আব্বস কিয়রোস্তামি: নতুন পৃথিবীর চলচ্চিত্রকার

এই লেখাটি সেন্সেস অফ সিনেমায় Mehrnaz Saeed-Vafa এর লেখার ভাবানুবাদ, তবে কিছু কথা নিজে অতিরিক্ত যোগ করেছি। কোনটা আমার আর কোনটা মেহ্‌রনাজ সাইদের সেটা উল্লেখ করার হ্যাপায় আর গেলাম না (শোনা যায় স্বয়ং এরিস্টটলও সেই হ্যাপায় যেতেন না :D)। লেখাটি প্রথমত “চলচ্চিত্র উইকি”-র জন্য। উইকির পাতায় কিয়রোস্তামির ফিল্মোগ্রাফি ও সংশ্লিষ্ট অনেক লিংক পাওয়া যাবে।

*****

আব্বস কিয়রোস্তামি (ইংরেজি: Abbas Kiarostami, ফার্সি: عباس کیارستمی, জন্ম: ২২শে জুন ১৯৪০) ইসলামী বিপ্লব (১৯৭৯) পরবর্তী ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিতর্কিত চলচ্চিত্রকার। নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত চলচ্চিত্রকারদের মধ্যেও তিনি অন্যতম, একবিংশ শতকেও অবশ্য তাকে নিয়ে কম আলোচনা হয় না। পড়াশোনা করেছিলেন তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে, সিনেমা জগতে তার পদচারণা শুরু হয়েছিল ক্রেডিট-টাইটেল ও বিজ্ঞাপন নির্মাণের মধ্য দিয়ে।

১৯৬৯ সালে ঊনত্রিশ বছর বয়সী কিয়রোস্তামি ইরানের Institute for Intellectual Development of Children and Young Adults (ইরানে যা কানুন নামে পরিচিত) এ একটি চলচ্চিত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানেই ১৯৭০ সালে তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা, ১২ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য ব্রেড অ্যান্ড অ্যালি, নির্মীত হয়। শিশুকল্যানে নিয়োজিত এই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর কাজ করাটা তার চলচ্চিত্র জীবনকে অনেক প্রভাবিত করেছে। আসলে সিনেমার প্রতি তার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিটাই কানুনের অবদান।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিয়রোস্তামির নাম প্রথম ভালমতো শোনা যায় ১৯৯০ সালে, “ক্লোজ-আপ” সিনেমার মুক্তির মধ্য দিয়ে। ১৯৯২ সালের “লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর…” তার অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করে। তবে তখনও মূলত ফরাসি চলচ্চিত্র বোদ্ধাদেরকেই তার কথা বলতে শোনা যেতো। ১৯৯২-এর সিনেমাটার জন্য কান চলচ্চিত্র উৎসবে Un Certain Regard জিতেছিলেন।

ভারতের সত্যজিৎ রায়ের মত কিয়রোস্তামি ইরানের প্রায় অনন্য ব্যক্তিত্ব নন। তিনি ১৯৬০-এর দশকে শুরু হওয়া ইরানী নবতরঙ্গ আন্দোলনেরই সৃষ্টি। বিপ্লবের আগে শুরু হলেও বিপ্লবপরবর্তী অন্য অনেক কিছুর মত সিনেমার এই নবতরঙ্গের অবক্ষয় ঘটেনি। এই আন্দোলনের পুরোধাদের মধ্যে আছেন ফারুগ ফারুখজাদ, সোহরাব শাহিদ সালেস, বাহরম বেইজই ও পারভিজ কিমিয়াভি। সালেস ইরানী সিনেমায় বাস্তবধর্মীতা নিয়ে আসেন যে কারণে তাকে ফরাসি চলচ্চিত্রকার রোবের ব্রেসোঁর সাথে তুলনা করা হয়, আর রূপকধর্মীতা এবং বাস্তবতা ও কল্পনার মিশ্রণ নিয়ে কাজ করার কারণে কিমিয়াভিকে ইরানের জঁ-লুক গদার বলা হয়।

