কিছু কৈশোর… (৩য় খন্ড)

(শিরোনামটি আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ’র একটি আত্মজৈবনিক গন্থ হতে অনুপ্রাণিত)

 

ক্যাডেট কলেজের শিক্ষা বা পুরো ব্যাবস্থাটা বাইরে থেকে অনেক আলাদা। কোন সন্দেহ নাই। একটা স্কুল বা কলেজের যে সকল কর্মকান্ড বাইরেও হয় সেগুলোও ক্যাডেট কলেজে একটু অন্যভাবে হয়। তবে কিছু আছে যেগুলো খালি ক্যাডেট কলেজেই সম্ভব। এমন একটা জিনিস ছিলো কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে বা চলতি ঘটনা প্রদর্শনী। সব কলেজেই এই প্রতিযোগীতাটা হতো। সব কলেজেরই এই সংক্রান্ত অনেক মজার স্মৃতি আছে। কিন্তু বিসিসি’র এই ইভেন্টটা ছিলো খুব আকর্ষনীয়। বিশেষ করে অন্য কলেজ থেকে স্যার’রা এসে আমাদের কলেজের সিএডি’র খুব প্রশংসা করতেন।

যেসব পাঠক নন-ক্যাডেট বা বিসিসি’র কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে সম্পর্কে জানেন না তাঁদের জানানোর জন্য বলি কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে মানে একটা মঞ্চ প্রদর্শনী। যেখানে কোন একটা সাম্প্রতিক বিষয় দেয়া হতো। বেশী’র ভাগ সময় থাকতো “ক্রাইসিস ইন ফিলিস্তিন”, ক্রাইসিস ইন আফগানিস্তান”, “টেররিজম ইন আওয়ার কান্ট্রি”, “ক্রাইসিস ইন কাশ্মীর” টাইপের সাবজেক্ট। কিছু স্পেশাল ইস্যু যেমন “সার্স ভাইরাস”, “ইনফরমেশন টেকনোলজি”, “জাতিসংঘ শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ”, “সুনামি” ইত্যাদিও থাকতো। আবার যে বছর বড় কোন খেলার আসর যেমন বিশ্বকাপ বা অলম্পিক হতো সেই বছর অবধারিত ভাবেই ঐ বিষয়গুলো থাকতো। পুরো অনুষ্ঠানটা হতো একটা মিশ্রন। যেখানে অনেক সাধারন  জ্ঞান সম্বলিত চার্ট বানানো হতো। কয়েকজন থাকতো স্পীকার বা বক্তা। যারা ওই সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে অনেক তথ্য উপস্থাপন করতো। আর ফাঁকে ফাঁকে কিছু নাটিকা। এই ছিলো কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে!!!

ব্যাক্তিগত ভাবে আমার খুব পছন্দের একটা ইভেন্ট ছিলো এইটা। এর কিছু কারন আছে। এর মধ্যে একটা কারন ছিলো আমি খুব নিম্নমানের পারফর্মার ক্যাডেট ছিলাম। অর্থাৎ কিছুই পারতাম না। আর কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে এত বিশাল এক আয়োজন ছিলো যে হাউসের ৬০ ভাগ ক্যাডেট ছাড়া করা সম্ভব ছিলোনা। সুতরাং কিছু না পারলেও ‘জব’ পাবার নিশ্চয়তা ছিলো। আর যুদ্ধ বিগ্রহ টাইপের বিষয় যখন থাকতো তখন কিছু ‘মৃত সৈনিক’ টাইপ চরিত্র লাগতো। বেশীর ভাগই নেয়া হতো ক্লাস সেভেন-এইট থেকে। যাদের প্রধান কাজ থাকতো ছোট ছোট নাটিকাগুলোতে মিছিল-টিছিল করা। আর গুলি খেয়ে “আঁ আঁ আঁ……” করে মরে যাওয়া। অথবা সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে খুক খুক করে অনবরত কাশি দেয়া। যেমন; হামীম/২৫তম ব্যাচ। তো এই টাইপের অভিনয়ের (মিছিল করা) মাধ্যমেই ক্যাডেট কলেজে আমার অভিনয় জীবন(!!!)শুরু!

