টু বি অর নট টু বি

টারান্টিনোর উপর ক্লাসিক সিনেমার প্রভাব সবচেয়ে বেশি বোঝা যায় তার ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস থেকে। বাস্টার্ডসে হলিউড এবং জার্মান ক্লাসিকের প্রচুর রেফারেন্স আছে। তবে “টু বি অর নট টু বি”-এর সাথে সাদৃশ্যকে কেবল প্রভাব বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। বলা যায় ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডসের শেষ দৃশ্য অনেকটাই টু বি অর নট টু বি থেকে অনুপ্রাণিত। আমার লেখার উদ্দেশ্য ১৯৪২ সালের এই ক্লাসিক সিনেমাটিই। কিন্তু টারান্টিনো দিয়ে শুরু করলাম কারণ, এতে একটি ঐতিহাসিক রূপরেখা টানা যায়, ক্লাসিকের প্রভাব এতে আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠে।

কোত্থেকে উড়ে এসে ওয়ারসর রাস্তায় জুড়ে বসেছে একা হিটলার

আর্নস্ট লুবিচের জন্ম জার্মানিতে, বের্লিনেই থাকতেন। ইহুদি হওয়ায় যথারীতি বেশিদিন এখানে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। পাশাপাশি হলিউডে উন্নত ক্যারিয়ারের হাতছানিও ছিল। এভাবেই লুবিচ হলিউডের স্বর্ণযুগের অন্যতম চলচ্চিত্রকারে পরিণত হন। এতোটাই যশ লাভ করেন যে তার সিনেমাগুলোতে বিশেষ একটি ছোঁয়া আছে বলে লোকে জেনে যায়, যাকে বলা হয় লুবিচ টাচ। তার ১৯৪২ সালের এই সিনেমাটিতে লুবিচ টাচ লক্ষ্য করা যায় প্রতি মুহূর্তেই।

আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়ার কিছুদিন আগে সিনেমাটি মুক্তি পায়। বিষয়বস্তু হিটলারের পোল্যান্ড দখল। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস-তে প্রায় পুরো কাহিনী, শুরু এবং শেষের কিছু অংশ লন্ডনে। হিটলার কিভাবে ওয়ারস-তে আসলেন তার ব্যঙ্গাত্মক ব্যাখ্যাটিই সিনেমার অন্যতম সেরা রম্য দৃশ্য। হঠাৎ দেখা যায়, ওয়ারস-র রাস্তা ঘাটে সব মানুষ কাজ ফেলে কিছু একটা অপলক নেত্রে দেখছে, অগ্রসরও হচ্ছে সেদিকে। ক্যামেরা মুভ করলে পর বোঝা যায়, তারা দেখছে হিটলারকে। জার্মানি এবং পোল্যান্ডের মধ্যে যখন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিক সেই সময় হঠাৎ হিটলার কিভাবে উড়ে এসে একেবারে রাজধানীর মধ্যস্থলে জুড়ে বসল সে এক রহস্য। তাও আবার সে সম্পূর্ণ একা। একটু পরেই রহস্য উন্মোচিত হয়:

পাশের একটি থিয়েটারে পরিচালক হিটলার বিরোধী একটি মঞ্চ নাটকের মহড়া করছেন। তিনি যতোই নাটকটিকে সিরিয়াস করার চেষ্টা করেন তার অভিনেতারা ততোই “টেরিফিক লাফ”-এর সূত্র খুঁজতে থাকে। হিটলারের ভূমিকা যেহেতু খুব কম সেহেতু তার চরিত্রে একজন সাধারণ অভিনেতা অভিনয় করছেন। পরিচালক বলেন, তার মেকআপ হিটলারের মত হয়নি। সবাই বলে আলবৎ হিটলারের মত হয়েছে। অবশেষে, পরিচালককে কনভিন্স করতে সে ওয়ারস-র রাস্তায় বেরিয়ে যায়, দেখাতে চায় আসলেই লোকজন তাকে হিটলার ভেবে ভুল করে কিনা।

