চোরের মায়ের বড় গলা

বেশ কিছুদিন ধরেই আমার মাথায় একটা বিজনেস আইডিয়া ঘুরতেসিল, এর জন্য দরকার ছিল কিছু ম্যান পাওয়ার এবং বিনিয়োগকারী। রাজীব ভাই এবং আমাদের ব্যাচের তিনজন মিলে আমরা প্ল্যান করলাম যে একটা অনলাইন বই এর দোকান খুলবো।
হার্ড কপি, সফট কপি যেটা সম্ভব সেটা বিক্রি করা হবে। হার্ড কপি সারা ইউরোপের মাঝে হোম ডেলিভারি দেয়া হবে, এবং সফট কপি যে কেউ ক্রেডিট কার্ড, পেপাল, মানিব্রুকারস এর মাধ্যমে পে করে ডাউন-লোড করতে পারবে।
একজন বললও যে নাহ, আমাদের মানুষেরা টাকা দিয়ে বই কিনবেনা, আমি বললাম নাহ, কিনবে। আমাদের টার্গেট কাস্টমার প্রবাসীরা, তারা দেশের যে কোনো কিছু টাকা দিয়ে কেনার সুযোগ থাকলে টাকা দিয়েই কিনবে।

এই প্ল্যান আমার মাথায় আসছে নিজে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে। কিভাবে আমি ভুক্তভোগী হলাম সেটা বলি,
লন্ডনে যারা থাকে বিশেষ করে টাওয়ার হ্যামলেট কিংবা নিউহ্যাম কাউন্সিলের আন্ডারে তাদের জন্য বাংলা বই পড়ার ভালো সুযোগ আছে। নিউহ্যাম লাইব্রেরী এবং আইডিয়া লাইব্রেরিতে প্রচুর বাংলা বই পাওয়া যায়। কিন্তু এতে সব সময় আপনার মন ভরবেনা। ব্রীকলেনে কিছু বই এর দোকান আছে, কিন্তু সেখানেও সব বই পাওয়া যায়না, এবং পাওয়া গেলেও বই এর দাম প্রচুর। তখন একমাত্র উপায়, গুগল করা, দরিদ্র ডট কম, পোলাপান ডটকম, আমার বই ডট কম সহ এধরণের বাংলা ফোরাম থেকে বাজে স্ক্যান করা পিডিএফ ফাইল অথবা বিশাল বড় ওয়াটার মার্ক লাগানো ই-বুক।

আমার চিন্তা ছিলনে আমরা দেশ থেকে প্রথমে ভালো পরিমাণের কিছু বই আনাবো, ওগুলা সারা ইউরোপে পাঠানোর চেষ্টা করবো এবং কারো বই এর রিকোয়েস্ট থাকলে তারা আমাদের কাছে অনুরোধ করতে পারবেন পরের লট আনানোর সময় আমাদের বই এর সাথে অনুরোধের বইগুলো আনানো যাবে। এবং যেই সব বই এর ই-বুক ভার্শন আছে সেগুলো আমরা বিক্রি করবো। আস্তে আস্তে আমরা অডিও বইও বিক্রির কথা ভাববো।

এবং এটা শুধু বই এর মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবেনা, আস্তে আস্তে অডিও/ভিডিও গান, মুভি এবং নাটক এগুলাও বিক্রি করা শুরু করবো। এবং অবশ্যই সব অনুমতি সাপেক্ষে এবং রয়ালিটি সহ।

যাই হোক এটা আর সম্ভব হচ্ছেনা, বা করার ইচ্ছা-নাই। এতদিন মানুষ খালি বই চুরি করতো, এমনকি আমিও এই দোষে দুষ্টু। কিন্তু এখন এটা নিয়া যখন দেখি বিভিন্ন মানুষের গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন একটু ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

একটা সময় ছিল যখন প্রবাসীদের জন্য এইসব চোরা সাইট কিংবা ফোরাম গুলাই একমাত্র অবলম্বন ছিল। কিন্তু এখন আমরা আগের সময়ে নাই, আমাদের শিল্পীদের গান এখন আইটিউন্সে বিক্রি হয়, স্পটিফাইতে পাওয়া যায়, পাওয়া যায় আমাজনেও। এটা ঠিক যে সব গান এখনো পাওয়া যায়না, কিন্তু এটা যেহেতু শুরু হয়েছে এটাকে সাপোর্ট করেন দেখবেন, বাংলা ছবি নেটফ্লীক্সে কিংবা লাভ ফিল্ম এ পাওয়া যাবে। যেমন হিন্দি ছবি পাওয়া যায়(অনেক বাংলাদেশিরাই অবশ্য এখানে মাসে মাসে টাকা দেয়, হিন্দি ছবি দেখার জন্য)।

