খপ্পরে পড়া

আমাদের কলেজ জীবনে বন্ধুদের মাঝে “খপ্পরে পড়া” নামে একটা বাগধারা বহুল প্রচলিত ছিল। প্রচলিত বাংলায় কথাটি এক ধরনের বাজে, নেতিবাচক এবং ক্ষেত্র বিশেষে নোংরা অর্থে ব্যবহৃত হয়, যেমন “ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়া”, “নারীখেকোর খপ্পরে পড়া” কিংবা “বিশ্ববেহায়ার খপ্পরে পড়া”, ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের কাছে কথাটা সাধারণ্যে প্রচলিত অর্থের চেয়ে অনেক খানি ভিন্ন, কোন প্রকার নোংরামির সংশ্রবহীন, কিছুটা তামাসা মিশ্রিত মজাদার একটা অর্থ বহন করত। অনেক সময় “জীবনে একটু বৈচিত্র আনার আশায়” আমরাই সেধে পরে কারোর খপ্পরে পড়তাম।

একটা কাল্পনিক কিন্তু সম্পুর্ন বাস্তব উদাহরণ দিলে এর মর্মার্থ পরিস্কার হবে। ধরুন, কোন এক শুক্রবার সকালে আমি রাস্তার বাম দিক দিয়ে হেঁটে হেঁটে বদর হাউস থেকে একাডেমিক ব্লকের দিকে যাচ্ছি। হঠাত উল্টোদিক থেকে আসতে থাকা মুর্তজা স্যার কে দেখে আমি হয়তো রাস্তা পেরিয়ে ডান দিকে চলে এলাম। কাছাকাছি হতেই তিনি মৃদুস্বরে ছোটখাট একটা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “ইয়াস মুজিব, কি ব্যাপার? তুমি রাস্তার এই পাশ দিয়া যাইতাছ ক্যান?” আমি মিনমিন করে বললাম, “না মানে ইয়ে … স্যার, পায়ে হাঁটা মানুষদের তো রাস্তার ডান দিক দিয়ে হাঁটার নিয়ম, তাই …”
স্যার: আমি যদি বলি ডাইন না বাম দিক দিয়া হাঁটার নিয়ম তাইলে কোনো অসুবিধা আছে?
আমি: না স্যার, অসুবিধা নাই, তখন ওই পাশ দিয়া মানে বাম দিক দিয়াই হাঁটবো
স্যার: ওই পাশ টা যে বাম পাশ – এর কি প্রমান আছে? আমার কাছে তো ওইটা ডাইন পাশ …
আমি: জ্বী স্যার, কথা ঠিক, কিন্তু আমি যখন সামনের দিকে হেঁটে যাব তখন তো ওই পাশ টা আমার বাম পাশ …
স্যার: কিন্তু আমি যদি সামনের দিকে না হাইটা পিছন দিকে হাঁটি? তখন তো ঐটা আমার ডাইন পাশ!
আমি: স্যার, সেটা আপনি মনে চাইলে মাঝে মাঝে পিছন ফিরে হাঁটতেই পারেন, কিন্তু আমরা তো সারাক্ষণ মুন-ওয়াক করি না …
স্যার: আমি যদি বলি যে, আমি সব সময় পিছন দিকে হাঁটি, তাতে তোমার কিছু করার আছে?
আমি: না স্যার, তা নাই, তবে আমরা তো সাধারনত সামনের দিকেই হাঁটি
স্যার: “সামনে”, “পিছনে” – এগুলাতো জাস্ট শব্দ, নাম। আমি যদি বলি মুন-ওয়াক করা মানে “সামনে হাঁটা” আর আমরা “সাধারনত” যেভাবে হাঁটি সেইটা হইল “পিছনে হাঁটা” তাইলে তোমার কিছু করার আছে? …

