অন্যরকম ক্যাডেট কলেজ – ২

[এই ধারাবাহিক উপন্যাসের একেক পর্ব একেকজন লিখবেন। যে কেউ লিখতে পারেন। কেউ যদি পরের পর্ব লিখতে চান তাহলে তাকে এই পর্বে মন্তব্য করে তা বলে দিতে হবে। যিনি আগে বলবেন তিনিই লিখবেন পর্বটি।]
<< গত পর্ব

পাঁচঃ

পরদিন সকাল আটটা নাগাদ একাডেমি ব্লকের সামনে সিআইডি’র গাড়ি এসে থামলো। খুনের একমাত্র পরোক্ষ উইটনেস আব্দুল গাফফারকেই প্রথমে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল।
– আমিই ফোন করেছিলাম। স্যার কথা শেষ করতে পারেননি। দড়াম করে একটা শব্দ হয়, তারপরই ফোনটা কেটে যায়।
একটু তাড়াহুড়া করেই বললেন, আব্দুল গাফফার।
ক্রাইম সিনে উপস্থিত কারও কথা শোনার সময় একটু বেশীই সতর্ক থাকেন নিখিল চৌধুরী। সমস্যা একটাই তিনি যে খুব সতর্ক তা যে কেউ বুঝে ফেলে। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন,
– তার মানে ফোনটা পড়ে থাকেনি, কেউ সেটা কেটে দিয়েছিল?
– একজাক্টলি। গাফফার সাহেবের কথায় বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল।
– খুব ঠাণ্ডা মাথায় খুনটা করা হয়েছে। এরকম খুনের ঘটনাতো আর কম শুনতে হয়নি। কিন্তু কি আশ্চর্য বলুন তো? সবার প্যান্ট হারানো, কলেজের সব সাইকেল উধাও হয়ে যাওয়া… কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে আপনার বিশ্বাস হয়?
– সত্যি বলতে, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে এতোসব ঘটে গেছে।
– ৩০ বছর ধরে এই পুলিশ প্রোফেশনে আছি। এরকম ঘটনার কথা শোনা তো দূরের কথা, ভাবতেও পারিনি।
সিভিল ডিটেক্টিভের কথা শেষ হতে না হতেই অ্যাডজুটেন্ট এগিয়ে এলেন। মুখে একটা অনাবশ্যক সারল্যের ভাব এনে গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন,
– আপনাদের হেল্প এর জন্য ধন্যবাদ। ল এনফোর্সমেন্টের ব্যাপারটা আমাদের মাথায় আছে। ভিপি স্যারের স্ত্রীর অবস্থা ভালো না। তবে উনার আত্মীয়রা অবশ্যই কেসটা আদালত পর্যন্ত নিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু যাই হোক, পুরো ইনভেস্টিগেশনটা ডিজিএফআই-ই করবে। ল-ইয়ার ঠিক হলে তিনি ডিজিএফআই থেকেই প্রয়োজনীয় সাহায্য নেবেন। আমার কথা আশাকরি বুঝতে পেরেছেন।
– হাঁ অবশ্যই। তবে নিয়ম অনুযায়ী অন্তত পোস্ট মোর্টেমটা, আমাদের হাতে আসতে হতো। নয়তো এ মুহূর্তে আমাদের করার কিছু থাকছে না।
– তার মানে আমার কথা আপনি একেবারেই বুঝেন নি। আবার বলছি, সিএমএইচ থেকে আমরাই সব কালেক্ট করবো। আপনাদের আসলেই কিছু করার নেই এখন।
বলার ভঙ্গীটা সহজ ভাবে নিতে পারেন নি, কিন্তু সে পরিস্থিতিতে অন্য কিছু ভাবা সম্ভব ছিল না নিখিল চৌধুরীর পক্ষে। ব্যাপারটা চুকে যাওয়ার পর তাই গাড়িতে উঠে রওয়ানা হলেন।
আব্দুল গাফফারও সসংকোচে বাড়ির দিকে হাটা দিলেন। লুঙ্গিটাই যে তার সংকোচের কারণ তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো। অ্যাডজুটেন্টের ডাক পড়লো তখনই,
– গাফফার সাহেব, একটু দাড়ান। আপনার সাথে কথা আছে।

