ডাল সমাচার

ঘটনা ১ :  ডিনার এ গেলাম ডাইনিং এ। দুপুরে ইউএস গভর্নমেন্ট এক্সাম ছিল।  পরীক্ষা থাকলে যা হয় আরকি ! পেটের ভেতর অদ্ভুত কিছু আওয়াজ হচ্ছিল। খাওয়া দাওয়ার রুচি কমে গিয়েছিল ভয় এর চোটে! তাই  পরীক্ষার এই সীমাহীন টেনশনে লাঞ্চ ই করা হয় নাই ! সো ডিনারের সময় বিশাল ক্ষুধার্ত অবস্থায় টেবিল আসলাম। টেবিলে বসে দেখি একটা স্পেশাল টাইপের সুপ সার্ভ করা। আমার স্কোয়াড লিডার আমাকে বললো ওটা টেস্ট করতে। তার ভাষ্যমতে জিনিসটা খুব ডেলিসিয়াস এবং সুপার টেস্টি। ভালো কথা , আমি মুখে দিলাম এবং  সাথে সাথে বলে উঠলাম , ” আরে! এ দেখি আমাদের মুগের ডাল ! ” উনি আমাকে বলেন ” হোয়াট ডিড ইউ সে?” আমি মাথা নেড়ে ভোজনরসিক ব্যক্তির মত বলি , ” ভেরি টেস্টি ! আই হ্যাভ নেভার টেকেন দিস টাইপ অফ সুপ ইন মাই লাইফ !  স্কোয়াড লিডার  তো অবাক। বিখ্যাত লেন্টিল স্যুপ আমি কখনো খাই নাই ! কি অবাক করা বিষয় ! উনি আমার জন্য আরো স্যুপ তথা ডাইল পাঠালেন। আমি ধন্যবাদ দিয়ে মনের আনন্দে চুক চুক করে ডাইল খেতে থাকলাম। পরে অনলাইনে মেন্যু চেক করলাম। দেখি মেন্যুতে খুব সুন্দর করে বোল্ড করে লেখা মেরিল্যান্ড লেন্টিল স্যুপ। ইচ্ছে করতেছিল গিয়ে বলি ,” ওহে ! কে কোথায় আছিস? কেউ একজন মেন্যু টা মোডিফাই কর ! লেন্টিল স্যুপের জায়গায় মুগের ডাইল লিখে দে!”

 

ঘটনা ২ : সামারের টাইমে একাডেমীর ডাইনিং এ সবসময় বুফে স্টাইলে খাবার দেওয়া হয়। মানে যার যার যা ইচ্ছা নিয়ে নিয়ে খাও। সেখানে রাইস জাতীয় কিছু থাকলে আমি কোনো চিন্তা না করে সেটাই নিয়ে নেই সবসময়। হাজার হোক বাঙালি তো ! তবে একাডেমীতে রাইস খুব কমই দেওয়া হয়। তো আজ লাঞ্চে গিয়ে প্রথমেই দেখি একটা রেয়ার ঘটনা ! রাইস পিলাফ আছে সার্ভারি তে। নিয়ে নিলাম কোনো চিন্তা না করে । কিন্তু আশেপাশে আর যা আছে তার কোনো কিছুই ভাত দিয়ে খাওয়ার মতো না। চিন্তায় পরে গেলাম। পাশে স্যুপ স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি লেন্টিল স্যুপ। এইবার পেলাম আসল জিনিস ! নাম এটার লেন্টিল স্যুপ , কিন্তু এইটা যে আসলে আমাদের ডাল , তা আমি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ভালো মতোই জানি ! নিয়ে নিলাম এক বাটি লেন্টিল স্যুপ তথা ডাইল!

