একটি স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর দিন

সব কিছু ঠিকঠাক, কাল সকাল পাঁচটায় বাস ছাড়বে। সবাই দশটার আগে বাসায় গিয়ে ঘুম। কালকের দিনটার জন্য ১ বছর ধরে প্ল্যান করা।
সবার ছুটি ঠিক করা ২ মাস আগে থেকে, বুঝতে হবে ১ বছর আগের প্ল্যান।
৫০ জনের সবাই এই দিনটা একসাথে থাকবে একসাথে তাদের জন্মস্থানে যাবে।

সকাল ৫ টায় বাস থাকবে শাহাবাগ মোড়ে, জাদুঘরের সামনে। ঘুম থেকে উঠে দেখি ৪:৫৫!!!
তাড়াতাড়ি লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠে রেডি করা ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে নিচে নামলাম।
কোনো রিকশাও নাই, মোড়ে আসার পর এক মামারে পাইলাম। তারে বললাম মামা যেভাবেই হোক তাড়াতাড়ি নিয়া যাও শাহাবাগ মোড়ে।
আমি যখন রিকশা থেকে নামলাম তখন বাজে ৫:১০।সাহাবাগে মাত
শাহাবাগে মাত্র পনেরো/ষোল জন। অথচ সবার থাকার কথা ১০ মিনিট আগে।
গিয়ে দাঁড়াইলাম সবার সামনে। আর বছর পর দেখা হল ওদের সাথে। অনেকের সাথে পাঁচ বছর পর। মামুন আর মুসফিক আমরা একসাথেই থাকতাম, বাকিদের অনেকদিন পরে দেখলাম, কেউ আগের থেকে মোটা, কেউ আগের থেকেও চিকন, কারো ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, আবার কলেজে মাকুন্দা বইলা যাদের টিজ করতাম তাদের ২ জনরেও দেখলাম চাপ দাড়ি। :O
সবাই আসা শুরু করলো, কেউ একা, কেউ গ্রুপে। দেখতে দেখতে ৫০ জন আমরা অনপ্যারেড ৬:১৫তে।
আজকে আমাদের সবার জন্মদিন, আমরা ৫০ জন যমজ ভাই। আমরা কাউকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাইনাই, এমনকি মুখেও শুভ জন্মদিন বলিনাই কিন্তু মনের মাঝে এমন একটা ফিলিংস কাজ করতেসিলো যা আমি লিখে বোঝাতে পারবোনা। এই ফিলিংস ভালোবাসার জনকে প্রেম নিবেদন করে, পজিটিভ উত্তর পাওয়ার ফিলিংসের চাইতেও অন্যরকম।
আমার মনে হল বিদেশে চার বছর থাকার কারণে যত রি-ইউনিয়ন, যত গেট টু গেদার এ যাইতে পারিনাই তার কষ্ট আমার মন থেকে আজ ধুয়ে গেল।
৫০ জন একসাথে ৫০ জন!!!
আপনি ভেবে দেখেন আবার আপনারা ৫০ জন এক হবেন, এক বাসে করে আরিচা ফেরি পার হবেন!! সেই কলেজ গেট দিয়ে কলেজে ঢুকবেন!! দেখেন কি অবস্থা হয় মনের। মনে হবে পাশের ট্যাবে অন করা ইউ টিউব এর গান বন্ধে করে দিতে, মনে হবে ভি এল সি প্লেয়ারে চলা মুভিটা বন্ধ করে দিতে, মনে হবে সবাইকে যদি এখন পাশে পেতাম, তাহলে সামনের বছরের জন্য প্ল্যানটা এখনি করে ফেলি।
তাহলে আমার মনের অবস্থা চিন্তা করেন।
বাসে উঠে মনে হল আমি কলেজের বাসে করে ১১ এর এক্সকারশানে যাচ্ছি। তবে একটা পার্থক্য আছে,
তখন আমরা কলেজ থেকে বাইরে যাব তার জন্য বাস চালু হলে চিল্লাচিল্লি শুরু করতাম, কিন্তু এবার কিন্তু কলেজে যাব বলে চিল্লাচিল্লি করতেসি।

বাসের চিত্র ঠিক যেন ২০০৭ এ কুমিল্লা যাওয়ার কিংবা ২০০৮ এ কুয়াকাটা যাওয়ার চিত্রের মত। পার্থক্য খুবি সামান্য। কিছু লিখলাম না, খালি মনে মনে ভাবুন আপনার এক্সকারশানে বাসে করে যাওয়ার কথা, তাহলেই হয়ে যাবে।

