আয় ফিরে তোর প্রাণের বারান্দায়

শীতের শুরুর দিকে দাদুবাড়িতে চলে যেতাম। সেই ছোটবেলায়। ধানকাটার মৌসুম চলতো তখন.. বাড়তি কাজের লোক নিয়োগ করা হতো সব ধান কাটা শেষ করার জন্য। স্পেশাল এই মূহুর্তে একটু বিশেষ তদারকি করতে আব্বু ,আম্মু র সাথে আমিও চলে যেতাম দাদুবাড়িতে। শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থানার কাকরকান্দী ইউনিয়নের বরুয়াজানি গ্রাম। বাড়ির উঠানে দাড়িয়ে ইন্ডিয়ান বর্ডারের ওপাশের মাথা উচু করে থাকা বিরাট উচু তুরা পাহাড় দেখা যায়.. আর দুই তিন মাইল গেলেই আমাদের সীমান্তবর্তী পাহাড় গুলো। আম, অর বড়ই, জলপাই আর কাঠাল গাছ গুলো পেরুলেই বিশাল একটা পুকুর। পুকুরের চারপাশে ছোটবড় অনেক তাল ও খেজুর গাছ অনেকটা প্রহরীর মতো ডিউটিরত । বাড়ির পিছনে বিশাল বড় একটা সেগুনের বাগান আর বাশঝার। সেই বাশঝারের এক পাশেই দাদুর বাবার কবর। এই কবরটা দেখে ছোটবেলায় কেন জানি ভয় পেতাম ! বাশঝার টা ক্রমশ ঢালু হয়েছে। এর ঠিক পিছন দিয়েই বয়ে গেছে বুড়ি ভোগাই নদী। একেবারে বই য়ে পড়া আদর্শ গ্রামের সংজ্ঞার সাথে যেন পুরোপুরি মিলে যায়। আমরা দাদুবাড়িতে গেলে বছরের বাকি সময়টায় একাকীত্বে ভোগা বুড়ো দাদু আর দিদামনি প্রচন্ড খুশি হতেন। উনাদের মুখে একটা অকৃত্রিম হাসি লেগে থাকতো পুরোটা সময় জুড়ে। প্রতি বেলা স্পেশাল খাওয়া দাওয়া চলতো। দুপুরে পুকুরে গোসল করার আগে জাল ফেলে কাজের লোকেরা মাছ ধরতো..ঘুরে ফিরে একই জাতের মাছ। কাতল, সিলভার কার্প, মৃগেল, তেলাপিয়া। আমি ঘাটে বসে বসে আঙ্গুলের নখ দাত দিয়ে কামড়ে কামড়ে কাটতাম আর মাছ আর জালের এই আত্মিক সম্পর্কের স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা চালাতাম। ধানের আটিগুলোকে টিনের ড্রামের উপর ক্রমাগত বাড়ি দিয়ে দিয়ে আটি থেকে ধান আলাদা করা হতো.. আটি থেকে ধান গুলো পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেলে সব আটি গুলোকে একসাথে রেখে উচু একটা পাল্লার মতো প্লাটফর্ম তৈরী করা হতো.. বিকালে শীতের কাপড় পরে ওই উচু খেড়ের পাল্লায় গিয়ে বসে থাকতাম। নিজ দিয়ে কেউ হেটে গেলে, অবজ্ঞাভরে নিচে তাকাতাম।ব্যাপক পার্ট !

সাদাকালো একটা টিভি ছিল বাড়িতে। কারেন্ট না থাকলেও ব্যাটারি দিয়ে দেখা যেত। শুক্রবার বিকালে টিভির সামনে দর্শক সংখ্যা বেড়ে যেত। আশেপাশের বিভিন্ন বাড়ি থেকে মানুষ জন আসতো পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা দেখার জন্য। সবার সাথে বসে আমিও সিনেমা দেখতাম। ৩ টায় বিটিভির বৈকালীন অধিবেশন শুরু হতো। আর ৩টা ২০ এ শুরু হতো সিনেমা। ৪টায় ছিল খবরের বিরতি আর বিজ্ঞাপন বিরতি তো আছেই। মানুষ জন সবাই খুব আবেগ নিয়ে সিনেমা দেখতো। চির নির্যাতিত বাঙালি বধু শাবানা, প্রতি পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া বামহাতি প্রেমিক নায়ক ওমর সানি, মায়ের দোয়ায় উজ্জীবিত নায়ক আলমগীর, গরীবের বন্ধু নায়ক জসীম সহ সব ভালো চরিত্রের প্রতি মানুষজনের ছিল প্রবল ভালোবাসা। ভিলেন টাইপ ক্যারেক্টার গুলো বিশেষ করে রাজীব, মিজু আহমেদ, কাবিলা, জাম্বু কে উদ্দেশ্য করে প্রচুর গালিগালাজ করা হতো। বেশ আনন্দদায়ক একটা অভিজ্ঞতা ছিল এই সিনেমা দেখা। মাঝে মাঝে রাতের বেলাও টিভি সিরিজ গুলো দেখতে বসে যেতাম। আলিফ লায়লা, সিনবাদ, রবিনহুড, রোবোকপ, টিম নাইট রাইডার, আর্থ ফাইনাল কনফ্লিক্ট আরো অনেক গুলো সিরিজ। একেক দিন একেকটা দেখাতো। এখনো মনে পরে , সিনবাদের মিভ কে দেখে মনে একধরণের বিশেষ অনুভূতি হতো। অনেক পরে বুঝতে পেরেছি যে ঐটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম ক্রাশ ! রাতে বাথরুমে যাওয়ার সময় সবসময় সাথে কেউ একজন টর্চ হাতে পাশ দিয়ে হাটতো। ব্যাপারটাতে খুব বিরক্ত হতাম। কিন্তু কিছু করার নেই, এটা দাদুর আদেশ। বাথরুমের পাশেই একটা হাসনাহেনা গাছ। রাতে সেখানে ফুল ফুটতো। সেই গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত সারা বাড়িতে। দাদুর মতে হাসনাহেনার গন্ধে নাকি সাপ চলে আসে।

