বাংলার গ্যালিলিও ‘রাধাগোবিন্দ চন্দ্র’

মানব সমাজের চালিকাশক্তি বারংবার পরিবর্তিত হয়েছে। কখনও ধর্ম আধিপত্য বিস্তার করেছে, কখনও করেছে দর্শন, কখনও বা আবার সনাতন প্রথায় চলেছে সব কিছু। বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। এটা বলার কারণ হতে পারে, বর্তমান সমাজের চালিকাশক্তি হল বিজ্ঞান। কিন্তু, আমাদের ভেবে দেখা প্রয়োজন আসলেই সমাজের সর্বস্তরে বিজ্ঞানের প্রভাব বিস্তৃত হয়েছে কি-না। এক উপায়ে সেটা বোঝা যেতে পারে।

একসময় মানুষ মনে করতো, তাদের বসতিটাই সবকিছু, এর বাইরে কিছু নেই। ধীরে ধীরে নতুন নতুন ভূমি আবিষ্কার করতে থাকে তারা। তারপরও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সমুদ্র। তখন ভেবে নেয় সমুদ্রই বোধ হয় সবকিছুর শেষ। কিন্তু মানুষ থেমে থাকেনি। সমুদ্র জয়ের নেশায় জলচর যান তৈরি করেছে। পাল তোলা নৌকায় সমগ্র পৃথিবী দাপিয়ে বেড়িয়েছে। এভাবেই একসময় আমরা জানতে পেরেছি পৃথিবীটা কত বড় এবং সেই পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান কোথায়।

এ ধরণের ভৌগলিক আবিষ্কারের পাশাপাশি আরেকটি বিষয় নিয়ে মানুষ সবসময়ই গভীরভাবে চিন্তা করতো। তা হল আকাশ। এই আকাশ নিয়ে মানুষের জল্পনা-কল্পনার কোন সীমা পরিসীমা নির্ধারণ করা যায় না। পৌরাণিক কাহিনীতে আকাশ ছাড়া যেন কিছুই নেই। একসময় আকাশ ছিল ঈশ্বরের স্থান। মানুষ তাই এমনও বিশ্বাস করতো, আকাশের অদ্ভূত বস্তুগুলো দ্বারা ঈশ্বর মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেন। এভাবে জ্যোতিষ শাস্ত্রের (Astrology) সৃষ্টি হয়।

কিন্তু, সভ্যতার ধারা সবসময় সত্য জ্ঞানের দিকে ধাবিত হয়। তাই বিজ্ঞানের মাধ্যমে চূড়ান্ত সত্যকে খুঁজে নিয়েছে মানুষ। মানুষকে আকাশ নিয়ে আর কল্পনা করতে হয়নি। সত্য জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের (Astronomy) জন্ম হয়েছে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত স্থাপিত হয়েছে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা যেতে পারে। কারণ গ্যালিলিও-র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই ধর্মের শৃঙ্খল ভেঙে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল।

আধুনিক বিজ্ঞানের সকল শাখাই মহাকাশ বিজ্ঞানে গিয়ে নতুন মাত্রা পায়। এজন্য পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জীববিজ্ঞান, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, জীবাশ্মবিজ্ঞান সবকিছুরই মহাকাশ পর্যায়ে পৃথক শাখা রয়েছে। যেমন, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্জীববিজ্ঞান ইত্যাদি। এটা স্বাভাবিক। আমাদের বিজ্ঞানের সবকিছু একসময় পৃথিবীর ভিত্তিতে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু এখন আমরা বুঝতে পারছি মহাবিশ্বের সুবিশাল পরিসরে আমাদের অবস্থান কোথায় এবং কত ঠুনকো আমাদের অস্তিত্ব।

