আর্টেমিসিয়া ভালগারিস

সোহরাওয়ার্দী হাউসের পোর্চ এ বসে আছি। একটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। ভ্যাপসা একটা গরম পরেছিলো। এই গরমের সময়  প্রেপ টাইমে অবস্থা ভয়ানক রকমের খারাপ হয়ে যায়। টাইয়ের নট লুজ করে বসলেও ঝামেলা ! স্যার এসে বারবার ডিস্টার্ব করে। ফ্যানের গরম বাতাস শরীর ও মনের উষ্ণতা আরো বাড়িয়ে দেয়। প্রেপ থেকে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়েছি। কালিয়াকৈরের ডিশ অপারেটর এর ওখানে কি একটা ঝামেলা হয়েছে নাকি শুনলাম। কোনো মিউজিক চ্যানেল নেই। বলিউডি নায়িকা দের গরম নাচ গান দেখা হবে না , তাই কেউ ই মনে হয় আজ টিভি রুমের দিকে পা বাড়ায়নি। ফাকা টিভি রুম দেখে হাউজ মাস্টার ইসরাইল হক স্যার তো অবাক ! গরমে ক্যাডেট রা ধরাশয়ী এই চিন্তা করে স্যার নিশ্চিন্ত মনে আজ রাউন্ড না দিয়েই তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেছেন । বৃষ্টিটা  টা খুব  দরকার ছিল। সোদা মাটির একটা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। গন্ধটা বেশ ভালো লাগে আমার। কেন জানি এই গন্ধটার মাঝে সতেজ একটা আমেজ খুঁজে পাই।শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ভ্যাপসা গরম টা আর নেই। বারবার শপের পিছনের কোনো একটা গাছে বোধহয় একটা নিশাচর পাখি বসে আছে। অনেক ক্ষণ ধরে অদ্ভুত একটা আওয়াজ  পাচ্ছি। পাখিটা একটানা ডেকেই চলছে। এনডিএম  বোধহয় এই সুন্দর ঘুম অনুকূল পরিবেশে এতক্ষণে ঘুমিয়ে পরেছে।

জাফরি হিটারে পানি গরম করছে। কফি বানাবে। নেসক্যাফে। সাথে গুড়ো দুধ আর চিনি। গুড়ো দুধের ব্র্যান্ড টা খেয়াল করিনি । দেখা দরকার। হাতের মাঝে গুড়ো দুধ আর চিনি মিশিয়ে চেটে চেটে খেতে বেশ লাগে। সানির কাছে এই আইডিয়া টা পেয়েছি। যাই হোক, এই মুহুর্তে জাফরির গুড়ো দুধের দিকে  হাত বাড়ানোর সাহস হলোনা। আমি কফি র আশায়ই  বসে আছি। হাতে একটা জলন্ত সিগারেট। সিগারেট টা ঘুরছে একটা চক্রে। আমি, ইসতিয়াক আর মাহমুদ। ইসতিয়াক, মাহমুদ , আমি। বেনসন এন্ড হেজেস।ফজলুল হক হাউজের সাজিদের কাছ থেকে কিনে আনা। আমার রুমে কোন স্যার চেক করেন না । তাই , আমার রুমেই রাখা ছিল প্যাকেট গুলো। একটু আগে নিয়ে আসলাম পোর্চ এ। জোবায়ের মৃদু স্বরে সালমান খানের মুভির  লেটেস্ট হিন্দি গান টা গাচ্ছে। বেসুরো গলা, লিরিকের আগামাথা কিচ্ছু ঠিক নেই। তবুও ও গাচ্ছে তো গাচ্ছেই। তারিক এর সাথে নেক্সট এল ক্লাসিকো  টা নিয়ে একটা গরম তর্ক চলছে। বাচা মরার লড়াই। এই ম্যাচ না জিতলে রিয়াল মাদ্রিদের সিজন টাই বরবাদ হয়ে যাবে। রাফি ওর ক্যামেরা টা দিয়ে এই অন্ধকারের মাঝেও কিছু বিমূর্ত ছবি তোলার চেষ্টা করছে। নিজেদের দিকে ক্যামেরা তাক করা থাকলে কেমন জানি অসস্তি লাগে। আমার ছবি আবার সবসময় ভয়ানক রকমের বাজে আসে । তবে ওর মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এই মুহুর্তে কোনো ছবি ই ওর  মনমতো হচ্ছে না। আশা রাখা যায়  সব ছবি একটু পড়েই ও ডিলিট করে দিবে। হাসান আর রাশেদ কি নিয়ে জানি ফিসফিস করে আলাপ করছে।টপিক টা ধরতে পারছিনা। খুব সম্ভবত কোনো এক রমণীকে নিয়ে। কি জানি নাম মেয়েটার। মনে আসছে না। আচ্ছা, ধরে নিলাম মেয়েটার নাম আসমা। ওদের দুজনেরই পরিচিত। হাসান নাকি কাল রাতে ফোনে কথা বলার সময় কি জানি বেফাস একটা মন্তব্য করে ফেলেছে।রাশেদ মনে হয় এতে কিঞ্চিত নারাজ। ওদের কথাবার্তার ভলিউম আরো নিচে নামছে।

