ধর্মঃ একটি নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়ন – ৩

মনোবিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা

সাংস্কৃতিক বিবর্তনবাদীদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রথার বিরুদ্ধে প্রধান প্রতিক্রিয়া নৃবিজ্ঞানের মধ্য থেকে আসেনি। সেটা এসেছে সামাজিক বিজ্ঞানে ঐতিহাসিক চিন্তাধারার প্রভাবের বিরুদ্ধে ইতিবাচকতাবাদী আন্দোলনের সাধারণ ক্ষেত্র থেকে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগের বছরগুলোতে মনোবিশ্লেষণের নিয়মতান্ত্রিক মনোবিজ্ঞানবাদ এবং Anne Sociologique এর সমান নিয়মতান্ত্রিক সমাজবিজ্ঞানবাদের উত্থান ঘটে। এর ফলে বিবর্তনবাদীরা বিবর্তনকে পটভূমির সাপেক্ষে সুনির্দিষ্ট তত্ত্ব আকারে উপস্থাপন করতে বাধ্য হন। অথচ এই উভয় আন্দোলনের প্রধান নেতা অর্থাৎ যথাক্রমে ফ্রয়েড ও ডুর্খেইম উভয়ের উপরই তখন পর্যন্ত বিবর্তনবাদের গভীর প্রভাব ছিল। আরও প্রাসঙ্গিকভাবে বলা যায়, এর ফলে নৃবিজ্ঞানে সুস্পষ্ট বিভক্তি এসে পড়ে এবং সামরিকভাবে মনোগতিশীল এবং সামরিকভাবে সামাজিক-গঠনগত দৃষ্টিভঙ্গি নামে দুটো পৃথক দৃষ্টিভঙ্গিতে গবেষণাগুলো পরিচালিত হতে শুরু করে।

এই ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে ফ্রয়েডের “টোটেম অ্যান্ড ট্যাবু”। এ বইটি মূল্যায়ন করতে গিয়ে নৃবিজ্ঞানীদের যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। ক্রোয়েবারের করা এই বইয়ের দুটি রিভিউ দেখেই তা বোঝা যায়। প্রথম রিভিউটি ছিল সম্পূর্ণ নেতিবাচক, কিন্তু দুই দশক পরে করা দ্বিতীয় রিভিউটি ছিল যথেষ্ট ইতিবাচক। কাল্পনিক নৃতত্ত্ব এবং অপ্রচলিত জীববিজ্ঞান থেকে ফ্রয়েডের মৌলিক অভিসন্দর্ভের জট খুলতে না পারা বা এই জট খোলার কোন চেষ্টা না করার কারণেই নৃবিজ্ঞানীরা এতো কঠিন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফ্রয়েডের এই অভিসন্দর্ভের মূলকথা ছিল, ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান ও বিশ্বাস নিউরোটিক লক্ষণের সদৃশ। ফ্রয়েড বলেছিলেন, প্রতিটি জীবের বদ্ধমূল ধারণা, স্বপ্ন এবং রূপকথা যে অন্তঃমানসিক উৎস থেকে আসে, একটি সামষ্টিক জীবগোষ্ঠীর এই চেতনাগুলো সেই একই উৎস থেকে আসে। ক্রোয়েবার ফ্রয়েডের আদিম অজাচার, পিতৃহত্যা এবং কিছু প্রাক-মানবীয় যাযাবর উপজাতি সম্পর্কিত তথাকথিত গল্পকে একেবারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই অনেকেই ধারণা করেন তিনি ফ্রয়েডের অন্তঃমানসিক উৎসের ধারণাটিকেও সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করেছেন। আসলে তিনি তা করেননি।

যারা ফ্রয়েডের আরও লেখা বিশেষত, “মৌর্নিং অ্যান্ড মেলাংকোলিয়া” ও “অবসেসিভ অ্যাক্ট্‌স অ্যান্ড রিলিজিয়াস প্র্যাক্টিসেস” পড়েছেন তাদের কাছে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যাবার কথা: মূল ইস্যু ছিল গণ পুরাণ ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর আচারানুষ্ঠাণের ধরণ ও কারণ ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহৃত স্বতন্ত্র সাইকোপ্যাথলজির ধরণ ও কারণ বিষয়ক তত্ত্বের কার্যকারিতা। রোহাইম ১৯৫০ সালে ফ্রয়েডের সাইকোসেক্সুয়াল উন্নয়ন বিষয়ক গোঁড়া তত্ত্বের আলোকে অস্ট্রেলীয় খৎনা প্রথার বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিনি বিশেষত ইডিপাল দুর্দশার সাথে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বগুলো ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু মনের গহীনে প্রোথিত আদিম স্মৃতি আবার ফিরে আসতে পারে বলে যে ধারণা আছে তা সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে বেটেলহাইম দীক্ষা অনুষ্ঠান চর্চা সম্বন্ধে একই ধরণের একটি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। অবশ্য তার প্রক্রিয়া আরও নিয়মতান্ত্রিক ও তুলনামূলক কম গোঁড়া ছিল। তিনি দীক্ষাকর্মকে দেখেছিলেন যৌন পরিচয়ের সংজ্ঞা ও স্থিতিশীলতার জন্য সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত প্রতীকী কৌশল হিসেবে। ১৯৪৫ সালে কার্ডিনার নব্য ফ্রয়েডীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে দেখিয়েছিলেন, গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসলে “মৌলিক ব্যক্তিত্ব কাঠামোর” বহিঃপ্রকাশ। তার মতে এই কাঠামো অবচেতন মনে জমে থাকা ঐতিহাসিক কোন মনোরোগের ক্রিয়ায় গঠিত হয় না, বরং শিশু প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত অনুশীলন থেকে উৎপন্ন পর্যবেক্ষণযোগ্য মনোরোগ থেকেই এর উৎপত্তি ঘটে। কার্ডিনারের এই গবেষণা ধারাকে পরবর্তীতে হুইটিং (হুইটিং অ্যান্ড চাইল্ড, ১৯৫৩) আরও বিস্তৃত রূপ দেন এবং একে একটি পরিমাণগত পর্যায়ে নিয়ে আসেন।

