ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বাড়িতে ১

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ার বাজারে ধ্বস আর ব্যাংকিং সিস্টেমের ব্যর্থতা জন্ম দিয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার এবং এর প্রভাব এখন সারা বিশ্বজুড়ে। এ পরিস্থিতির সাথে পুঁজিবাদী মার্কিনীদের পরিচয় নতুন নয়, বিগত শতাব্দীতে সীমিত ও বড় পরিসরে অনেকবারই এর মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ১৯৩০ সালের গোড়া থেকে প্রায় এক দশক স্হায়ী হওয়া গ্রেট ডিপ্রেসন (The Great Depression). বর্তমান সময়ের এই অর্থনৈতিক মন্দাকে মিডিয়া এবং প্রশাসন গ্রেট ডিপ্রেসনের সাথে তুলনা করছে মাঝে মধ্যেই। সেই সময়ের (দুঃসহ) স্মৃতি যাদের মণিকোঠায় স্হায়ী আসন গেড়েছে তারা অবশ্য এ বিষয়টি মানতে একেবারেই নারাজ। তাদের মতে এটা স্রেফ বাতুলতা। যাই হোক, যে কারণে এ বিষয়ের অবতারণা সেটি হল যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট (সংক্ষেপে F.D.R.), যাঁর অনুপম প্রশাসনিক দক্ষতার কারণেই গ্রেট ডিপ্রেসনের সময়ে ভঙ্গূর অর্থনীতির পূণর্গঠন (economic recovery) সম্ভব হয়েছিল। এ রচনা মূলত তাঁর জীবন এবং বর্তমানে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্হানে রূপ নেয়া নিউ ইয়র্কের হাইড পার্কে অবস্হিত তাঁর বাসভবন নিয়ে। কিছুদিন আগে আমরা কজন বন্ধু মিলে ঐতিহাসিক সেই স্হান পরিভ্রমণে গিয়েছিলাম। তার স্মৃতিকণিকা পাওয়া যাবে এ রচনায়।

তবে তার আগে আবারও খানিকটা অর্থনৈতিক প্রসংগ। এই প্রলম্বিত ভূমিকার উদ্দেশ্য ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের অবদানকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা। বস্তুতঃ আজকের অর্থনৈতিক মন্দার সাথে গ্রেট ডিপ্রেসনের অনেক পার্থক্য আছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৯৩৩ সালে রুজভেল্ট ক্ষমতায় আসীন হওয়ার প্রাক্বালে যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে প্রতি ৪ জনে ১ জন চাকরিশূন্য ছিল। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট হার্বার্ট হুভার এর শাসনকালে ( ১৯২৮-১৯৩২) জাতীয় ঋণ (National Debt) বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায় (১৬% থেকে ৩২%) । শেয়ার বাজার এবং ব্যাংকিং সিস্টেমে ব্যক্তিগত বিনিয়োগকৃত পুজিঁ হারিয়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্হার প্রতি জনমনে চরম অনাস্হার জন্ম দেয়। এই অবিশ্বাস থেকে অনেকেই তাদের সমুদয় সঞ্চয় রাতারাতি উত্তোলন করে নড়বড়ে ব্যাংকিং সিস্টেমের পুরোপুরি ধ্বস নামাতে সহায়তা করে। এই অনাস্হার মূল কারণ হল আজকের মত সেইসব দিনে ব্যাংকগুলো FDIC(Federal Deposit Insurance Corporation) Insured ছিল না। সহজ ভাষায় এখন রাষ্ট্রই অনেক ব্যাংকে বিনিয়োগকৃত অর্থের সিংহভাগের ঝুঁকি বহন করে।প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট পুরো ব্যাংকিং সিস্টেম ঢেলে সাজানোর মানসে সবগুলো ব্যাংককে রাষ্ট্রের আয়ত্তাধীনে আনেন। আস্হা ফিরে পেয়ে সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে তাদের উত্তোলিত অর্থ জমা করা শুরু করে এবং অর্থনীতির চাকা আবার সচল হতে সাহায্য করে। গ্রেট ডিপ্রেসনের সময়েই কেন্দ্রীয় প্রশাসন এধরণের অনভিপ্রেত পরিস্হিতি এড়াতে ব্যাংকগুলোকে FDIC এর আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই কারণে বর্তমান সময়ে সাধারণের অবিশ্বাস থেকে উদ্ভূত ব্যাংকিং সিস্টেমের পুরোপুরি ধ্বসের ঝুঁকি যথেষ্টই হ্রাস পেয়েছে।

