“বাংলাদেশ: আশায় নতুন জীবনের বসতি” প্রসঙ্গে

১৯৭০ সালে সমগ্র পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন হল। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানীরা ক্ষমতা হস্তান্তর করল না। দেশের উপর দিয়ে এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেল, শোষকেরা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মার্চের শুরু থেকেই জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের নামে টালবাহানা শুরু করল। অবশেষে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে মুক্তির শপথ নিলেন। তার সাথে আপামর জনতা কণ্ঠ মেলাল। কোটি মানুষের এই কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য কুৎসিত ঘড়যন্ত্র আঁটল হানাদারেরা। ২৫শে মার্চ রাত থেকে শুরু হয়ে ২৬শে মার্চ সকাল পর্যন্ত গণহত্যা চালাল তারা। অনেক বাঙালি প্রাণ হারাল, কিন্তু তার চেয়েও বেশী বাঙালি একত্রিত হল, জীবন বাজি রেখে দেশকে মুক্ত করার শপথ নিল। যে জাতি জীবনের বিনিময়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার শপথ নেয় তাদের কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না- এই কথা আবারও প্রমাণিত হল। ১৬ই মার্চ সেই রেসকোর্স ময়দানেই ৯০ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পন করল পাকিস্তানীরা।

যুদ্ধ, ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসে বিধ্বস্ত একটি দেশে নতুন উদ্যমে পুনর্গঠন কাজ শুরু হল। কিন্তু অনেকগুলো সমস্যা এই পুনর্গঠন কাজে বাঁধা হয়ে দেখা দিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, স্বাধীন দেশে সবার চাই চাই মনোভাব, সরকারের মধ্যে ভাঙন এবং সবকিছু সুন্দরভাবে পরিকল্পনা করার মত যোগ্য লোকের অভাব। তারপরও ১৯৭২ সালে এদেশের অবস্থা খুব বেশী খারাপ ছিল না। তখন অন্তত বাঙালিদের আশা ছিল, তাদের অনেকগুলো স্বপ্ন বাস্তবায়নের উপায়ও ছিল। প্রয়োজন ছিল কেবল, একটু স্থিতিশীলতা, দুর্ভাগ্যবশত যেটা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। যাহোক, সেটা পরের ব্যাপার। আমার এ লেখার বিষয় ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন, নাম “Bangladesh: Hope Nourishes a New Nation“, লেখক উইলিয়াম এস এলিস, প্রতিবেদনের জন্য ছবি তুলেছেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের ফটোসাংবাদিক ডিক ডুরেন্স ২। সম্প্রতি এই চমৎকার প্রতিবেদনের অনুবাদ শেষ করেছি। আমার করা বাংলা অনুবাদের শিরোনাম “বাংলাদেশ: আশায় নতুন জীবনের বসতি“। শিরোনামটি অবশ্য আমার দেয়া না, শিরোনাম দিয়েছেন সহব্লগার আলমগীর।

ন্যাট জিওর এই প্রতিবেদন সম্পর্কে আমি প্রথম জানতে পারি সহব্লগার বিপ্লব রহমানের একটি লেখা থেকে। লেখার সাথে তিনি ন্যাট জিওর মূল প্রতিবেদনের স্ক্যান করা পৃষ্ঠাগুলো জুড়ে দেন। সেখান থেকেই অনুবাদ করেছি। বিপ্লব রহমান সে লেখার মাধ্যমে অনুবাদের উন্মুক্ত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আমিই রাজি হয়ে গেলাম। রাজী না হওয়ার কোন কারণই ছিল না। এমন একটা লেখা অনুবাদ করতে পারাটাও গর্বের। বিপ্লব রহমান ন্যাট জিওর মূল ইংরেজি লেখাটি সংগ্রহ করেছিলেন প্রয়াত ব্যবসায়ী আহমেদ উল্লাহ্‌’র ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে। আহমেদ উল্লাহ‌ পরিবার এতোদিন ধরে এটি সংরক্ষণ করে না রাখলে, সচলায়তন পর্যন্ত লেখাটা আসতেই পারতো না। বিপ্লব রহমান বছর চারেক আগে সেখান থেকে সিডি আকারে লেখাটি সংগ্রহ করেছিলেন।

অনেকে অনুবাদটি সচলায়তনের সাথে সাথে সিসিবি-তেও প্রকাশ করতে বলেছিলেন। কিন্তু কপিরাইট বিষয়ক জটিলতার কারণে সেটা সম্ভব হয়নি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের সাথে অনুবাদের ব্যাপারে যোগাযোগ করেছিলাম। তারা বলেছে, প্রতিটি ছবির জন্য ২০০ ডলার এবং প্রতি পৃষ্ঠা টেক্সটের জন্য ২০০ ডলার করে দিতে হবে। স্বভাবতই আর ওমুখো হইনি। কপিরাইট ছাড়াই অনুবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন লাভজনক কাজে এটি ব্যবহার করা হচ্ছে না, তাই কপিরাইট নিয়েও ভাবছি না।

