হাতিবেড় গ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কুমির প্রজনন খামার

এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান :: ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ভাওয়াল গড়াঞ্চলের বিস্তীর্ণ শালবন পরিবেষ্টিত হাতিবেড় গ্রাম। লালমাটি আর অসমতল টিলা বনভূমি ঘেরা অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যমন্ডিত এ পল্লী। এক সময় এ গ্রামটি জনবসতিহীন বন্য পশু-পাখির অভয়ারণ্য ছিল। মাত্র ২০ বছরের ব্যবধানে ভালুকার বিশাল বনাঞ্চল পরিণত হয়েছে দেশের অন্যতম শিল্পাঞ্চল জনপদ হিসেবে। আর দিন বদল আর পালাবদলের পালায় এ গ্রামেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কুমির প্রজনন খামার। ২০০৪ সালের শেষ দিকে শুরু হয় এর কার্যক্রম। মাত্র ৬ বছরেই খামারটি দেখেছে সাফল্যের মুখ। কুমিরের বিভিন্ন অনুষঙ্গ রফতানির পাশাপাশি স্থানটি দেশি-বিদেশি পর্যটক এবং দর্শনার্থীদের নজরও কেড়েছে বলে মনে করেন বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড। কুমির চাষের সম্ভাবনা, ‘আশা জাগানিয়া’ সাফল্যসহ ফার্মের আদ্যোপান্ত নিয়ে প্রতিবেদন তৈরী করেছেন ইউ.কে.বি.ডি.নিউজ’র ময়মনসিংহ প্রতিনিধি এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান।
কুমির কাহিনী ও রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের শুরুর গল্প
কুমির আমাদের ভূগোল ও ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কুমির নিয়ে নানা গল্প আজো আবহমান গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জলে কুমির আর ডাঙায় বাঘÑ এটাও সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশে সাধু পানির কুমির বিলুপ্ত। সুন্দরবনে এখনো নোনা পানির কুমির রয়েছে। এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে কুমির এক কল্পনার বিষয়বস্তু। সেই শৈশব থেকেই মা-দাদী-নানীরা কুমির নিয়ে নানা গল্প শুনিয়ে আসছেন তাদের সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনীদের।
পানিতে কুমির খুব ভয়ঙ্কর। অনেকটা ডাঙায় বাঘের মতোই। এ জন্তুটির সামনে পড়লে তো উপায়ই নেই। ভাওয়াল গড়াঞ্চলের বিস্তীর্ণ শালবন পরিবেষ্টিত হাতিবেড় গ্রামের বিশাল ফার্মটির পুকুরের পাশ দিয়ে আমরা ক’জন হেঁটে যাচ্ছি। খানিকটা দূর থেকে দেখছি, ‘গুটিকয়েক’ কুমির পানির নিচে বিশ্রাম নিচ্ছে। হঠাৎ একটি পুকুর থেকে সমুদ্র্রের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো তীব্র শব্দ। অ্যাডভ্যাঞ্চেরাস দৃশ্য। নিজেকে নিরাপদে রেখে তাকিয়ে দেখলাম, পুকুরের পাশেই নিজের সুবিধামতো একটি জায়গা তৈরি করে সেখানে বিশ্রাম নিচ্ছে কুমিরটি। সতর্ক পায়ে আমরা হেঁটে চললেও সেই হাঁটার শব্দেই কুমিররাও সতর্ক হচ্ছিল। সতর্ক হতে গিয়েই এত শব্দ! এরপর থেকেই আমাদের চলাফেরা, তাকানো সব ব্যাপারেই সতর্কতা দ্বিগুণ বেড়ে গেল।