এবার আসা যাক মূল কথায় অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রসঙ্গে। মার্কিন প্রেসিডেন্টরা সবোর্চ্চ দু টার্ম (৮ বছর) পর্যন্ত অফিসে থাকতে পারেন (দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হলে)। কিন্তু এর একমাত্র ব্যতিক্রম প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যিনি তিন টার্ম ক্ষমতায় ছিলেন এবং ৪র্থ টার্মের জন্য মনোনীত হওয়া সত্বেও শারীরিক অবস্হার অবনতির কারণে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরে দাড়াঁতে হয়। প্রথমবার প্রেসিডেন্ট মনোনীত হওয়ারও ১১ বছর আগে (১৯২১) পোলিওতে (কথিত) আক্রান্ত হয়ে তাঁর কোমরের নিচের অংশ সম্পূর্ণ অবশ হয়ে যায়। বাকি জীবনে তিনি চলনক্ষমতাহীন ছিলেন এবং হুইল চেয়ারই ছিল তাঁর চলাচলের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু তাঁর অদম্য মনোবল আর দূরদর্শীতা তাঁকে ইতিহাসের অন্যতম সেরা মার্কিন প্রেসিডেন্টের স্বীকৃতি এনে দিয়েছে। ক্রান্তিকাল থেকে টেনে তুলে যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় super power হিসেবে অধিষ্ঠিত করার সফলতায় তাঁকে ঐতিহাসিক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন আর জর্জ ওয়াশিংটনের সমতুল বলে গণ্য করা হয়। এডওয়ার্ড স্মিথ রুজভেল্টের জীবনীতে লিখেছিলেনঃ

He lifted himself from a wheelchair to lift the nation from its knees

ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের শৈশব কেটেছে অঢেল বিত্ত বৈভবের মাঝে যা অধিকাংশ আমেরিকান প্রেসিডেন্টের শৈশবের চাইতেই আলাদা। ফ্রাঙ্কলিন ছিলেন পিতা জেমস রুজভেল্ট এবং মাতা সারা’র একমাত্র সন্তান যাঁরা উভয়েই নিউ ইয়র্কের সম্‌ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য/সদস্যা। ফ্রাঙ্কলিন শৈশব থেকে তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন নিউ ইয়র্ক শহর থেকে প্রায় ৯০ মাইল উত্তরে তাঁর পৈতৃক বাসভূমি হাইড পার্কের স্প্রিং উড এস্টেটে (Springwood Estate)। এটিই পরবর্তীতে The Home of Franklin D. Roosevelt National Historic Site এ রূপ নিয়েছে। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত ৩০০ একরের এই এস্টেটের পশ্চিম সীমানায় বয়ে গেছে প্রমত্তা হাডসন নদী। এতে আছে ফ্রাঙ্কলিনের বাসভূমি, লাইব্রেরী, মিউসিয়াম, বাগান এবং অনেক ভাস্কর্য। ১৯৪৫ সালে মৃত্যুর পর ফ্রাঙ্কলিন চিরশয্যায় শায়িত আছেন এই বাগানেই (Rose Garden) , পাশে সমাধিস্হ তাঁর স্ত্রী এলিনর রুজভেল্ট।

আমরা বন্ধুরা ন্যাশনাল হিস্টোরিক সাইটের ভিসিটর’স সেন্টার থেকে টিকেট কিনে নেই গাইডেড ট্যূরের জন্য। পরবর্তী ট্যূর শুরু হওয়ার অপেক্ষমান সময়ে আমরা মিউসিয়াম দেখতে যাই। সমসাময়িকতার প্রভাবে মিউসিয়ামে গ্রেট ডিপ্রেসনের সময়কার বিভিন্ন ছবি, ম্যাগাজিন, অডিও এবং ভিডিও আর্কাইভ প্রদর্শিত হচ্ছিল। এছাড়াও গ্যালারিতে চলছিল একটি ভিডিও ডকুমেন্টরী। গ্রেট ডিপ্রেসনের সময়ে ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের জাতির উদ্দেশ্যে রেডিওতে প্রচারিত উদ্দীপিত ভাষণ, অর্থনীতির পূণর্গঠনে নতুন আইন প্রনয়ন, মিলিটারী একাডেমী (ওয়েস্ট পয়েন্ট) পরিদর্শনসহ অনেককিছুই স্হান পেয়েছে এতে। বাইরে থাকা ছবিগুলোতে দেখলাম গ্রেট ডিপ্রেসনের সময়ে আশ্রয়হীন, খাদ্যহীন গণমানুষের মুখ, সরকারী রিলিফ প্রোগ্রামের আওতায় স্যূপ সংগ্রহের প্রতিযোগিতা। এই দুঃসময়ে জাতির উদ্দেশ্যে অভিষেক ভাষণে (inaugural address) বাগ্মী প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট আশার প্রদীপ জালিয়েছিলেনঃ