আমার আর একটা কাজ ছিলো। শুনেছি এই জিনিসটা নাকি এখন আর নেই। আমাদের সময় সাধারন জ্ঞানের তথ্য দেয়া চার্টগুলো আমরা বক্স পেপারে কালো রঙ করে তার উপরে ছোট ছোট অক্ষর কেটে লাগিয়ে, গাম দিয়ে লাগিয়ে বানাতাম। সে এক সাধনার বিষয়। শত শত অক্ষর কাটো। রঙ করো। গাম লাগাও। অশ্বমেধ যজ্ঞ টাইপের অবস্থা! আর কাটাকাটি’র কাজ সবসময় করতো শুধু ক্লাস সেভেন-এইট। এবং তদারকিতে থাকতেন ক্লাস ইলেভেনের সবচেয়ে ‘জুনিয়র কন্ট্রোল পটিয়সী’ একজন। অক্ষর কাটার সকল অনাচার তিনি কঠোর হস্তে দমন করতেন। তবে বেশী’র ভাগ সময়ই দেখা যেতো ক্লাস সেভেন-এইটের ২০-২৫ জন অক্ষর কাঁটায় কামলা খাঁটা দিচ্ছে আর ক্লাস ইলেভেন এর সেই রাগী ভাই বাছাই করা ২-১ জন জুনিয়র নিয়ে হাসি হাসি মুখে, নীচু গলায় গল্প করছেন। কাকতালীয় ভাবে সেই সব জুনিয়ররা হতো অতি সুদর্শন!!! গায়ের রঙ কিঞ্চিত ময়লা হবার কারনে জুনিয়র থাকতে খাটুনিই করতে হতো; ‘গল্প’ করার সুযোগ হতোনা।

ক্লাস ইলেভেন আসার পর যখন “জ়ে.পি.’শীপের ব্যাপার স্যাপার” শুরু হয়ে যেত তখনই শুরু হতো কারেন্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে’র কাজ। সকল আগ্রহী জুনিয়র প্রিফেক্ট পদপ্রার্থী’রা ঝাপিয়ে পড়তেন কাজ করার জন্য। সিএডি ও জুনিয়র প্রিফেক্টশীপও অনেকটা একসুত্রে গাঁথা ছিলো। যে ক্যাডেট হয়তো সেভেন-এইটে আর্টস এন্ড ক্রাফটস পরীক্ষায় উপর্যুপরি ২৫ এ ১০ এবং ৭৫ এ ৩০; মোট চল্লিশ নম্বর পেয়ে কোনমতে ফেল ঠেকিয়ে দিতো, দেখা যেতো ক্লাস ইলেভেন আসার পর সেই ক্যাডেটই জুনিয়র কোন ভালো ছবি আকিঁয়ের ছবিতে ‘কালার কম্বিনেশনে ভুল’ ধরার পান্ডিত্য অর্জন করেছেন। এপোলেট’র পাঁচ দাগের ছিলো এমনই ‘ক্ষমতা’!!!

বিসিসি’র ইতিহাস পুরোটা জানিনা, তবে আমাদের সময় ৬ বছরে একটা সাধারন প্রবণতা দেখতাম। প্রতি বছর যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয় বরাদ্দ হতো শেরে-বাংলা হাউজের জন্য। অর্থাৎ কখনো আফগানিস্তান, কখনো ইরাকের যুদ্ধ ফুটিয়ে তোলা। কিছু জিনিস ছিলো কমন। যেমন; হাউসের কোরান তিলাওয়াত পারদর্শী ক্যাডেট সাধারনত আরব দেশের কোন ব্যাক্তি যেমন, ও.আই.সি প্রেসিডেন্ট, ওসামা বিন লাদেন, সাদ্দাম হোসেন ইত্যাদি চরিত্রে অভিনয় করতো। আরবীতে কোন একটা বক্তব্য পাঠ করাটাই ছিলো তাঁর কাজ। আর আমাদের কলেজ লাইফের পুরো সময়টাতে যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল হোতা ছিলো তখনকার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। বুশের একটি ভাষন ছিলো অনিবার্য। এবং সেটি বরাদ্দ ছিলো হাউসের অতি ফর্সা ক্যাডেটটির জন্য। এই মুহুর্তে ২১তম ব্যাচের ফাহাদ ভাই ও ২৬তম ব্যাচের সালেহ’র কথা মনে পড়ছে। একবার সোহরাওয়ার্দী হাউজের বিষয় ছিলো ‘ইরাক যুদ্ধ’। ওইবারও যতদূর মনে পড়ে ফর্সা ক্যাডেট ২৫তম ব্যাচের রবিউল করেছিলো এই চরিত্রটি।

