেঞ্চ প্লেয়ার হিসাবে নাগেটসের জয়গুলাতে স্মিথের অবদানও অনেক। এইরকম পেচগিমারা ডিলের ফলস্বরুপ নাগেটস ওয়েস্টার্ন কনফারেন্স রানার-আপ। হ্যাটস অফ টু নাগেটস-এর জিএম।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : দিহান (অতিথি)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।