অবশ্য ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশতাক ভাই আগেই ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাদের সব। বলেছেন, সব কুমিরের চেয়ে এই ফার্মেরগুলোই বেশি ভয়ঙ্কর। এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় ক্রোকোডাইলস প্রোসাস কুমিরের চাষ। কুমির চাষের এ প্রকল্প শুরু হয় ২০০৩ সালে। এলাকা নির্বাচন, এলাকাটি কুমিরের বসবাসের উপযোগী করে তোলা, পুকুর তৈরি, গাছপালা রোপণ ইত্যাকার কাজকর্ম করতে সময় লেগে যায় প্রায় বছর খানেক। অতঃপর ২০০০ সালের ২৩ ডিসেম্বরের প্রথম ৭৫টি কুমির এনে ফার্মটির আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয়। বর্তমানে এ প্রকল্পে ছোট-বড় মিলিয়ে কুমির আছে ৮২০টির বেশি। চাষ করা কুমিরের এই প্রজাতি মূলত লোনা পানির কুমির। তবে লোনা পানির প্রজাতি হলেও এটি আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং পানিতে বাস করতে পারে। সুন্দরবনে যে কুমির পাওয়া যায় সেগুলোও একই প্রজাতির। এ কারণেই নিশ্চিন্তে ক্রোকোডাইলস প্রোসাস প্রজাতির কুমিরকে বেছে নেয়া হয়েছে।
আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বে লোনা পানির কুমিরের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। সারাবিশ্বে এখন যেসব কুমিরের চামড়া পাওয়া যায় তার তুলনায় এই প্রজাতিটি খুবই সামান্য। বলা চলে, শতকরা মাত্র একভাগ। শুধু চামড়া নয়, মাংস, হাড়, দাঁত এগুলোর চাহিদা এবং কদরও অনেক বেশি। জানা গেছে, বিশ্বে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের কুমিরের মাংসের বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালের ৫ মে কুমির চাষের জন্য অনুমতি পায়। এরপর আন্তর্জাতিক সংস্থা সিআইটিইএসের অনুমোদন সাপেক্ষে মালয়শিয়ার সারওয়াত থেকে সোয়া কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৫টি কুমির আমদানি করে। যে প্রত্যয় আর প্রত্যাশা থেকে এ ফার্ম কর্তৃপক্ষের স্বপ্ন ৬ বছর পর সেই স্বপ্নের স্বার্থক বাস্তবায়নও হয়েছে।
দুঃসাহসিক কাজ ডিম সংগ্রহ অতঃপর বাচ্চা ফুটানো
কুমিরের ডিম মানেই অতি মূল্যবান বস্তু। কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এরপর বিস্তার ঘটে পরবর্তী প্রজন্মের। তবে কুমিরের সব ডিম থেকেই বাচ্চা ফোটে না। যেসব ডিমে বাচ্চা ফোটে না সেগুলোও কিন্তু ফেলনা নয়। বিভিন্ন স্থানে উপাদেয় খাবার মেন্যু হিসেবে বিক্রি করার ব্যবস্থা থাকে। আমাদের দেশে এ ডিমের আবেদন খুব একটা না থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দারুণ জনপ্রিয়।
নিজের জানের মায়া ত্যাগ করে কুমিরের ডিম সংগ্রহ করতে হয়, এটি দুঃসাহসিক, জানালেন এ চ্যালিঞ্জিং অভিযানের কয়েক দক্ষ কর্মী। সাধারণত যে জলাশয়ে কুমির থাকে তার পাশেই খড়কুটো, মাটি দিয়ে বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার আগ পর্যন্ত তারা সেগুলোকে বিশেষভাবে পাহারা দেয়। কুমিরের নিজস্ব যতœ এবং পরিচর্যায় ডিম থেকে বাচ্চা ফুটতে অনেক সময় লাগে। সংখ্যায়ও কম হয়। ডিম সংগ্রহ করে ইনকিউবেটরে রেখে ফোটালে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি বাচ্চা পাওয়া সম্ভব। এজন্য চাষীরা এ পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