এই হাউসে’র ২০০২ সালের সিএডি ব্যাতীত অন্য কোন সিএডি আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। আসলে একঘেয়েমি পেয়ে বসেছিলো। তবে আমরা যখন ক্লাস টুয়েলভে (সম্ভবত) তখনকার দুইটা জিনিস এখনো মনে পড়ে।

১/ তখন মার্কিন সেনাদের ধর্ষন নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক নিন্দা চলছে। শেরে-বাংলা হাউজের থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক একটা যুগান্তকারী সিধান্ত নিলো। তাঁরা কলেজের স্টেজে ধর্ষনের দৃশ্য দেখাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সবার মধ্যে চাপা গুঞ্জন। কিভাবে এই দৃশ্য দেখানো হবে তা নিয়ে বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনা। সেই নাটিকায় ধর্ষনকারী তো সবাই হতে চায় কিন্তু ধর্ষিতা চরিত্র কে করবে? পরবর্তীতে আমাদের আমিন ধর্ষকের চরিত্রে অভিনয় করে। বলা বাহুল্য আমিনকে দেখে মনে হচ্ছিলো সে চরিত্র নিয়ে খুব খুশি। আর ধর্ষিতা? এক জুনিয়র করেছিলো; তাঁর নাম বললাম না, শুধু বলি কাকতালীয় ভাবে সেই ছেলেটিও ছিলো সুদর্শন। ( যদিও এই ‘সুদর্শন’ এর সাথে আমিনে’র চরিত্র নিয়ে খুশি হবার কোন যোগসাজশ নেই বলে বিশ্বস্ত সুত্রে জানা গেছে )।

২/ সত্যি কথা বলতে সিএডি তে অভিনয় করার তেমন কিছু থাকতো না। তবে একটা ছোট চরিত্রে অভিনয় করে আমাদের নূর ক্লাস শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার জিতেছিলো। চরিত্রটি ছিলো বিবিসি রিপোর্টার এর। কিছুই না একজন রিপোর্টার শুধু একটা টিভি রিপোর্ট করবে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে। এই সাধারন চরিত্রকে অসাধারন করে তোলে নূর। হু-ব-হু বিবিসি রিপোর্টারের নকল করে আমাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলো নূর।

 

সোহরাওয়ারদী হাউজ আমাদের সময় ছিলো খেলাধুলায় খুব পারঙ্গম। সেই কারনে কিনা জানিনা খেলা সংক্রান্ত বিষয় যেমন অলিম্পিক-বিশ্বকাপ ফুটবল দেয়া হতো সোহরাওয়ার্দী হাউজকে।এইসব জিনিস নিয়ে তথ্য অনেক দেয়া যেতো। কিন্তু নাটিকা বানানো ছিলো খুব দুষ্কর। আমরা যখন ক্লাস ইলেভেনে তখন বরাবরের মতো ওঁদের বিষয় ছিলো বিশ্বকাপ ফুটবল ২০০৬। ঐবার আমার হাউস (শরিয়তউল্লাহ হাউস) চ্যাম্পিয়ন হলেও আমার নিজের কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছিলো সোহরাওয়ার্দী হাউজেরটা। বিশ্বকাপের জাঁকজমকটা খুব ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলো ওরা। এর পিছনে আমাদের শশী’র (পরবর্তীতে জুনিয়র প্রিফেক্ট ও হাউস কালচারাল) অনেক অবদান ছিলো বলে জানি।তিনটি ঘটনা না বললেই নয়;

