এই তো জীবন….

ক্যাডেটরা দুষ্টু হয়, ক্যাডেট কলেজে ঢুকার আগেই তা কানে এসেছিল। কলেজে পা ফেলার প্রথম দিন থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া শুরু করলাম । অভিভাবকদের নিয়ে ডাইনিং রূমে যাওয়ার সময় দেখলাম একটা ছাগল শ্যান্ডো গেনজি আর জাঙ্গিয়া পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতগুলা বাইরের লোকের সামনে যেন লজ্জা না পায়, এ কারনেই হয়তো কোন সিনিয়র ভাই এ ব্যাবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু পাশেই একটা গরুকে কেন এ ব্যাবস্থার আওতায় আনা হয়নি, তা তখন বুঝতে পারিনি। কিছুদিন পর বুঝতে পেরেছি। গরুর মাপমতো হবে, এরকম সাইজের গেনজি আর জাঙ্গিয়া পরার মতো কোন ভাইয়াকে ক্যাডেট লাইফে চোখে পরেনি।
দুষ্টামি প্রতিরোধ করার জন্য বিভিন্ন ধরণের শাস্তির ব্যবস্তাও অবশ্য ছিল। সেগুলো ক্যাডেটদের উপর নির্বিচারে প্রয়োগ করার পর অবশ্য টিচারগণ বলতেন , ”কলেজ থেকে বের হওয়ার পর বুঝতে পারবে কি হারিয়েছ। তোমাদের জীবনের সবচেয়ে সুখের সময় তোমরা এখন কাটাচ্ছ।” শুনে মনে মনে গালি দিতাম। জেলখানায় ঢুকিয়ে ইচ্ছামতো ডলা দিয়ে কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা!
কলেজ থেকে বের হয়ে ভর্তি হলাম ভার্সিটিতে। যেহেতু ঢাকার বাইরে, থাকার ব্যবস্থা নিজেদেরকেই করতে হবে। অনেক খোঁজাখুঁজি করে যে বাড়ি ঠিক করলাম সেটাকে বলা যায় ”এন্টহাউজ”। সকালে ক্লাসে গিয়ে বিকালে বাসায় ফিরে দেখতাম প্রত্যেকটা ঘরে পিঁপড়া মাটি তুলে রেখেছে। ওগুলো পরিস্কার করা ছিল রুটিন কাজ। হায়রে! কোথায় আমার তিনতলার ”ওমর ফারুক হাউজ”?
আরেকটা রুটিন কাজ ছিল। রাতেরবেলা পাউরুটি আর জেলী কিনে রাখা। না হলে পরদিন সকালে ক্লাস এ যেতে হবে না খেয়ে। শুধু তাই না, বাকি দুইবেলা খাবারের ব্যবস্থাও আমাদের নিজেদেরকই করতে হবে। হায়! কোথায় আমার ডাইনিং রুম? ঘন্টা বাজিয়ে খেতে ডাকলেও যখন হেলতে দুলতে যেতাম! খাওয়ানোর গুরুদায়িত্ব তখন ছিল ডিউটি মাস্টারের, ক্যাডটদের কি আর এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আছে? আর এখন সপ্তাহে শিডিউল অনুযায়ী যাও বাজারে. . . . . .
যাই হোক, দেহে একজন ক্যাডেটের রক্ত বইছে বলেই নতুন ব্যবস্থার সাথে দ্রুত মানিয়ে নিলাম।
আশ্চর্যজনকভাবে, ভার্সিটিতেও টিচাররা দেখলাম মোটামুটি একই কথা বলা শুরু করলেন-”ছাত্রজীবনটাই হচ্ছে সুখের সময়। যখন চাকরীজীবনে ঢুকবে, তখন বুঝতে পারবে, কি সময়টাই না কাটিয়ে এসেছ!” ব্যাটা বলে কি? প্রত্যেকদিন গাদাগাদা এসাইনমেন্ট আর দুইদিন পরপর ক্লাসটেস্ট দেয়া সুখের জীবনের লক্ষ্মণ?! কবে যে শালা ভার্সিটি লাইফ শেষ করে চাকরী করব আর নিজের ইচ্ছামত চলব!
একসময় সে ইচ্ছাও পূরন হয়। আর সাথে সাথে টিচারদের কথাও সত্য বলে মনে হয়। আগে ইচ্ছে হলেই কোন ক্লাস মিস দেয়া যেত। বৃষ্টি হচ্ছে, এমন আরামের সময়টা একটু ঘুমিয়ে নেই, একটা ক্লাস না করলে কি এমন আসে যায়? কিন্তু অফিস ফাঁকি? কোনভাবে এক দুই দিন না হয় দেয়া গেল, কিন্তু দিনের পর দিন তো আর এমন করা যায় না। ঈদেও আগে পরে এক দুই দিন ছুটি বেশি নিয়ে টানা কয়েকদিন ছুটি কাটাতে পারবো কিনা, তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আহা, কোথায় গেল আমার স্টুডেন্ট লাইফ?
এখন কলিগদেও মধ্যে যারা বিবাহিত তারা বলেন, ”ভাই, বিয়ের আগের লাইফটাই মজার। বিয়ে করলে বুঝতে পারবেন।” কথাটা উড়িয়ে দিতে গিয়ে টিচারদের কথা মনে পড়ল, যাদেও কথা একসময় পাত্তা দিতাম না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে যাদের কথা আজ সত্য বলে প্রমানিত! অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে। আর তাই কলিগদের এসব কথা আর উড়িয়ে দেই না। বিয়ে হচ্ছে দিল্লীকা লাড্ডু। যে খায় সে পস্তায়, যে খায় না সেও পস্তায়। এই লাড্ডুও একসময় খেতে হবে, তারপর জুনিয়র কলিগদের গম্ভীরমুখে সেই একই কথা বলতে হবে, ” ভাই, বিয়ের আগের…”
যখন পিছন ফিরে তাকাই, তখন ক্যাডেট কলেজের জীবনটাকে মনে হয় সোনালী সময়। কলেজ থেকে বের হওয়ার দিন একজনকেও দেখিনি যার চোখে পানি নেই। অথচ কলেজজীবনের প্রত্যেকদিন আমরা এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করতাম। কিন্তু ছয়টি বছর তিলে তিলে জমে উঠা মায়া কি অস্বীকার করা যায়? একসময় যে হাউস, ক্লাসরুম, মসজিদ, অডিটরিয়ামের উপর অধিকার জন্মেছিল, তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেল! হয়তো আরও অনেকবার ফিরে আসা হবে, কিন্তু সেই অধিকার নিয়ে আর ফিরে আসা হবে না।
আসলে ফেলে আসা জীবনটাই সবচেয়ে সুন্দর। আমরা ছুটে চলি একটা খন্ড জীবন থেকে আরেকটা খন্ড জীবনের পথে। এই ছুটে চলার সময় যখনই একটু পিছন ফিরে তাকাই, মনে হয়, ” আহা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, আহা ….”

