হায়াও মিয়াজাকির বিশ্ব

প্রিয় এনিমেশন পরিচালক হায়াও মিয়াজাকির সিনেমা যত দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। জাপানী এনিমেশনকে এনিমে বলা হয়। তাই আমিও এখানে এনিমে ব্যবহার করছি। আসলে শুধু এনিমে সেক্টরে না, সবকিছু মিলেই জাপানে মিয়াজাকির চেয়ে মেধাবী কোন চলচ্চিত্র পরিচালক এখন নেই। ইসাও তাকাহাতার দুটো সিনেমা খুবই ভাল লেগেছে। কিছু দিক দিয়ে তাকাহাতা মিয়াজাকির সমমানের হলেও তার ওপর মিয়াজাকির প্রভাব সুস্পষ্ট। আমি এখন পর্যন্ত মোট পাঁচটা সিনেমা দেখলাম, প্রত্যেকটাই সুন্দর। সবচেয়ে ভাল লেগেছে মাই নেইবর তোতোরো। মিয়াজাকির সিনেমা দেখে সেই কথার মর্ম বুঝতে পারলাম,

শিশু সাহিত্য তখনই ভাল হয় যখন তা শিশুদের জন্য লেখা হয় না। আসলে শিশু সাহিত্যের মর্মার্থ বোঝার ক্ষমতা কেবল বড়দেরই আছে। শিশুরা তা দেখে কেবল নির্মল আনন্দটাই পেতে পারে, আর কিছু না।

আর বাচ্চাদের বোঝানোর ছলে যে মানুষের অন্তরে কত ভাষা ঠেসে দেয়া যায় এটা মিয়াজাকি না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব না। হলিউড ও ইউরোপের কিছু রূপকথার সিনেমা তো দেখেছি, দেখেছি লর্ড অফ দ্য রিংস বা স্পেনের প্যানস ল্যাবিরিন্থ। কিন্তু কোনকিছুই মিয়াজাকির মত স্পর্শ করতে পারেনি। স্টেরিওটাইপিং না থাকার কারণেই বোধহয় মিয়াজাকির চরিত্রগুলো এত মোহনীয় হয়ে উঠে, চরিত্রগুলোকে খুব কাছ থেকে বোধহয় এজন্যই দেখতে ইচ্ছে করে।

হায়াও মিয়াজাকি

হায়াও মিয়াজাকি

মিয়াজাকির সিনেমার প্রথম পাঠ হতে পারে থিম বোঝার মাধ্যমে। তাই তার মুখ্য থিমগুলো নিয়েই আজ আলোচনা করতে চাই।

ভাল-মন্দ

মিয়াজাকির অধিকাংশ চরিত্রই খুব গতিময়। তারা থেমে থাকে না, নিজেদের পরিবর্তন করতে জানে, কিন্তু এই পরিবর্তন কখনও প্রথাগত ভালো-মন্দের সংজ্ঞা মেনে হয় না। তার ভিলেন চরিত্রগুলোরও প্রায়শ্চিত্ত করার ক্ষমতা থাকে, তাই তাদেরকে সরাসরি অ্যান্টাগনিস্ট বলে দেয়া যায় না। যেমন প্রিন্সেস মোনোনোকি তে লেডি এবোশি গাছপালার উপর নির্ভরশীল প্রাণীদের কথা না ভেবেই কারখানার কাঁচামালের জন্য বনের পর বন উজাড় করে, কিন্তু অন্যদিকে তার আশ্রয়ে থাকা কুষ্ঠ রোগী ও পতিতারা তাকে খুব ভালোবাসে ও শ্রদ্ধা করে। মিয়াজাকির আরও কিছু সিনেমার মত এটাও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে পরিপূর্ণতা অর্জন করে। এনিমেশন সিনেমায় এমনটা বিরল। অধিকাংশ সময়ই শিশু সাহিত্যের আদলে প্রোটাগনিস্ট ও অ্যান্টাগনিস্ট সৃষ্টি করা হয় এবং শেষে গিয়ে অ্যান্টাগনিস্টের পরাজয়ের মাধ্যমে সিনেমা পরিপূর্ণতা অর্জন করে। মিয়াজাকি এটাকে পরিবর্তন যেমন করেছেন ঠিক তেমনি এর পেছনে শৈল্পিক পটভূমি দাঁড় করিয়েছেন। স্পিরিটেড অ্যাওয়ে সম্পর্কে তিনি একবার বলেছিলেন,