এই লেখাটিকে আমি তিন অংশে ভাগ করছি। প্রথমে মূল প্রতিবেদনের একটি সারাংশ তুলে ধরব। কোন অনুচ্ছেদে লেখক কি বলেছেন তা-ই বলার চেষ্টা করব আর কি। এর পরের অংশে উইলিয়াম এলিসের লেখা পড়ে আমার কি অনুভূতি হয়েছে তা লিখব। আর সবশেষে অনুবাদ করতে গিয়ে কি কি অভিজ্ঞতা হয়েছে তা লিখব।
অনেকদিন আগে তারেক ভাইকে (মু. নূরুল হাসান/কনফুসিয়াস) কথা দিয়েছিলাম, অনুবাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি আলাদা পোস্ট দেব। আলাদা দিতে না পারলেও এই পোস্টের তৃতীয় ও শেষ অংশের মাধ্যমে সেই প্রতিজ্ঞার কিছুটা পূরণ হবে। এক ঢিলে দুই পাখি আর কি।

উইলিয়াম এস এলিস রচিত প্রতিবেদনের সারাংশ

সারাংশ শুরু করতে গিয়ে দেখলাম অনেক বড় হয়ে যাবে। তারচেয়ে পোস্টটা পড়ে নেয়াই ভাল হবে। তাই সারাংশ না দিয়ে কেবল ভূমিকা আর উপসংহার এবং সূচিপত্রটা উল্লেখ করি।

এলিস শুরু করেছেন এভাবে:

বিশাল প্রান্তরে আড়াই লক্ষ মানুষ উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিলো। অবশেষে তাদের নেতা ক্লান্ত শরীরে এসে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। তিনি প্রথমে কি বলবেন তা সবাই জানতো। তারা যেন উত্তর দেয়ার জন্যও প্রস্তুত ছিলো।
নেতা চিৎকার করে বললেন, “জয় বাংলা”। সাথে সাথে লক্ষ মানুষের লক্ষ কণ্ঠ থেকে প্রত্যুত্তর এলো। মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হলো, “জয় বাংলা”। প্রতিধ্বনিগুলো যেন বজ্রের গর্জনে রূপ নিলো।

এরকম একটি দেশ নিয়েই এরপর লিখতে বসেছেন। আলাদা অনুচ্ছেদে লিখেছেন, প্রতিটি অনুচ্ছেদের নাম দিয়েছেন। নামগুলো অবশ্য সেই অনুচ্ছেদের কন্টেন্টকে নির্দেশ করে না। অনুচ্ছেদের নাম দ্বারা সেই অনুচ্ছেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে নির্দেশ করে। কথা না বাড়িয়ে অনুচ্ছেদগুলোর নাম জুড়ে দিচ্ছি:

– গণহত্যা শেষে একটি জাতির উত্থান
– এক নদীবিধৌত উর্বর সমভূমি
– যুদ্ধের ডামাডোলে দেউলিয়া জাতি
– সীমিত আয়ে বাধ্যতামূলক কৃচ্ছ্রসাধন
– বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চয়তার আশায় অধিক সন্তান গ্রহণ
– কষ্টকর কাজের শেষে মধুর সঙ্গীত
– ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দুরা অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা পেয়েছিল
– মুক্তির আশায় কারাগারে দিনযাপন
– জনগণের অতিবিশ্বাসই মুজিবের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়
– ভারতীয় সেনাবাহিনী অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছিল
– মুরং তামাক- আগুন থেকে এক অন্যরকম ধূয়া
– বিভিন্নভাবে সাহায্য আসছে
– সবাই সরকারের কর্মকাণ্ড গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে
– অভিশপ্ত বিহারীদের জীবনধারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে
– এক প্রাক্তন “অপরাধী” গ্রাম মাতিয়ে রেখেছে
– সূর্য ওঠার আগেই সব রেশন শেষ হয়ে গেল

লেখার শুরুটা যেমন সুন্দর ছিল, শেষটাও তেমনি সুন্দর। লেখা শেষ করেছেন এই বলে,

এদেশের উদীয়মান সূর্য খুব কম সময়ই দিগ্‌বলয়ে পড়ে থাকতে চায়। দেখতে না দেখতেই রক্তাভ লাল রঙের পর্দা জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। তারপরই সে এল- পূর্ণ গোলকটি তার সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হল, সাদা আলোর ছটায় ভরিয়ে দিল আকাশটাকে।

অবশ্য সবশেষে একটি ছবিও ছিল। বাংলার অধিকাংশ মানুষ কৃষক। কৃষকের জীবনই যেন বাংলার জীবন। তাই ডিক ডুরেন্সের শেষ ছবির বিষয় ছিল: কৃষকের ডাকে মাটির সাড়া দেয়া। ছবির ক্যাপশন হিসেবে লিখেছেন:

বাংলার মাটি কৃষকের ডাকে সবসময়ই সাড়া দেয়, বলিয়ারপুরের কাছে এমনই এক কৃষককে দেখলাম। বাঙালিদের জীবন হাজারও সমস্যায় জর্জরিত। তারপরও স্বাধীনতার অবিশ্বাস্য প্রেরণাকে পুঁজি করে আশায় নতুন জীবনের বসতি গড়ে উঠছে।