ছয়ঃ

প্রিন্সিপালের কথা মানলে তো কলেজে প্রথমবারের মতো এবার লুঙ্গি কনফারেন্স হয়ে যাবে। অন্তরে যা-ই থাকুক, মুখে লুঙ্গির কথাটা গোপন করে নাজমুল হুদা ফোনে বললেন,
– কিন্তু, স্যার অনেকেরই আসার মতো অবস্থা নেই।
– ভারপ্রাপ্ত ভিপি হিসেবে সে দায়িত্বটা আপনাকেই নিতে হবে। বলেই ফোনটা রেখে দিলেন প্রিন্সিপাল আজিজুর রহমান।
এই প্রথমবারের মতো আতঙ্কের সাথে বিস্মিত হলেন হুদা সাহেব। যে প্যান্টটা পড়ে একাডেমি ব্লকে যাবেন বলে ভাবছিলেন ঠিক সেই প্যান্টটাই পড়ে আছেন তিনি এখন। এটা কোন ধরণের কথা ভাই। নির্বাক হয়ে থাকার মত যথেষ্ট সময় নেই। তাই ফোন করে সবাইকে জানালেন।

সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে এক আব্দুল গাফফার বাদে সব শিক্ষকই প্যান্ট পরে প্রিন্সিপালের বাসায় উপস্থিত। প্রিন্সিপাল এসে বসতেই সবাই মুখে একটা শ্রদ্ধার ভাব এনে ঠিকঠাক হয়ে বসলো। প্রিন্সিপাল আজিজ সাহেব কিছু বলতে যাবেন তার আগেই, চারুকলার প্রভাষক সাইফুল আলম বলে উঠলেন,
– স্যার, অন্য কিছু আলোচনা করার আগে এই সবকিছু উধাও হয়ে যাওয়া আর ফিরে আসার বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা দরকার না?
সব সময় আগ বাড়িয়ে কথা বলাটা উনার স্বভাব। তবে এবারেরটা বেশি বেখাপ্পা লাগলো। কারণ এই উধাও হবার বিষয়টা এমন যে, কেউ তা ভাবতেও পারছে না, বা চাইছে না। অগত্যা প্রিন্সিপাল বললেন,
– আপনিই ব্যাখ্যা করুন না, মিস্টার আলম। মুখে তার ব্যাঙ্গমাখা ক্রোধ স্পষ্ট।
– না স্যার, আমি কি জানি দেখলাম, সেটাই
– সেটা কি?
– সেটা মানে ইয়ে..
– হয়েছে, আপনাকে আর বলতে হবে না। আসল ঘটনা হল, যা ঘটেছে তা আসলে ঘটেনি, বুঝতে পারছেন মিস্টার আলম!!
কিন্তু, সাইফুল আলম ততক্ষণে অন্যমনস্ক হয়ে গেছেন। তিনি বুঝতে পারছেন না, সেই মায়াবী পরিবেশটাকে কিভাবে ভাষায় প্রকাশ করা যায়।

সাতঃ

এই রকম জটিল পরিস্থিতিতেও হাউসে কোন স্যার নেই। এনসিও রা সবাই অবশ্য তাদের ডিউটি করছে। বরকত স্টাফকে কাছে পেয়েই রাসিফ জিজ্ঞাস করলো,
– স্টাফ, ভিপি স্যার কি আসলেই খুন হয়েছেন?
– এইটা নিয়া কোন কথা বলতে নিষেধ করা হইছে না?
– না মানে, স্টাফ অবস্থা যদি ততোটা সিরিয়াস হয় তাইলে তো আপনাকে আরেকটা বিষয় জানানো দরকার।
– কেনো কি হইছে? বরকত স্টাফের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার ছাপ।
– আমার হাউসের ক্লাস সেভেনের একটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নাম সাজিদ।
– কি বল এই সব। কতক্ষণ থেকে। আমারে আগে বল নাই ক্যান?
– গতকাল লাইট্‌স অফের পর তাকে কেউ দেখে নাই। বিষয়টা ভালো ঠেকছে না। সিরিয়াস কিছু হতেই পারে।
আর কোন কথা না বলে শহীদুল্লাহ হাইসের ক্লাস সেভেনের টেন সিটার রুমের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলো দুজনেই।