নায়িকা এমন এক জগতে গিয়ে পড়ে যেখানে ভাল এবং মন্দ একসাথে থাকে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কিন্তু তাকে মন্দকে ধ্বংস করতে হয়নি, ভাল এবং মন্দ আগের মতই সহবাস করছে, নায়িকা কেবল এই পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে শিখেছে।

ভাল-মন্দের এই জটিল সীমারেখা সম্পর্ক প্রশ্ন করলে মিয়াজাকি বলেন, একবিংশ শতকের অত্যন্ত জটিল সমাজ ব্যবস্থায় ভালো-মন্দের প্রাচীনপন্থী সংজ্ঞা খাটে না। প্রাচীন আচার-ব্যবহার এখন আর প্রযোজ্য নয়, সেগুলো হয় বাদ দিতে হবে নয় সংশোধন করতে হবে। এই যুগের সাহিত্য বা শিল্পে অতি সাধারণ স্টেরিওটাপিং করে পার পাওয়া যায় না, এমনকি শিশু সাহিত্যেও না। মিয়াজাকি নিজেও কখনও কখনও নিরাশায় ভুগেন, কিন্তু শিশুদের কাছে তিনি সামগ্রিকভাবে পৃথিবীর একটি ইতিবাচক চিত্রই তুলে ধরতে চান।

অবশ্য এক্ষেত্রেও মিয়াজাকির খানিকটা বিবর্তন হয়েছে। তার প্রথম সিনেমাগুলোতে কিছু খাঁটি ভিলেন দেখা যেতো। যেমন ক্যাসল ইন দ্য স্কাই এর মুস্কা, কোনকিছুই বোধহয় তাকে ভাল করতে পারতো না। কিন্তু পরের দিকের বেশ কিছু সিনেমাতে দেখা গেছে, কোন ভিলেনই নেই, যেমন- মাই নেইবর তোতোরো। এছাড়া তার বেশ কিছু সিনেমাতে জাপানের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও সুপ্রাচীন সর্বপ্রাণবাদের (Animism) স্বাদ পাওয়া যায়। স্পিরিটেড অ্যাওয়ের থিম আগাগোড়াই সর্বপ্রাণবাদ থেকে এসেছে। মাই নেইবর তোতোরো তেও এর কিছু ছাপ রয়ে গেছে।

পরিবেশবাদ

মিয়াজাকির সিনেমাতে অনেক সময়ই পরিবেশের প্রতি সহানুভূতি, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন এবং পৃথিবীর নাজুক রূপটি দেখা যায়। মাই নেইবর তোতোরো তে বিশাল গাছের ওপাশে পাহাড় ঘেঁষে এক অদ্ভুত বন দেখা যায় যেখানে সব ঐন্দ্রজালিক জীব-জন্তুর বাস। একটি পরিবার এই গাছের পূজা করে। প্রিন্সেস মোনোনোকি তে মিয়াজাকি একটি বিস্ময়কর বাস্তুতন্ত্র তৈরি করেছেন যেখানে সুপ্রাচীন গাছগাছালি, ফুল, নেকড়ে, দেব-দেবী, নদী সবই পাওয়া যায়। স্পিরিটেড অ্যাওয়েতে পরিবেশ সচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে একটি “রিভার স্পিরিট” এর মাধ্যমে। এই “নদীর আত্মা” আত্মার দেশে আসে নিজেকে পরিষ্কার করতে। পরিষ্কার করতে গিয়েই বোঝা যায় মানুষ নদীকে কতটা দূষিত করে ফেলেছে। ডিভিডি কমেন্টারিতে মিয়াজাকি বলেছেন, এই দৃশ্যটা একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত। নিজের বাড়ির পাশে একটি নদী পরিষ্কারে সাহায্য করেছিলেন মিয়াজাকি। সেখানকার অভিজ্ঞতা থেকেই রিভার স্পিরিটের জন্ম দিয়েছেন।