তবে সমাজের সবাই এখনও মহাবিশ্বের প্রেক্ষিতে চিন্তা করতে পারে না। প্রায় সবাই ভাবতে পারে, সমগ্র বিশ্বে আমাদের দেশের অমুক জেলায় আমার অবস্থান। কিন্তু সমগ্র মহাবিশ্বের অমুক ছায়াপথের অমুক তারা জগতের অমুক গ্রহে আমাদের অবস্থান, এটা অধিকাংশ মানুষই ভাবতে পারে না। তাই আধুনিক বিজ্ঞান সবাইকে সেই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিতে চায়। সবাই যেন মহাবিশ্বের সাপেক্ষে নিজেদের অবস্থান বুঝতে শিখে। এতে আবার এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়। কারণ কাউকে স্পষ্টভাবে এই ধারণা দিতে হলে বিজ্ঞানের সব শাখার সাধারণ জ্ঞান নিয়ে আলোচনা করতে হয়।
তাই বর্তমানে বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণের চাবিকাঠি হল আন্তর্জাতিকতা (Internationalism) ছাড়িয়ে মহাজাগতিকতার (Universalism) প্রসার ঘটানো। জাতীয়তাবাদ (Nationalism) এখনও প্রবল আমাদের মধ্যে। কিন্তু বিশ্বায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতাবাদ প্রসার পাচ্ছে। তবে বিজ্ঞানের চাহিদা আরও বেশী, বিজ্ঞান চায় মহাজাগতিকতাবাদের প্রসার।

ইউনেস্কো ২০০৯ সালকে “আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ” ঘোষণা করেছে। ২০০৭ সালের ২০শে ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ২০০৯ সালকে বিশেষভাবে বেছে নেয়ার কারণ হচ্ছে, ৪০০ বছর আগে ১৬০৯ সালেই গ্যালিলিও দুরবিন বানিয়ে আকাশ দেখা শুরু করেছিলেন। এই বর্ষ পালনের উদ্দেশ্য, মানুষ যেন মহাবিশ্বে তাদের অবস্থান পুনরায় আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়। এবারের আবিষ্কার হবে সজ্ঞানে, কল্পনার বশে নয়। এটা ইউনেস্কোর একটি বৃহত্তর উদ্যোগের অংশ। বৃহত্তর উদ্যোগটি হল, বিজ্ঞানের সাথে সংস্কৃতির মিথষ্ক্রিয়া বাড়ানো এবং সংস্কৃতিতে বিজ্ঞানের অবদান তুলে ধরা।

বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সংস্কৃতির বিকাশ ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিল। এ কারণে বিশ্ব ঐতিহ্যে বিজ্ঞানের অবস্থান একটি বিশাল অংশ জুড়ে। বিজ্ঞানের মধ্যে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞানের সম্পত্তিগুলো বেশি প্রভাব রেখেছে। বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত মানমন্দিরগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট স্থাপনার সংখ্যা অনেক। কিন্তু, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

২০০৯ সাল আসার আগেই তাই ইউনেস্কো আরেকটি বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে: জ্যোতির্বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান চিহ্নিত করা। ইউনেস্কো থেকে “জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্ব ঐতিহ্য” নামে একটি কর্মপরিকল্পনা পেশ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, বিশ্বের সকল দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞান স্থপনাগুলো চিহ্নিত করা হবে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে এবং উন্নয়নের জন্য কাজ করা হবে। জ্যোতির্বিজ্ঞান স্থাপনাগুলোতে একই সাথে তদানীন্তন স্থাপত্য ও শিল্পের ছাপ পাওয়া যায়। এ হিসেবে ঐতিহ্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠবে এই বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলো।

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি ১৯৯৪ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট স্থানের সংখ্যা বেশ কম। সেগুলোর মধ্যে আবার জ্যোতির্বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট স্থাপনার পৃথক উল্লেখ ছিল না। কিন্তু, আদ্যিকাল থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের পূর্বপুরুষ এবং আমরা এই স্থাপনাগুলোতে বসেই অপার বিস্ময়ে আকাশ দেখে আসছি। আকাশ দেখে এবং এর রহস্য উদ্‌ঘাটন করেই আমরা সভ্য হয়েছি। তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান স্থাপনাগুলোর গুরুত্ব পৃথকভাবে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছে ইউনেস্কো। এখনও পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে এটি। তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়নি।