যাহোক অবশেষে পোলীয় সরকারের আদেশে তাদের নাটক প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়। কারণ সরকার মনে করছে, এতে হিটলার রেগে যাবে। এই আদেশ আসতে না আসতেই সত্যি সত্যি হিটলার বাহিনী কোন পূর্বাভাস না দিয়ে পঙ্গপালের মত পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ শুরু করে। অধিকৃত হয় ওয়ারস। যে থিয়েটার দিয়ে সিনেমা শুরু হয়েছিল সেখানটাই সিনেমার মূল নাট্যমঞ্চ। থিয়েটারের সবাই যোগ দেয় ওয়ারস-র হিটলার বিরোধী আন্ডারগ্রাউন্ড আন্দোলনে। এর সাথে জড়িয়ে যায় পোলীয় বিমান বাহিনীর এক লেফটেন্যান্ট, “স্তানিসলাভ সোবিনস্কি”।

মৃত্যুর জন্য প্রায় প্রস্তুত হিটলার ও তার সাঙ্গপাঙ্গ

থিয়েটারের প্রধান অভিনেত্রী “মারিয়া তুরা”, হ্যামলেট চরিত্রে সব সময় অভিনয় করে তার স্বামী “জোসেফ তুরা”। মারিয়ার অভিনয় দেখে সোবিনস্কি তার প্রেমে পড়ে যায়। প্রথমে কয়েকদিন বেনামী ফুলের তোড়া পাঠানোর পর, একদিন মারিয়ার সাথে তার ড্রেসিং রুমে সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয় তার। মারিয়া শিখিয়ে দেয়, জোসেফ যখন মঞ্চে গিয়ে হ্যামলেটের দীর্ঘ্য পাট বলা শুরু করবে তখনই যেন সে উঠে আসে। হ্যামলেটের কথা শুরু হয় “টু বি অর নট টু বি” দিয়ে। প্রতিবার জোসেফ যখনই টু বি অর নট টু বি বলে তখনই তার চোখের সামনে দিয়ে সোবিনস্কি উঠে যায়, ড্রেসিং রুমে তার বউয়ের সাথে আড্ডা দিতে।

একদিন সোবিনস্কি মারিয়াকে বলে, সে তার স্বামীর সাথে কথা বলে সব ঠিক করবে। সে তার স্বামীকে ছেড়ে তার কাছে চলে আসবে, মঞ্চ ছেড়ে ঘর-সংসার করবে। মারিয়া যতোই বোঝানোর চেষ্টা করে সে ততই বলে যায়। এদিকে তার স্বামীর হ্যামলেট শেষ হয়ে আসছে। এমন সময়ই পত্রিকার খবর আসে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সোবিনস্কি বিদায় নিয়ে চলে যায় ইংল্যান্ডে। মিত্র বাহিনীর সাথে মিলে যুদ্ধ শুরু করে নরঘাতক হিটলারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাকে আবার ফিরে আসতে হয় ওয়ারস-তে, এক পোলীয়র সন্ধানে যে হিটলারের স্পাই হিসেবে কাজ করছে। সে প্রথমেই আসে থিয়েটারে। থিয়েটারের আন্ডারগ্রাউন্ড গোষ্ঠীটির সাথে মিলে শুরু হয় তাদের হিটলার বিরোধী অভিযান।

স্পাইয়ের সাথে মারিয়া তুরা

সিনেমার ব্যঙ্গাত্মক আবহটি খুবই উপভোগ্য। হিটলারের কিছু তথাকথিত সদগুণ নিয়ে এমন ব্যঙ্গ করা হয় যে কারোই বুঝতে বাকি থাকে না, ব্যক্তিগত চরিত্রের হাজারটা দোষ ত্রুটিও অন্য একজন মানুষের ক্ষতি করার সাথে তুলনীয় হতে পারে না। হিটলার মদ খায় না, ধূমপানও করে না, তার কথায় নাকি সৈন্যরা পিপিলিকার মত অগ্নিকূণ্ডে ঝাপিয়ে পড়ে। শেষ দৃশ্যে এই পিপিলিকা অ্যালিগরির ব্যবহার অতুলনীয়। মিশন সফল করে জোসেফ, মারিয়া, সোবিনস্কি ও অন্যরা একটি জার্মান বিমান ছিনতাই করে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা করে। বিমানের একমাত্র জার্মান আরোহী হচ্ছে চালক দুইজন। এদিকে তাদের মধ্যে হিটলার চরিত্রে যে অভিনয় করছিল সেও আছে, দেখতে হুবহু হিটলারের মত। জার্মান বৈমানিক দুজন মনে করে তারা হিটলারকে নিয়েই যাচ্ছে। একজন ককপিটে গিয়ে তাদের বলে তোমাদের ফুয়েরার ডাকছেন, যাও, এর মধ্যে আমরা চালাচ্ছি। তারা পেছনে এলে পর ছদ্মবেশী হিটলার বিমানের জানালা খুলে বলে, ঝাঁপ দাও। কোন বাক্যবয় না করে তারা হুকুম মান্য করে, হাইল হিটলার বলে ঝাঁপ দেয়। আমাদের হিটলার বলে, “Two very obliging fellows… Now let’s go to England.”