এভাবে অনির্দিস্ট কাল পর্যন্ত এই কথোপকথন চলতে পারে, যতক্ষণ না আমি রণে ভঙ্গ দিচ্ছি। তবে প্রথম একটা-দুটা কথার পরেই যদি আমি আমতা আমতা করে বলতাম, “স্যার, মানে আসলে সত্যি বলতে কি, আপনাকে দেখে ভয় পাইছি, তাই …” – তাহলে তিনি আর বেশিক্ষণ কথা না টেনে একসময় ছেড়ে দিতেন। এভাবে “এস্কেইপ” করার আইডিয়াটা পেয়েছিলাম ২০ ইনটেকের শামস ভাই এর কাছ থেকে। সে যাহোক, এরকম একটা ঘটনাটাকে আমরা বন্ধুদের কাছে এভাবে বর্ণনা করতাম – দোস্ত, জানিস না তো কি হইছে! আজ সকালে মুর্তজা স্যারের খপ্পরে পড়ছিলাম, একেবারে খবর হয়ে গেছে।

এতক্ষণে আশা করি আমাদের ক্যাডেট জীবনে প্রচলিত “খপ্পরে পড়া” কথাটার গূঢ় অর্থ অনুধাবন করা গেছে। তো, সেদিন জার্মানি-ব্রাজিল সেমিফাইনাল ম্যাচ দেখার সময়, প্রায় দুই যুগ পরে, আবার সেই পুরোনো “খপ্পরে পড়া” কথাটা মনে পড়লো। প্রথমার্ধের ৩০ মিনিট না যেতেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এল “ব্রাজিল আজকে জার্মানদের খপ্পরে পড়েছে! এই রকম উপর্যুপরি assault!! By the way, who’s gonna be the next?”

পুনশ্চ: ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধেয় মুর্তজা স্যার আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষ। ক্যাডেটদের সামনে তিনি একজন ভয়াবহ টাইপের মানুষের একটা আবহ তৈরী করে রাখতেন। কিন্তু ওই মুখে তর্কা-তর্কি (বকাবকি নয়) করা পর্যন্তই ছিল ওনার রাগের বহিঃপ্রকাশের চরম সীমা। আমরা ওনার সাথে বিতর্ক (নাকি মৃদু ঝগড়া?) করে মজাই পেতাম। আমার বিশ্বাস, তিনিও এতে মজা পেতেন। কোন একটা জিনিসকে গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সম্পুর্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে কিভাবে দেখতে হয় সেটি তাঁর সাথে তর্কা-তর্কি করেই শিখেছি। তিনি আমাদেরকে হাতে কলমে দেখিয়েছেন কিভাবে গায়ের জোর কিংবা পদমর্যাদার জোর না খাটিয়ে যুক্তির উপরে পাল্টা যুক্তি প্রয়োগ করতে হয়। স্যার, আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।

পুনরায় পুনশ্চঃ ফুটবলে আমি কোনকালেই ব্রাজিল/আর্জেন্টিনা/জার্মান কোন দলেরই ফ্যান ছিলাম না। তাই, কেউ যেন মনে না করেন যে, আমি এখানে ব্রাজিল ফ্যানদেরকে খোঁচা খুঁচি করছি।

এম কে
১০ জুলাই ২০১৪

 

২,০০৫ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “খপ্পরে পড়া”

    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      পারভেজ ভাই, স্যারের সাথে দেখা হলে এই লেখাটার কথা বইলেন না যেন, প্লীঈঈঈজ ... :no: :no:

      :bash: :bash: :bash:


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
      • পারভেজ (৭৮-৮৪)

        আমার সাথে দেখা হওয়ার সম্ভবনা অতি ক্ষীণ। আমার দুই বন্ধুর সন্তান পড়ে ঐ স্কুলে। ওদের সাথে স্যারের নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ওরা কেউ সিসিবি-তে নাই বলে স্যারের পক্ষে এটা সম্পর্কে জানার খুব একটা সুযোগ দেখছি না।
        নো টেনশন...
        🙂 😀 :)) 😛


        Do not argue with an idiot they drag you down to their level and beat you with experience.