পল্লী বিদ্যুতের কানেকশনে সন্ধ্যার পর প্রায়ই লোডশেডিং হতো.. জমাট কালো অন্ধকার ! হারিকেন বা কেরোসিনের কূপিবাতির আলোয় চারদিকে একধরনের একটা অদ্ভুত পরিবেশ তৈরী হতো.. রাতে খাওয়ার সময় আম্মু মাছের কাটা আলাদা করে দিতেন। আর অনেকদিনের পুরোনো বুড়ো কাজের লোক জয়নাবের মা ডালিমকুমার এর গল্প শুনাতেন। মামদো ভূতের গল্প বলতেন। টোনাটুনির গল্প বলতেন। টোনা টুনির পিঠা বানানোর সেই গল্প তন্ময় হয়ে শুনতাম। সবার মুখে খালি এক নামই শুনতাম, জয়নাবের মা! উনার আসল নাম কখনো জানা হয়নি। রাতে বিছানায় শুয়েই কাথা দিয়ে আপাদমস্তক ঢেকে দিতাম। যেন কাথার  ঢুকলেই জয়নাবের মার গল্পের সেই ব্রহ্ম দৈত্য আমাকে কিছু করতে পারবেনা। মশারীর ভেতর থেকে হারিকেনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। টিমটিমে আলো। টিনের দেয়ালে অনেক কিছুর ছায়া পরে যেত। অবাক হয়ে দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পরতাম। মাঝে মাঝে শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙ্গে যেত। চুপ করে কাথার নিচে শুয়ে টিনের চালে শিশির পরার মৃদু আওয়াজ শুনতাম। আমি যে জেগে আছি সেটা কাউকে বুঝতে না দেয়ার একটা চেষ্টা থাকতো সবসময়। মাঝে মাঝে আমার চাচা, ফুফুরাও ওই সময় গ্রামের বাড়িতে চলে আসতেন। তখন তো আরো পোয়াবারো। ! সব ভাইবোন মিলে বিভিন্ন খেলাধুলা, কিছু খুনসুটি, মন কষাকষি চলতো দিনভর। যদিও গ্রামের স্বাভাবিক নীরবতায় এই হাসি ঠাট্টা , আনন্দ ফূর্তি আমার কাছে সেই অল্প বয়সেই কেন জানি একটু খাপছাড়া লাগতো। কিছু সময় যাওয়ার পরই আমি ওদের থেকে একটু আলাদা হয়ে যেতাম। আমার কাছে গ্রাম মানে হলো এক প্রশান্ত নীরবতা। মাঝে মাঝে সেই নীরবতা ভাঙ্গবে নিশাচর পাখির ডাকে, বাশবাগানে ঘাপটি মেরে থাকা শেয়ালের ডাকে কিংবা শেষ রাতে টিনের চালে পরা মৃদু শিশিরের শব্দে। অন্য কিছু সেখানে বেমানন। অদ্ভুত মায়াময় একটা জীবন ছিল সেটা!