২০০৯ সালকে সামনে রেখে বাংলাদেশের শৌখিন ও পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে “বিশ্ব জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যবাহী স্থান” হিসেবে একটি মনোনয়ন দেয়া। এক্ষেত্রে অনেকটাই বিস্মৃত একটি নাম উঠে এসেছে। তিনি হলেন রাধাগোবিন্দ চন্দ্র। বাংলাদেশে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার অগ্রদূত তিনি। অবশ্য দেশ বিভাগের পর ষাটের দশকে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান।

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র

১৮৭৮ সালের ১৬ই জুলাই যশোরের বাগচর গ্রামে জন্ম তার। ১৯৭৫ সালের ৩রা এপ্রিল বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে মৃত্যুবরণ করেন। যশোরের বাগচরে তার বাড়িটি এখনও রয়েছে।

৩রা এপ্রিল রাধাগোবিন্দের ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। দেশের বরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এতে অংশ নিয়েছেন। আলোচনার শেষে সর্বসম্মতিক্রমে যশোরে রাধাগোবিন্দের বাড়িকে বিশ্ব জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়। আশা করা হচ্ছে, ইউনেস্কোতে এই স্থানের নাম পাঠানো হবে।

কিন্তু আন্তর্জালে রাধাগোবিন্দ নিয়ে খুব বেশী কিছু লেখা হয়নি। বাংলা উইকিপিডিয়াতে গত বছর একটি নিবন্ধ শুরু করা হয়েছিল। এটাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রবন্ধ হিসেবে রয়েছে। ইংরেজি উইকিপিডিয়াতে তার নিবন্ধটি সমৃদ্ধ করে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবদানের সাথে রাধাগোবিন্দের স্মৃতি জড়িয়ে থাকুক এটাই সবার কামনা।

দুরবিনের সাথে চন্দ্র

রাধাগোবিন্দ সমাজের একেবারে নিচু স্তরে বাস করে নিজ উদ্যোগে যে পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করেছেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। ১৯১৮ সালের ৭ই জুন তিনি আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পেলেন যা তার নক্ষত্রের মানচিত্রে ছিল না। তিনি তার এই পর্যবেক্ষণের কথা হাভার্ড মানমন্দিরে জানান এবং এভাবেই “নোভা অ্যাকুইলা-৩ ১৯১৮” আবিস্কৃত হয়। পরে তাকে “আমেরিকান এসোসিয়েসন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজারভার” (American Association of Variable Star Observers – AAVSO) সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে। ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ এর মধ্যে তিনি ৩৭,২১৫টি বিষম তারা পর্যবেক্ষণ করেন এবং এসব তথ্য আভসো (AAVSO) কে প্রদান করেন। তার এই কার্যক্রমের জন্য তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আভসোর এক তালিকায় স্থান করে নেন, যাতে আর মাত্র ২৫ জন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা ১০,০০০ এর বেশি বিষম তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন।

রাধাগোবিন্দের বাড়িই আমাদের ঐতিহ্য। কারণ এই বাড়ির ছাদে বসেই তিনি দুরবিনে চোখ লাগিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। অনেক স্থানেই বলা হয়, গ্যালিলিও প্রথম একটি সাধারণ দুরবিনের এক পাশে একটি অসাধারণ মস্তিষ্ক স্থাপন করেন। এভাবেই মহাজাগতিক রহস্যের দ্বার উন্মোচিত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাধাগোবিন্দই প্রথম এ কাজটি করেছেন, একটি অতি সাধারণ দুরবিনের এক পাশে একটি অসাধারণ মস্তিষ্ক স্থাপন করেছেন। এভাবেই তিনি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছেন, বাংলাদেশের গ্যালিলিও হিসেবে। এই অনুসন্ধিৎসাই আমরা ঐতিহ্য হিসেবে বয়ে বেড়াবো।

