আলস্যে ভিজেছে মন, বৃষ্টিতে আর কি আসে যায় !

এক আমেরিকান বন্ধুর কাছ থেকে কেনা সেকেন্ড হ্যান্ড সেনহেইজার হেডফোন টা কানে লাগিয়ে কাউচে বসে গেলাম। ল্যাপটপে অর্ণব এর রবীন্দ্রসঙ্গীত এর প্লে-লিস্ট টা ছেড়ে দিলাম। কম করে হলে একটা ঘন্টা আর গান সিলেকশন করতে হবেনা। একটানা চলতে থাকুক। পারফেক্ট আবহাওয়া। বসে আছি আমার স্পন্সর ফ্যামিলির বাসার বেজমেন্টে।রাত প্রায় ১০ টার মতন। সন্ধ্যাই ঠিক মতন হলো ঘন্টাখানেক আগে। সূর্য টা ডুব দেওয়ার কিছুক্ষণ আগে থেকেই আকাশ কালো করে মেঘরা জড় হচ্ছিল। বিকেলে এপল স্টোরে যেতে হয়েছিল। আমার প্রাগৈতিহাসিক আইফোন ফোরের ক্যামেরাটার চোখে ছানি পরেছে। যা ছবি তুলি সবই ঝাপসা আসে.. তিন বছর সার্ভিস দিয়ে গেল বেচারা। ফোন চেক করে স্টোর এর ছেলেটা বললো ফোন চেঞ্জ করতে। আমি মাথা নেড়ে চলে আসলাম। কি লাভ ফোন চেঞ্জ করে.. ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস এর প্রতি আমার কেন জানি কোন মোহ নেই। গত বছর দেশে ফিরে প্রায় এক মাসের মতন নোকিয়া ১১০০ এর একটা ফোনসেট ব্যবহার করেছিলাম ইচ্ছে করে.. এমন একটা ফোন খুজছিলাম যেটা দিয়ে কথা বলা ছাড়া আর কিছুই করা যায়না। বলা বাহুল্য দেশের সেই একটা মাসের স্মৃতি খুব ভালো মতন মেমরিতে গেথে গেছে। ফোন টেপাটিপি করে সময় নস্ট করিনি খুব একটা।তবুও এবার ফোনটার ক্যামেরা টা ঠিক করতে চাচ্ছিলাম সামনের ট্যুর টার কথা চিন্তা করে..সব ঠিক থাকলে ২/৩ দিন এর মাঝেই একটা ট্রেইনিং প্রোগ্রাম এ পার্ল হারবার, হাওয়াই তে যাওয়ার কথা। সাড়ে তিন সপ্তাহ এর জন্য। শুনেছি হাওয়াই খুব সুন্দর জায়গা। ভালো DSLR ক্যামেরা আমার নেই। এর মাঝে ফোন এর এই ক্যান্সার।মনে হচ্ছে এবার ছবি টবি আর তোলা হবেনা। একদিক দিয়ে খারাপ হয়নি। ছবি তুলতে গিয়ে চোখের দেখাটা এখন মিস হবেনা। ( আঙ্গুর ফল খুব মিস্টি )