বছরে একবার বর্ষাকালে কুমির ডিম দেয়। একসাথে একটি কুমির প্রায় ৩৫ থেকে ৭০টি ডিম দেয়। যে বাসায় ডিম দেয় সেই বাসা থেকে সাবধানে, কয়েকজন মিলে সেগুলো সংগ্রহ করতে হয়। ডিম সংগ্রহের সময় কুমির এসে আক্রমণ করলো কি না সেদিকেও তীক্ষè নজর রাখা ছাড়া অন্য উপায় নেই। সংগ্রহ করা ডিমগুলো ইনকিউবেটরে রাখার সময় প্রাথমিকভাবে অবস্থান (বাসায় যে অবস্থায় থাকে) অপরিবর্তিত রাখা বাধ্যতামূলক। কারণ, অবস্থান পরিবর্তন হলে ডিম থেকে আর বাচ্চা হয় না। বাসা থেকে ডিম তোলার সময় কালি দিয়ে অ্যাঙ্গেল মার্কিং করে ঠিক সেইভাবে ইনকিউবেটরে বসানো হয়। ডিমগুলো বসানোর পর ৩২ থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৮০ থেকে ৯০ দিন রাখলে বাচ্চা ফুটতে শুরু করে। ইনকিউবেটরে ডিম রাখার ২৪ ঘণ্টা পর বোঝা যায় কোন ডিম থেকে বাচ্চা হবে আর কোনটায় হবে না। যেগুলোতে বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না সেগুলোকে বের করে খাবার জন্য বিক্রি করা হয়।
কুমিরের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত সবই যেন সোনা
উদ্যোমী দু’ উদ্যোক্তা। একজন রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোঃ মেসবাউল হক, অন্যজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশতাক আহম্মেদ। স্বপচারী এ দু’ মানুষের উদ্যোগেই ময়মনসিংহের ভালুকার রেপটাইল ফার্ম লিমিটেড গড়ে উঠে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা এই ফার্ম আজ সাফল্যের মুকুট পড়েছে। শুরু করেছে বিদেশে কুমির রপ্তানি। এ দেশ থেকে যাচ্ছে কুমির, আসছে কাড়ি কাড়ি টাকা। রেপটাইল ফার্ম ক্রোকাডাইলাস প্রোসাস প্রজাতির কুমিরের চাষ করছে। এ জাতীয় কুমিরের চাহিদা বিশ্ববাজারের অধিক এবং দামও অনেক। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, কুমির রপ্তানির পর ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের কুমির দিয়ে তৈরি সামগ্রী স্থান করে নেবে। ফলে আরও উদ্যোক্তা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে।
আমাদের সুন্দরবনে এ জাতীয় কুমির রয়েছে। এরা মূলত লোনা পানির কুমির। এ কুমিরকে পরিবেশ উপযোগী করে তারা স্বাদু পানি ভূ-খ-ে চাষ করছেন। অভিযোজন প্রক্রিয়াটি যে তারা সাফল্যজনকভাবে করতে পেরেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত এমনকি ডিম- কুমিরের কিছুই যেন ফেলনা নয়। এসব কিছুই চড়ামূল্যে বিক্রি হয়। কুমিরের চামড়া থেকে বেল্ট, হাড় দিয়ে পারফিউম, দাঁত দিয়ে মূল্যবান অলঙ্কার ও রক্ত দিয়ে ক্যান্সার রোগ প্রতিষেধক তৈরী হয়। এছাড়াও ফ্রান্স, আমেরিকা, জার্মান, ইতালি, চীন, স্পেন, থাইল্যান্ড ও তাইওয়ানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৭০ থেকে ৭৫ হাজার আমেরিকান ডলারে প্রতি বছর কুমিরের মাংসের চাহিদা রয়েছে। রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশতাক আহমেদ বলেন, চামড়া, দাঁত, মাংস, হাড় এগুলো চলতি বছরেই আলাদাভাবে রপ্তানি করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে আমাদের।
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড আনুষ্ঠানিকভাবে কুমির রপ্তানি শুরু করায় দেশের অর্থনীতির সম্ভাবনার সিংহদূয়ার খোলে গেছে। উন্মোচিত হয়েছে এক নতুন দিগন্তের। ক’দিন আগেও যারা বলতেন খাল কেটে কুমির আনা, এখন তারা ভুলেও সে আপ্তবাক্য উচ্চারণ করেন না। তাদের মুখেই শোনা যায়, খাল কেটে কুমির নয়, হাতিবেড় গ্রামে সোনা এসেছে। প্রোসাস প্রজাতির চামড়ায় তৈরি একটি সাধারণ পার্সের দাম ৫০,০০০ ডলার।