রাধাগোবিন্দ একটি কিংবদন্তীর নাম

চন্দ্র

অনেকে জানেন বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ইউনেস্কো চিহ্নিত তিনটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট আছে:
১। মসজিদবহুল বাগেরহাট শহর
২। পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
৩। সুন্দরবন
সর্বকালের সেরা বাঙালি জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাধাগোবিন্দ চন্দ্র-র বাড়ি-ই হোক আমাদের চতুর্থ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। সোসাইটি-র একটি দল যশোরে তার বাড়ি ঘুরে এসেছে। গত মাসে ঢাকার কাঁটাবনে “রাধাগোবিন্দ মেমোরিয়াল লেকচার” নামে একটি বিজ্ঞান বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছিল যাতে বক্তৃতা দিয়েছেন আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানী ডঃ দীপেন ভট্টাচার্য। রাধাগোবিন্দ আবিষ্কৃত প্রথম তারা “নোভা আকুইলা” নিয়ে তিনি বিস্তারিত কথা বলেছিলেন। রাধাগোবিন্দ-র জীবনে পড়ে আমি একই সাথে দুটি বিষয় উপলব্ধি করেছি: ঘরের কাছে এক মহান ব্যক্তি রেখে আমরা কোনদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলাম এবং আমেরিকা কিভাবে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে গিয়ে গিয়ে মেধাবীদের সাথে যোগাযোগ করে। উল্লেখ্য AAVSO-র প্রথম দু’জন আন্তর্জাতিক সদস্য ছিলেন যথাক্রমে:
১। জিওভান্নি বি. লাচ্চিনি – ইতালি (৫৮,০০০ বিষম তারা পর্যবেক্ষণ)
২। রাধাগোবিন্দ চন্দ্র – বাংলাদেশ (তদানীন্তন ‘ভারত’) (৩৭,২১৫ টি)

আমার দম বন্ধ হয়ে আসে!- কি পরিমাণ উচ্চাভিলাস ও একাগ্রতা থাকলে একজন মানুষ অতি নিম্ন মানের দুরবিন ব্যবহার করে সাইত্রিশ হাজার তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন এবং সবগুলো পর্যবেক্ষণের ফলাফল লিপিবদ্ধ করতে পারেন! রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের খবর তো বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ দূরের কথা সরকারও জানতো না। অথচ তার সম্মানে সুদূর হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে একটি ভাল মানের দুরবিন পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এমনকি ১৯৬০-এর দশকে হার্ভার্ড থেকে একটি অনুসন্ধিৎসু দল বাংলাদেশের যশোরে এসেছিল গোবিন্দের সাথে দেখা করতে। এসে শুনে, রাধাগোবিন্দ নাকি অনেক আগেই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেছেন। কেউ তার ঠিকানা দিতে পারেনি। অবশেষে ভারতীয়দের সাথে যোগাযোগ করে হার্ভার্ড দল তার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিলেন, কিন্তু গিয়ে শুনেন ইতিমধ্যেই তিনি দেহত্যাগ করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য অন্তত মৃত্যের পরে হলেও আমরা এই মহান ব্যক্তিকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারছি।

চন্দ্রের বাল্যকাল সম্পর্কে জেনে আরও চমৎকৃত হয়েছি। তিনি তিন তিন বার ম্যাট্রিকে ফেল করার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা “নবম শ্রেণী” পর্যন্ত। পড়াশোনা আর করতে না পেরে তিনি ১৫ রুপী বেতনের একটি চাকরিতে যোগ দেন। তার কাজ ছিল পয়সা পরীক্ষা করা। এমন সময়ই জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথে তার প্রথম পরিচয় ঘটে। এলাকার এক আইনজীবী ছিলেন কালিনাথ মুখোপাধ্যায় নামে যিনি সে সময় আকাশের একটি মানচিত্র তৈরি করছিলেন, নিছক শখের বশে। রাধাগোবিন্দ তার সাথে মানচিত্র তৈরির কাজে লেগে যান, আর তখন থেকেই তার নেশার সূচনা। ১৯১২ সালে পৃথিবীর কাছ দিয়ে হেলির ধূমকেতু উড়ে যায় যা চন্দ্র বাইনোকুলার দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। সে বছরই লন্ডন থেকে ১৩ পাউন্ড দিয়ে একটি ৩ ইঞ্চি ব্যাসের দুরবিন আনান। শুরু হয় তার পর্যবেক্ষণ জীবন। পর্যবেক্ষণ করে বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যাবার পর ১৯২৬ সালে AAVSO-র শুভাকাঙ্ক্ষী চার্লস ডব্লিউ, এলমার তাঁকে একটি ৬ ইঞ্চি ব্যাসের দুরবিন পাঠান। এই ৬ ইঞ্চি দুরবিন দিয়েই তার আসল কাজ শুরু হয়, ৩৭,২১৫ টি তারা পর্যবেক্ষণ করে অসাধ্য সাধন করেন। ১৯৫৪ সালে চন্দ্র আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যবেক্ষণ জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি ভারতে গিয়েছিলেন ১৯৬০ সালে। তার মানে তাঁর পুরো জ্যোতির্বিজ্ঞান জীবন কেটেছে এই বাংলাদেশের যশোরে, আমাদেরই পাশে।