প্রতিবেদন সম্পর্কে আমার কথা

১৯৭২ সালে এদেশের অবস্থা কেমন ছিল তা আমি জানি না। তখন তো আমার জন্মই হয়নি। তাই বলা যায়, আমি এলিসের কাছ থেকে জেনেছি। নিজের দেশের কথা একজন বিদেশী সাংবাদিকের মুখে শুনতে খুবই ভাল লেগেছে। আর এলিসের সাংবাদিকসুলভ দক্ষতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। প্রথমবারের মত একটি দেশে গিয়ে তারা কত সহজে দেশের অন্তরের খবর বের করে নিয়ে আসতে পারেন, কত সহজে এমন সব কথা বলে দিতে পারেন, যে কথাগুলো সারাজীবন এদেশে থেকেও অনেকের পক্ষে বলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তার স্থান নির্বাচনেরও প্রশংসা করতে হয়। পুরো বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য কোথায় কোথায় যেতে হবে তার সবই যেন তিনি জানতেন। এই মুগ্ধতা থেকেই প্রতিবেদনের কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করে বলছি:

০১

রাজনীতি বিষয়ে তার কথাগুলো বেশ স্বচ্ছ ও দূরদর্শী ছিল। এক্ষেত্রে অবশ্য তিনি যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাদের নামও উল্লেখ করতে হয়। তিনি শেখ মুজিবের সাথে কথা বলেছেন, তার সাথে ড়্যালিতে যোগ দিয়েছেন। ড়্যালিতে মুজিবের প্রতি জনগণের অগাধ আস্থা দেখেই আবার বুঝতে পেরেছেন, “জনগণের অতিবিশ্বাসই মুজিবের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে”। মুজিবের মুখে তিনি শুনেছেন, “কারাগারের জীবনও এত কষ্টের ছিল না”। এত কষ্ট করেও শেখ মুজিব কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। ১৯৭২ সালের অবস্থা অন্তত এরকমই ছিল। সবার মন রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।

কমিউনিস্টদের সাথে বিভেদের বিষয়টিও স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। সংবিধানের চারটি মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র নিয়ে তখন পর্যন্ত কোন সংশয় ছিল না। কিন্তু সমাজতন্ত্র শাপে বর হয়ে দেখা দিয়েছিল। সমাজতন্ত্র প্রয়োগ করতে গিয়ে মুজিব বড় বড় সব শিল্প কারখানার জাতীয়করণ করেছিলেন। কিন্তু কমিউনিস্টরা সন্তুষ্ট হয়নি। এনায়েতুল্লাহ খানের মুখেই এলিস শুনেছেন, “কিন্তু সেগুলো কিভাবে পরিচালনা করা হবে তা নিয়ে তাদের কোন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেই।” এনায়েতুল্লাহ খানের আরেকটি কথায় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎই যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে, “সামাজিক সংস্কার বিষয়ে সরকার যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেগুলো রাখতে না পারলে বাংলাদেশে এক দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হবে।” আমরা বোধহয় এখনও সেই অস্থিতিশীলতার মধ্যে আছি।

০২

মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ কৌশল, তাদের বর্তমান কার্যক্রম সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। হাবিবুল আলমের যুদ্ধকৌশল যেভাবে বর্ণনা করেছেন- তা খুবই ভাল লেগেছে। হাবিবুল আলম তাকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মিশনের বর্ণনা দিচ্ছেন, মাঝেমধ্যে কর্মচারী ও ওয়েটাররা এসে তাকে অভিবাদন জানিয়ে যাচ্ছে; হাবিবুল আলম যে এখানকার হিরো। একসময় এলিস আলমকে প্রশ্ন করেন, “তুমি এই সবগুলো লোকের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিলে, তারপরও ওরা এতো বন্ধুভাবাপন্ন কেন?” উত্তরে আলম বলেছিল, “কারণ ওরা সবাই মুক্তিবাহিনী ছিল।”

মাহবুবউল্লাহ্‌র জবানীতে আমরা যুদ্ধ পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছি। মাহবুবউল্লাহ যুদ্ধের আগেই ছাত্রদের মিছিলে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিল। তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। তার ছাত্রজীবন শেষ, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হয়ে যায়নি। ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করা অধিকাংশ ছাত্র এখনও দিনের অধিকাংশ সময় এই ভার্সিটির চত্বরে কাটায়, আড্ডা দিয়ে। আড্ডার প্রধান বিষয় রাজরীতি, মুজিব আজকে কি করল, সরকার পুনর্গঠনের কাজ কতটুকু এগিয়ে নিল- এসবই ছিল তাদের আলোচনার মুখ্য বিষয়।

