লেখকের স্বাধীনতা এবং হুমায়ুন আজাদ

কলেজে মাঝে মাঝে খুব মেজাজ খারাপ হতো যখন দেখতাম একটা পার্টি সারাক্ষণ হুমায়ূন আহমেদের লেখা নিয়ে সমালোচনা করতো।ভালো লাগতো তাদের সমালোচনা যদি তারা অন্য লেখকদের বই পড়ে করতো কিংবা কেউ হুমায়ূন আহমেদের বই উপহার পেলে তারা প্রথম সিরিয়াল না দিত। তারা সমরেশ পড়তো না, তারা সুনীল পড়তো না এমনকি সেবা প্রকাশনীর বই ও পড়তো না। তাহলে কার সাথে কম্পেয়ার করে হুমায়ূন আহমেদের লেখাকে খারাপ বলতো বুঝতামনা। কিংবা অন্য কারো বই এর প্রতিও তাদের আগ্রহ ছিলোনা।
আমি সব পড়তাম প্রায়, সেবা প্রকাশনী বাদে। বিদেশী অনুবাদ পড়তাম তবে কম। কিন্তু আমার কাছে মন হয় আমার বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে প্রাণের কমিকস এবং টিনটনের পর হুমায়ূন আহমেদের কারণে।
এখন একটা নতুন সিনেমা কিংবা নাটক দেখার আগে যেমন উত্তেজনা বোধ করি তখন করতাম একটা না পড়া বই এর জন্য। এখনও করি তবে আগের মত না। স্ক্রিনে বই পড়ে মজা পাইনা কাগজের বই এর মত.

হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখা ছিল অনেকটা এরকম যে , ” একজন খারাপ লোক সমাজে খারাপ কথা বা কাজ দিয়ে মানুষকে যত ক্ষতি করে তার চেয়ে বেশী ক্ষতি করে একজন লেখক, তার লেখার মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে””

আমি গত মাসে দুই মাসে কম পক্ষে ২০ টার মত হুমায়ূন আহমেদের বই রিভিশন দিয়েছি এবং তার মাঝে ১২/১৩ টা মিসির আলি। এবং একটার পর একটা বই পড়ার কারণে আমার মনে হয়েছে হুমায়ূন আহমেদ বেশ ভালো ভাবেই লেখকের মাঝে বিভ্রান্ত ছড়িয়েছেন। যুক্তির কথা বলে উনি মিসির আলির বইয়ে অনেক অযৌক্তিক জিনিষ ঢুকিয়েছেন। পাঠককে অবাক করার জন্য অনেক কাহিনী ঢুকিয়েছেন কিন্তু সেগুলো সমাধান করেননি বেশ কয়েকটি বইতে। এরকম কাহিনী অনেকেই লিখতে পারে কিন্তু খুব কমই সেগুলোর সমাধান দিতে পারে।
এবং শেষের দিকের বই গুলা পড়ে মনে হয়েছে শুধু লেখা দিতে হবে বলেই লিখেছেন।

নিচের ব্লগটা হুমায়ূন আহমেদ মারা যাওয়ার আগের লেখা, এ ব্যাপারটা আগেও শুনেছিলাম যে হুমায়ুন আজাদকে আক্রমণ করার পর একটা সাক্ষাৎকারে হুমায়ুন আহমেদ এই আক্রমণ নিয়ে যা বলেছেন তা কখনই আরেকজন লেখকের কাছ থেকে আশা করা যায়না।
নিচে কোট করছি:

”বাংলাদেশের লেখকরা কি স্বাধীন?
– হ্যাঁ, বাংলাদেশের লেখকেরা স্বাধীন।
তাহলে ডঃ হুমায়ুন আজাদকে মরতে হল কেন ?
– কারণ যে বইটা তিনি লিখেছিলেন, তা এতই কুৎসিত যে, যে কেউ বইটি পড়লে আহত হবে। তার জন্য মৌলবাদী হতে হয়না।”

হুমায়ুন আহমেদ পুরপুরি ঠিক না বললেও আংশিক সত্য বলেছেন, বাংলাদেশে বাজারি লেখকরা বেশ স্বাধীন। কিন্তু সব লেখকরা স্বাধীন নয়।

সালমান রুশদিকে যখন বেশ কয়েকবার মারার জন্য যখন চেষ্টা করা হয়েছিল, তার ইটালিয়ান এবং জাপানিজ ট্রান্সলেটরকে যখন আহত করা হয়, তার নরওয়ের পাবলিশারকে যখন পিঠে গুলি করা হয় এবং বরফের উপর ফেলে রাখা হয় তখন ভ্যাটিকান, ক্যান্টারবারির আর্চবিশপ, ইজরায়েলের প্রধান র‍্যাবাই এর সাথে অনেক রাজনীতিবিদরাও মনে করেছিলেন সালমান রুশদি নিজেই এসব ঝামেলার সৃষ্টি করেছেন ”স্যাটানিক ভার্সেস” লিখে।