১/ আমাদের সোহরাওয়ার্দী হাউজের এক ব্যাচমেট, (ধরি তাঁর নাম ‘পূরক’) এর ছদ্মনাম ছিলো ফুটবল। ক্লাস ইলেভেনে আসার পর বেচারা ভালো ঝামেলায় পড়েছিলো। হাউজ কমন রুমে সিএডি’র কাজ হতো। সে নিজেও ছিলো নিবেদিত কর্মী। কিন্তু কমন রুমে সবার মুখে তখন শুধু ‘ফুটবল’ শব্দটি। কিছুই করার থাকতোনা মুখ বুঁজে সহ্য করা ছাড়া।

২/ এই ঘটনাটি অত্যন্ত আশ্চর্যের। কিন্তু ১০০ ভাগ সত্য। সেই হাউজের আমাদের ব্যাচে আরেকজন ছিলো মশিউর। ক্লাস ইলেভেনে’র আগে জীবনেও কোনদিন ফুটবলের গোল কিপিং করেনি। বিশ্বকাপ ফুটবলের একটি নাটিকায় সে প্রথম গোলকিপার চরিত্রে অভিনয় করে। অভিনয়ের (???) প্রস্তুতি অতি নিষ্ঠার সাথে করার কারনে সত্যিকারের ফুটবল মাঠেও সে একজন দক্ষ গোলকিপার হয়ে ওঠে। এরপরের কাহিনী শুধুই ইতিহাস। শুধু মাত্র ২৫তম ব্যাচের বা তখনকার কলেজের সেরা গোলকিপারই নয়, ক্লাস ইলেভেনে পড়া অবস্থায়ই আন্তঃক্যাডেট কলেজ ফুটবল প্রতিযোগীতায় কলেজ টিমের দুই গোলকিপারের একজন হবার মাধ্যমেই মশিউর তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়।

৩/ পাঠকদের নিশ্চয়ই ২০০৬ বিশ্বকাপের ‘জিদানের ঢুস’এর কথা মনে আছে। তো সেবার সোহরাওয়ার্দী হাউজের একটি নাটিকা ছিলো সেই ‘ঢুস’ নিয়ে। জিদানের চরিত্রে অভিনয় করেছিলো আমাদের রেজা। আসল ম্যাচে জিদান এর চেয়েও সম্ভবত রেজা’র বেশি রাগ ছিলো। কথা হলো দুষ্ট মাতারেজ্জি’র চরিত্র কে করবে? অবশেষে অতি দুষ্ট মুসতাকীমকে বেছে নেয়া হলো। মুসতাকীম তখন কলেজে কর্মরত জনৈক ‘বহুভাষাবিদ’ শিক্ষক যিনি একইসাথে জ্ঞাতি চাচা হন, তাঁর কাছে গিয়ে বেশকিছু স্প্যানিশ গালি শিখে এলো। ইতালি’র খেলোয়াড় মাতারেজ্জি কেন স্প্যানিশের গালি দেবে এমন চিন্তা কারো মাথায় আসেনি। তো যাই হোক, আসল প্রতিযোগিতা’র দিন জিদান রূপী রেজা, মাতারেজ্জি রূপী মুসতাকীমকে এমন এক ঢুস দেয়, যে মুস্তাকীমকে আর ব্যাথা পাবার অভিনয় করতে হয়নি।

 

আমার নিজের হাউস ছিলো শরীয়তউল্লাহ হাউজ। কত যে স্মৃতি!!! আমাদের হাউজের ভাগ্যে সবসময় এমন সব টপিক পড়তো যে জানার পর পাঁচদিন হতাশ হয়ে বসে থাকতে হতো কি দেখাবো। যেমন; “সার্স ভাইরাস”, “সুনামি”, “জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী” ইত্যাদি। এগুলো নিয়ে যে কি নাটিকা বানাবো তা ভাবতে ভাবতে মাথার চুল পড়ে যাবার যোগাড় হতো। কয়েকটা ঘটনা বলি।

১/ আমি খুব ভালো মানচিত্র আঁকতে পারতাম। মানবিক বিভাগের ছাত্র ও ভুগোল আমার প্রিয় বিষয় হবার কারনে সেই প্রতিভা আরো বিকশিত হয়। বিশাল বিশাল সব মানচিত্র আঁকা লাগতো। আজ বলতে খুব লজ্জা লাগছে, তবুও বলি; আমাকে অনেকে বলেছে ও আমার নিজের ধারনা ২০০৪-২০০৮ এ কলেজে আমার চেয়ে ভালো মানচিত্র আর কেউ আঁকতে পারতোনা।