তবে অনেক দিক দিয়ে কিয়রোস্তামি তার ইরানী সহকর্মীদের থেকে আলাদা। তিনি অন্যদের মত ডি ডব্লিউ গ্রিফিথ-দের (মার্কিন চলচ্চিত্রকার, যাকে সিনেমার গতানুগতিক ব্যাকরণের জনক বলা হয়) বেঁধে দেয়া গণ্ডির মধ্যে থাকেননি, সিনেমা বানানোর মৌলিক নিয়মটাই ভেঙে ফেলেছেন। তিনি সবকিছু ব্যাখ্যা করেন না, আসলে আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোই ব্যাখ্যা না করে সিনেমা শেষ করে দেন। এই বিষয়গুলো তখন ব্যাখ্যা করতে হয় দর্শকদেরকে। যে অংশটুকু ব্যাখ্যা করেননি সেটুকু দর্শকের কল্পনায় তৈরি হয়। নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে এক্ষেত্রে সমঝদারেরা শিল্পীর সৃষ্টিকে পূর্ণতা দেয়। যেমন, “টেস্ট অফ চেরি”-তে জনাব বাদি কেন আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা জানানো হয় না, কারণটা আমাদেরকেই ভেবে নিতে হয়।

আখ্যানধর্মী কল্পকাহিনী ও প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যবর্তী সীমারেখা নিয়েও তিনি টেস্ট অফ চেরি-তে খেলেছেন। সিনেমার শেষ দৃশ্যে, যখন জনাব বাদি তার স্বনির্মীত কবরে শুয়ে আছেন, তখন ধীরে ধীরে কিয়রোস্তামি গল্প থেকে বিদায় নিয়ে বাস্তব জগতে চলে আসেন। সিনেমাটি পেশাদার ফিল্ম-ক্যামেরায় দেখানো হচ্ছিল, কিন্তু বাস্তবের প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয় সাধারণ ভিডিও ক্যামেরায়। বাস্তব জগতে আমরা কিয়রোস্তামি ও তার ক্রুদেরকে টেস্ট অফ চেরি সিনেমার শুটিং (শেষ দৃশ্যটারই) করতে দেখি। এই পরিবর্তন দর্শকদেরকে বেশ ধাক্কা দেয়- ধাক্কা দিয়ে তাদেরকে সিনেমার প্রামাণ্য অংশটার ভেতরে ফেলে দেয়, সেখানে তারা কিয়রোস্তামির জায়গা থেকে অবাস্তব অংশটা পর্যবেক্ষণ করতে বাধ্য হয়। এরপর সম্বিত ফিরে ফেলে কিভাবে তারা অনায়াসে কল্পনা থেকে বাস্তবে গিয়ে কল্পনাটিকে পর্যবেক্ষণ করে ফেললো এবং ফিল্ম-ক্যামেরা থেকে ভিডিও-ক্যামেরায় অবস্থান্তর তাতে কতটুকু ভূমিকা রাখলো সেটা নিয়েই চিন্তিত হয়ে পড়ে। এভাবে দর্শকরা সিনেমাটির মাঝে নিজেদের উপস্থিতি টের পায়।