সেই আরিচা ফেরি, দোকান গুলার খাবারের মেনু আগের মতই আছে। বড় কড়াইয়ে আলু-ভাজি, মাঝখানে ইলিশ মাছ আর উপরে শুকনা মরিচ দাড় করানো।
এবার ফেরিতে কেউ আমাদের দিকে অন্যভাবে তাকায়নাই, কেউ জিজ্ঞাসা করেনাই আমরা কি ক্যাডেট স্কুলের ছেলে কিনা কিংবা কেউ আফসোস করেনাই এত অল্প বয়সে আনসারে যোগদান করার কারণে।

দোয়ারিকা ব্রীজটা যেন আর আসতেই চায়না। আরিচা থেকে নামার পর,
আগে কলেজে আসার সময় দোয়া করতাম যান বাসে দেরী হয় এখন দেরী সহ্য হচ্ছেনা।

শিকারপুর ব্রীজটা পার হওয়ার পরই কেমন যেন একটা অনুভূতি আসতে লাগল।
সবাই চুপ করে করে আছে, সবাই বাম দিকে তাকিয়ে আছে, আমি শিউর করে বলতে পারি কলেজ পণ্ড দেখার জন্য তাকিয়ে আছে,
সবাই একসাথে চিৎকার দিয়া উঠলো কলেজ পণ্ড দেখার পর।
আমরা কলেজের ভিতর ঢুকলাম ২ নাম্বার গেইট দিয়ে। বাস থামানো হল, হকি গ্রাউন্ডে। সেই হকি গ্রাউন্ড, এখনো পিছনে পেয়ারা গাছ গুলা আছে 🙁
আমরা আসতে আসতে নামলাম নিচে, সবাই যেন কবি কিংবা আর্টিস্ট। খুব খুটিয়ে খুটিয়ে সব কিছু দেখতেসে।
কেউ গাছে হাত দিয়ে কি যেন ভাবতেসে, কেউ ফুটবলের বার ধরে, ইকবাল আবার ২টা বিম দিয়ে নিল ফুটবলের বার ধরে, কেউ ঘাস ধরতেসে। অন্যরকম একটা ফিলিংস বোঝানো যাবেনা।

তারপর আমরা পুরা ফুটবল গ্রাউন্ড, বাস্কেটবল গ্রাউন্ড,মস্কের আশেপাশে, ফোয়ারা, ডাইনিং হল, হাসপাতাল সব খুব মনোযোগ সহকারে ঘুরে দেখলাম, তারপর একাডেমী ব্লকে গিয়ে ছবির ওইখানে গিয়ে ছবি দেখলাম। ক্যাডেটরা সব আমাদের দিকে তাকাই আসে। আমরা আস্তে আস্তে টয়লেটে গেলাম(জুনিয়র), কয়েকজন গেল আর্ট গ্যালারি তে, টয়লেটে কোন জায়গায় কাঁঠালটা রাখসিলাম, জানালা গুলায় যে আগে শিক ছিলনা পিছনে সেই নিয়ে আলোচনা, ৪১ যেদিন ধরা খাইল সেদিন আমরা কই বসে ওরা আসেনা কেন অপেক্ষা করতেসিলাম সেটা মনে করার চেষ্টা করলাম।
তারপর লাইব্রেরী তে গেলাম, নীল নকশার চুরির কাহিনী, এম আই থ্রি স্টাইলে ইকোনোমিকস বই চুরি করার কাহিনী শুনাইলাম সবাইকে। মুস্তো শুনাইল সে কিভাবে চিকন বই চুরি করতো, আর মাহমুদের পামেলা বা কোনো এক সেলিব্রেটীর ছবি ছিঁড়তে গিয়ে বনিক স্যারের কাহিনী মনে পড়ে গেল। এখনো ওই বড় গ্লোবটা আছে, তবে নতুন রঙ করা হয়েছে।
ভূগোল ডিপার্টমেন্টে এখনো আমিন ভাই এর বানানো সোলার সিস্টেম এর মাটি দিয়ে বানানো জিনিসটা আছে, বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে গিয়ে নূর ওর বায়োলজি প্রাকটি-কাল খাতাটা পেয়ে গেল, চুরি করতে পারতেসিলোনা, নিলয় সাহায্য করলো 🙂
তারপর হাউজ, যে যেই রুমগুলাতে ছিল সেখানে গিয়ে অবেক্ষণ অনেক কিছু চিন্তা করতে লাগলো। ৩০৩ এ এখনো শুঁটকী পুড়াই খাওয়ার দাগটা আছে। সোহরাওয়ার্দী হাউজের সিনিয়র টয়লেটে এখনো হালকা করে বোঝা যায় আমাদের সিরিয়াল এর লিস্টটা,MCJH(MAd,casper,jontu,
hen)।