এদিকে জিসান বারবার বিরক্ত হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। সিগারেটের ধোয়া টা যে ওর পছন্দ হচ্ছে না , তা বেশ বুঝতে পারছি।জিসান বেশ কয়েকদিন ধরে নামাজ পড়ার জন্য প্রেয়ার রুমে ডাকছে। প্রতিবারই কোনো না কোন অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছিনা। প্রেয়ার রুম এখন বন্ধ। সুতরাং এখন যে ও আমাকে নামাজ পড়ার জন্য ডাকবে না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। তাই, আপাতত গিল্টি ফিল না করে ওর দিকে তাকিয়ে একটা শয়তানী হাসি দিলাম। নাসিফ উশখুস করছে। ওর আজ রাতের মাঝে মেকানিক্সের চ্যাপ্টার টা শেষ করার কথা ছিল। অংক গুলো ফেলে রাখতে ওর ভালো লাগছেনা। ঢাকা বোর্ডে গতবছর বলবিদ্যায় শুধু থিউরি যারা পড়েছিল তারা বেশ বড় রকমের ধরা খেয়েছে। অংকের অপশনে অংক ছিল। ও কোনো ঝুকি নিতে চায় না ।তবে , আড্ডাটা ছেড়ে উঠতেও  বোধহয় ওর  মন চাচ্ছেনা। তাই একটু মুখ ব্যাজার করে বসে আছে ও।শাদমান আবার ফিসফিস করে আলাপ করছে। মুঠোফোনে। ওপাশে  মেয়ে বন্ধু। মেয়েটি আমাদেরই  সমগোত্রীয়। একটা গার্লস ক্যাডেট কলেজের। দুই ব্যাচ জুনিয়র। এসএসসি দিয়ে ছুটিতে গেছে বাসায়। ননস্টপ কথা চলছে। রঙিন দুনিয়া ওর এখন। লাল, নীল , গোলাপী দুনিয়া। জোত্স্না টা  লুকোচুরি খেলছে। বারবার মেঘের কোণে লুকাচ্ছে এবং একটু পরেই বের হয়ে আসছে। হাইড এন্ড সিক ! ছোটবেলায় খেলতাম অনেক। এখন খেলি না আর, শুধু দেখি। চারপাশের সবাই হাইড এন্ড সিক খেলে। চারপাশের মানুষগুলো , প্রকৃতি,পশুপাখি সবাই হাইড এন্ড সিক খেলে।  একটা স্পীড এনার্জি ড্রিঙ্কস কিনে রেখেছি ক্যান্টিন থেকে । তাওসিফের কাল বার্থডে  । ওকে গিফট করবো। ও আবার এনার্জি ড্রিংক এর খুব বড় ভক্ত! যেকোনো মুহুর্তে নজরুল হাউজ  থেকে তৌহিদ, সোহান, মুয়াম্মার, হাবিব  আর ফজলুল হক হাউজ  থেকে মোজাম্মেল, রাইয়ান, তামজিদ, খালেদ,ফেরদৌস  রা চলে আসবে। আজ চ্যাম্পিয়নস লীগের সেমি ফাইনাল। ভাগ্যিস , স্পোর্টস চ্যানেল গুলো আছে। হাউজ বেয়ারা ভালো। তাই,আজ রাতে আমাদের হাউজেই খেলা দেখা হবে ।শেডের দিকে নজর রাখছি তাই । জুনায়েদ কে ডাকা দরকার।  ছেলেটা তাহসানের গলা নকল করতে পারে।  এখন এই পরিবেশে একটা গান হলে খারাপ হয় না। জোবায়েরের বেসুরো গান থেমে গেছে অনেক আগেই।কিন্তু  আলসেমি লাগছে। উঠতে ইচ্ছে করছে না। সানি কে বললাম জুনায়েদ কে ডেকে আনতে। কিন্তু ও এখন এত দূর হেটে নিচের বক্স রুমে  যেতে রাজি নয়। কোনো জুনিয়র ও নেই। সবাই গভীর ঘুমে। কি আর করা ! বসেই রইলাম।