প্রিন্সেস মোনোনোকি, ক্যাসল ইন দ্য স্কাইনাউসিকা অফ দ্য ভ্যালি অফ উইন্ড– এই তিন সিনেমাতেই বাস্তুতান্ত্রিক স্বর্গ হুমকির সম্মুখীন হয়, এই নৈসর্গ্যিক বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে দেয়ার হুমকি দেয় সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সামরিক বাহিনী। দুই পক্ষে যুদ্ধ বাধে। প্রাকৃতিক উপায়ে জীবন ধারণ এবং সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে সংস্কৃতি ধ্বংস এই দুয়ের মধ্যে সংঘাত চলে নিরন্তর। প্রোটাগনিস্টরা এই যুদ্ধে প্রচণ্ড সক্রিয় হয়ে উঠে। এছাড়া যুদ্ধ ও সংঘাতের দৃশ্যগুলোতে ভূমি ও সম্পদের নির্বিচার ধ্বংস খুব স্পষ্টভাবে দেখানো হয়, আবহে থাকে সামরিক সঙ্গীত। এর মাধ্যমে স্থানীয় অধিবাসীদের ভীতি ও কষ্ট প্রকট হয়ে ওঠে।

দ্য নিউ ইয়র্কার সাময়িকীতে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মিয়াজাকি বলেছিলেন যে, আধুনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকাংশই খুব হালকা ও কৃত্রিম এবং শুনতে একটু হাস্যকর শোনালেও তিনি মাঝেমাঝে ভাবেন, ভবিষ্যতে একটা অ্যাপোক্যালিপ্টিক যুগ আসবে; এই যান্ত্রিক সভ্যতা ধ্বংস হবে, সবুজ সংস্কৃতি আবার সিংহাসনে আরোহণ করবে। মিয়াজাকি সম্রাট হিরোহিতোর যুগ পার করেছেন। সে যুগে শিল্পায়নের নামে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংস করা হয়েছে, পাহাড় ও নদীর সেই কান্নাই হয়তো তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আর সার্বিকভাবে মিয়াজাকি মনে করেন, শিশুদের বিশ্বে বড়দের হস্তক্ষেপ করা উচিত না, আরও স্পষ্ট করে বললে, শিশুদের উপর বড়দের ভিশন চাপিয়ে দেয়া উচিত না।

যুদ্ধের বিরোধিতা

নাউসিকা প্রিন্সেস মোনোনোকি এই দুই সিনেমাতেই যুদ্ধবিরোধী মনোভাব স্পষ্ট। প্রিন্সেস মোনোনোকি তে আশিতাকা মানুষের দুই গ্রুপের যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। এই যুদ্ধের একসময় অবসান ঘটে, আশিতাকা তখন প্রকৃতির সাথে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। এ ধরণের যুদ্ধে মিয়াজাকি সবসময়ই গ্রাফিক ডিটেইলের দিকে খুব বেশি মনোযোগ দেন। অ্যাপোক্যালিপ্টিক বিশ্বের প্রকৃত চেহারা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। নাউসিকা ও মোনোনোকি দুটোতেই অকাল প্রয়াত প্রাচীন বিশ্বের ধ্বংসাবশেষের ছড়াছড়ি দেখা যায়। ক্যাসল ইন দ্য স্কাই এ সামরিক বাহিনীর প্রকৃত চেহারা ফুটে উঠেছে সূক্ষ্ণ ডিটেইল নিয়ে: লোভী, সহিংস, মাথামোটা যারা অকারণেই ধ্বংস করতে ভালোবাসে।

মিয়াজাকির স্পিরিটেড অ্যাওয়ের ইংরেজিং ডাব্‌ড ভার্শন যুক্তরাষ্ট্রে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ২০০৩ সালে এটা “সেরা এনিমেশন চিত্র” হিসেবে অস্কার পায়। কিন্তু মিয়াজাকি নিজে পুরস্কার আনতে আমেরিকায় যাননি। পরবর্তীতে এর কারণ হিসেবে বলেছিলেন,

আমি এমন কোন দেশ ভ্রমণে যেতে চাইনি যারা ইরাকে বোমা হামলা করছে।

মানুষের আকাশে ওড়া

মিয়াজাকির একটি বড় জিয়নকাঠি হচ্ছে মানুষের আকাশ জয়। ওড়াকে তিনি দেখেন, মহাবিশ্বের সবচেয়ে মৌলিক যে বল, যে বাঁধা, সেই মহাকর্ষকে হার মানিয়ে মুক্ত হয়ে যাওয়া, ‘লিবারেশন ফ্রম গ্র্যাভিটি” এই বাক্য দুটো তাকে অনেকবার ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ২০০২ সালে স্টুডিও জিবলি “ইমাজিনারি ফ্লাইং মেশিন” নিয়ে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা বানায় যাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন স্বয়ং মিয়াজাকি।