দুপুরে ডাইনিং হলে লাঞ্চ করলাম। আজকে সবাই হাত দিয়ে খাওয়ার অনুমতি পাইল।
তারপর আমরা কলেজের আমাদের সময়ের সব রতন ভাই জয়নাল ভাইদের সাথে কথা বললাম।
বিকেলে সবাই ড্রেস চেঞ্জ করে মাঠে নেমে গেলাম। ১০ মিনিট ফুটবল তো ৫ মিনিট ভলি, তারপর ২/৩ মিনিট বাস্কেট আবার ফুটবল। তারপর সবাই গোসল এ গেলাম কলেজ পন্ডে। তারপর মাগরিবের পর আমরা বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে কেক কাটলাম, ৩৪ সিনিয়র মোস্ট ক্যাডেট হওয়ার কারণে সে কেক কাটলো প্রিন্সিপাল স্যার এর সাথে । টি ব্রেক আজকে সবার গ্রাউন্ড এ হইসে। তারপর??
তারপর বিদায়ের পালা।বাসে উঠলাম সবাই। এবার ছয় বছর এর উল্টোটা হইলো।
আগে কলেজে আসার সময় পণ্ড দেখলে আমরা চুপ খাই যেতাম এবার চিল্লাচিল্লি করসি,
আর কলেজ থেকে বের হয়ে চিল্লাচিল্লি করতাম এবার চুপ হয়ে ছিলাম,
জামান গানের কলি খেলার প্রস্তাব রাখলো সবাই না করে দিল। অনেকদিন পর একটা খুশি খুশী মনে সবাই জার্নি করতেসে, কেউ পাশের জনের সাথে কথা বলেনা।
চোখের ভিতর তখন হয়তো টিভি রুমের ছবি কিংবা টিটি খেলার ছবি, বা ক্যান্টিন এর সিরিয়ালের ছবি বা দাদুর চুল কাটার ছবি………………………………।

৭ইমে, ২০১৩ ইং
ক্যাডেট নাজমুল
ক্যাডেট নং-১২৩৮
শ.সো.হা
বরিশাল ক্যাডেট কলেজ
বরিশাল-৮২১৬

কাহিনীটা এখনো ঘটেনাই তবে ঘটবে বলে আশারাখি,
হয়তোবা সামনের বছরে, ০২-০৮ ইনটেক প্ল্যান করবে, এইবার আর ভ্যানু ঠিক করা লাগবেনা। এবারের ভ্যানু যার যার কলেজ।
যেখানে গিয়ে জন্মদিন পালন করার মজা বিশ্বের কোথাও পাওয়া যাবেনা।

ভালো থাকিস দোস্তরা, শুভ জন্মদিন তোদের সবাইকে।
শুভ জন্মদিন ০২-০৮ ইনটেক

৬৬২ বার দেখা হয়েছে

৯ টি মন্তব্য : “একটি স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর দিন”

  1. মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)
    ৪১ যেদিন ধরা খাইল সেদিন আমরা কই বসে ওরা আসেনা কেন অপেক্ষা করতেসিলাম

    :(( :(( :(( :((

    আগের ভার্শনটাই ভালো ছিল 🙁 🙁 🙁


    "আমি খুব ভাল করে জানি, ব্যক্তিগত জীবনে আমার অহংকার করার মত কিছু নেই। কিন্তু আমার ভাষাটা নিয়ে তো আমি অহংকার করতেই পারি।"

    জবাব দিন
  2. দিবস (২০০২-২০০৮)

    খুব ভাল লিখেচ বাইয়া, আমাদের তিপ্পান্ন জন মাঝে মাঝেই একসাথে হওয়ার স্বপ্ন দেখি,কিন্তু মনে হয় না এ জীবনে সেটা আর সম্ভব হবে। 🙁


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।