স্টোর থেকে বের হয়েই ইউবার এ ঢুকে একটা ক্যাব এর জন্য রিকুয়েস্ট প্লেস করলাম। গাড়ি চলে আসলো ৩/৪ মিনিটের মাঝে। ইউবার এপটা আমার কাছে রেভলুশনারি একটা টেকনোলজি বলে মনে হয়। ট্যাক্সি ক্যাব এর কন্সপেট টাই বদলে দিয়েছে এই জিনিস। গতকাল রাতে “সিলিকন ভ্যালি” নামক একটা এইচবিও কমেডি শো দেখছিলাম। সেই শো তে এরকম অনেক এপ আর টেকনোলজিকাল জিনিসপত্রের পেছনের ড্রামাগুলো খুব ফানি ভাবে দেখানো হয়েছে। সিরিজটা বেশ ভালো লাগলো। এইরকম টেকি নার্ড দের কাজকর্ম দেখতে ভালোই লাগে আসলে। ফিন্চার এর “দা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক” মুভিটাও বেশ ভালো লেগেছিল। যাই হোক, গাড়িতে বসা অবস্থায় টের পাচ্ছিলাম যে আজকে একটা বড়সড় বৃস্টি হতে পারে। গ্লাসটা অর্ধেক নামানো ছিল। বাতাসে গত ১ মাস একবারও না কাটা মাথার চুল গুলো উড়ছিল। গাড়ি যেখানে আমাকে ড্রপ করে গেলো সেখান থেকে আমার স্পন্সর ফ্যামিলির বাড়ি ১ মিনিটের হাটা রাস্তা। হাটা শুরু করার পরপরই বাতাসে একটা গন্ধ টের পাচ্ছিলাম। এই গন্ধ আমার চেনা। বৃস্টি আসার আগে এরকম একটা গন্ধ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অনেকক্ষণ বাইরে দাড়িয়ে রইলাম। বেশ কয়েকটা খরগোশ দৌড়াদৌড়ি করছে আশেপাশে। হুট করে সামনে দিয়ে চলে গেল একটা। এদের দেখলেই কেন জানি আমার একটা আফসোস হয়। আলসেমি করে বেচারা কচ্ছপের সাথে রেসটা হেরে গেলো। এদের দৌড়াদৌড়ি দেখে মনে হয় সেই কষ্টেই বোধহয় বেচারারা এখনো দৌড়াচ্ছে। বাসার ভেতরে ঢুকে চলে এলাম বেজমেন্টে। গতকাল রাতে এখানেই ঘুমিয়ে পরেছিলাম। কম্বল- কাথা সব এখানেই পরে রয়েছে। ঘুম ভেঙ্গেছে চোখে সূর্যের আলো পরার পর.. কাউচের সামনেই বড় একটা গ্লাস লাগানো। সামনের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। অবাক করার মতন ব্যাপার হলেও সত্যি যে সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর বাইরে তাকিয়ে দেখেছিলাম যে বাইরে আরেকটা খরগোশ দাড়ানো। সকালবেলার সেই খরগোশটা দেখে কেন জানি ডনি ডার্কো মুভির সেই মনস্টার খরগোশটার কথা মনে পরে গিয়েছিল। কেন জানিনা ! এখনো এতটা রোমান্টিক হতে পারিনি মনে হয়।

বলতে না বলতেই এর মধ্যেই প্রবল বৃস্টি শুরু হয়ে গেল। ম্যারিল্যান্ড এর বৃস্টি এমনিতে খুব বিরক্তিকর লাগে আমার কাছে। হালকা হালকা কি বিরক্তিকর বৃস্টি যে পরে! কিন্তু আজকেরটা বেশ অন্যরকম। বারবার বিদ্যুত চমকানো দেখতে পাচ্ছি। বাইরে রাখা একটা খালি ফুলের টবে পানির প্রবল বেগে পরা দেখে ভালোই বুঝতে পারছি যে আজ বেশ ভালোই বৃস্টি হচ্ছে। সমস্যা একটাই- কোন শব্দ শুনতে পাচ্ছিনা। টিনের চলে বৃস্টি পরার মতন মধুর শব্দ আমি জীবনে খুব কমই শুনেছি। টিনের চাল এখানে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। তবুও নিদেন পক্ষে কিছু শব্দ তো শুনতে হবে, তাইনা? কান থেকে হেডফোন নামিয়ে দিলাম। আপাতত অর্ণব আর চন্দ্রবিন্দুকে ছুটি। বাইরের বৃস্টি আর মৃদু বজ্রপাতের শব্দ এখন কিছুটা হলেও শুনতে পাচ্ছি।ভালো লাগছে। কম্বলটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিলাম। থাকি বসে এভাবে কিছুক্ষণ।সকালে ব্যাগ গুছানো যাবে। এরকম প্রাকৃতিক আলস্য সবসময় আসেনা। এরকম মুহুর্তে কিছু করতে নেই। ঝিম মেরে বসে থাকতে হয়। আকাশ পাতাল ভাবতে হয়। দু-কলম হাবিজাবি অখাদ্য জিনিসপত্র লিখতে হয়। “জীবনানন্দ এর কবিতা” , ” রবীন্দ্রনাথের বৃষ্টির কবিতা” লিখে গুগল সার্চ করতে হয়। ইউটিউবে ঢুকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে হয়। সেগুলো করার চেষ্টাই করছি আপাতত।

কোথা থেকে শুরু করে কোথায় চলে গেলাম ! আসলে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত গাওয়ার একটা প্রবণতা আমার মাঝে প্রবল। টপিকে থাকতে পারিনা। অবশ্য সত্যি কথা বলতে কোন টপিক ও ছিল না লেখা শুরু করার আগে। কথা বলতে বলতে যেহেতু আমার স্পন্সর ফ্যামিলির টপিক আসলো তাই একটা জিনিস শেয়ার করি।