        জবাব দিন
  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আহ মুজিব ভাই, দিলেন তো ব্রাজিল ফ্যানদের লুকিয়ে রাখা ক্ষত জাগিয়ে 😛 তবে জার্মানী কয়েকটা গোল বেশি দিয়ে ফেলছিলো, খেলা শেষে যারা ব্রাজিলের ফ্যান না তারাও সমব্যাথি হয়ে পড়েছিল। তাই ঠিকমত পঁচানিও দিতে পারি নাই 🙁


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  2. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    (১) হুংকারের পরপরই আলাপ আলোচনা যেই দার্শনিক (কটাক্ষ করার উদ্দেশ্যে বলা দার্শনিকতা নয়) দিকে মোড় নিলো আহা! সে কথা বলতে কমেন্টে আসার আগে দেখি পুনশ্চ দিয়ে বলে দিয়েছেন। এইযে একজন ছাত্রের মাঝে প্রশ্ন করার মনোভাব তৈরী করার চেষ্টা সেটা হয়তো সেই পরিস্থিতিতে খপ্পড়ে পড়া ক্যাডেটের মোটেও ভাল লাগবে না কিন্তু কাজ যা করার করে দিবে। সেদিন থেকে ১৫-২০ বছর পরে যখন পিছে তাকাবে তখন ঘটনাটি মনে করে ধন্যবাদ দিবে স্যারকে। কোনটা সঠিক? কোনটা ডান কোনটা বাম? যা দেখছি, যেভাবে দেখছি সেভাবেই কেন দেখছি? আমাদের বলা হয়েছে সেভাবে দেখতে? সকালটা শুরু হলো প্রশ্ন করার মনোভাব নিয়ে! মূর্তজা স্যারকে এবং স্যারের সাথে এই রকম বাতচিত চালাবার জন্য আপনাকে ::salute::

    (২) ডিসক্লেইমার দিয়া পুরান (প্রায়) শুকায় যাওয়া ক্ষততে ফুলের টোকা দেয়ার তীব্র প্রতিবাদ জানাইলাম! x-(


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      ১) স্যারের এই পরোক্ষ শিক্ষার কারণেই বোধ হয়, আমিও ক্লাসে আমার ছাত্রদেরকে আবোল-তাবোল যা খুশি চিন্তা করতে উৎসাহ দিতাম। কিন্তু ইন্টারে গাইডবুক মুখস্ত করে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে সাড়া পেয়েছি খুবই কম 😕 🙁 😕 এ আই পরতে আসা ছেলেমেয়েদেরই যদি আই এর ঘাটতি হয়, তখন আর কতদূর টানা যায় বলো?

      ২) আমি যদি বলি, জার্মানদের কিক করা বলগুলির ৭ টাই জাল ফাঁকি দিতে পারে নাই, সেই তুলনায় ব্রাজিলিয়ান দের অনেক কম বল জালে আটকা পড়েছে, অতএব ব্রাজিল জয়লাভ করেছে - তাইলে তোমার কিছু বলার আছে? ... যাও এবার খুশি তো, মোকাব্বির? 😀 😀


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন
  3. জুনায়েদ কবীর (৯৫-০১)

    ক্লাস সেভেনে (১৯৯৫) মুর্তজা স্যারকে আমরাও কিছুদিন পেয়েছিলাম... কঠিন একজন মানুষ ছিলেন। ব্যাপক ডরাইতাম। স্যারের চেহারার সাথে নায়ক সোহেল রানার ভাল মিল ছিল। (ঠিক বললাম কি? :-/ )


    ঐ দেখা যায় তালগাছ, তালগাছটি কিন্তু আমার...হুঁ

    জবাব দিন
    • মুজিব (১৯৮৬-৯২)

      হাঃ হাঃ হাঃ :khekz: :khekz:

      তোমরা তোমরা খামোখাই ডরাইতা জুনায়েদ!

      ক্যাডেটদের সামনে তিনি একজন ভয়াবহ টাইপের মানুষের একটা আবহ তৈরী করে রাখতেন।

      সোহেল রানার সাথে ওনার মুখাবয়বে কিছুটা মিল ছিল বৈকি


      গৌড় দেশে জন্ম মোর – নিখাঁদ বাঙ্গাল, তত্ত্ব আর অর্থশাস্ত্রের আজন্ম কাঙ্গাল। জাত-বংশ নাহি মানি – অন্তরে-প্রকাশে, সদাই নিজেতে খুঁজি, না খুঁজি আকাশে।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুজিব (১৯৮৬-৯২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।