দর্শকদেরকে সিনেমায় উপস্থিত করানোর জন্য কিয়রোস্তামির ব্যবহার করা অন্য প্রক্রিয়াগুলোর একটি হচ্ছে অন্ধকার দৃশ্য। সিনেমার পর্দায় কোন দৃশ্য না থাকায় সেটুকু দর্শককে তৈরি করে নিতে হয়, তাকে কিছুক্ষণের জন্য চলচ্চিত্রকার হতে হয়। যেমন, “দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস” (১৯৯৯) সিনেমার অন্ধকার দৃশ্যে যখন মেয়েটি গরুর দুধ দোহাচ্ছে তখন ছেলেটি তাকে ফারুগ ফারুখজাদের কবিতা আাবৃত্তি করে শোনায়। “এবিসি আফ্রিকা” (২০০১) নামক প্রামাণ্য চিত্রে প্রায় ৭ মিনিট দৃশ্য অন্ধকার থাকে যখন কিয়রোস্তামিকে কথা বলতে শোনা যায়। এটা দেখে স্ট্যানলি কুবরিক “২০০১: আ স্পেস অডিসি”-র শুরুতে যে অন্ধকার দৃশ্য ব্যবহার করেছিলেন তার কথা মনে পড়ে যায়। দৃশ্য অন্ধকার করার মাধ্যমে একদিকে যেমন দর্শকের সংশ্লিষ্টতা বাড়ানো যায় তেমনি তাতে শব্দের সৃজনশীল ব্যবহার সম্ভব হয়। এবিসি আফ্রিকার এই অন্ধকার দৃশ্যের সবচেয়ে মারাত্মক অংশটি হচ্ছে কিয়রোস্তামির নিজের ঘরে প্রবেশ। আমরা বুঝতে পারি তিনি ঘরে ঢুকেছেন, জানালার পর্দা টেনে দিচ্ছেন কিন্তু কিছুক্ষণের জন্য কিছুই দেখা যায় না। তারপর হঠাৎ একটা বিদ্যুৎ চমকের আলোয় এক সেকেন্ড বাইরের কিছু গাছ দেখা যায়। দর্শকরা অনেকক্ষণ ধরে একটি দৃশ্যের প্রতীক্ষায় ছিল যদিও তারা জানতো না দৃশ্যটি ঠিক কি হবে, এ কারণে এটি এক ধরণের জাদুর মর্যাদা পেয়েছে।

দর্শকের সৃজনশীল অংশগ্রহন নিশ্চিত করার জন্য কিয়রোস্তামি আরও অনেক কৌশল প্রয়োগ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে “ক্লোজ-আপ”-এর কথা বলা যায়। এই সিনেমায় নাটক জমে ওঠার অনেক সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে কিছু ছোট চরিত্র (যাদের বিষয়ে দর্শকদের খুব একটা আগ্রহী হওয়ার কথা নয়) নিয়ে এসে এই স্বাভাবিক তরল নাট্যপ্রবাহ ব্যাহত করেছেন। এছাড়া সিনেমার কাহিনীটা রৈখিক নয় এবং সেখানে কল্পকাহিনী ও বাস্তবতার এমন মিশ্রন আছে যে তাদেরকে আলাদা করা যায় না। এই সবকিছুর একটা অর্থ দাঁড় করানোর দায় দর্শকের উপরই বর্তায়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষাঙ্গদের কাছে বাস্কেটবল যেমন শক্তি, জনপ্রিয়তা ও সামাজিক গতিশীলতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল, ইরানে চলচ্চিত্রেরও তেমন একটা ভূমিকা আছে যা ক্লোজ-আপে বেশ জোড় দিয়ে দেখানো হয়েছে। এই সিনেমায় চরিত্রগুলোর সাথে আমরা পরিচিত হই তাদের মিথ্যাচারিতা ও অভিনয়ের মাধ্যমে। কিয়রোস্তামি একবার বলেছিলেন, “সত্যে পৌঁছানোর সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ হচ্ছে মিথ্যা”। ক্লোজ-আপে এর মাধ্যমে তিনি মিডিয়ার মিথ্যাচারিতারও সমালোচনা করেছেন।