২/ তথ্য-প্রযুক্তি নিয়ে সিএডি করতে গিয়ে আমরা প্ল্যান করলাম যে স্টার্টিংটা করবো এই ভাবে, যে একটা মেশিন ভয়েজ দিয়ে সাউন্ড দেয়া হবে; “Welcome…….To the era of Information Technology”. ঝামেলা হলো ঐরকম একটা যান্ত্রিক ভয়েজ কই পাবো। কলেজে তখন ‘তথ্য-প্রযুক্তি’র বিকাশ হয়নি। নাই ইন্টারনেট। নাই কোন সফটওয়ার। শেষমেশ এগিয়ে এলেন হাউজ প্রিফেক্ট আহসান ভাই। (“হ্যাশ রেসপেক্ট” ভাই’র জন্য সবসময়) মাইক্রোফোন নিয়ে তিনি এমন এক ভয়েজ দিলেন যেটা কেমন ছিলো তা লিখে বোঝানো যাবেনা। যারা সেদিন শুনেছে শুধু তারাই বুঝবে!!! এরপর ভাই’র সাথে আমরা দুষ্টুমি করে ঐরকম স্বর করেই কথা বলতাম!

৩/ ‘সুনামি’ নিয়ে সিএডি করতে গিয়ে আমাদের সবার গলদঘর্ম অবস্থা। সুনামি কিভাবে মঞ্চে দেখায়!!! এমন সময় ত্রাতা হয়ে এলেন আমাদের মেহের কবীর স্যার। ক্লাস সেভেনের ১৬ জনকে স্যার কমন রুমে বিশেষ প্রশিক্ষন দেন ‘হিউম্যান ওয়েভে’ তৈরী করার। ভারতেশ্বরী হোমসের মেয়েরা যেমন ডিসপ্লেতে ঢেউ তৈরী করে, তেমন। তারপর সেই ঢেউ’য়ের ওপর আকাশী বেড কাভার সেলাই করে বানানো এক বিশাল চাদর দিয়ে স্যার বানালেন তাঁর অনবদ্য ‘সুনামি’র ঢেউ। প্রতিযোগীতার আগেরদিন স্যার কোথা থেকে যেন এক বিশেষ লাইট নিয়ে এলেন। (ডিজে’র লাইটিং এর মতো, তবে খুব তীক্ষ্ণ) আর কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে স্যার নিজেই লাইট নিয়ে বসে গেলেন লাইটিং এর কাজে। সেই লাইটে হিউম্যান ওয়েভ দিয়ে স্যার আমাদের দেখালেন পানি ছাড়াও ঢেউ হয়!!! সবাই মুগ্ধ চোখে দেখেছে কলেজ অডিটোরিয়াম সুনামি’র ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছে। হয়তো পানি নেই কিন্তু ভেসে যাচ্ছে, এটা নিশ্চিত।

৪/ ‘গল্পের গরু নদীতে নামানো’ টাইপের একটা কাজ করেছিলাম ‘তথ্য-প্রযুক্তি’ নিয়ে সিএডি করতে গিয়ে। তখন প্রত্যেকটা ব্যাচের কালচারাল ফাংশানে হিন্দি গানের সাথে ড্যান্স হতো। সব ব্যচের বেস্ট ড্যান্সার’রা কাকতালীয় ভাবে তখন শরীয়তউল্লাহ হাউজে। টুয়েলভে সানী ভাই, আমাদের তৌহিদ, টেনে ইমতিয়াজ, নাইনে আদীব, এইটে আনোয়ার সব বাঘা বাঘা ড্যান্সার! তখন আমরা প্ল্যান করলাম যে আমরা একটা নাটিকা বানাবো যেখানে দেখানো হবে ‘তথ্য-প্রযুক্তির কুফল’। হিন্দি চ্যানেলে নাচ গান দেখে যুবসমাজ নষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি-ইত্যাদি। পুরো স্টেজকে আমরা বানালাম টি,ভি স্ক্রিন। এক কোণায় আবার ‘সনি’ টিভির লোগো।দেখানো হবে টিভিতে হিন্দি গানের সাথে নাচ হচ্ছে। এই সম্পুর্ন অপ্রাসঙ্গিক ও ‘জোর করে প্রাসঙ্গিক বানানো’ নাটিকা দিয়ে ঐবার আমরা বাজিমাত করে দেই। সানী ভাই’র নেতৃত্বে সে কি ড্যান্স!! দেখে সবাই এতজোড়ে করতালি দিলো যে বিচারকরা মনে হয় ভুলেই গেছিলো যে এই ড্যান্স পারফর্ম্যান্স মূল বিষয়ের সাথে জোর করে জোড়া দেয়া।

