পোতাশ্রয়ের নির্বাক কমেডি

একটিবার চার্লি চ্যাপলিনদের যুগে ফিরে যাওয়া যাক। সেটা নিঃসন্দেহে নির্বাক কমেডির স্বর্ণযুগ। মুখের কথা ছাড়া কেবল অঙ্গভঙ্গি আর চলচ্ছবির মাধ্যমে যখন চলচ্চিত্রকাররা সমাজকে বিদ্রুপ করতেন আর মানুষের অন্তরকে ভালবাসতেন। ২০১১ সালের একটি সিনেমায় ঠিক তেমন বিদ্রুপ আর ভালোবাসার ছবি দেখতে পেলাম। সিনেমার নাম ল্য আভ্র্ (Le Havre), পরিচালনা করেছেন ফিনল্যান্ডের ওটার চলচ্চিত্রকার আকি কাউরিসম্যাকি। আকি-র নাম যদি আগে কেউ শুনে না থাকেন, তাহলে এটাই শোনার সর্বোত্তম সময়, কারণ এই সিনেমার মাধ্যমে তার সাথে পরিচিত হওয়াটা সবার জন্যই অন্যরকম এক অভিজ্ঞতা হবে।

ল্য আভ্র আসলে ফ্রান্সের উত্তর উপকূলের একটি ছোট বন্দর ও শিল্প নগরীর নাম, যেখান থেকে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় লন্ডন। এমন শহরগুলোর রঙ্গমঞ্চে বর্তমানে অতি সাধারণ একটি নাটক হচ্ছে অনুন্নত দেশগুলো থেকে অবৈধ অভিবাসী ও শরণার্থীদের আগমন, তবে এখানে থাকার জন্য নয়, লন্ডনের মত বড় বড় ইউরোপীয় শহরগুলোতে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে। এখানকার সমুদ্রের তীরে যে সারি সারি কার্গো কন্টেইনার রাখা সেখান থেকে কখনো কখনো শিশুর আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। তেমনি একটি আর্তনাদের মাধ্যমেই বলতে গেলে আমাদের লা আভ্র সিনেমার কাহিনী শুরু হয়। রাতে শিশুর কান্না শুনে গার্ড পুলিশকে খবর দেয়। সকাল বেলা ইনস্পেক্টরের নেতৃত্বে একদল পুলিশের সামনে কন্টেইনারটি খোলা হয়, ভেতরে দেখা যায় কয়েকটি আফ্রিকান পরিবার নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। এক অতি কৃষ্ণকায় বৃদ্ধের ইশারায় একটি কিশোর উঠে দৌঁড় দেয়, পুলিশের অনেকটা সামনে দিয়েই নির্বাক কমেডির মত পালিয়ে যায়।

অন্যদিকে আমরা দেখতে পাই এক সামান্য মুচি, তার জুতা সেলাই ও পালিশের সামগ্রী নিয়ে লা আভ্রের রাস্তায় হেঁটে বেড়ায়, কখনো কখনো প্রতিকূল সমাজের হাতে বঞ্চনার শিকার হয়। নিষ্ঠুর ও অসৎ সমাজ কিভাবে সরল মনের সৎ মানুষদের অতি সাধারণ স্বপ ভঙ্গ করে সিনেমাটিতে তাই দেখানো হয়েছে। মার্সেল মার্ক্স নাম্নী এই মুচির স্ত্রী আছে। নিম্নবিত্তের সংসার জীবনকেও বেশ কমেডি করে ফুটিয়ে তুলেছেন কাউরিসম্যাকি। মার্সেল তার স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালবাসেন, স্ত্রীও স্বামীর প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্ত। মার্সেল দিনের পর দিন আশপাশের মুদি দোকান থেকে ধার করে খাবার কিনেন। অনেক কষ্টে কিছু টাকা জমানোর চেষ্টা করেন দুজন মিলে। দোকানদারদের কেউ কেউ মার্সেলকে আসতে দেখলে দোকান বন্ধ করে দিয়ে বলে, ‘আমি দোতলায়, দোকানে নেই’ যদিও অর্ধনমিত দরজার ফাঁক দিয়ে তার পা দেখা যায়। তারপরও প্রতিবেশী সবাই মার্সেলকে খুব ভালবাসে। লক্ষ্য করুন স্বামী স্ত্রীর শেষ নাম- মার্ক্স- দিয়েই বোঝা যায় তারা প্রোলেতারিয়েত। এই প্রোলেতারিয়েতদের বন্ধু কেবল প্রোলেতারিয়েতরাই, সমাজ এবং সমাজের পুলিশের প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই।