ক্লোজ-আপে কিয়রোস্তামির সিনেমার অনেক বৈশিষ্ট্যের ছাপ আছে। যেমন, এর মুখ্য চরিত্র নিষ্পাপ কিন্তু দোষী, অবশ্য “ট্র্যাভেলার” (১৯৭৪) ও “দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস”-এর চরিত্রের মত সে সহানুভূতিহীন নয়। কিয়রোস্তামির সিনেমা আত্মসচেতন, বিভিন্ন সময় তিনি নিজের উপস্থিতি জানান দেন। ক্লোজ-আপের শুরুতে তিনি আসামীর সাক্ষাৎকার নেন, আর শেষে নিজের ক্রুদের সাথে তাকে কথা বলতে দেখা যায়। “হোমওয়ার্ক” (১৯৯০) এ তিনি নিজে শিশুদের সাক্ষাৎকার নেন, আর “কেইস ওয়ান অ্যান্ড কেইস টু” (১৯৭৯) তে কথা বলেন কয়েকজন সাংস্কৃতিক কর্মকর্তার সঙ্গে। “থ্রু দি অলিভ ট্রিস”, “লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর” এবং “দি উইন্ড উইল ক্যারি আস” এ কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে হলেও তার উপস্থিতি আছে। এরকম আাত্মসচেতন সিনেমা এক ঢিলে দুই পাখি মারে- এর মাধ্যমে একদিকে তিনি চলচ্চিত্রকার হিসেবে নিজের অবস্থানের সমালোচনা করেন, এবং অন্যদিকে এটা দর্শকদেরকে আরও সচেতন করার মাধ্যমে তার ভার (বা সিনেমা বানিয়ে তিনি যে দোষ করেছেন তা) কিছুটা লাঘব করে। এই দুই প্রক্রিয়ার যৌথ প্রযোজনায় তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে বিনয়ী, পরিশীলিত, ও দার্শনিক সিনেমাগুলো নির্মাণ করেছেন।

যেকোন দৃশ্যের গড়ন বা কাঠামো যে কৌতুকরস বা এমনকি কাব্যরস তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে তা কিয়রোস্তামি খুব ভাল করে জানেন। আপাতদৃষ্টিতে খুব ঘটনাবিরল একটি দৃশ্যের শুটিং বিশেষ কোন গড়নে করলে তাতে হাসির খোরাক পাওয়া যায়। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাক তাতির সিনেমা। তাতির “প্লেটাইম” (১৯৬৭) এর মতোই কিয়রোস্তামির খুব মজার একটি সিনেমা হচ্ছে স্বল্পদৈর্ঘ্য “অর্ডারলি অর ডিসঅর্ডারলি” (১৯৮১)। দৃশ্যের গঠনপ্রক্রিয়া, শব্দসংযোগ এবং পটভূমিতে পরিচালকের নিজের ধারাবর্ণনা এতে রসাত্মক উপাদান যোগ করেছে। যেমন কিছুটা উপর থেকে দূরে স্কুলের আঙিনায় শিশুদের পানি খাওয়া বা বাসে ওঠার জন্য সারিবদ্ধ হওয়া দেখানো, তেহরানের রাস্তায় এক ধৈর্য্যহীন চালকের কারণে সৃষ্ট যানজট। এগুলো জনবহুল স্থানে শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলার মাঝে অন্তর্নিহিত কৌতুকরসটি ফুটিয়ে তোলে।

তবে দৃশ্যের গঠনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সিনেমার চরিত্রগুলোর অবস্থা তুলে ধরায় কিয়রোস্তামি অনন্য। এক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আঁকাবাকা পথ বা যেকোন বস্তুর আঁকাবাকা ও দৈব গতি। আঁকাবাকা পথের উদাহরণ অনেক। “হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড্‌স হোম?” এ আঁকাবাকা পথ বোঝায়- বন্ধুকে খুঁজে পেতে শিশুটিকে কত বাঁক নিতে হবে। এরকম তার অধিকাংশ সিনেমাতেই মুখ্য চরিত্রের গন্তব্য বা উদ্দেশ্য খুব দুর্গম বা দুর্লভ থাকে, যে কারণে দৃশ্যের গড়নের মাধ্যমে তাদের বেগতিক দশা আরও প্রকট করে তোলা যায়। টেস্ট অফ চেরিতে লোকটি আত্মহত্যার পর তাকে কবর দিতে রাজি হবে এমন কাউকে খুঁজছে, “তাই” সে গাড়িও চালাচ্ছে তেহরানের আশপাশের বন্ধুর পাহাড়ী পথে। “লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর…”-এ পরিচালকটি ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত গ্রামাঞ্চলে তার আগের সিনেমায় অভিনয় করেছে এমন দুটি শিশুকে খুঁজছে। “দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস”-এ একটি আপেল এবং ক্লোজ-আপে একটি খালি পানীয়-র ক্যান-কে লক্ষ্যহীনভাবে গড়িয়ে যেতে দেখা যায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে শুনতে এ দৃশ্য দুটিকে খুব তুচ্ছ মনে হলেও আসলে একবার দেখার পর কেউ এই আপেল ও ক্যানের কথা ভুলতে পারবে না। এমনকি দৃশ্যটি দেখার সময় অনেকে আশা করতে শুরু করেন যে এদের একটা গন্তব্য জুটবে। এসব দৃশ্যই কিয়রোস্তামির প্রধান স্বাক্ষর।