০৩

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান, আচার-ব্যবহার, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা- কোনকিছুই এলিসের প্রতিবেদন থেকে বাদ পড়েনি। বলিয়ারপুর গ্রামে কৃষকদের জীবনযাপন, ময়মনসিংহে ঘূর্ণিঝড় পীড়িত গ্রামবাসীর দুর্ভোগ, মেঘনা নদীতে জেলেদের জীবনযুদ্ধ, পার্বত্য চট্টগ্রামে মুরংদের সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা- সবকিছুই তিনি লক্ষ্য করেছেন।

০৪

যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ১ কোটিরও বেশী মানুষ ভারতে চলে গিয়েছিল। এই বিশাল শরণার্থীদের সামলাতে গিয়ে ভারত সরকার হিমশিম খেয়েছে। কলকাতা তখন দুই বাংলার এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। অবশ্য, সেখানকার সব বাঙালিই ছিল নিঃস্ব। দুই বাংলার এই মিলন ডিক ডুরেন্সের একটি ছবিতে ফুটে উঠেছে। একাত্তরে কলকাতায় গিয়ে পূর্ববঙ্গের এক ছেলে পশ্চিমবঙ্গের এক মেয়ের প্রেমে পড়েছিল। যুদ্ধ শেষে সেই মেয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে, ঘটা করে তাদের বিয়ে হচ্ছে। ডিক ডুরেন্স কনের ছবিটিই তুলেছিলেন। ক্যাপশনে লিখেও দিয়েছিলেন, “পারিবারিকভাবে বিয়ের ব্যবস্থা করার চিরন্তন প্রথা ভেঙে এই বিয়ে হচ্ছে।”

০৫

বিদেশী সাহায্যের বিষয়গুলো আরও ভালভাবে ফুটে উঠেছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে তিনি কথা বলেছেন। সবাই এক কথা বলেছে, জীবনে অনেক বিপর্যস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণের কাজ করেছে, কিন্তু এখানকার মত এত খারাপ অবস্থা কোথাও দেখেনি। তিনি এই ত্রাণ কার্যক্রমকে এখন পর্যন্ত নেয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ৭ কোটি মানুষের জন্য এত বড় প্রকল্প হাতে নেয়াই তো দরকার ছিল। অনেকগুলো দেশ সাহায্য করছিল, এনজিও, রেড ক্রস, মিশনারি, জাতিসংঘ- কেউই থেমে ছিল না।

তিনি দেখিয়েছেন, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশী সাহায্য করেছে ভারত। এর পরেই আছে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। তবে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে জাহাজগুলো বন্দরে ভীড়তে সাহস করছে না। কারণ যুদ্ধের সময় বাঙালিরা অনেকগুলো পাকিস্তানী জাহাজ বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেগুলোর সাথে লেগে কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে রুশ সরকার এই বন্দর পরিষ্কারের কাজ করে দিচ্ছে। তবে এলিস বোধহয় এখানে একটি বিষয় বলতে ভুলে গেছেন, পাকবাহিনী বঙ্গোপসাগরে অনেক মাইন পুঁতেছিল। সেগুলোও ভীতির অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। রুশরা মূলত সেগুলোই পরিষ্কার করছিল।

এলিস স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই দেশে বর্তমানে রাশিয়ার প্রভাব খুব বেশী। এমনকি ঢাকার টিভিতে প্রচুর রুশ অনুষ্ঠান দেখা যায়। এদেশের সংবাদপত্রও রুশ সংবাদ সংস্থার সাহায্য নেয়। কিন্তু এরপর জুড়ে দিলেন,

তারপরও আমেরিকানদের প্রতি সাধারণ বাংলাদেশীদের এক অকপট মমত্ববোধ আছে। আমাকে অনেকেই বলেছে, “তোমাদের সরকার যদিও যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অবস্থান নেয়নি, তারপরও আমরা জানি, তোমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আমাদের পক্ষেই ছিল।”

এরপর রাশিয়া এবং আমেরিকার সাহায্যের পরিমাণটা উল্লেখ করলেন: এখন পর্যন্ত আমেরিকা বাংলাদেশকে রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশী ত্রাণ সাহায্য পাঠিয়েছে। তখনও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধ চলছে, এখানে সেই যুদ্ধের প্রভাবটা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশীরা সাধারণ মার্কিনীদের ব্যাপারে ভুল বলেনি। অ্যালেন গিন্সবার্গ, জর্জ হ্যারিসন বা বব ডিলনের কথা তো আর ভুলে যাওয়া যায় না।

০৬

বিহারীদের সমস্যা নিয়ে একটা আলাদা অনুচ্ছেদই লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর বিহারীদের উপর অত্যাচার বাংলাদেশের ইতিহাসে অবশ্যই একটি কালো অধ্যায়। যুদ্ধের পর যে কাজটা হওয়া দরকার ছিল, সেটা না হয়ে বরং বিহারী অত্যাচারের মত লজ্জাজনক কাণ্ড ঘটেছে। যুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা দরকার ছিল, সে বাঙালি-বিহারী-পাকিস্তানী যে-ই হোক। কিন্তু কোন রাজনৈতিক কারণেই হয়ত সেটা সম্ভব হয়নি। তবে বিহারী হত্যার ব্যাপারে একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না:
সে সময় দেশের মানুষের উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আর অনেকের হাতে তখনও অস্ত্র ছিল। বিহারীরা স্বভাবতই যুদ্ধে পাকিস্তানীদের সাহায্য করেছিল। যুদ্ধের পর প্রতিশোধ নিতে তাই অনেকেই ভুল করেনি। অনেক ক্ষেত্রে নিষ্ঠুরভাবে প্রতিশোধ নেয়া হয়েছে। এটা কোন কেন্দ্রীয় আদেশে হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনাই বলা যায়, যদিও এ ধরণের বিচ্ছিন্ন ঘটনা অনেক ঘটেছে।