গত ৩ বছরে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি নানা ভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। অনেকগুলো মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে যাদের সংস্পর্শে এসে আমার মাঝে অনেক বড় কিছু পরিবর্তন এসেছে। আমার স্পন্সর ফ্যামিলি এদের মাঝে মনে হয় সবচেয়ে বড় ইমপ্যাক্ট টা ফেলছে আমার উপর.. উইকেন্ডে বা অন্য কোন ছুটিতে যখন এই বাড়িটাতে আসি , এসেই দরজার পাশে দাড়িয়ে দেখি তারা ইউএস এর ফ্লাগ এর পাশে একটা বাংলাদেশ এর পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছেন। ব্যাপারটা ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। এরকম নি:শ্বর্ত ভালবাসার প্রতিদানে কিভাবে দেব জানিনা। হয়তো কোন একদিন অন্য কারো জন্য ভালো কিছু করে.. হয়তো কোন একদিন।

10419794_4297670937442_1055774097_n
শেষে বোনাস হিসেবে লুমিনার্স এর গানটা দিয়ে দিলাম এমনি এমনি।  হালকা ধাচের এই গানের লিরিকটা কেন জানি  খুব ভালো লাগে।  গানের লিংক ” Classy Girl “
২,৭১৬ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “আলস্যে ভিজেছে মন, বৃষ্টিতে আর কি আসে যায় !”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    প্রথম মন্তব্যটা করেই ফেললাম। নোটিফিকেশান আদান প্রদান একটি সামাজিক প্রক্রিয়া।
    সিলিকন ভ্যালি দেখার জন্য মঞ্জুর একাধিকবার রেকমেন্ড করেছে। দেখতে হবে।
    আমেরিকার এই পতাকাপ্রীতিটা আমার খুব ভাল লাগে।


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • নাফিস (২০০৪-১০)

      সিসিবিতে নোটিফিকেশন আসলে খুবই ভালা লাগে :tuski: :tuski:
      সিলিকন ভ্যালি দেখে ফেলেন। হালকা জিনিস। কোয়ালিটি ভালো। এইচবিও বানাইছে। বুঝেন ই তো 🙂
      পতাকা প্রীতি এতই বেশি যে সাউথ ক্যারোলিনা এখনো কনফেডারেট ফ্ল্যাগ নামাইতে পারলো না। বিল মাহের এর একটা ভিডিও দেখতেছিলাম কেবল এই বিষয়ে।

      জবাব দিন
      • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

        কনফেডারেট পতাকা নিয়া চুদুরবুদুর ঐটা আবার বেশী বেশী। বর্ণবাদী ঘোচুর দল! Roof এর লিখা, ছবি সব প্রকাশ পাইতেসে। এইগুলা জানোয়ার বললে জানোয়াররে অপমান করা হবে।


        \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
        অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

        জবাব দিন
          • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

            হাহাহাহাহা! এইটা এপিক ছিল। আমেরিকার বৃহত্তম হিপোক্রিসি গুলার একটা মনে হয় এই কনফেডারেট ফ্ল্যাগ নিয়া চুদুরবুদুর! লেনার্ড স্কেনার্ড ভাইজানেরা তো এখনো কনফেডারেট ফ্ল্যাগ গায়ে চাপায় কনসার্টে নামে। ঐ দিকে অবশ্য টেক্সাসের সুপ্রিম কোর্ট ডিসিশানটা অত্যন্ত কাজের হইসে। এইসব মকরামি বন্ধ করে লাইনে নিয়ে আসা দরকার 'মারিকাকে।


            \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
            অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

            জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    অনেক দিন পরে নাবিক! সব মিলিয়ে বেশ লাগলো লেখা :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    সিলিকন ভ্যালি দেখা শুরু করেছি! দারুণ লাগছে!
    তোর বেশি বেশি দিনলিপি লেখা উচিত!
    আমাদের জীবনে তো বৈচিত্র নাই- তোর জীবনে সেটা ভরপুর!


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  4. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    চমৎকার ছাড়া ছাড়া লেখা, ভাসমান মেঘের পেঁজার মত, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা ঠাওর করা যায়না।
    আলস্যভাবটা দারুণভাবে সংক্রামক হয়েছে।
    গানটা রিয়েলী ক্লাসী! ভালো লেগেছে।
    "I asked her why
    she replied
    it was nothing
    I was doing wrong!"
    So wonderful!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সাইদুল (৭৬-৮২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।