ভাগ্যের আবর্তে কন্টেইনার ঘটনার দিনই মার্সেলের সাথে দেখা হয়ে যায় কিশোর আফ্রিকান অভিবাসী ছেলেটির। পোতাশ্রয়ের কাছে একটি সিঁড়িতে বসে দুপুড়ের খাবার খাচ্ছিল মার্সেল। এমন সময় বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে নির্ভরতার চোখে তার দিকে তাকায় কিশোরটি। কিশোরের জন্য খাবার রেখে এসেছিল মার্সেল। পরদিন গিয়ে দেখে সে খাবার নেই। এভাবেই তাদের পরিচয়। মার্সেলের কুকুর সিনেমার ক্রেডিটে যার নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল তাকে অনুসরণ করেই ছেলেটি অবশেষে মার্সেলের ঘরে পৌঁছায়। যদিও মার্সেলের নিঃসন্তান স্ত্রী ততোদিনে হাসপাতালে চলে গেছেন। কিশোরটির প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ অনুভব করে মার্সেল। শুরু হয় তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য মার্সেলের সংগ্রাম এবং তার প্রতিবেশীদের দায়িত্ব পালন। এটা করার জন্য মার্সেল কতোটা পথ পেরিয়েছেন তাই সিনেমাটির মানবতাবোধের সাক্ষ্য বহন করে। ইনস্পেক্টরকেও এখানে এক মজার ভূমিকায় দেখতে পাই আমরা- কি ভূমিকা সেটা না হয় নাই বললাম।

কাউরিসম্যাকিকে চার্লি চ্যাপলিন, জঁ রেনোয়ার এবং জাক তাতি দের গভীর মানবতাবাদী কমেডি ঘরানার উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে। তাদের মতোই কাউরিসম্যাকি মানুষের দুর্দশা ও দুঃখবোধকে মেলোড্রামার মত তীব্র আবেগ বা হতাশার সাথে তুলে ধরেন না। আমরা ইতিমধ্যেই নিম্নবিত্ত মানব জীবনের দুর্দশার সাথে খুব ভালভাবে পরিচিত। তাই তার সাথে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার বদলে কাউরিসম্যাকি দেখান যে এই দুর্দশারও বিনয়ী মায়া এবং ক্ষণস্থায়ী সৌন্দর্য্য আছে, দেখান কিভাবে চূড়ান্ত দুর্দশার সামনে দাঁড়িয়েও ভদ্র ব্যবহার করা যায়।

সিনেমাটি একই সাথে ফ্রান্সের প্রতি ফিনিশ কাউরিসম্যাকির একটি প্রেমপত্র। তবে গোটা ফ্রান্সের প্রতি নয়। বিশেষ করে একটি অর্ধকল্পিত ও অর্ধবিলুপ্ত প্রোলেতারীয় ফ্রান্সের প্রতি, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ফ্রান্সের জনপ্রিয় সঙ্গীত ঘরানার প্রতি। এমনকি মার্সেলের স্ত্রীর নাম রেখেছেন আরলেতি- ১৯৩০ ও ৪০-এর দশকের শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিনিধি বিখ্যাত অভিনেত্রী ও গায়িকার নামে। নুভেল ভাগ তথা ফরাসি নবতরঙ্গের সাথে পরিচিতরা এতে দেখতে পাবেন জঁ-পিয়ের লেউ তথা ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর “লে কাত্র সঁ কু” (The 400 Blows, ১৯৫৯) সিনেমার সেই কিশোরকে।