টেবিলে গিয়ে এক্কেবারে কঠিন একটা ডালভাত খাওয়া দিলাম ! খাওয়ার সময় কিছু খেয়াল থাকে নাকি ? খাচ্ছি তো খাচ্ছি ! তবুও ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল সামথিং ইস রং! খেয়াল করে দেখলাম যে টেবিলের বাকি ১০ জন আমার দিকে কিছুক্ষণ পর পর  চোরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে । শুধু তাই না, মাঝে মাঝে তাদের মুখ অবাক বিস্ময়ে হা ও হয়ে যাচ্ছে । বুঝতে পারলাম যে এরা হয়তো এদের এ ক্ষুদ্র জীবনে কাউকে রাইস পিলাফ আর লেন্টিল স্যুপ মিশাইয়া  খাইতে দেখে নাই। ঐ মুহূর্তে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি একটু গিজগিজ করতেছিল, তাই আমিও তাদের সাথে খেলাধূলা শুরু করে দিলাম। এরা যতবার আমার দিকে তাকায়, আমি ততবারই এক চামচ করে লেন্টিল স্যুপ নিয়ে ভাতের সাথে মাখায়ে মুখে পুড়ি আর ভোজনরসিক এর মতো ডানে বামে মাথা নাড়ি ! টেবিলের সবাই মোটামুটি কনফিউজড। কিছুক্ষণ পর আসল চাল দিলাম। বললাম,” ডুড, ইউ ওয়ান্ট টু ট্রাই?” তারা আরো কনফিউজড। তারা আমাকে যা বললো তার সারমর্ম হলো তারা এর আগে কখনো কাউকে এভাবে রাইসের সাথে সুপ মিশিয়ে খেতে দেখে নাই। তাই ব্যাপার টা তাদের কাছে খুবই অদ্ভূত লেগেছে। ভালো কথা ! আমি খাই, তারা বড় বড় চোখ করে দেখে। তাদের অবাক হওয়ার মাত্রা আরও বেড়ে গেল যখন তারা দেখল আমি ঐ ডাল-ভাতের সাথে সল্ট-পেপার আর সালাদের পেয়াজ মাখানো শুরু করলাম। বুঝতে পারলাম যে এটাই মোক্ষম সময় ! একটা গলা খাকারি দিয়ে তখন আমি তাদের ডাল  ও তার উত্পত্তি ও পুষ্টিগুণ বিষয়ে একটা ছোটখাট বক্তৃতা দিয়ে দেওয়া শুরু করলাম। সেই সাথে ভাতের সাথে ডালের জুটি কেন ডি ক্যাপ্রিও ও কেট উইন্সলেট জুটির চেয়েও  বেশি রোমান্টিক ও আবেদনময়ী সে বিষয়েও হাল্কা বিশ্লেষণ ধর্মী আলোচনা করলাম। একটা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেসেন্টেসন  করতে পারলে আরও ভাল হত মনে হয় । বেশ কয়েকজন কে বেশ কনভিন্সড মনে হলো। তারা বিজ্ঞ এর মত ডানে বামে , উপরে নিচে মাথা দুলাতে লাগলো। এর মাঝে তিন জন প্লেট নিয়ে উঠে গেল। কিছুক্ষণ পরে এরা রাইস আর লেন্টিল স্যুপ নিয়ে ফিরে এল  । প্রমাদ গুনলাম ! যা ভাবছিলাম তাই হলো দেখা যায় ! তারা ভাত আর লেন্টিল স্যুপ মিশিয়ে খাওয়া শুরু করলো!   তাদের ডানে বামে , উপরে নিচে মাথা দুলানো কন্টিনিউ করা দেখে বুঝতে পারলাম খানা তাদের ব্যাপক পছন্দ হইছে। কথা না বাড়াইয়া টেবিল থেকে উঠে জোরে হাটা দিলাম।পিছনে ফিরে আর তাকালাম না ! থাক,অনেক হইছে , একদিনে বেশি বিনোদন নেওয়া ভালো না।

বিষয়টাকে  একটা ইতিবাচক অর্জন হিসেবে দেখছি। ভবিষ্যতে কেউ যদি কোনদিন বলে,” এই ছোকরা ! আম্রিকা গিয়া কি করছো?” তখন খুব ভালো একটা উত্তর দিতে পারবো,” ইয়ে মানে .. ওদের ধইরা ডাইল- ভাত খাওয়াইছি।”

 

দাত থাকতে মানুষ নাকি দাতের মর্যাদা বুঝে না ! অতীব সত্যি একটা কথা। দেশে ১৯/২০  বছর ডাল খেয়ে খেয়ে কখনো কিছু মনে হয় নাই । বিদেশ বিভূয়ে জীবন শুরু করার পর ই প্রথম ডালের মর্ম হারে হারে টের পাওয়া শুরু  করলাম । ডাল ভাত ছাড়া জীবন বড়ই ম্যারমেরে লাগা শুরু করলো। দেখতে দেখতে ১ বছর পার হয়ে গেল। ইদানিং অনুভূতি গুলো ভোতা হয়ে গেছে , তাই মনে হয় ধাতস্থ হয়ে গেছি অনেকটা। আর কিছু মনে হয় না । তবুও ডাল তুমি ডাল ! তোমাকে সংগ্রামী লাল সালাম …

২,৪৮৪ বার দেখা হয়েছে

৩৭ টি মন্তব্য : “ডাল সমাচার”

  1. শাহরিয়ার (০৬-১২)
    ” এই ছোকরা ! আম্রিকা গিয়া কি করছো?” তখন খুব ভালো একটা উত্তর দিতে পারবো,” ইয়ে মানে .. ওদের ধইরা ডাইল- ভাত খাওয়াইছি।”


    • জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব - শিখা (মুসলিম সাহিত্য সমাজ) •

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    কলেজ থেকে কি এক অভ্যাস বানায় দিলো, একহ্ন ডাইল ছাড়া কোন বেলায় কেতেই পারি না 😛

    লেখায় মজা পাইছি, চালায় যাও :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    আমি বড় ডাইলের বাটি মুখের সাথে লাগাইয়া চো,চো কইরা শ্যাষ করতাম।
    এই বিষয়ে রেকর্ডের কথা ভাবা উচিত ছিলো।
    আমি মনে হয় তিনটা খাইছিলাম।
    :party:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফারহান(মকক/২০০৪-২০১০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।