৫/ ক্যাডেট লাইফের শেষ সিএডি ছিলো ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী’। সেরা সিএডি’ও ছিলো সেটা। ঐ সিএডি করার জন্য আমরা কলেজ প্রিন্সিপাল এর সহায়তায় আর্মিদের সত্যিকারে’র হেলমেট-বুট-অস্ত্র ইত্যাদি আনিয়েছিলাম যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে। আমাদের কর্মকান্ডে অনুপ্রানিত হয়ে যশোর ক্যান্টনমেনট থেকে দুইজন অফিসার এসেছিলো ঐ সিএডি দেখার জন্য। পরে কলেজ তঁদেরকে বিচারক করে দেয়। আমাদের প্রদর্শনী’র শেষ দৃশ্য ছিলো একজন মৃত সেনা অফিসারের শেষকৃত্য নিয়ে। একটা কফিন যার উপর একদিকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও অন্যদিকে জাতিসংঘের পতাকা নিয়ে কুচকাওয়াজ করে ঢোকে চারজন। ২৬ ব্যাচের ফাহাদকে ‘সিরোমনিয়াল ড্রেস’ পড়িয়ে বানাই সেনাবাহিনী প্রধান। আর কলেজ স্টাফদের কাছে থেকে আটজন কে ‘মৃত ব্যাক্তিকে সশস্ত্র সালাম’ এর ড্রিল শিখিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অসাধারন ভাবে বানানো একটা কফিন; বিউগলের করুন সুর, এর সাথে সত্যিকারের অস্ত্র নিয়ে ‘সশস্ত্র সালাম’! আমার ক্যাডেট কলেজ জীবনে সিএডিতে এমন অসাধারন মুহুর্ত আর দেখিনি। ভালো একজন লেখক হলে দৃশ্যটা কেমন ছিলো বোঝাতে পারতাম। (আফসোস!!) অনুষ্ঠান শেষে মেডিক্যাল অফিসার নিজে ডেকে আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলো। তাঁর নাকি দৃশ্যটি দেখে মনে নাড়া দিয়েছিলো। এমন মৃত্যুতো তাঁরও হতে পারে। অতএব বোঝাই যাচ্ছে দৃশ্যটা কত বাস্তব ছিলো!!!

সত্যিকথা বলতে কারেণ্ট এফেয়ার্স ডিসপ্লে আমার কাছে এক নেশার নাম।তাছাড়া সিএডি ছিলো একটা বিশাল ফেস্টিভাল। একটা বিষয় বলা দরকার। আমাদের একটা সিএডি নামাতে হতো খুব কষ্ট করে। বাজেট কম। ঝামেলা বেশী। তীব্র প্রতিযোগীতা। বিশাল কর্মী বহর নিয়ন্ত্রন করা…হাজারো ঝামেলা! এরসাথে আছে হাউজে হাউজে স্নায়ুযুদ্ধ। যেমন লাইব্রেরীতে গিয়ে ‘টাইম’ ম্যগাজিন ইস্যু করা। কোন হাউজ আগে করবে সেটা নিয়ে গোপন প্রতিযোগীতা। দেখা যেতো নিজেদের হয়তো দরকার না। তবু অন্য হাউজের ঝামেলা তৈরী করার জন্য কোন এক হাউজ ‘টাইম’ ম্যগাজিন ইস্যু করে নিয়ে গেছে। তখন আবার বিভিন্ন ‘লবিং’ করতে হতো।