কাউরিসম্যাকিকে আবার মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণার প্রতি অনুরক্ত হিসেবেও আখ্যায়িত করা যায়। তিনি পুরনোকে ভালবাসেন, পুরনোকে অস্বীকার করতে চান না। ল্য আভ্রে দেখা যায়, পুরনো দিনের ভিনাইল রেকর্ডে গান শোনা, সেলুলয়েড ফিল্ম, দুষ্প্রাপ্য পুরনো পোশাক এবং অনেক পুরনো মডলের নতুন জিনিস। একমাত্র যে মানুষটিকে এখানে আধুনিক মুঠোফোন ব্যবহার করতে দেখা গেছে সে খারাপ লোক।

মার্সেল ও আফ্রিকার গ্যাবন থেকে আসা এই কিশোরের অ্যাডভেঞ্চার, আরলেতির পরিণতি, ইনস্পেক্টরের অভিসন্ধি, বড় বড় চোখের প্রচণ্ড বিনয়ী ও স্মার্ট কিশোরটির গন্তব্য কিছুই আর বলতে চাই না আমি। সিনেমাটি রয়েছে কিসের জন্য? তবে এটুকু বলতে পারি, এর মধ্যে শিশুতোষ সিনেমার একটা আবহও আছে। শিশুতোষ সিনেমার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটু পরপর আশ্বাসের বাণী শোনানো, কারণ বড়দের মত শিশুদেরকে বেশিক্ষণ ভয়ের মধ্যে রাখতে বারণ। কাউরিসম্যাকি ল্য আভ্রতে এই কাজটি যেমন করেছেন তেমনি আবার একধরণের নির্বিকার (ডেডপ্যান) কমেডির মাধ্যমে অতি-আবেগ ও মেলোড্রামাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখেছেন।

তাছাড়া মার্সেলের একটি ভাল কাজ করার দুর্দান্ত চেষ্টাকে এমনভাবে দেখানো হয়েছে যাতে মনে হয় এটা কোন বড় পুরস্কারের যোগ্য নয়। পুরস্কারের জন্য কেউ এমন কাজ করে না, এমন কাজ করে কেউ পুরস্কৃতও হয়, খুব বেশি হলে হয়ত একটু তিরস্কার জোটে। তবে ২০১১-র অন্যতম সেরা এই সিনেমা যেকোন দর্শকের জন্যই একটি পুরস্কার। কান চলচ্চিত্র উৎসবে FIPRESCI প্রাইজ পাওয়া এই সিনেমাটি না দেখে থাকলে ২০১১ সালটা কেউ সফলভাবে কাটাতে পেরেছেন বলব না আমি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
এ ও স্কট, দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
রজার ইবার্ট, শিকাগো সান-টাইমস

ইংরেজি সাবটাইটেলসহ ট্রেইলার:

১,৬৯৫ বার দেখা হয়েছে

৬ টি মন্তব্য : “পোতাশ্রয়ের নির্বাক কমেডি”

  1. নাজমুল (০২-০৮)

    অসাধারণ ব্লগ মুহাম্মদ ভাই। :boss: :boss:
    খোলা ব্লগে ডাউনলোড লীংক চাইলাম না, ফেবুতে মেসেজ দিলাম।
    সাবটাইটেল সহ ডাউনলোড লীঙ্ক দিলে জনাবের নিকট বাধিত থাকতাম। 😀

    জবাব দিন
  2. রাব্বী (৯২-৯৮)

    আজ দেখলাম। আমার খুব ভাল লেগেছে। কাউরিসম্যাকির কাজের প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো। অভিবাসনের এই চিত্র সম্ভবত ইউরোপের, নিশ্চিতভাবে উত্তর আমেরিকায় অন্যরকম। তোমার রিভিউ লেখাটা সিনেমাটার মতোই।


    আমার বন্ধুয়া বিহনে

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।