Only Thing We have to Fear is Fear Itself

সেই সময়ের ‘নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে নতুন (রুজভেল্ট) এবং বিদায়ী (হুভার) প্রেসিডেন্টের মোটরকেডের কার্টুন ছাপা হয়েছিল যেখানে দেখানো হচ্ছিল হাসোজ্জ্ব্যল নতুন প্রেসিডেন্ট পাচ্ছেন উষ্ণ অভ্যর্থনা আর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ম্লানমুখে বসে। আরেকটি কার্টুনে দেখলাম জনসাধারণ বস্তা ভর্তি টাকা লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে যার ব্যাংকার প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট স্বয়ং। বস্তার গায়ে বড় হরফে লেখা “confidence”। তাকিয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি এরকম “confidence” লেখা কয়েকটা বড় সাইজের বস্তা পড়ে আছে কাঠের বক্সে পাশেই। এছাড়াও সেখানে ছিল ফ্রাঙ্কলিনের জীবনের বিভিন্ন সময়ে নানান প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া সম্মাননা, উপহার আর কিছু দুর্লভ চিঠির সংগ্রহ। গ্রেট ডিপ্রেসনের সময়ে অনেকেই ফ্রাঙ্কলিনের প্রতি তাদের পূর্ণ আস্হা জানিয়ে ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছিলেন। দেয়াল জুড়ে এরকম শয়ে শয়ে চিঠি ছড়ানো।

মিউসিয়াম থেকে বের হয়ে বাগানে ঢোকার পথেই দেখি ফ্রাঙ্কলিন আর এলিনর চেয়ার টেবিলে বসে হাস্যমুখে স্বাগত জানাচ্ছেন। লাইফ সাইজের ভাস্কর্য দুটিকে পার হয়ে এলাম। বাগানে ঢুকে এক পাশে চোখে পড়ল হরেক রকমের গোলাপের গাছ। এক সময় মনে হচ্ছিল সব রঙের গোলাপই মনে হয় পাওয়া যাবে এখানে। বাগানের বাইরে দেখলাম মিউসিয়াম আর লাইব্রেরীর মাঝামাঝি জায়গায় ঐতিহাসিক বার্লীন প্রাচীরের দুটি ভগ্নাংশ। ভগ্নাংশ দুটি একজন নারী আর একজন পুরুষের আদলে কাটা। তারা বের হয়ে আসছে নীচের কাটাতাঁরের (barbed wire) বাঁধা পেরিয়ে আর ভিত্তির একপাশে লেখা “Freedom of Speech”।এই ভাস্কর্যের নাম রাখা হয়েছে “Breakfree”। এটি ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিলের নাতনীর মিউসিয়ামকে দেয়া উপহার। প্রাচীরের ভগ্নাংশের বাকি অংশ যার নাম “Breakthrough” সেটি রাখা হয়েছে মিসৌরীর চার্চিল মেমোরিয়াল মিউসিয়ামে যেখানে চার্চিল তাঁর খ্যাতনামা “Iron Curtain Speech” দিয়েছিলেন।

আনগাইডেড ট্যূরের পর্ব আপাতত শেষ। ফিরে গেলাম ভিসিটর’স সেন্টারে যেখানে গাইড আমাদের অপেক্ষায়।পরিচয় পর্ব শেষে গাইডকে অনুসরণ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বাড়ির দিকে।
[ক্রমশঃ]
তথ্যসূত্রঃ
1. The Home of Franklin D. Roosevelt – National Historic Site
2. Wikipedia

২,৮৭৪ বার দেখা হয়েছে

৩০ টি মন্তব্য : “ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের বাড়িতে ১”

  1. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    গ্রেট ওপেনিং নীলোৎপল ভাই :boss: :boss: চমৎকার তথ্যসমৃদ্ধ ভ্রমণকাহিনী :clap: :clap:
    কেমন আছেন বস্ :hug: অনেকদিন পর 🙂 আমাদের সাজ্জাদের কি অবস্থা? দেশে আসবেন কবে?


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  2. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    দারুণ লেখা ভাইয়া। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করবো।

    সিসিবিতে স্বাগতম।
    এই কে আছিস ? ভাইয়া কে এক্কাপ চা দে 😀


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।