এক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেয় তাহলে তো কথাই নাই, চমৎকার ব্যাপার। দেশে জি সিরিজ এর মত বড় প্রতিষ্ঠান আছে যাদের পক্ষে গান বিক্রি করার একটা সাইট খোলা কোনো ব্যাপারই-না, কিন্তু তারা শিল্পীদের প্রাপ্য টাকা দিতে চায়না তাদের কাছ থেকে এধরনের উদ্যোগ আশা করাও ভুল।
তবে সরকার থেকে এটা করা কোনো ব্যাপার না। তাদের প্রথম কাজ হবে এইসব ফোরাম, সাইট, ব্লগ বন্ধ করে দেয়া। তারপরে বাংলা গানের কালেকশানের এম্পিথ্রী ফরমেট(যদি কোনো গানের না থাকে, তবে সব গানেরই থাকার কথা) করে বিভিন্ন পেমেন্ট সিস্টেম এর ব্যবস্থা করে বিক্রি শুরু করে দেয়া। দেশের বাইরের সবাই ভিসা, মাষ্টার কার্ড, এমেক্স,পেপাল, মানিব্রুকারস ইত্যাদি উপায়ে পে করতে পারবে এবং দেশে যাদের অনলাইনে পেমেন্ট করতে সমস্যা তারা বি ক্যাশ করে দিলে তাদের একাউন্টে ক্রেডিট করে দিলে তারা গান কিনতে পারবে, গিফট ভাউচার এর ব্যবস্থা থাকতে পারে। আমাদের দেশে-তো সব দিবসই মানুষ পালন করে। বন্ধু দিবস, ভালোবাসা দিবস, পহেলা বিশাখ আরও কত দিবস। এইসব দিবসে মানুষ বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবারের সদস্যদের ৫০০ টাকা কিংবা যে কোনো মূল্যের গিফট ভাউচার দিতে পারে। সাথে সিডি হোম ডেলিভারির ব্যাবস্থা করা যেতে পারে, যদি উপহার হয় কারো জন্য তাহলে থাকতে পারে গিফট র‍্যাপ করার সুযোগ।
এবং যদি সম্ভব হয় গায়ক কিংবা ব্যান্ড টিমের নিজস্ব ওয়েবসাইটেও তারা গান কেনার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন। আজকে মিফতাহ ভাইকে দেখলাম তার গানের আই টিউন্স, আমাজন, স্পটিফাই এবং নিজের সাইট থেকে কেনার লিঙ্ক দেয়া আছে।
এগুলা কঠিন কোনো ব্যাপারনা। থালা থেকে এখন আই পড এর যুগ চলে এসেছে সুতরাং বিক্রির ব্যাপারেও আধুনিক হতে হবে।

একই কাজ করা যেতে পারে বই এর ক্ষেত্রে, বই এর হার্ড কপির সাথে থাকুক অন্যান্য সফট কপির ফরম্যাট। আমি কিন্ডেল কেনার শখ থাকলেও কখনো কিনিনাই একমাত্র একটা কারণে যে, যদি বাংলা ফন্ট সাপোর্ট না করে। বা এধরণের পদক্ষেপ নিয়ে দেখুন তাহলে দেখবেন যে হয়তোবা আমাদের কিন্ডেল কিংবা অন্যকোনো ই-বুক রিডার কেনার দরকার নাই, হয়তবা ওয়ালটন কিংবা বাংলাদেশী অন্য কোনো কোম্পানি হয়তোবা রিডার বানিয়ে ফেলবে। অডিও বই আরও বেশী বের হতে পারে।

এত কথা বলার প্রধান কারণ, সেদিন আসিফ মহীউদ্দিন এর একটা স্ট্যাটাস এ বইচোর সাইট গ্রন্থ ডট কম জয় জয়কার দেখে। এবং সাইটের মালিক এর অনেকের আপত্তির পাল্টা যুক্তি দেখে। ঠিক চোরের মায়ের বড় গলার মত ব্যাপার। এখনো চিন্তা করেছিলাম কিছু কমেন্ট দিয়ে দিব, পরের চিন্তা করলাম ময়লা যত ঘাঁটাবো গন্ধ তত বের হবে।

১,৬০৬ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “চোরের মায়ের বড় গলা”

  1. ইফতেখার (৯৫-০১)