এলিস নিজে মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পে গিয়ে বিহারীদের অবস্থা দেখে এসেছেন। একটি ছবিতে তাদের দুর্দশার বিষয়টি বেশ পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে।

অনুবাদ করতে গিয়ে যা বুঝলাম এবং যা শিখলাম

সত্যি কথা বলে দেই। অনুবাদ করতে গিয়ে অনেক সময়ই আমি খেই হারিয়ে ফেলেছি। আমি অস্বীকার করতে পারব না যে, আরেকটু পরীশ্রম করলে অনুবাদের মান আরও ভাল হত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আমি মাঝেমধ্যেই কথা হারিয়ে ফেলি। কি লিখব বুঝে উঠতে পারি না। সেই ব্লক থেকে মুক্তি পেতে বেশ সময় লেগে যায়। এজন্য মাঝেমাঝে পুরো একদিনের জন্য অনুবাদ আটকে থাকে। তারপরও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কি বুঝলাম এবং কি শিখলাম তা বলার চেষ্টা করি এখন:

০১

প্রথমেই ভাবানুবাদ এবং আক্ষরিক অনুবাদের বিষয়টি বলে নিই। বিপ্লব রহমান ভাবানুবাদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আমিও ভাবানুবাদ করার জন্যই হাত তুলেছিলাম। এই ভাবানুবাদ আর আক্ষরিকের প্যাঁচে কয়েকবার পড়তে হয়েছে।
আমার মতে, আক্ষরিক অনুবাদকে কখনই ভাল অনুবাদ বলা যায় না। এখানে আক্ষরিক বলতে বুঝাচ্ছি: মূল বাক্য যেখান থেকে শুরু এবং যেখানে শেষ হয়েছে অনুবাদেও বাক্যটি সেখান থেকে শুরু করে সেখানে শেষ করা। আর বাক্যের মধ্যকার প্রতিটি শব্দকে বাংলা করার চেষ্টা করা। এটা কখনও ভাল হতে পারে না।
আর আমার কাছে ভাবানুবাদ অর্থ হচ্ছে: শব্দার্থের চেয়ে কনটেক্সটকে বেশী গুরুত্ব দেয়া, এক বাক্যকে ইচ্ছামত ভেঙে কয়েক বাক্য করা বা একাধিক বাক্যকে একসাথে জুড়ে দেয়া, ইংরেজি যে শব্দের অনুরূপ কোন শব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হয় না সে শব্দ বাদ দিয়ে কনটেক্সট থেকে নিজের পছন্দমত একটি শব্দ বেছে নেয়া।

এখানে আমি তাই ভাবানুবাদটাই করেছি। অনেক ক্ষেত্রে তাই মূল ইংরেজির সাথে অনুবাদের মিল খুব কম হয়ে গেছে। সচলায়তনে একজন্য অবশ্য বলেছিলেন, এরকম দলিল ধরণের লেখার আক্ষরিক অনুবাদই করা উচিত। এক্ষেত্রে আমার কথা হচ্ছে, যেখানে লেখক তথ্য ও বিবৃতমূলক কথা বলেছেন সেখানে তো ভাবানুবাদ আর আক্ষরিকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
“Then, too, it is no secret that the United States has contributed cash and goods with a value of $250,000,000, compared to the Soviet Union’s $94,000,000.”
এই তথ্যমূলক লেখাতে তো এমন কোন ভাব নেই যে ভাবানুবাদ করতে হবে। এক্ষেত্রে তাই আক্ষরিক আর ভাবানুবাদ একই কথা। কিন্তু লেখক যেখানে উপমা ব্যবহার করেছেন সেখানে আক্ষরিক করার কোন উপায়ই ছিল না। তাই আক্ষরিক শব্দটি আমি ব্যবহার করতে চাই না। আমি এই অনুবাদকে বলতে চাই “বস্তুনিষ্ঠ ভাবানুবাদ”, কারণ আমি সজ্ঞানে তথ্য ও ভাবের কোন বিকৃতি সাধন করিনি।

০২

একটি প্রধান সমস্যা ছিল উপমা নিয়ে। এ ধরণের প্রতিবেদনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তথ্য এবং বিবরণীর মাধ্যমে একটি ভাব প্রকাশের চেষ্টা। এই ভাব প্রকাশের জন্যই লেখক অনেক ভাবের কথা বলেছেন। ভাব বলতে উপমার ব্যবহারকেই বোঝাচ্ছি। উপমা এবং রূপকের ব্যবহার একেক ভাষায় একেক রকম। এই অনুবাদে দুইটি ক্ষেত্রে উপমাগত সমস্যা হয়েছে:
– Phrase
– উপমা হিসেবে একটি সম্পূর্ণ বাক্যের ব্যবহার।