সোবিনস্কি এবং জোসেফ বিদায় নিচ্ছে মারিয়ার কাছ থেকে। মারিয়া জোসেফকে বলে: "তুমি যদি ফিরে না আসো", উত্তরে জোসেফ বলে, "তবে সোবিনস্কিও ফিরে আসবে না।"

সিনেমার শেষের দিকে হিটলার ও তার সব সাঙ্গপাঙ্গকে হত্যার দৃশ্য থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছে টারান্টিনো। এখানেও একটি বিকল্প ব্যঙ্গাত্মক ইতিহাস দেখানো হয়েছে। হিটলার দলবল নিয়ে ওয়ারসতে একটি নাটক দেখতে এসেছে। থিয়েটারের এই আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মীরা পুরো থিয়েটার উড়িয়ে দিয়ে তাদের মিশন সফল করে। সফল করার আগে তাদের পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটিও ক্লাসিক।

তবে টারান্টিনোর সাথে লুবিচের পার্থক্যটি লক্ষ্য করার মত। টারান্টিনোর সিনেমায় কোন জয়জয়কার দেখা যায় না। বিজয়ী পক্ষ আনন্দ উদযাপন করে না বরং যুদ্ধের বিভীষিকায় হারিয়ে যায়। তাদের অনেকেও মারা যায়। সেদিক থেকে লুবিচের সিনেমায় মিত্র পক্ষকে সজীব রাখার মাধ্যমে এক ধরণের এন্টি-প্রোপাগান্ডার প্রতিষ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। ১৯৪২ সালে মুক্তি পেয়েছিল, এটা মনে রাখলে এই প্রতিষ্ঠাকে পুরোপুরিই জাস্টিফাইড মনে হয়। ওয়ার কমেডির ইতিহাসে সিনেমাটি অনন্য এবং সে কারণে দীর্ঘায়ু লাভ করবে বলে আশা করা যায়। অনেক ওয়ার কমেডির মধ্যেই যে ডার্ক সাইড থাকে তার অভাব আছে এতে, লুবিচের স্বকীয় যে চলচ্চিত্রায়ান তাতে কুবরিকের ব্ল্যাক কমেডির কোন উপাদান নেই। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণেই আছে অজস্র হাসির খোরাক। পুরো সিনেমাটিই হিলারিয়াস।

সিনেমার একটি কমিক দৃশ্য…

পুরো সিনেমা দেখা যাবে এখান থেকে: ফ্রি স্ট্রিমিং

১,৯১৪ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “টু বি অর নট টু বি”

  1. আন্দালিব (৯৬-০২)

    কী সৌভাগ্য! আজ কার মুখ দেখে সকালে ঘুম থেকে উঠেছিলাম, মুহাম্মদের লেখা পড়তে পেলাম, তাও একদম তরতাজা!! 😀

    লেখাটা একটু সাদামাটা হয়েছে, মনে হয় অনেকদিন লেখো না বলে (?)। তবে এই ছবিটা দেখি নাই, তাই জেনে ভালো লাগলো। বাস্টার্ডস দেখে অনেকদিন শেষদৃশ্য আর প্রথম দৃশ্য মাথায় ঘুরেছে। পুরো ছবির আর বাকি অংশ এই দুটো দৃশ্যের আলোয় ম্লান হয়ে যায়! এই ছবিটাও দেখতে হবে। পাইপলাইনে ফেললাম।

    তারপর খবরটবর কী তোমার?? কেমনাছো? 🙂

    জবাব দিন
  2. রকিব (০১-০৭)

    মুহাম্মদ ভাই!!!!
    ৪-৫ বার রিফ্রেশ দিয়ে নিশ্চিত করলাম; হ্যাঁ আপনার নামই তো দেখায়!!!
    সিনেমা সংক্রান্ত কমেন্ট কালকে সিনেমা শেষ করে দিবো।
    কেমন চলে প্রবাস জীবন?


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : ফয়েজ (৮৭-৯৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।