    কথা সত্য যে টাকা দিয়ে কেনার সুযোগ থাকলে অনেকেই টাকা দিয়েই কিনবে।

    আগে প্রায় সব বাংলা গানই এই ঐ সাইট থেকে ডাউনলোড দিতাম, আমাদেরগানে কেনার সুযোগ পাওয়ার পর এ্যাভেইলেবল এ্যালবাগুলো কিনেছি (আগে থাকলেও) - আর্টিস্টকে সাপোর্ট করার জন্য। বইয়ের ক্ষেত্রে এইটা আরো বেশী খাটে। বইতে তো আর রেডিও টিভি অন্তত রয়্যালটি পাওয়া যায় না।

    রকমারী (আরেকটার নাম মনে পড়ছে না) থেকে কেনা সম্ভব, বাট ফ্রেইটের খরচ দিতে গেলে বইয়েরদাম ধরার বাইরে চলে যায়। বইদ্বীপ এর আইডিয়াটা অনেক ভালো, বাট বলতে গেলে কিছুই এ্যভেইলেবল না।

    জবাব দিন
  2. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    মডার্ন লাইব্রেরীর ১০০ উপন্যাস তালিকা ধরে ইপাব নামাইয়া ইসিএফে শেয়ার দিয়ে দিসি। সংজ্ঞানুসারে আমি চোর। তবে ডাকাত নই। ডাকাত হইলো উপরের গুলা। যারা চুরি করা মালসামানের উপর মূল্য সংযোজন করছে।

    বাঙলাদেশে কপিরাইট বিষয়ক সচেতনতা এখনো প্রস্তরযুগেই আছে। বাঙলা বই চুরি করার চেষ্টা এখনো করি নাই। কেন জানি ইচ্ছা করে না।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  3. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    যেদিন থেকে কম্পিউটারের সাথে পরিচয় সেদিন থেকেই চুরির উপর ভরসা করে আছি। এক এন্টিভাইরাস বাদে আর কোন সফটওয়্যার কিনে ব্যবহার করেছি বলে মনে পড়ে না। টরেন্ট আইডিএম দিয়ে গিগাবাইটের পর গিগাবাইট মুভি সিরিয়াল নামাচ্ছি। তাই আমাকে একজন পুরদুস্তর চোর বলা যায়। তবে গত কয়েক বছরে যে জিনিষটা করার চেষ্টা করছি তা হলো দেশি কোন কিছু এভাবে চুরি না করার। দেশি গান ডাউনলোড করা পুরোপুরি বাদ দিয়েছি, বই ডাওনলোড ও বাদ দিয়েছি তবে সেটা মূলত ই পাব ভার্সনের অভাবে। তবে ইদানিং কিছু সাইট দাড়াচ্ছে অনলাইনে বই বিক্রীর, ঠিক ভাবে চালু হলে অবশ্যই সেখান থেকে ইবুক কিনবো।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  4. মাহমুদ (১৯৯০-৯৬)

    বই চুরি করায় কোন দোষ নাই, মার্ক টোয়েনের বরাতে আমাদের স্কুলের পাঠ্য বইয়ে জেনেছি 😛


    There is no royal road to science, and only those who do not dread the fatiguing climb of its steep paths have a chance of gaining its luminous summits.- Karl Marx

    জবাব দিন
  5. ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

    নাজমুল তোমার এতো সুন্দর পোস্টটার এরকম নাম দিয়েছ কেন? চালিয়ে যাও। আমিও বিজনেস নিয়ে ভাবছি।


    “Happiness is when what you think, what you say, and what you do are in harmony.”
    ― Mahatma Gandhi

    জবাব দিন
  6. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    ছোট একটি আইনী তথ্যবটীকা লিখে যাই। লেখকরা অবশ্য জানার কথাঃ

    কপিরাইট আইন ২০০০ অনুসারে, বইপুস্তক ইত্যাদির ক্ষেত্রে কপিরাইটের মেয়াদঃ লেখকের জীবন + ৬০ বছর। এরপরে সেটা জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায়।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  7. টিটো মোস্তাফিজ

    আমি নিজেও বেশ কিছু বই চুরি করেছি। মানে পিডিএফ যোগাড় করেছি । কিন্তু পড়া হয়নি। কাগজের বই পড়ার মজাই আলাদা। সংবাদ পত্র অন লাইনে পড়ি কিন্তু ভালো কিছু ( যেমন বাংলাদেশের জয় বা বিশেষ কোন অর্জন ) থাকলে কাগজটা কিনি। আমি হয়তো সেকেলে । যাই হোক তোমার লেখাটা খুব ভালো লেগেছে :hatsoff: :hatsoff:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ওয়াহিদা নূর আফজা (৮৫-৯১)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।