আম

খাবার টেবিলে আমার বউ আমাকে প্রশ্ন করল, “তুমি আম চেনো?”
প্রশ্নটা শুনে যথেষ্ট বিরক্ত হলাম। আমি বাঙালী ছেলে। বাঙালী হয়ে আম চিনব না, তা হয় নাকি? কন্ঠে যথেষ্ট বিরক্তি ঢেলে উত্তর দিলাম, “আম না চেনার কি আছে?”
“না, মানে কোনটা কি আম, সেটা চিনতে পার?”

একটু চিন্তা করলাম।এবার প্রশ্নটা যুতসই হয়েছে। আমিও চামে কেটে বের হবার চেষ্টা করলাম, “কিছুদিন পর বাজারে গেলেই দেখবে বড় বড় সাইজের আম উঠেছে। ওগুলো হল ফজলি আম। আর …”

“ফজলি আম আমি চিনি।” ঠান্ডা গলায় বলল সে। “আর কোন জাতের আম চেন? আমার হাতে এইটা কি আম?”

বছরের এই সময়টায় হিমসাগর আর গোপালভোগ আম-ই বাজারে সবচেয়ে বেশি উঠে। গোপালভোগ নামটা শুনলেই আমার কেন যেন গোলগাল ধরনের আমের চেহারা ভেসে উঠে। আমি বললাম, “গোপালভোগ।”
“হয় নাই। হিমসাগর।”
“তুমি কিভাবে জান যে এটা হিমসাগর?”
“আমার কথা না হয় বিশ্বাস কর না, আব্বার কথা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবা?”

আমি আড়চোখে একবার শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকালাম। আমের ব্যাপারে উনার কথা বিশ্বাস না করার প্রশ্নই উঠে না। এ ব্যাপারে উনি পরিচিত মহলে একজন বিশেষজ্ঞ। উনি আম নিয়ে আসছেন আর সেটা খারাপ হয়েছে, এমনটা কখনো হয়নি।

মেয়ের কথায় সায় দিয়ে উনি অল্প একটু মাথা নাড়লেন – হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে।

বউ এবার বলল, “তোমার একটা এসাইনমেন্ট আছে। আজকে আব্বা তোমাকে আম চেনাবে আর কাল অফিস থেকে ফেরার সময় তুমি গোপালভোগ আম নিয়ে আসবে। ঠিক আছে?”

অনিচ্ছা সত্বেও আমি মাথা ঝাঁকাই। বাজার-সদাই করা কোনোকালেই আমার ভাল লাগে না।
খাবার পর ট্রেনিং শুরু হল। বাসায় তিন জাতের আম ছিল। হিমসাগর, গোপালভোগ আর ল্যাংড়া। আধা ঘন্টা পর যখন ট্রেনিং শেষ হল তখন আমার আত্ববিশ্বাস আকাশছোঁয়া। অন্ততঃ এই তিন জাতের আম কিনতে আমার কখনো ভুল হবে না।

পরদিন অফিস শেষ করে গুলশান-২ গোলচত্বরে এসে আমের খোঁজে নামলাম। বাসস্ট্যান্ডের একটু আগে কয়েকটা ভ্যানগাড়িতে আম বিক্রি করছে। তার একটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদারদের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। কিভাবে যেন আনাড়ী কাস্টমার চিনে ফেলে। আমাকে দেখেই ভ্যান ওয়ালা বিপুল উৎসাহ নিয়ে বলল, “মামা আম নিবেন? কোনটা নিবেন? হিমসাগর না ল্যংড়া?” তারপর হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, “এই যে মামা, সবচেয়ে ভালো হিমসাগর এইদিকে। আর এইগুলা হইল গোপালভোগ। এক্কেরে ফাসক্লাস।”

আমি ভ্যানের উপর তাকালাম। ট্রেনিং সেশনের কথা মনে করার চেষ্টা করলাম – ‘হিমসাগর একটু গোলগাল। দেখতে বাংলা পাঁচের মত। গোপালভোগ একটু লম্বাটে। ল্যাংড়াও লম্বাটে, তবে গায়ে সাদা সাদা ফুটকি আছে। আর গন্ধটা একটু ঝাঁঝালো।’

গোলগাল না হয় একটু আলাদা করা যায়, কিন্তু সব আম-ই তো দেখতে বাংলা পাঁচের মত! কিছু একেবারে ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের ফার্স্টক্লাস হাতের লেখার মত, আর কিছু আমার মত কাকের ঠ্যাং-বকের ঠ্যাং টাইপ হাতের লেখার মত। কি যে করি?

মাথায় একটা চিন্তা আসল। একটু সামনে গেলেই বাজার। ওখানে নিশ্চয়ই ভাল আম পাওয়া যাবে। দোকানদারও আশা করি ঠকাবে না।

বাজারে গিয়ে ফলের দোকানের সামনে দাঁড়াতেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। এখানে দেখি হাজার রকম আম! সবই বাংলা পাঁচ।

যাক, দোকানে যখন আসছি তখন দাম জিজ্ঞেস করে যাই।

“মামা, গোপালভোগ কত?”
“একদাম একশ বিশ।”
গতকালই শ্বশুর মশাই আশি টাকা দিয়ে কিনছে।
“মামা, আশি টাকা দিবেন?”
“একদাম। এক টাকাও কম দিতে পারমু না।”

না পারলেই ভালো। আমি দোকান থেকে সরে আসি। মনে মনে একটা বুদ্ধি করি। প্রথম ভ্যানওয়ালার কাছে আর যাওয়া যাবে না। ওই ব্যাটার ভাবভঙ্গি খুব একটা ভাল লাগে নাই। ওই ব্যাটা নিশ্চিত ঠকানোর চেষ্টা করবে। ওই ভ্যান এর পর আরো দুইটা ভ্যান আছে। আমি শেষটাকে টার্গেট করি।

ভ্যানের সামনে গিয়ে খুব ভাব নিয়ে বলি, “গোপালভোগ কত?”
ভ্যানওয়ালা একবার আমার উপর চোখ বুলিয়ে বলল, “একশ বিশ।”
“ভাল হবে তো?”
“মামা, আমার সব আমই চিনির মত মিষ্টি। টেস্ করবেন?”