বিনিয়োগ, ব্যবস্থাপনা ও রপ্তানি
হাতিবেড় গ্রামে গড়ে উঠা রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের বয়স এখন ছয়। এ ৬ বছরে কুমিরের সংখ্যাও বেড়েছে কয়েকগুণ। ছোট-বড় মিলিয়ে কুমির প্রচুর। সবগুলোকে রাখা হয়েছে অনুকূল পরিবেশে। একই সাথে নেয়া হচ্ছে বিশেষ যতœ। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আনা। প্রায় ছয় বছর ধরে একাধারে বিনিয়োগের পর রপ্তানিযোগ্য ৩০০ কুমির থেকে সম্প্রতি ৫ থেকে ৭ ফুট লম্বা আকারের ৬৭ টি কুমির জার্মানীর হাইডল বার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য রপ্তানি করা হয়েছে। প্রতিটি কুমির রপ্তানি হয়েছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা দরে। সূত্র জানিয়েছে, জার্মানীর হাইডেল বার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কুমিরের শরীরের অংশ বিশেষ থেকে মানব দেহের রোগ প্রতিরোধক মেডিসিন আবিস্কার কালচারের জন্য কুমিরগুলো হাতিবেড় গ্রাম থেকে আমদানি করেছে। ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে জার্মান হাইডেল বার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড কুমির রপ্তানির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। এরপর সরকার কুমির রপ্তানির চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে সম্প্রতি এ ৬৭ টি কুমির রপ্তানি হয়।
এছাড়া বাকী ২২৩ টি কুমির ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানির প্রক্রিয়া চলছে। তন্মধ্যে স্পেন, জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালি এ ফার্মের কুমিরের ব্যাপারে প্রচন্ড আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ আগ্রহের মধ্য দিয়েই এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই চার দেশে কুমির রপ্তানির সম্ভাবনার পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। এছাড়া চলতি প্রজনন মৌসুমে ২১ টি মাদি কুমিরের মধ্যে ১৮ টি মাদি কুমির ৮‘শ ৮৫ টি ডিম দিয়েছে। এতে তারা বেশ খুশি।
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেড সূত্র জানায়, কুমির প্রজেক্টের বিনিয়োগ হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ এবং লাভজনক। অন্য যেকোনো ব্যবসায়ের তুলনায় এটি সময়সাপেক্ষ বলে অনেকেই এর প্রতি আগ্রহী নন। তাছাড়া কিছু কিছু ব্যবসায় খুব অল্প সময়ের বিনিয়োগেই বেশি মুনাফা আয় করা সম্ভব বলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রজেক্টে কেউ আসতে চায় না।
তবে প্রজেক্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোশতাক আহমেদ জানান, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কুমির চাষে বিনিয়োগ করা সবচেয়ে নিরাপদ। কেননা, কুমিরের কখনো অসুখ হয় না। এজন্য মরে যাওয়ার ভয়ও থাকে না। আবহাওয়ার সঙ্গে একবার মানিয়ে নিলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দেখভাল করে রপ্তানি করলে এ থেকে ব্যাপক আয় সম্ভব। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এই প্রজেক্টটিকে খুব বড় বিনিয়োগ হিসেবে দেখা গেলেও আসলে তা খুব বেশি নয়।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, বসুন্ধরা সিটি প্রায় ৭ থেকে ৮ বছর ৪০০ কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করার পর কয়েক বছর হলো চালু হয়েছে। সেই তুলনায় আমাদের প্রজেক্টটি কিন্তু খুব বড় ইনভেস্টের বলা যাবে না। ২০০৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬-৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া সবগুলো কুমিরের খাবার বাবদ মাসে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয় হচ্ছে। সম্প্রতি প্রথমবারের মতো ৬৭ টি কুমির জার্মানীর হাইডল বার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য রপ্তানি করা হয়েছে। এখন প্রতি বছরেই পর্যায়ক্রমে কুমির রপ্তানি করা হবে।