রাধাগোবিন্দ চন্দ্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে নিচের পাতা দুটোতে ঘুরে আসুন:

ফেসবুক এ রাধাগোবিন্দ চন্দ্র-র ফ্যান পেজ
বাংলা উইকিপিডিয়া-য় তার জীবনী


লেখাটি সচলায়তন-এ পূর্ব প্রকাশ করেছিলাম। ‘শেষকথা’ টুকু যোগ করে এবং কিছু সাম্প্রতিক তথ্য যোগ করে সিসিবি-তে প্রকাশ করলাম। কারণ এখনও এটা খুব রেলিভেন্ট।

২৫ টি মন্তব্য : “বাংলার গ্যালিলিও ‘রাধাগোবিন্দ চন্দ্র’”

  1. মাসরুফ (১৯৯৭-২০০৩)

    হায় রে অভাগা আমি-এই মহান বিজ্ঞানীর নাম আমি আমার সাড়ে ২৪ বছরের জীবনে এই আজকে প্রথম শুনলাম!তাও আবার উনার বাড়ী হচ্ছে আমার বাড়ী বাগেরহাটের পাশের জেলা যশোরে!

    জবাব দিন
          • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

            কিছুই করার নাই। রাধাগোবিন্দের মত এত অখ্যাত এবং এত বিখ্যাত বিজ্ঞানী পৃথিবীর ইতিহাসে বোধহয় আর নাই। বাংলাদেশের প্রায় কেউই তার নাম জানে না। আসলে জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ যাদের নাই তাদের প্রায় কেউই জানে না। তবে ভবিষ্যতে আশাকরি আরও বেশি জানবে।

            এরকম আরেকজন অখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হলেন "মোহাম্মদ আবদুল জব্বার"। জব্বার বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে বাংলায় সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য লেখা তিনিই শুরু করেছিলেন। বুয়েট এর একটা অফিসিয়াল স্কাই ম্যাপ আছে যেটা জব্বারের করা। (বর্তমানে অবশ্য এটা অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির কাছে আছে) তিনি কোন হলের জানি প্রভোস্ট ছিলেন। আবদুল জব্বারের লেখার ভক্ত আমি। উনার "তারা পরিচিতি" বইটা যেকোন বাঙালি আকাশ পর্যবেক্ষকের জন্য অবশ্য পাঠ্য।

            বর্তমানে বুয়েটে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির অনেক কাজ করছেন ইলেকট্রিক্যাল এর শিক্ষক "ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী"। বুয়েটের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই তিনি "জ্যোতির্বিজ্ঞান শব্দকোষ" নামে বাংলা ভাষায় প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞান ডিকশনারি লিখেছিলেন যেটা প্রকাশ করেছিল বাংলা একাডেমি।

            জবাব দিন
  2. তানভীর (৯৪-০০)

    ধন্যবাদ মুহাম্মদ, তোমার কল্যাণে আমাদের এরকম একটা মেধাবী ব্যাক্তির সাথে পরিচয় হল। আমরা তোমাকেও একদিন রাধাগবিন্দ চন্দ্রের জায়গায় দেখতে চাই।