নাহ্, মানুষকে আমি সহজে অবিশ্বাস করতে পারি না। বললাম, “থাক। আপনি ভাল দেখে বেছে চার কেজি দেন। তবে দাম একটু কম রাখতে হবে।”
সে চার কেজি আম দিল। অনেক দরাদরির পর একশ টাকা করে দিতে রাজি হল। গুনে গুনে চারশ টাকা দিয়ে চার কেজি আম কিনে আমি বাসায় ফিরলাম।

গোসল করে খেতে বসার পর ও জিজ্ঞএস করল, “এটা কি আম আনছ?”
“কেন, গোপালভোগ।”
“এটাকে গোপালভোগ বলে?”
আমি শ্বশুরের দিকে চেয়ে বললাম, “বাবা, এগুলা গোপালভোগ না?”
“না।”
“তাহলে এগুলা কি আম?”
উনি আরেকবার ভালমত আমগুলা দেখে বল্লেন, “ঠিক চিনতে পারছি না।”

সর্বনাশ, আমার শ্বশুর মশাই পর্যন্ত এই আম চিনতে পারছে না! আল্লাহ্ জানে কি যে নিয়া আসছি। ভরসা একটাই, আম যদি খেতে ভাল হয, তাহলে মান-সম্মান থাকে।

খাওয়ার পর সবার প্লেটে আম দেয়া হল। দেখতে ভালই, গন্ধটাও ভাল। এক টুকরা মুখে দিলাম। আর সাথে সাথে টেনিদার ‘পেশোয়ার-কি-আমীর’ গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। কাঁচা আম টক হয় জানি, কিন্তু পাকা আম যে এত টক হয় আমার জানা ছিল না। দাঁতে প্রচন্ড শিরশিরে একটা অনুভূতি হল আর তার ঠিক পরেই মাথাটা ঝাঁ করে উঠল। আধমিনিট মনে হয় আমার কোন হুঁশ ছিল না। যখন একটু ধাতস্থ হলাম, তাকিয়ে দেখি সবার একই অবস্থা।

বউ তার প্লেট আমার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, “এগুলা সব তুমি খাবা।”

মাথা খারাপ!ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়?

শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন, “কত করে নিছে?”
“একশ টাকা কেজি।”
“কয় কেজি আনছ?”
“চার কেজি।”

উনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, “চিনতে না পারলে প্রথমে অল্প করে কিনতে হয়।”

আমি প্লেটগুলোর দিকে তাকাই। একটুকরার এক কামড়ের বেশি কেউ খায়নি, খাওয়া সম্ভবও না। আর এর সবগুলা খেতে হবে আমাকে? অসম্ভব।

আমি হাত ধুতে চলে যাই। ভাল করেই জানি, আমগুলার একটা না একটা গতি ঠিকই হবে। মেয়েরা আবার যে কোন জিনিসের গতি করার বিষয়ে ভালো ওস্তাদ।

১,৫৭০ বার দেখা হয়েছে

১০ টি মন্তব্য : “আম”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    মজা পাইলাম ভাই...

    আমিও কোন আমই চিনিনা। আব্বু আম্মু চিনে, আমারে যে যেটা বুঝায় আমই তাই বুঝি এই বিষয়ে।
    নিজে তাই কোন দিনই আম কিনতে যাই না।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লাগলো মুস্তাকিম ভাই :)) আমার নিজের এধরনের অভিজ্ঞতা হউএছিল একবার পেয়াজ কিনতে যেয়ে, যাবার আগে অবশ্য দেশি, ইন্ডিয়ান, বার্মিজ, নতুন, পুরাতন সব ধরনের পেয়াজ সম্পর্কে ব্যাপক বিশ্লেষনি তথ্য পেয়েছিলাম কিন্তু কিনতে গিয়ে কিছুই আর কাজে লাগছিল না। শেষে যা আছে কপালে ভেবে কিনে ফেললাম, বাসায় ফিরে সেটা ব্যাপক হিট। ভাগ্যগুনে কেনাকাটায় সুনামও হয়ে গেল, সেই সুনাম ধরে রাখার জন্য এখন প্রায় সকল ধরনের কেনাকাটা সযতনে এড়িয়ে চলছি 😛


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    লন্ডনে ভালো আম পাওয়া যায়.
    দেশে থাকতে ছোট বেলায় আমের ঝাকা নিয়া আম খাইতে বসতাম.
    বিদেশি নয় আমার পছন্দ দেশি আম.
    নানা বাড়ির - টাঙ্গাইলের আম খুব ভালো.

    এখন অবশ্য কোন ফলই খাই না; ফলের রিজিক শেষ.


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুস্তাকিম (৯৪-০০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।