কুমির বেড়ে উঠে পুকুর ও নার্সারিতে
ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার পর দীর্ঘ সময়ের জন্য সেগুলোকে রাখা হয় নার্সারি ফার্মে। অতি যতœসহকারে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, আলো এবং সার্বক্ষণিক দেখভাল করার মাধ্যমে বেড়ে ওঠে কুমিরগুলো। ইনকিউবেটরে বাচ্চা ফোটানোর পর সেগুলো রাখা হয় বিশেষভাবে তৈরি একটি নার্সারিতে। যেখানে সার্বক্ষণিক তাপমাত্রা থাকে ৩২-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাইরে থেকে অনাকাক্সিক্ষত শব্দ যাতে সেখানে পৌঁছতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। কারণ বাচ্চা কুমিরগুলো নির্দিষ্ট শব্দ ছাড়া অনাকাক্সিক্ষত শব্দ শুনলে ভয় পেতে পারে। নার্সারিতে সাধারণের যাওয়ার অনুমতিও মেলে না সব সময়। অচেনা মানুষের গন্ধ নাকে গেলে নাকি বাচ্চা কুমির খাবার খায় না। আর না খেলে বাচ্চা অবস্থায় কিছুদিন পর স্ট্রোক করে মারা যায়। রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডে’র সার্বক্ষণিক দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা নাসির জানান এসব তথ্য।
তিনি আরো জানান, আমাদের এ ফার্মে মোট ২টি নার্সারি আছে। একটিতে রাখা হয় সদ্যোজাত থেকে ৬ মাস বয়সী বাচ্চা এবং অন্যটিতে ৬ মাসের বেশি বয়সী। সদ্যজাত বাচ্চা লম্বায় সাধারণ ১ থেকে ১.৫ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ৬ মাস পর সেগুলোর কোনোটি ২ থেকে ৩ ফুটও হয়ে থাকে। নার্সারিতে রাখার পর কুমিরগুলো বড় হলে ধীরে ধীর নিজেদের মধ্যে অ্যাটাকিং বা অ্যাগ্রেসিভ মনোভাব চলে আসে। আর তখনই সমস্যা হতে শুরু করে। ফার্মের একটি নার্সারিতে বড় আকারের কুমির রয়েছে যেগুলো আর কিছুদিন পর রফতানি করার প্রক্রিয়া চলছে। যেসব কুমির নার্সারিতে বড় হয় সেগুলো বড় কুমিরের সঙ্গে পুকুরে ছেড়ে দেয়া সম্ভব হয় না। কারণ বড় কুমির তখন ছোটগুলো খেয়ে ফেলতে পারে।
মালয়েশিয়া থেকে বড় কুমির আনার পর সেগুলো রাখা হয়েছে পুকুরে। বর্তমানে ৩২টি পুকুর রয়েছে ফার্মে। এ পুকুরগুলোও তৈরি করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শকের সাহায্য নেয়া হয়েছে। তৈরিকৃত পুকুরের গড় গভীরতা ৬ থেকে ৭ ফুট এবং ভেতরের চারপাশে পাকা করা। পুকুরের পাশে রাখা হয়েছে কিছুটা খালি জায়গা যেখানে কুমির বিশ্রাম নেয় এবং ডিম পাড়ার জন্য বাসা তৈরি করে। অস্ট্রেলিয়ার ফার্মগুলোর অনুসরণীয় পদ্ধতিতে এখানকার অধিকাংশ পুকুর তৈরি করা হয়েছে। নার্সারিতে গড়ে প্রতিদিন পানি পরিবর্তন করা হলেও পুকুরে তেমনটা প্রয়োজন হয় না। তবে পানি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয়।
কুমিরের খাবার