    জবাব দিন
  3. ফয়েজ (৮৭-৯৩)

    আরে আজিব তো, আমি এনার নাম জানি। নিজেরে বিজ্ঞ বিজ্ঞ মনে হচ্ছে। 😀

    একটা কথা ঠিক বলেছো, উন্নত বিশ্ব এগিয়েছে কারন তারা গুনীর কদর করেছে, তাদের সম্মান দিয়েছে, আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা গুনীর কদর করেছি তিনি বা তাঁরা মারা যাবার পরে। তাও মৃত্যু দিবস পালন আর আলোচনা সভার মাঝেই, অন্য কিছু করার টাইম নেই।


    পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনও গেল না

    জবাব দিন
  4. আহসান আকাশ (৯৬-০২)
    ধন্যবাদ মুহাম্মদ, তোমার কল্যাণে আমাদের এরকম একটা মেধাবী ব্যাক্তির সাথে পরিচয় হল। আমরা তোমাকেও একদিন রাধাগবিন্দ চন্দ্রের জায়গায় দেখতে চাই।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  5. মোস্তফা (১৯৮৮-১৯৯৪)

    খুবই চমৎকার একটি পোষ্ট। আমাদের দেশেই যে কত বরেন্য ব্যক্তির জন্ম হয়েছে আমরা তা জানি না। এটা না জানা টা কারো ব্যক্তিগত দোষ নয়। দোষ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমরা এমন কিছু পড়াই আর এমনভাবে পড়াই, তাতে সবাই শুধু পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্যই পড়ি, জানার আগ্রহে নয়। এখন অন্তর্জালের কারণে, ব্লগের কারণে অনেক কিছুওই জানা যায়। তাই কারোর আশায় বসে না থেকে আমাদের বাংলা উইকিপিডিয়া কে সমৃদ্ধ করা উচিত। যে যখনই সময় পাই, যে কোন বই থেকে নতুন কিছু পড়ি, চেষ্টা করা উচিত কয়েক বাক্য হলেও বাংলা উইকিতে যোগ করে দিই।

    মুহাম্মদ তুমি একটি পোষ্ট দিতে পারো, বাংলা উইকিতে কিছু সংযোজন করতে হলে প্রক্রিয়াটি কি এই নিয়ে। আমরা যারা ব্লগে লিখি তাদের জন্য এই সময়টুকু দেওয়া খুব বেশি কিছু নয়। আগে বাংলা উইকি সমৃদ্ধ হলে ইংরেজী উইকিতে সেগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে। আবার কেউ যদি ইংরেজী উইকিতে ভাল কিছু পান, মনে করেন যে এটা বাংলা উইকিতে দিলে ভাল হবে সেটাও অনুবাদ করে দিতে পারেন।

    আসুন সবাই মিলে বাংলা বিশ্বকোষটিকে সমৃদ্ধ করি।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      খুব ভাল প্রস্তাব মোস্তফা ভাই। অনেক সমালোচনা থাকলেও উইকিপিডিয়া যে আন্তর্জালে মুক্ত জ্ঞানের জগতে নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। আমার আন্তর্জাল পাগলামির শুরু হয়েছিল উইকিপিডিয়া দিয়ে।

      ঠিক আছে। বাংলা উইকিপিডিয়া কী এবং এতে কিভাবে লিখতে হবে তা নিয়ে একটি বিস্তারিত লেখা দেয়ার ইচ্ছা রইল। একটু ফ্রি হলেই লিখে ফেলবো।

      জবাব দিন
  6. রকিব (০১-০৭)

    স্যালুট টু রাধাগোবিন্দ চন্দ্র।
    খুব ছোটকাল থেকেই টেলিস্কোপের প্রতি বিশাল একটা লোভ ছিল, এখনো বোধহয় মরেনি। ৪.৫ ইঞ্চির একটা টেলিস্কোপ দেখে রেখেছি, আরেকটু পয়সা জমলে বগলদাবা করবো।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : কুচ্ছিত হাঁসের ছানা (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।