ফ্রেইজ নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে চাই না। কারণ অধিকাংশ ফ্রেইজেরই উপযুক্ত বাংলা করা সম্ভব।
সমস্যাটা বাধে বাক্য নিয়ে। এলিস যখন বাংলার কোন সাধারণ ঘটনা বা কোন ব্যক্তির কথা বলার ভঙ্গিকে আমেরিকার কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের সাথে তুলনা করেন তখন আমাকে আসলেই হতাশ হতে হয়। কিভাবে অনুবাদ করব বুঝতে পারি না। সবচেয়ে ভাল হয়, বাংলার প্রকৃতি থেকেও সেরকম কোন সৌন্দর্য্য বের করে আনা। তবে অনেক সময় সেটাও সম্ভব হয় না। একটি উদাহরণ দিই:

এলিস বঙ্গবন্ধুর সাথে ময়মনসিংহের একটি ড়্যালিতে গিয়েছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিষয়ে লিখলেন। কাহিনী হচ্ছে, মানুষের জয় বাংলা স্বর মিলিয়ে যেতে না যেতেই শেখ মুজিব সবার উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন। প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়ার ভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে লেখক বলেছেন:
“And then, as dark clouds ran like tumbleweed before a wind gusting out of the northwest, Bangabandhu posed a question,”
এই তো প্যাঁচে পড়ে গেলাম। এই প্যাঁচ থেকে ছুটতে আমার অনেক সময় লেগেছিল। এখানে লেখক উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা বাতাসের তোড়ে ঘোরকৃষ্ণ মেঘগুলো ঝরাপাতার মত উড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু এর সাথে আদৌ কারও কথা বলার ভঙ্গি আমেরিকায় বোঝানো গেলেও বাংলাদেশে বোঝানো যায় বলে আমার মনে হয়নি। ইংরেজিতে এটি হয়ত খুব স্বাভাবিক, কিন্তু বাংলায় আমি পারিনি। অবশেষে লিখে দিয়েছি, “জয় বাংলার ধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতেই বঙ্গবন্ধু সবার উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,”

০৩

শব্দের সঠিক অর্থ করতে গিয়েও অনেক সময় ঝামেলায় পড়তে হয়। যেমন, আমি হলোকস্ট শব্দের অর্থ কি করব তা প্রথমে বুঝতে পারিনি। শব্দটার আসল অর্থ পূর্ণদগ্ধ। কিন্তু এখানে গণহত্যা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত। তাই জেনোসাইড না থাকা সত্ত্বেও গণহত্যাই ব্যবহার করেছি।

মাঝে মাঝে লেখকের অনেক শব্দ আমি বাদ দিয়েছি। মাঝে মাঝে লেখক কোন শব্দ উল্লেখ না করলেও আমি জুড়ে দিয়েছি। মাঝেমাঝে আবার সবকিছু ঠিক রেখেছি। এগুলো কেবল স্বজ্ঞা তথা intuition এর উপর নির্ভর করে করেছি। বিভিন্নভাবে লিখে দেখেছি, যেভাবে পড়তে সবচেয়ে ভাল লাগে সেটাই গ্রহণ করেছি।

০৪

অনুবাদ করতে গিয়ে নতুন অনেক কিছু শিখেছি। পাশাপাশি আগে কেউ অনুবাদের ভুল ধরিয়ে দিত না। কিন্তু এই বিষয়টি বেশ গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় সবাই এগিয়ে এসেছেন। প্রতি পর্বেই কেউ না কেউ পরামর্শ দিয়েছেন। পরামর্শ মোতাবেক অনেক কিছু পরিবর্তন করেছি। ভবিষ্যতেও অখণ্ড সংস্করণটিতে এ ধরণের পরিবর্তন আসতে পারে। প্রিন্ট তো নয় যে কোন পরিবর্তন করতে পারব না।

সাহায্যের ক্ষেত্রে দুজনের নাম না করলেই নয়, “সংসারে এক সন্ন্যাসী” এবং “অতন্দ্র প্রহরী” (রনি ভাই)। রনি ভাই বানান এবং বাক্য গঠনের অনেক অসামঞ্জস্য ধরিয়ে দিয়েছেন। আর সংসারে এক সন্ন্যাসী প্রায় প্রতি পর্বেই পাশে ছিলেন, তাঁর পরামর্শের কারণেই একটি বিষয়ে নতুনভাবে ভাবতে পেরেছি। এই ভাবনার সাথে কালের সম্পর্ক আছে।