রুমের নাম করবী। সাজিদ নেই, কিন্তু সবার মধ্যে যে ভয়টা থাকার কথা সেটা নেই। কারণ একটাই। ক্ষেত্রবিশেষে ভীতু হলেও ক্লাসমেটদের মধ্যে সাজিদের একটা বিশেষ নাম আছে, তাকে দেখলেই কেন যেন মনে হয় সবকিছু মানিয়ে নিতে পারবে। পরম নির্ভরতার প্রতীক। কাউকে রুম থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। সবাই যার যার টেবিলে বসে করিডোরের দিকে চেয়ে আছে, ভাবছে, এই বুঝি সাজিদ চলে এলো।
সাজিদ এলো না, রুমে ঢুকলো রাসিফ ভাই আর বরকত স্টাফ। সবাই দাড়িয়ে গেল। রাসিফ বলল,
– সবাই বাইরে করিডোরে গিয়ে ফলইন হও।
– দাড়াও একটু। রাসিফের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে বরকত স্টাফ ক্লাস সেভেনের একটা ছেলেকে জিজ্ঞাস করলেন,
– সাজিদের বেড কোনটা?
সবাই একযোগেই রুম লিডারের সাইডের শেষ বেডটা দেখিয়ে দিল। আর তাই স্তম্ভিতও হল সবাই একসাথে।
সাজিদ বেড কাভার মুড়ি দিয়ে তার বেডেই শুয়ে আছে।

আটঃ

– পোস্ট মর্টেমে অস্বাভাবিক কিছু পাওয়া যায়নি। একেবারে নরমাল হার্ট অ্যাটাক। রিপোর্ট বলছে, হামিদুর রহমানের মৃত্যুর সময় ০৬:৪৭:৫০। সর্বোচ্চ পাঁচ সেকেন্ড এদিক ওদিক হতে পারে। খুনের পর কলেজে বিশেষ আর কিছু ঘটেনি। তবে চাঞ্চল্যকর একটা তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যে টেলিফোনটি দিয়ে উনি কথা বলছিলেন তা কাটা হয়েছে ০৬:৪৯:০৩ -এই সময়ে। আনুমানিক হিসেবে মৃত্যুর প্রায় এক মিনিট পর কেউ ফোনটা কেটেছে। অথচ, পদার্থবিজ্ঞানের গাফফার সাহেব বলছেন, হামিদুর রহমানের কণ্ঠ শেষবার শোনার পাঁচ থেকে দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ফোনটা কেটে যায়। তিনি নাকি শুধু শব্দটাই শুনেছেন।
একসাথে এতোগুলো কথা বলে একটু বিরতি দিলেন মেজর আসকার শাইখ। ডিজিএফআই-এর এই কেইসটার জন্য তাকে ফিল্ড চিফ করে একটা উইং গঠন করা হয়েছে। উইংয়ের বাকি সবার উদ্দেশ্যেই কথাগুলো বলছিলেন। শেষ করার পর বাম পাশ থেকে দ্বিতীয় চেয়ারে বসা অফিসার জানতে চাইলেন,
– স্যার, সবকিছু উধাও হয়ে আবার ফিরে আসার বিষয়টা নিয়ে কি ভাবছেন।
– দেখুন আমরা আজগুবি কিছু ভেবে নিতে পারেনি। ডাটা বলছে, পুরো এক দিন শিক্ষকরা কেউ বাসা থেক বের হননি। পরদিন ভোরেই সবার সব প্যান্ট ফিরে আসে। এটাকে ব্যাখ্যা করার কোন উপায়.. শেষ করতে পারলেন না, তার আগেই ফোনটা বেজে উঠলো,
– স্যার, শুধু প্যান্ট না, আস্ত একটা ক্যাডেটই উধাও হয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। আমার ক্লাস সেভেনের একটা ছেলে।
তটস্থ হয়ে বললেন কলেজের অ্যাডজুটেন্ট মেজর নিয়ামুল করিম।
– ওকে, তাকে আপাতত আপনার ইন্টারোগেশনে রাখুন, আমরা একটি ডিসিশন নিয়ে তারপর আসছি।

পরের পর্ব>>

৯ টি মন্তব্য : “অন্যরকম ক্যাডেট কলেজ – ২”

মওন্তব্য করুন : হাসান (১৯৯৬-২০০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।