[৬ মাস আগে যেটুকু অনুবাদ করেছিলাম সেটুকু এখানেই শেষ হল। পরীক্ষা চলছে। শেষ হলে বাকি অনুবাদ শুরু করবো। তবে অবশ্যই আরও ভালভাবে বুঝে। মাহমুদ ভাইয়ের সহায়তায় আগের চেয়ে এবার আরও ভালভাবে বুঝবো। আশাকরি লেখার সহজবোধ্যতাও সেক্ষেত্রে বাড়বে। আর গার্টসের বক্তব্যের পাশাপাশি তার ত্রুটিগুলোও উঠে আসবে।]

[চলবে…]

< < গত পর্ব

৫ টি মন্তব্য : “ধর্মঃ একটি নৃতাত্ত্বিক অধ্যয়ন – ৩”

  1. আমিন (১৯৯৬-২০০২)

    লেখাগুলো পড়ে যাচ্ছি। দুর্ভাগ্যবশত নৃতত্ত্ব নিয়ে অনেক আগ্রহ থাকলেও পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে আলোচনায় অংশ নিতে পারলাম না। আমার মত পাঠকদের কথা চিন্তা করে অনুবাদ রিলেটেড লিংক প্রোভাইড করলে ভালো হ্ত।

    জবাব দিন
  2. জুবায়ের অর্ণব (৯৮-০৪)

    ভাল লিখেছো মুহাম্মদ। মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে জানিনা, মনে আছে কোন এক কালে ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান হালকা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তাঁর সুন্নাতে খাতনার ব্যাপারটা ভালো লাগলো। এটা দুঃখজনক যে, আমরা বেশীরভাগেরাই এই পৈচাশিক ব্যাপারটাকে কৌতুককর মনে করি, অথচ- genital mutilation is not a joke. আমি মনে করি সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মত পৃথিবীর সব দেশেই এটা রেগুলেইট হওয়া উচিত। কন্সেন্টের বয়স বা ১৮ বছর হওয়ার আগে এসব প্রস্তরযুগীয় মগজহীন যাদুটোনা সম্পুর্ণ বন্ধ করা উচিত। বিশেষ করে যেখানে এটার কোন positive outcome নেই contrary to বরাবরের মতই আমদের মুসলমানদের মনে করে নেওয়া যে, আমাদের অশিক্ষিত dark age biblical পুর্বপুরুষদের মুখনিঃসৃত আবর্জনাই সবচেয়ে উতকর্ষপুর্ণভাবে বিজ্ঞানসম্মত।