ইংরেজি ভাষায় সাধারণত কাল (Tense) খুব যত্ন সহকারে ঠিক রাখা হয়। অতীত হলে সবকিছু অতীত কালেই বর্ণনা করা হয়। কিন্তু বাংলায় এ ধরণের সামঞ্জস্য রাখার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলায় সবার আগে আসে কোন অনুচ্ছেদের প্রাঞ্জলতার বিষয়টি। সবগুলো অতীত কালে লিখলে স্বভাবতই পড়তে খারাপ লাগে, এজন্য মাঝে কোন একটি বাক্যে বর্তমান বা বর্তমান এবং অতীত কালের অন্যান্য ধরণ ঢুকিয়ে দিলে ভাল হয়। এখানে মূল সমস্যাটা হয় শেষ শব্দ নিয়ে। পদ্যে যেমন শেষ শব্দে মিল রাখলে ছন্দ আসে, গদ্যে তেমনি শেষ শব্দে মিল রাখলে গন্ধ আসে। উদাহরণ দেই:

“দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে ১ কোটি বাংলাদেশী ভারতে চলে গিয়েছিল। আর বাংলাদেশের ভিতর আরও ১ কোটি বাঙালি নিজ বাসভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমিয়েছিল।”

এখানে প্রতিটি লাইনই “ছিল” দিয়ে শেষ হয়েছে, পড়তে খুবই খারাপ লাগছে। সংসারে এক সন্ন্যাসীর পরামর্শে এই অনুচ্ছেদ ভেঙে তাই এভাবে লিখলাম।

দেশের প্রতিটি অঞ্চল থেকে মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে ভারতে বাংলাদেশী শরণার্থীর সংখ্যা দাড়ায় ১ কোটিতে। আর বাংলাদেশের ভিতর আরও ১ কোটি বাঙালি নিজ বাসভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়।

আরেকটি উদাহরণ দেই: (এটা অবশ্য কাল নিয়ে নয়)
আবেগপ্রবণ বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে জীবন দিয়ে ভালবাসতো। তারা নিজেদের মাতৃভূমিকে বলত “সোনার বাংলা”। এই নদীমাতৃক দেশের দিগন্তবিস্তৃত ধান ক্ষেত তাদের মুগ্ধ করত, বর্ষণমুখর দিনে চামেলির সুবাস তাদের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করত।

চারটির মধ্যে তিনটিই “তো” দিয়ে শেষ হয়েছে। এটা কেটে এরকম করে দিলেই সমস্যা একটু কমে যায়:
আবেগপ্রবণ বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষাকে জীবন দিয়ে ভালবাসতো। তারা নিজেদের মাতৃভূমিকে বলত “সোনার বাংলা”। এই নদীমাতৃক দেশের দিগন্তবিস্তৃত ধান ক্ষেত মুগ্ধ করত তাদের, বর্ষণমুখর দিনে চামেলির সুবাস পরিশুদ্ধ করত তাদের আত্মাকে।

০৫

শুরু এবং শেষের মধ্যে একটি দ্যোতনা রাখতে পারলে আমার বেশ ভাল লাগে। উইলিয়াম এলিসের লেখা পড়ে দেখলাম সেটা সম্ভব। লক্ষ্য করুন, শুরুর এক স্থানে আমি এরকম অনুবাদ করেছিলাম,

বঙ্গবন্ধুর সাথে তার জনতার এই বাক্য বিনিময়কে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের এক সমবেত সঙ্গীত বলা যায়। সেই সঙ্গীত, যার গায়েনেরা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়েছে, তারপরও মাথা নত করেনি; অবশেষে পৃথিবীতে একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে।

এখানে “জ্বলে-পুড়ে” লেখার সময় যে সুকান্তের কথা মনে হয়েছিল তা অস্বীকার করব না। কিন্তু এই শব্দ দুটিই আমাকে অনুবাদ শেষ করতে সাহায্য করেছে। অনুবাদ শেষ হয়েছে এভাবে:

এদেশের উদীয়মান সূর্য খুব কম সময়ই দিগ্‌বলয়ে পড়ে থাকতে চায়। দেখতে না দেখতেই রক্তাভ লাল রঙের পর্দা জ্বলে-পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। তারপরই সে এল- পূর্ণ গোলকটি তার সম্পূর্ণ রূপ নিয়ে উদ্ভাসিত হল, সাদা আলোর ছটায় ভরিয়ে দিল আকাশটাকে।

এতোদিন বাঙালিরা জ্বলেছে-পুড়েছে। তাদের সাথে সাথে প্রতিদিন সকালে আকাশেও এমন একটা জ্বালানো-পোড়ানো চলত। আগে হয়ত বাঙালিরা এক সকাল শেষে পরবর্তী সকালের অপেক্ষা করত, কারণ মাঝের পুরোটা আলোকজ্জ্বল দিনই তারা নিজেদের অন্তর পোড়াতে বাধ্য হত। এখন আর তাদের জ্বলে-পুড়ে মরতে হবে না। এখন তারা সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত দিবসের স্বাদ নিতে পারবে। বাঙালিরা তো এই সূর্যের জন্যই অপেক্ষা করছিল, অবশেষে সে এল। আমার নিজের এটুকু বুঝে বেশ ভাল লেগেছে। এরপরই একটি ক্যাপশনের মাধ্যমে শিরোনামের সাথে শেষ লাইনের একটি সংযোগ তৈরী করতে চেষ্টা করেছি:

বাংলার মাটি কৃষকের ডাকে সবসময়ই সাড়া দেয়, বলিয়ারপুরের কাছে এমনই এক কৃষককে দেখলাম। বাঙালিদের জীবন হাজারও সমস্যায় জর্জরিত। তারপরও স্বাধীনতার অবিশ্বাস্য প্রেরণাকে পুঁজি করে আশায় নতুন জীবনের বসতি গড়ে উঠছে।

পরিশিষ্ট

২,৮৩৭ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : ““বাংলাদেশ: আশায় নতুন জীবনের বসতি” প্রসঙ্গে”

  1. অনুবাদটা নিয়মিত পড়ছিলাম সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এই লেখাটাও পূর্ন মনযোগ দাবি করে। সেজন্যে প্রিয়তে রাখলাম। সময় করে মন দিয়ে পড়বো বলে। 🙂
    আপাতত কমেন্ট বাড়াইয়া লই। আইজকা ফার্স্ট হওয়ার একটা চান্স আছে মনে হয়। 😉 😉

    জবাব দিন
  2. সাকেব (মকক) (৯৩-৯৯)

    সচলে লগইন করা হয়না...তাই অনেক দিনের পাওনা ধন্যবাদটুকু এই সুযোগে দিয়ে দেই :hatsoff:

    আমি বিশেষজ্ঞ নই, তবে আমার কাছে যথেষ্ট সাবলীল আর পরিপক্ক অনুবাদ বলে মনে হইসে...আর অনুবাদের অভিজ্ঞতাটাও খুবই উপভোগ্য...


    "আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
    আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস"

    জবাব দিন
  3. মুহাম্মদ কে একটা ধন্যবাদ না দিলেই না :thumbup: আসলে এর সাথে একটা :salute: প্রাপ্য । এই রকম একটা অনুবাদ কাজ করা আসলেই অসাধারন । নেটে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এর জন্য এইটা একটা ভাল দলিল হয়ে থাকবে । সচলে একদম প্রথম থেকে পড়া ছিল আজকে শেষ হইল । আর কিছু বলার নাই তোমার জন্য ভাই :boss:

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    অনুবাদ নিয়া নতুন করে কিছু বলার নাই। সর্বোচ্চ উৎকৃষ্ট মানের অনুবাদ হয়েছে আমার মতে 🙂 মুহাম্মদরে :salute: দিলেও কম হয়ে যায়। সাব্বাশ ব্যাটা :party:
    তবে আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লেগেছে ওর অনুবাদকালীন চিন্তাভাবনাগুলো। তখনকার ঘটনাবলী মোটামুটি নিরপেক্ষ সূত্রে একইরকম হবার কথা। রিপোর্টটি অনন্য হয়ে আছে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের একে হৃদয়দিয়ে অনুধাবন করার প্রচেষ্টায়। আমার কাছে অনুবাদকালীন মুহাম্মদের চিন্তা চেতনাকেও সেরকম সংশ্লিষ্টতায় পূর্ণ লেগেছে :hatsoff: :hatsoff:
    নয় মাসের ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা দেশকে দাড়া করানোর কাজটা সহজ কিছু ছিলোনা। নানান প্রতিকূলতার ঘটনাগুলো হয়তো বিস্মৃতিপ্রবণ বাঙ্গালির মাথা থেকে হারিয়ে যাবে বঙ্গবন্ধুর শাসনকালীন ব্যর্থতার ইতিহাসের অতি এবং ক্ষেত্র বিশেষে উদ্দেশ্যমূলক বর্তমান প্রচারণাগুলোর সামনে। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের ধারে কাছে সময়েও জন্মাইনি তাদের জন্য এই লেখগুলোই সত্যিকারের প্রমাণ হয়ে থাকবে।


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন
  5. সায়েদ (১৯৯২-১৯৯৮)

    এইটা পড়তে হবে বইয়ের মতোন করে...........আগে প্রিন্ট করে বাঁধাই করব তারপর - সবগুলো একত্র করে। বিশাল একটা কাজ হয়েছে। ওয়েল ওয়েল ডান ব্রাদার :clap: :clap: ।
    অনেক অনেক :salute: :salute: :salute: ।


    Life is Mad.

    জবাব দিন
  6. তাইফুর (৯২-৯৮)

    মুহাম্মদ, তোর লেখায় কমেন্ট করতে গেলে নিজেকে দরীদ্র মনে হয়, তাই মনে হয় তোর লেখাগুলো অনেকবার পঠিত হলেও কমেন্ট জমা পড়ে কম ...
    অসাধারণ লেখা, অভূতপূর্ব বিশ্লেষণ ...
    তোর বয়স নিয়ে আমার ডাউট দিন দিন বাড়ে ...


    পথ ভাবে 'আমি দেব', রথ ভাবে 'আমি',
    মূর্তি ভাবে 'আমি দেব', হাসে অন্তর্যামী॥

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মাস্ফ্যু

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।