এখন কলেজে প্রতি হাউজে ইন্টারনেট সুবিধা। আমাদের সময় শুধু প্রিন্সিপাল স্যার’র রুমে ছিলো ইন্টারনেট। কোনো তথ্য পাওয়া ছিলো খুব দুষ্কর। লাইব্রেরীর পত্রিকা-ম্যাগাজিনই ছিলো ভরসা। একটা অভিজ্ঞতা না বললেই নয়; সিএডি’র বিষয় ছিলো ‘তথ্য প্রযুক্তি’। স্টেজে বক্তারা সমানে বলে যাচ্ছে যে “আজ একটি মাত্র ক্লিক করলেই, পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয়… বিজ্ঞান আজ পৃথিবিকে নিয়ে এসেছে আমাদের বেডরুমে…” অথচ আমাদের বানানো সব কয়টা চার্ট ছিলো বিভিন্ন ১ মাস-২মাস পুরোনো ম্যাগাজিন থেকে সংগ্রহ করা!!!

আমি এখনো কলেজে সিএডি গুলোতে কি হয় তাঁর খোঁজ রাখি। এবং কলেজের অন্য সব কিছুর সাথে এই ইভেন্টটা খুব বেশি ‘মিস’ করি। আমার মধ্যে এই নেশা ধরিয়ে দেন ২২ ব্যাচের আমিন ভাই। রাত ১২টা-১টা-২টা পর্যন্ত ২২ ব্যাচের আমিন ভাই, সৌরভ ভাই, ফিরোজ ভাই, মাসুদ ভাই, ‘ভাই’ নাজমুল ভাই,(প্রথম ‘ভাই’ সম্বোধনটি মাফিয়ামুলক) জাহিদ ভাই কাজ করতেন। তাঁদের সাথে আমি। আর ২-১ জন জুনিয়র। আমি তখন মাত্র এইট-নাইনে পড়ি। সারা হাউজে ঘুমে। কমন রুমে এতজন সিনিয়রের মধ্যে বসে থাকতে খুব সম্মান বোধ করতাম।

২২তম ব্যাচের আমিন ভাই আমার ক্যাডেট কলেজ লাইফে দেখা সবচেয়ে সৃষ্টিশীল মানুষ। তিনি যখন ইলেভেনে তখন আমার কাটা-কাটি পার্টি থেকে ‘প্রমোশন’ হয়। তিনি পরবর্তীতে হাউজ কালচারাল প্রিফেক্ট হোন। আমার জীবনে কোনদিন কলেজ প্রিফেক্ট হবার ইচ্ছা হয়নি, কিন্তু আমিন ভাই’কে দেখে খুব ইচ্ছা হতো হাউজ কালচারাল প্রিফেক্ট হতে। আমিন ভাই’র জন্য ‘হ্যাশ রেসপেক্ট’!!!

২,৮৭২ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “কিছু কৈশোর… (৩য় খন্ড)”

  1. কিছু লেখা চোখে পানি নিয়ে আসে, কেউ দেখে ফেলার আগেই আবার মুছে ফেলতে হয়। গতকাল রাতে যেমন আল রাহমানিয়াতে আসার মত সামর্থ্য না থাকাতে পানি এসেছিল চোখে, আজ আবার একই কাহিনী।অনেক ভাল লিখেছিস।
    আমরা কম দৌড়ালেও ব্রেইন দৌড়াত বেশি সবসময়। (ব্লু ব্লু আপ আপ ) 🙂 🙂 :clap: :boss: 😉

    জবাব দিন
  2. রায়হান (১৯৯৮-২০০৪)

    প্রথমেই তালিয়া
    :clap:
    বিদিক লিখছস
    কলেজ লাইফের পুরাই স্মৃতি তুলে নিয়ে এসেছিস