মুস্তাকিম (৯৪-০০)
২০তম ইনটেক, রংপুর ক্যাডেট কলেজ
২৬ জুন, ২০০৯

৪,২৮৪ বার দেখা হয়েছে

৬৬ টি মন্তব্য : “এই তো জীবন….”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    বহুদিন কলেজ লাইফের এমন চমৎকার স্মৃতিচারণ পরিনি দোস্ত।
    অসাধারন।

    এতো চমৎকার লিখিস অথচ খালি বলতি লিখতে পারিস না।
    এখন থেকে নিয়মিত হয়ে যা।

    সিসিবিতে স্বাগতম। ৯৪'ব্যাচ দেখলেই ভালো লাগে।

    কাল দেখা হবে। আমি ফোন দিবো।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ব্লগে স্বাগতম ভাইয়া... দারুন স্মৃতিচারণ :hatsoff: :hatsoff:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. মেহেদী হাসান (১৯৯৬-২০০২)

    অসাধারন ওপেনিং.........।। চালিয়ে যান, আশা করি অনেক বড় ইনিংস খেলতে পারবেন। :hatsoff: :hatsoff:

    এই ছুটে চলার সময় যখনই একটু পিছন ফিরে তাকাই, মনে হয়, ” আহা আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, আহা ….”
    জবাব দিন
  4. এহসান (৮৯-৯৫)
    একসময় যে হাউস, ক্লাসরুম, মসজিদ, অডিটরিয়ামের উপর অধিকার জন্মেছিল, তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেল! হয়তো আরও অনেকবার ফিরে আসা হবে, কিন্তু সেই অধিকার নিয়ে আর ফিরে আসা হবে না।

    এত সহজ করে দারুন সত্য একটা কথা বললে ভাই। খুবই ভালো লাগলো লেখাটা। :clap: :clap: :clap: পাঁচ তারা

    জবাব দিন
  5. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আরেকটা '৯৪ ইনটেক? নাহ্ ব্লগটার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেল! এইডা কি কামরুল, রবিনের ষড়যন্ত্র!! সিনিয়র কেউ কেউ একটু উঁকি-ঝুঁকি দেয়, হারাইয়া যায়!! '৭৫-এর আগে আমি তো আছি "লোন ক্রুসেডর"। :grr: :grr: :grr: একাই একশ!!!

    লেখাটা খারাপ না ................. কিন্তু এখনো সিসিবি ডিসিপ্লিন পালন না করায় মেজাজটা x-( হয়ে আছে! দেখলাম অ্যাডজুটেন্টও সেইডা মনে করাইয়া দিছে! আর কামরুল সাম্প্রদায়িকতার চেষ্টা কইরা যাইতাছে। ৩৫ ঘণ্টা সিসিবিতে আছিলাম না, এর মইধ্যে এতো অধঃপতন? 😡

    কামরুল লুঙ্গি পইড়া লং আপ!! আর মুস্তাকিম ১০টা :frontroll: কুইক.................


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
  6. মুস্তাকিম (৯৪-০০)

    :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: :frontroll: লেখাটা সম্পর্কে ভাল ফিডব্যাক আসায় আরো দুই টা (ফ্রি)। আসলে এত ভাল ফিডব্যাক আসবে তা কল্পনাওকরিনি। :frontroll: :frontroll:

    জবাব দিন
  7. মাহমুদ (১৯৯৮-২০০৪)

    এইখানে (মানে সিসিবিতে) আসলে,ভুইলা যাই যে,আমি এক্স-ক্যাডেট,
    সবার কথাবার্তা শুইনা,মনে হয় আমরা ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা মারতেছি;যে কাজটায় আমার সদা আগ্রহ!
    মাঝে মাঝে পুরা ক্লাস ঝিমাইয়া লাস্টের দিকে ফাইজলামি শুরু করতাম।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কালবেলা (৯৩-৯৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।