    ফ্রয়েড বোধহয় ধর্মকে একটি অবেসেসিভ উতপাত মনে করতো। এটা আমি মনে করি কিছুটা হলেও সত্যি। বিহেইভিওরাল বায়োলজি এক্ষেত্রে কিছু আলোকপাত করতে পারে। একটি পপুলেইশনের জীববিজ্ঞানগত টিকে থাকা (survival) এর জন্য নুন্যতম কিছু নীতবোধ দরকার, যেমন হত্যা বর্জনীয় ইত্যাদি। কেননা, এর অভাবে যদি একজন আরেকজনকে হত্যা করতে থাকে পপুলেইশন propagate করবে না, পপুলেইশন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই, সেই পপুলেইশনই টিকে থাকবে যা সুযোগ পেলেই হত্যা করেনা। এজন্যই দেখা যায়, যেসকল প্রজাতিতে ক্যানিবলিজম বিদ্যমান সেখানেও, মা সন্তানকে খাদ্য হসেবে গ্রহন করলেও সব মাই সব সন্তানকে খেয়ে ফেলছে না কেননা তা হলে পপুলেইশন propagate করতো না, এ কারণেই আমাদের অসভ্য যাযাবর (hunter-gatherer) পুর্বপুরুষের সমাজ মগের মুল্লুক হলেও নিজের গোত্রের একজনকে খুন করা সবসময়ই নিরুতসাহীত হয়েছে। সম্ভবত এটাই জন্ম দিয়েছে eye for an eye যা কিনা প্রথম প্রাকৃতিক আইন (natural law). মজার ব্যাপার হচ্ছে ধর্ম এখানে প্রথম এই প্রাকৃতিক আইনকে নিজের মনগড়া আইন দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে সমর্থ হয়। প্রাকৃতিক আইন যেখানে বলে "if you don't scratch my back I won't scratch back your's" ধর্ম বলে "I will scratch your back regardless if a supermassive sky-daddy wills thus." একারণেই, ধর্ম উতসাহীত করে খতনা, সতীদাহ প্রথা, উইচ হান্টিং, চুরি করলে হাত কেটে ফেলা, পাথর মেরে হত্যা ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। মোজেজ বা মুসা যে ছিলো একটা npd রোগী (narcissist personality disorder) এবং arguably একজন মানসিক প্রতিবন্ধী এক নির্দেশে হত্যা করে ৩০০০ মানুষ এ কারণে যে, তারা পুজা করেছিলো অন্য একটি ঈশ্বরের যা মুসার ঈশ্বর ছিলো এই নরপশু এবং এর পুর্বপুরুষ যে নিজের ছেলেকে জবাই করার গল্প ফাঁদে এসকল ঘৃণ্য সাইকোপ্যাথ ক্রিমিনাল কিন্তু নায়ক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে ধর্মের সুবাদে। ধর্মের প্রভাব একারণেই আমাদের নীতিগত মুল্যবোধের উপর corrosive. এবং নীতিগত মুল্যবোধ যা আপহোল্ড করে মনুষ্যত্ব একইভাবে ধর্মের উপর corrosive.

    কিন্তু, আশার ব্যাপার হলো একসময় মানুষই বুঝতে পারে যে there is no such supermassive sky-daddy to save them from themselves. বিউবনিক প্লেগ সৃষ্ট ব্ল্যাকডেথ মারে ২০০ মিলিয়ন মানুষ। কত বড় সংখ্যা এটা? আমি ১১৫৮ তম ক্যাডেট যে ২৪ তম ইনটেকের ক্যাডেট, ২০০ মিলিয়নতম ক্যাডেটটি হবে ৪০ লক্ষতম ইনটেকের একজন ক্যাডেট, বা ক্যাডেট কলেজ ৪০ লক্ষ বছর অপারেইট করলে ২০০ মিলিয়নতম ক্যাডেটটি পাওয়া যাবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষ প্রাজাতির বয়সই মাত্র ২ লক্ষ বছর। আজ থেকে ২ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে কোন মানুষ ছিলো না। যাই হোক চৌদ্দশো শতকে পশ্চীম ইউরোপে ব্ল্যাকডেথীবং এর পরপরই রেঁনেসার মধ্যপ দিয়ে ডার্কএইজের সমাপ্তির মধ্যে বোধহয় কোন যোগসুত্র না খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। শিক্ষিত শ্রেনী ১৪০০ বছর সময় নেয় অনুধাবন করতে যে এই ১৪০০ বছরে ধর্মের অর্জন ০, অশ্বডিম্ব। অনুন্যত দেশগুলোতে ধর্ম এখনও বিদ্যমান আমি বলবো শিক্ষার হারের স্বল্পতা এবং দারিদ্রের জন্য, আমি মনে করি আমাদের জীবদ্দশায়ই আমরা দেখে যেতে পারছি যে এটা মানুষকে আর প্রতারিত করতে পারছে না।

    শেষমেষ একটা কথা বলেই শেষ করি, পড়ছি ফিউরিয়ার ট্রান্সফর্ম যা দায়ী পৃথিবীর ৪০% মানুষের খাদ্যের জন্য। সার তুলে নেও খাদ্য ৪০% কমে যাবে। ব্রিটেনের ৬০ মিলিয়ন জনসংখ্যার মাত্র ২% বাদবাকী ৯৮% এর খাদ্য উতপাদন করতে পারে। না ভেবে পারিনা, কোথায় ছিলো আমাদের বিবলিকাল কোরফাদারেরা যখন তাদের জীবনের বেশীরভাগ সময়ই ব্যয় করতে হতো নিজের বাঁচে থাকার খাদ্য জোগাড় করতে? এখন আমাদের পপুলেইশনের সাইজ ৬ বিলিয়ন যা মেরু ছাড়া আর পৃথিবীর সবজাগাতেই আছে, কত ছিলো আমাদের বিকৃতরুচীর বিবলিকাল ফোরফাদারদের পপুলেইশন সাইজ? কি ব্যাবস্থা তাদের ছিলো মহামারী রোধের? আমাদের সভ্যতা মানুষের অর্জনের একটি মহীরুহ এবং মানুষের জীবন সীমিত সময়ের জন্য। আমরা একটি অসফল, কাল্পনিক চরিত্রের পুজারত কাল্টের সামষ্টিক প্যারানয়াতে ভুগে যেন এই সীমিত সময়টা নষ্ট না করি এই কামনাই রইলো।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।