    সাথে আমার ও কয়েকটা কাহিনি মনে পরে গেল

    ১/ এক বার শরিওতুল্লাহ হাউসের টপিক ছিল খুব সম্ভবত "পরিবেশ দূষণ"।
    জেটা দেখানোর জন্য মঞ্চে পুরা আসল গরু তোলা হইছিল, ফান হচ্ছিল যখন ওই গরু আর নামতে চাচ্ছিল না।
    ২/ শেরে বাংলা হাউসের একবার টপিক ছিল ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার আক্রমণ। সোলা দিয়ে টুইন টাওয়ার বানানো হল এবং প্লেন কিনে আনা হল। প্ল্যান ছিল ২ তলা থেকে প্লেন এসে টাওয়ার ভেঙ্গে দেবে। কিন্তু প্লেন এসে আর ঠিক মত ভাংতে পারল না। বাধ্য হয়ে দৌড় দিয়ে কে যেন হাত দিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে আসে।
    ৩/ সোহ্রাওয়ারদি হাউসের টপিক ছিল ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এখানে তারা থার্ড আম্পায়ারের রিপ্লে দেখানো টা কে যে সুন্দর ভাবে মঞ্চে উপস্থাপন করেছিল , এখনও মনে আছে।

    আর তোর আরকটা কাহিনি থেকে মনে পরল যে আমাদের হাউসের টপিক সবসময় যুদ্ধ টাইপ। তো টপিক পরল আফগানিস্তান আক্রমন । যথারীতি আরবি ভাসন। ২০ ব্যাচের রিয়াজ ভাই হইল ওসামা বিন লাদেন( ভাই রে আসলেই লাদেনের মত লাগছিল। বুশ ওই দিন টের পাইলে সিউর ধইরা নিয়া জাইতো)
    আমারে বানানো হইল মোল্লা ওমর । কিন্তু ফান হইল ওই আফগান মোল্লা ওমর এর চরিত্র তেও আমারে দিয়া আরবি ভাসন দেয়াইল।২০ ব্যাচের সুমন ভাই লিখে দিসিল ভাসন। এমন ই মুখস্ত করাইছিল ওইটা এহন ও ২/৩ লাইন মনে আছে।
    =D


    একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার,সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার

    জবাব দিন
  3. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    সেই ক্লাস এইট থেকে অংশগ্রহন করে আসছি। সার্স ভাইরাস নিয়ে আমাদের ডিস্প্লেটি আসলেই চমৎকার হয়েছিল। প্রেজেন্টার হিসাবে জাহিদ ভাই আর তাওসীফ ভাই ছিলেন ট্রাম কার্ড। সাথে জামানের কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়, যে সার্স ভাইরাস কোষের ক্রস সেকশনের ছবি দুপুরের পর দুপুর না ঘুমিয়ে বিশাল জোড়া দেয়া বোর্ড পেপারে একে ফেলেছিল। মাস্টার পিস হয়েছিল একটি।

    তুষার দাবী করেছে- হামীম সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে খুক খুক করে কাশি দিয়েছে... ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, প্লানটা প্রথম অয়াহিদুজ্জামান স্যারের মাথায় আসে, তিনি গনিতের ফজলুল করিম স্যারকে বললে- ফজলুল করিম স্যার আমাকে ডেকে পাঠান। প্লান শোনার পর আমি একবার অভিনয় করে দেখাই। দুইজন স্যার আমাকে ফুল মার্ক্স দেন। সাথে সহভিনেতা ছিল আমার ফলোয়ার জুনিয়র মাহমুদ।

    সেখানে আমি চাইনীজ হোটেল মালিক সেজেছিলাম, বেড়াতে আসা অতিথিদের চাইনীজ খাবার খেতে আমত্রন করছি, কিন্তু রেড মিটের মাধ্যমে সার্স ভাইরাস ছড়িয়ে পরলে- সবাই অসুস্থ হওয়া শুরু করে, সেই সিম্পটমস, প্যানিক ও ভালনারিলিবিটি নিয়েই ছিল আমাদের অংশটুকু। মেশিন চালু হতে একটা স্পার্ক লাগে, আমাদের ডিস্প্লের স্পার্ক ছিল এই হোটেলের অংশটুকু।

    তুষার সাহেব, আমার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য তোমার পোস্টে মাইনাস।
    থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ অল


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  4. শিবলী (১৯৯৮-২০০৪)

    চমৎকার লিখেছো তুষার । এখনও মনে আছে সাংবাদিক হবার ছলে আমি প্রথমবার স্টেজে উঠেছিলাম । পরে দেখলাম শাহনূর ভাই খালেদা জিয়া সেজে কী ভাষণটাই না দিল...............থ্যাংকস......অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ......

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুশফিকুর রহমান তুষার [০২-০৮]

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।