দাদু মারা গেছেন ২০১০ সালে। শেষ  দাদুবাড়িতে গিয়েছিলাম দুই বছর আগে.. অনেক কিছুই নাকি বদলে গেছে এখন.. এখন নাকি লোডশেডিং খুব কম হয়.. আর কারেন্ট গেলেও নাকি চার্জার আর আইপিএস জলে উঠে.. হারিকেন আর কুপিবাতির ব্যবহার কমে গেছে। সেই ধানকাটা মৌসুম, খেড়ের  পাল্লা, জাল দিয়ে মাছ ধরা, হারিকেনের আলো, রোবোকপ , প্রথম কেমন কেমন অনুভূতির নায়িকা মিভ, এরকম অনেক কিছুর কথা মনে পরে গেল ব্লগার তারেক অণু র তোলা কিছু গ্রামের ছবি দেখে। ছবি গুলো দেখা শেষ করেই ঘোরের মাঝে থেকেই লেখা শুরু করলাম। কি লিখছি নিজেও জানিনা। কোনো প্ল্যান ছাড়াই লিখে ফেললাম এতোদূর। দিদামনি এখনো বেচে আছেন। দেশে ফিরে দাদুবাড়িতে একটা ভালো রকমের ফ্যামিলি জমায়েতের ব্যবস্থা করা লাগবে। ভাবছি পারলে, কিছু বন্ধুদের নিয়েও গ্রাম দেখিয়ে আনবো। ইচ্ছে আছে , জীবনের যেকোনো একটা পর্যায়ে গিয়ে গ্রামে সেটেল্ড হওয়ার। হতে পারে সেটা জীবনের পড়ন্ত বেলায় অথবা অন্য কোন সময়ে। প্রিয় সিনেমা Into the Wild এর ভূত আমার মাথায় খুব ভালো করে চেপে আছে এখনো। মাঝে মাঝে মুভির নায়কের মতো করে বলতে ইচ্ছে হয়,‘But you are wrong if you think that the joy of life comes principally from human relationship. God’s placed it all around us. It’s in everything. It’s in anything we can experience. People just need to change the way they look at those things.’  এই সবকিছুকে বুঝতে হলে নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতা দরকার। তাই গ্রামে যাওয়া আমার জন্য খুব জরুরী। তাছাড়া নিজের শিকড় এর সাথে সময় কাটানোর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারেনা। মাঝে মাঝে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি,এটলিস্ট আর যাই করি, নিজের শিকড় কে কখনো ভুলে যাবোনা। আমার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্ষ্যাত হলো সেই ব্যক্তি যে নিজের শিকড় এর কথা বলতে লজ্জা পায়..

১,৭৫৭ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “আয় ফিরে তোর প্রাণের বারান্দায়”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    আসলেই.........

    পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্ষ্যাত হলো সেই ব্যক্তি যে নিজের শিকড় এর কথা বলতে লজ্জা পায়..

    লেখা ভাল হইছে খুব।
    গ্রামে গেলে আমারে নিয়া যাইস। 😀


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. সৌরভ(০৬-১২)

    আমি ঘাটে বসে বসে আঙ্গুলের নখ দাত দিয়ে কামড়ে কামড়ে কাটতাম আর মাছ আর জালের এই আত্মিক সম্পর্কের স্বরূপ উদঘাটনের চেষ্টা চালাতাম

    :clap:


    মুক্তি হোক আলোয় আলোয়...

    জবাব দিন
  3. রেজা শাওন (০১-০৭)

    নাফিস

    তোমার আমার একই গল্প। জেলা এক থাকবে, থানা বদলে যাবে আর দাদুবাড়ি'র জায়গায় 'নানাবাড়ি' বসবে। গারো পাহাড়ের কোলঘেঁষা এই গ্রামগুলো যে কী অনন্য মায়া বুকে নিয়ে আছে- সেটা এখানে না গেলে টের পাওয়া যাবে না।

    আমার শৈশবকে আমার হিংসা হয়।

    জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    পেশার সুবাদে কয়জনের নিজের গ্রামের বাড়ি থাকার সৌভাগ্য হয়েছে জানি না তবে আমি বলবো আমি সৌভাগ্যবান। পাশ করার পর প্রথম ৬ মাস পিউপিলেজ (ল'এর ইন্টার্নশীপ) করতে এরপরে ২০১১ আর মার্চ থেকে আরো একবছর। নানাবাড়ি মেঘনার পাড়ে (মানে আক্ষরিক অর্থে পাড় পর্যন্ত সীমানা। ভৈরব-আশুগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংযোগ সেতু মাঝামাঝি এলে বামে তাকালে বিদঘুটে সবুজ রঙের বাড়িটি দেখা যায়।) এদিকে দাদাবাড়ির সামনে বিল।

    পুরো দেড়টি বছর ভোর ৬টায় উঠে মেঘনার পাড়ে সকাল দেখার সুযোগ পেয়েছি। আপাদত আর কিছু না চাইলেও চলবে! 🙂

    লেখাটা পড়ে অনেকক্ষণ নিজস্ব থ্রিডি জগতে ঘুরে বেড়ালাম! 🙂 (সম্পাদিত) (সম্পাদিত)


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    নানাবাড়িতে একবার হাসনাহেনা গাছের পাশে পড়ে থাকা ইট উল্টে সাপ দেখ্তে পেয়েছিলাম।
    এখনো চোখের সামনে কুন্ডলি পাকিয়ে থাকা সাপ দেখ্তে পাচ্ছি যেনো


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সামিউল(২০০৪-১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।