রেপটাইল ফার্মের ছোট-বড় সব কুমিরের জন্য আলাদা খাবার দেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। খাবার হিসেবে পুকুরগুলোতেও বেশ কিছু প্রজাতির মাছ চাষ করা হয়েছে। ৬৭টি বড় কুমিরের জন্য সপ্তাহে সর্বোচ্চ দুইবার ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি পরিমাণ মাংস পর্যায়ক্রমে পুকুরে দেয়া হয়। মেন্যু হিসেবে সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদির মাংস এবং বিভিন্ন মাছ থাকে। যেসব কুমিরের বয়স ৬ মাস থেকে ২ বছর, সেগুলোকে মুরগির মাথা কুচি করে খাবার হিসেবে দেয়া হয়। আর ছয় মাসের কম বয়সী কুমিরকে দেওয়া হয় কিমা।
অন্যান্য তথ্য
প্রোসাস প্রজাতির কুমিরের চামড়ার তৈরি একটি মেয়েদের সাধারণ পার্সের দাম ৫০,০০০ ইউএস ডলার! এ পণ্যের ক্রেতারাও নাকি হাতেগোনা। সত্যিই তো, এত দাম দিয়ে কে কিনবে এগুলো? শুধু ব্যাগ বা পার্স নয়, কুমিরের দাঁত দিয়ে তৈরি হয় দামি অলঙ্কার, হাড় দিয়ে পারফিউম, চামড়া দিয়ে জুতা, বেল্ট, কোটসহ আরো অনেক কিছু। তবে সব শরীরের সব চামড়া নয়, পেটের দিকের চামড়াটা নাকি বেশি মূল্যবান। চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে পাপুয়া নিউ গিনি, ইন্দোনেশিয়া, চায়নাসহ প্রায় অর্ধশতাধিক দেশে কুমিরের চাষ করা হচ্ছে।
কুমির ছাড়াও যা আছে সেই ফার্মে
আলোকিত হাতিবেড় গ্রাম। এ গ্রামেই রয়েছে দেশের প্রথম ও একমাত্র কুমিরবেড়। রেপটাইলস ফার্ম এলাকায় কুমির যাতে স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রকল্প এলাকায় ৬ হাজার ফলজ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষ রোপণসহ কৃত্রিম ঘাস রোপণ করে সবুজায়ন করা হয়েছে। এয়াড়া অফিস কক্ষের বারান্দায় রয়েছে নানা ধরণের অর্কিড। যা নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের।
স্বপ্নচারীদের ভাবনা-চিন্তায় আরো যা রয়েছে
রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ মোশতাক আহমেদ বলেন, সরকারের সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কুমির খামারের পাশে তারা একটি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুলতে চান। ২০১৬ সাল নাগাদ কুমির খামারের পাশেই বাণিজ্যিকভাবে বিষধর সাপের খামার, প্রজাপতির মিউজিয়াম এবং পাখির চিড়িয়াখানা স্থাপন করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
পরিশেষ
এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি উন্নয়ন বান্ধব নয়। বরং মেধা ও উদ্যমে অনেক সময় তা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তারপরও ব্যক্তিক ও যৌথ উদ্যোগে এবং সৃষ্টিশীল ও মননশীলতার ভিতের ওপর ১৬ কোটির বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দিনবদলের অগ্রযাত্রায় ভাঙছে অনুন্নয়নের অচলায়তন। উদয় হচ্ছে উন্নতির নতুন নতুন পথ। এসব খবর আমরা ক’জনেই বা রাখি। এখন সময় এসেছে, আমাদের উন্নয়নের বিষয়গুলো সামনে আনা, ভালকে ভালো বলা। সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেয়া। এ কুমির চাষই দেশের অর্থনীতিতে আমুল পরিবর্তন করে এক নতুন মেরুকরণের জন্ম দিতে পারে বলে বিশ্লেষক মহল ।