সিগারেট জলছে, ঘড়ির কাটা ডান থেকে বামে ঘুরছে। মেঘ কেটে যাচ্ছে। দূরের তারা গুলো এখন পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। কে জানি একবার বলেছিল যে, যে তারা গুলো রাতের আকাশে দেখি , তার অনেক গুলোই আসলে অনেক বছর আগেই মারা গেছে।এখন ওখানে ওগুলো নেই! কি আশ্চর্যের কথা ! একটা জিনিস নেই, তবুও আমরা ওটাকে দেখেই চলছি। নিরন্তর! বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেছে । বারবার শপের পিছনের পাখিটা আর ডাকছে না। ক্লান্ত হয়ে গেছে মনে হয়। দূরের ঢাকা -টাঙ্গাইল হাইওয়ের বাসগুলোর  হর্নের শব্দ কানে আসছে। চারদিকে শুধু ভালো লাগা। ঘড়ির ব্যাটারি টা খুলে ফেললাম। সময় টাকে থামিয়ে দেওয়া দরকার। আচ্ছা পৃথিবীর সব ঘড়ি একসাথে বন্ধ হয়ে গেলে কি সময় থেমে যাবে? কি জানি? ছেলে মানুষী প্রশ্ন। টিপু কে জিজ্ঞাসা করলাম। ভালো রকম একটা ঝারি মারলো। আমাকে আতলামি বন্ধ করতে বললো ও । উপদেশ অগ্রাহ্য করলাম, কারন আমার কানে কোনো কথা ঢুকছে না।আমি এখন অনেক ব্যস্ত। তারা দেখছি, মাটির গন্ধ শুকছি, নিশাচর পাখির ডাক শুনছি, চাদের লুকোচুরি খেলা দেখছি, বাসের হর্নের আওয়াজ শুনছি,কফি খাচ্ছি, বেসুরো হিন্দি গান শুনছি,কান পেতে প্রেমিক বন্ধুর ফোনালাপ শুনছি । আমি এখন  অনেক ব্যস্ত।

 

(অনেক দিন ধরে ভালো কোনো স্বপ্ন দেখা হয় না । এরকম একটা স্বপ্ন দেখতে পেলে মন্দ হত না )

 

#আর্টেমিসিয়া ভালগারিস হলো একধরণের গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। যা অনেক জায়গায় মুগোয়ার্ট নাম পরিচিত। এর পরিমিত ব্যবহার  মানুষ এর  স্বপ্নকে অনেক রঙিন ও প্রাণবন্ত করে তোলে। যদিও থুজন নামক এক জাতীয় বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ থাকায়  চিকিত্সক রা সবসময়ই এটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সবাইকে নিরুত্সাহিত থাকেন।

২,৫৪৪ বার দেখা হয়েছে

২৯ টি মন্তব্য : “আর্টেমিসিয়া ভালগারিস”

  1. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    জটিল হইসে। ভালগারিস না দেখে আমি প্রথম ভ্যাজাইনালিস দেখলাম, চোখে সমস্যা না মনে সমস্যা কে জানে


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শাহরিয়ার (২০০৬-২০১২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।