কিয়রোস্তামির “হোয়ার ইজ দ্য ফ্রেন্ড্‌স হোম?”, “থ্রু দি অলিভ ট্রিস” এবং “লাইফ অ্যান্ড নাথিং মোর…” কে বর্তমানে “কোকের ট্রিলজি” হিসেবে অভিহিত করা হয় কারণ এই তিনটিরই পটভূমি কোকের গ্রাম। এগুলোতে স্থাপত্য ও প্রাকৃতিক দৃশ্যের উপর অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন যা তার দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। প্রকৃতিতে সৌন্দর্য্য কতটুকু আছে তার কাছে সেটার চেয়েও মুখ্য হচ্ছে আমরা সেই সৌন্দর্য্যের দিকে কতটুকু নজর দিচ্ছি। অন্তত তার মুখ্য চরিত্রগুলো সেই সৌন্দর্য্য খেয়াল করে না। ফ্রেন্ড্‌স হোম-এ বিধ্বস্ত গ্রামের পটভূমিতে সুন্দর সুন্দর গাছ, নাথিং মোর-এ দূর থেকে দেখানো ফাটল ধরা রাস্তা, ও ক্যারি আস-এ গম খেতের দৃশ্য এগুলো মূল চরিত্রগুলোর নজরে আসে না, এবং দর্শকরা সেটাও বুঝতে পারে।

ডিজিটাল ক্যামেরা কাজে লাগিয়ে সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সংখ্যক ক্রু নিয়ে কিয়রোস্তামি “এবিসি আফ্রিকা” বানিয়েছেন। জাতিসংঘের অনুরোধে তিনি উগান্ডা গিয়েছিলেন এইডস আক্রান্ত শিশু এবং তাদের উদ্ধারকল্পে দেশটির নারী সংগঠনের কার্যক্রমের উপর একটি প্রামাণ্য চিত্র বানাতে। এটাই ইরানের বাইরে তার প্রথম সিনেমা। এর মাধ্যমে তার নতুন ধরণের সিনেমা সৃষ্টির সংকল্প আরও স্পষ্ট হয়েছে। তিনি ডিজিটাল ক্যামেরাকে কলমের সাথে তুলনা করেছেন। আগে যেখানে বিশালকায় ফিল্ম-ক্যামেরা নির্মাতা ও চরিত্রের মাঝে দেয়াল তুলে দিতো এখন সেখানে ডিজিটাল ক্যামেরা চরিত্রগুলোকে আরও স্বতঃস্ফূর্ত করে। লেখককে যেমন কলমের গুণাগুণ নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হয় না এখানে তেমনি পরিচালককে ক্যামেরার দোষ-গুণ নিয়ে না ভাবলেও চলে, লেখকের কলম থেকে বের হওয়া চরিত্র যেমন কলমের উপস্থিতি টের পায় না তেমনি হয়তো চরিত্রকে ক্যামেরার উপস্থিতি টের পেতে না দিয়ে একদিন সিনেমা বানানো সম্ভব হবে।