এদের সাথে আমরা হুমায়ূন আহমেদের কথার মিল পাই যদিও হুমায়ূন আহমেদ একজন লেখক এবং তারা বিভিন্ন ধর্মের গুরু। ধর্মিয় গুরুরা কখনোই মানবতা কিংবা বাক স্বাধীনতার পক্ষে থাকতে পারেননা কিন্তু একজন লেখক হিসেবে কি হুমায়ূন আহমেদ বলতে পারতেননা,
”এটা একটা বই, এই বই জোর করে কারো হাতে দিয়ে দেয়া হচ্ছেনা। যার ইচ্ছা সে কিনবে, যার ইচ্ছা সে পড়বে। আজান দিয়ে ”পাকসার জমিন সাদ বাদের” বিভিন্ন অধ্যায় পাঁচ বেলা বাজানো হচ্ছেনা। যার আঘাত লাগবে তার পড়ার দরকার নাই এবং এর জন্য তাকে আক্রমণ কোনও ভাবেই মানা যায়না। লেখার উত্তর লেখা দিয়েই দিতে হবে চাপাতি দিয়ে নয়।”
না হুমায়ূন আহমেদ সেরকম কিছু বলেননি বরং বলেছেন পুরো উল্টোটা। হাতে সময় এবং সুযোগ থাকলে হয়তোবা উনিও দুটি কোপ দিতেন যেহেতু উনি মনে করেন এই বই পড়ে যে কেউই আহত হতে পারে তার জন্য মৌলবাদী হতে হয়না।
হুমায়ুন আহমেদ যদি এই বছর বেঁচে থাকতেন তাহলে দেখে যেতে পারতেন হুমায়ুন আজাদের, ”পাক সার জমিন সাদ বাদের মত” কাহিনী দেশে ঘটা শুরু হয়েছে। যেখানে সব লেখকরা মিলে মৌলবোদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন তা না করে তারা বরং ইনিয়ে বিনিয়ে সব দোষ লেখকদের ঘাড়েই ফেলছেন, তাদের বই নিষিদ্ধ করা হচ্ছে আটক করা হচ্ছে তাদের প্রকাশকদের। এবং এই কাজ গুলো মৌলবাদীদের নিজেদের করতে হচ্ছেনা। তাদের পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমী এবং সরকারই করছেন। এক সপ্তাহ আগে জাফর ইকবাল, দুই দিন আগে ইমদাদুল হক মিলন সামনের সপ্তাহে কার ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে আমরা জানিনা।

হুমায়ুন আজাদ আমার খুব পছন্দের লেখক না। কারণ তার লেখা পড়ার মত যোগ্যতা আমার নেই বলেই মনে করি। ৩ টা বড় বড় সমগ্র কিনেছিলাম বেশ দাম দিয়ে ব্রিক লেনের একটা দোকান থেকে কিন্তু ” ৪ টা বই পড়তে পেরেছিলাম বাকিগুলো আমার কাছে অন্যরকম মনে হয়েছে তবে ” আমার অবিশ্বাস” দুই বার পড়েছিলাম ভালো লাগার কারণে। বিজ্ঞানের বই না লিখেও বিজ্ঞানের অনেক বিষয় তার বই থেকে পাওয়া যায় যেখানে হুমায়ুন আহমেদ তার মিসির আলির বইতে
যুক্তির নামে কিছু অযুক্তি এবং সায়েন্সের নামে কিছু সুডো সায়েন্স ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।

যাই হোক লিংক শেয়ার করতে গিয়ে অনেক কিছু লিখে ফেললাম। আর কথা না বাড়িয়ে আখতারুজ্জামান আজাদের, ”অনুভূতি জেনারেল স্টোর” কবিতার দুটো লাইন লিখে শেয়ার করে শেষ করি।u

“”লাস্ট আইটেমটা দেখাই, সহিসালামতে ধরবেন বস।
বস, বস, বস! আস্তে, আস্তে, আস্তে!
এটি ধর্মানুভূতি;
আলতো করে ধরুন, এটি অত্যন্ত মোলায়েম, হালকা এবং ভঙ্গুর।
ধরিবামাত্র ইহা আঘাত পায়,
করিবামাত্র ইহা আঘাত পায়,
বলিবামাত্র ইহা আঘাত পায়;
কিছু না বলিলেও ইহা আঘাত পায়, আঘাতে-আঘাতে জর্জরিত ইহার জন্ম।
ধর্মানুভূতি কিনলে আপনার অঢেল লাভ।
এর গায়ে কেউ ফুলটোকা দিলেই—
আপনি তাকে গাল ভরে গালি দিতে পারবেন,
পল্টন-প্রেসক্লাবে সশস্ত্র শোডাউন করতে পারবেন;
হাত কাটতে পারবেন,
জিভ কাটতে পারবেন,
কল্লাও কাটতে পারবেন;
আইন-বেয়াইন আপনাকে কিছুই বলবে না, উলটো আপনি করতে পারবেন ব্লাসফেমি কেস!
বিনা পুঁজিতে ধর্মানুভূতিব্যবসার মতো লাভজনক ব্যবসা দ্বিতীয়টি নেই।””

৩,৯৪৫ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “লেখকের স্বাধীনতা এবং হুমায়ুন আজাদ”

  1. পারভেজ (৭৮-৮৪)

    এনারা হয়তো নিজেদের নিরাপত্তার জন্য এমনটা বলে থাকবেন।
    কঠিন কোনো অবস্থান নিলে কোপ খাওয়ার ভয় তো আছেই সাথে থাকছে রাস্ট্রিয় যন্ত্রের বিরাগভাজন হবার সম্ভবনা।
    এতটা লোড নেবার চেয়ে দু'চারটা ভেইগ কথা বলে বালবাচ্চাদের খুশি করে দেয়ার সুযোগটা হয়তো হাতছাড়া করতে চান নাই।
    এটাই যে হয়েছে, তা বলছি না।
    তবে এরকমও হতে পারে ব্যাপারটা।
    যদিও সেটার জন্য অন্য কাউকে যে অনেক মূল্য দিতে হতে পারে, সেকথা তারা ভাবেন নাই....


    Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    হুমায়ুন আজাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটা বই আছে।বেশ ছোট। পড়ে দেখিস। (সম্পাদিত)


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।