১১ টি মন্তব্য : “হাতিবেড় গ্রামে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র কুমির প্রজনন খামার”

  1. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    মোস্তাক ভাই, অনেক দিন থেকেই আপনার কাজ ফলো করে আসছিলাম। আমাদের ব্যাচের কয়েকজনের ইচ্ছে আপনার মতন কিছু করার। কিন্তু প্রাথমিক মূলধন এত বেশি প্রয়োজন যে আপাতত আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

    যাই হোক আপনার জন্য রইল অনেক অনেক শুভ কামনা।


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
  2. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    ভাইয়া, কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম চেয়ারম্যান এবং এমডির মধ্যে দ্বন্দ্বের কারনে ফার্মের কুমিরের যত্ন হচ্ছে না এবং তারা মরে যাচ্ছে। সরকারেরও মনে হয় একটা অংশ আছে এখানে, এবং তারাও বলেছেন এই সমস্যার কথা।

    আশা করি এরকম কোন কিছু ঘটেনি, বা ঘটলেও তা বেশীদূর এগুতে দেননি আপনারা। কারন এসব খবর আমাদের হতাশ করে খুব।

    আমরা সবাই নামের পাশে আমাদের কলেজ সাল গুলো ব্যবহার করি। নতুবা সমস্যায় পড়তে হয় কমেন্ট করতে গিয়ে। এদিকে একটু নজর দিবেন ভাইয়া প্লিজ।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    মোশতাক ভাই,
    আপনাকে এখানে দেখে খুব ভালো লাগছে। ওফা ইয়াহু গ্রুপে আপনার লেখা ফলো করি। রেপটাইলস ফার্মের অগ্রগতি প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় অনুসরণ করছিলাম সবসময়। এখানে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ পেলে ভালো লাগবে, বাংলাদেশে ভিন্নধরণের বিনিয়োগের ব্যাপারে আমরাও নতুন করে ভাবতে পারবো।

    জবাব দিন
  4. অয়ন মোহাইমেন (২০০৩-২০০৯)

    ভাই,
    আপনাকে আমরা ৫০তম ব্যাচের ছেলেরা চিনিই "কুমির মোস্তাক ভাই " নামে 😛 কিন্তু এ ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানতাম না। আজকে জেনে খুবই ভাল লাগলো এবং আপনাকে এবং রেপটাইলস ফার্ম লিমিটেডকে শুভকামনা রইল।

    জবাব দিন
  5. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ব্লগে স্বাগতম মোস্তাক ভাই।

    এই প্রকল্পটিতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল ২০০৭ সালে, তখন মনে হয় ৬০-৭০টি কুমির ছিল, এক কথায় বলা যায় ভয়ঙ্কর সুন্দর! তবে তখন আমাদেরকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ঢুকতে হয়েছিল (শেষ পর্যন্ত এক সিনিয়র ফৌজিয়ানের সুত্র ধরে 😛 ) মানুষের অনিয়মিত চলাচলের কারনে নাকি কুমিরদের প্রজননে সমস্যা হবে একারনে চলাচল সীমিত রাখা হত বলে শুনেছিলাম। পরে যখন দেখলাম এটা দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে তখন বেশ অবাক হয়েছি। (সম্পাদিত)


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মহিউদ্দিন (৯৫-০১ বকক)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।