এবিসি আফ্রিকাতে শক্তিশালী নারী চরিত্র দেখা যায় যা তার আগের কোন সিনেমাতেই ছিল না। হয়তো এবিসি আফ্রিকার মাধ্যমে কিয়রোস্তামি নারী চরিত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। পরবর্তীতে ক্যারি আস, “টেন” (২০০২), ইতালি ও ফ্রান্সে নির্মীত “সার্টিফাইড কপি” (২০১০) এবং জাপানে নির্মীত “লাইক সামওয়ান ইন লাভ” (২০১২) এ গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী নারী চরিত্র ছিল। টেন এর কাহিনী মূলত নারী চরিত্রদের কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। এতে আমরা দেখি, একটি শিশুও পুরুষ-প্রধান সমাজের সার্টিফিকেট পেয়ে মা-কে (নারী হিসেবে) অবমাননা করতে শিখে যায়। সার্টিফাইড কপি-তে ভালবাসা, প্রেম বা প্রণয়ের অধিবিদ্যাগত (মেটাফিজিক্যাল) অর্থ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন যা নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে সম্ভবত তার প্রথম পরীক্ষণ।

কিয়রোস্তামির সিনেমা একটি নতুন যুগের ভবিষ্যদ্বাণী, যে যুগে প্রবেশ চলচ্চিত্রের প্রাপ্য অধিকার। সিনেমা এখনও খুব চটকদার, এখনও চলচ্চিত্র মানে লাল গালিচা, কোটি টাকা, স্বপ্নের চাকা। কিয়রোস্তামি চেয়েছেন একটা বিকল্প তৈরি করতে, সঙ্গীত, কবিতা, চিত্রশিল্প বা সাহিত্যে যে বিকল্প অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। বিকল্প সিনেমাও অবশ্য অনেকে তৈরির চেষ্টা করেছেন, এখনও অনেকে করছেন, কিন্তু কিয়রোস্তামির বিকল্পটা সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তার সিনেমা একেবারে স্টেরিওটাইপ বর্জিত। ইরানের দুর্গম গ্রামাঞ্চলের দৃশ্য দেখলেও আমাদের কাছে কোন চরিত্রকে অপরিচিত বা টিপিক্যাল মনে হয় না। বাঙালি বলে বিশ্বের অন্য সবার থেকে আমি আলাদা, বা ইরানী বলে সে আমার চেয়ে অনেক ব্যতিক্রম- নিজের এরকম একটা অনন্য সংজ্ঞা তৈরি করার যে চিরন্তন প্রয়াস কিয়রোস্তামির সিনেমা তাতে আঘাত করে। এদিক থেকে তার সিনেমা সত্যিকার অর্থেই একবিংশ শতকের, বা হয়তো ত্রয়োবিংশ শতকের।

৭ টি মন্তব্য : “আব্বস কিয়রোস্তামি: নতুন পৃথিবীর চলচ্চিত্রকার”

  1. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    ভাই ধন্যবাদ নেন এমন সুন্দর একটা লেখার জন্য, প্রথমেই বলছি এই লেখাটার পেছনে যে প্রচুর পরিশ্রম আছে সেটা লেখা পড়লেই বোঝা যায়।
    অনেক কিছু জানতে পারলাম। ইরানী চলচিত্র আসলে খুব ভালো করছে, সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও।


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    হুশ হুশ করে ভেপু বাজিয়ে ট্রেনটি চলে গেলো
    আকাশের গায়ে সাজিয়ে দিয়ে নতুন মেঘ...

    লেখা খুব ভালো হইছে।

    ইচ্ছা কইরা প্রকাশের সাথে সাথে পড়ি নাই। একটু সময় নিলাম।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  3. রায়হান

    আব্বাসের ছবির কাহিনী অনন্য । প্রকৃতির ছোঁয়া থাকে । সম্পূর্ণ আলাদা চোখ । আজকে shirin দেখলাম । অন্যরকম নিঃসন্দেহে । তবে তার অনেক দর্শন আমার বেশ ভাল লাগে । তার সাক্ষাৎকারগুলি পড়তেও বেশ লাগে । অনেক আগে আপনি তার একটা সাক্ষাৎকার অনুবাদ করেছিলেন । সেটাও সুন্দর ছিল ।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাব্বী (৯২-৯৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।