ক্যাসল ইন দ্য স্কাই এ পুরো একটা উড়ন্ত শহর তৈরি করা হয়েছে। মেঘের আড়ালে সবার অলক্ষে সেই শহর উড়ে বেড়ায়, অভিকর্ষের সাথে জটিল খেলায় মেতে থাকে সর্বক্ষণ। নাউসিকা নামের মেয়েটি নিজের গ্লাইডারে করে নিপুণ দক্ষতায় উড়ে বেড়ায়, এছাড়া এই সিনেমায় এয়ারবোর্ন সশস্ত্র বাহিনী দেখা যায়, দুই পক্ষেই- প্রোটাগনিস্ট এবং অ্যান্টাগনিস্ট। মাই নেইবর তোতোরো তে তোতোরো নামের অদ্ভুত প্রাণীটি সেতসুকি ও মেই কে নিয়ে আকাশে উড়ে বেড়ায়। এক পলকে পুরো একটা গ্রাম দেখিয়ে আনে। স্পিরিটেড অ্যাওয়েতে চিহিরো ঘুরে আসে ড্রাগনরুপী হাকুর সাথে।

তবে মিয়াজাকির সবচেয়ে সফল সিনেমাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রিন্সেস মোনোনোকি তে কোন ওড়ার দৃশ্য নেই উড়তে পারে এমন কোন চরিত্রও নেই।

রাজনীতি

মিয়াজাকি এক সময় মার্ক্সবাদী ছিলেন। তার মার্ক্সীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ কিছু সিনেমায় ঘটেছে। যেমন ক্যাসল ইন দ্য স্কাই এ শ্রমিক শ্রেণীকে মার্ক্সীয় ধারায় এক ধরণের আদর্শায়িত সমাজ হিসেবে দেখানো হয়। তবে নাউসিকা নিয়ে কাজ করার সময় মিয়াজাকি মার্ক্সবাদ ত্যাগ করেন। এ সম্পর্কে বলেন, “কেবল শ্রমিক বলেই তার সবকিছু ঠিক হবে এটা আর মেনে নিতে পারলাম না।” অবশ্য এখনও তার মধ্যে কিছু সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা আছে। এখনও তিনি পুঁজিবাদ, বিশ্বায়ন এবং আধুনিক জীবনের ওপর এগুলোর প্রভাবের তীব্র সমালোচনা করেন।

নারীবাদ

স্টুডিও জিবলির প্রধান তোশিও সুজুকি বলেছেন, হায়াও মিয়াজাকি নারীবাদী। নারী শ্রমিকদের প্রতি তার মনোভাব দেখেই সুজুকি এমন ধারণা পোষণ করেন। আমাদের অবশ্য এটা বুঝতে হলে স্টুডিওতে যাওয়ার দরকার নেই। সিনেমাতেই অনেক নারীবাদী থিম দেখা যায়। যেমন তার সিনেমার প্রায় সব অ্যান্টাগনিস্ট এবং প্রোটাগনিস্ট চরিত্রই নারী। মোটকথা চরিত্র যদি শক্তিশালী হয় তবে তা নারী হবেই। যেমন তার সিনেমায় আসলে কোন নায়ক নেই। নায়িকাই মুখ্য। প্রায় প্রতিটি সিনেমার কেন্দ্রে থাকে একটি মেয়ে, অবশ্যই কম বয়সী। বয়স্ক নারীদের তিনি খুব কর্কশ ও শক্তিশালী ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে দেখান, বয়স্ক পুরুষদের দেখান ক্লাউন ও দুর্বল হিসেবে। নায়কের বিপরীতে মাঝেমাঝে যে নায়কোচিত চরিত্র দেখা যায় সে খুব স্পর্শকাতর ও মোলায়েম হয়, সবাইকে ভালোবাসতে চায়। কিন্তু নায়ক-নায়িকার মধ্যে সম্পর্কটা হয় একেবারেই প্লেটোনিক, অনেকটা ভাই-বোনের মত। সবগুলো সিনেমার কনক্লুসিভ প্রোটাগনিস্ট চরিত্রে থাকে মেয়ে, এবং মিয়াজাকির সব নায়িকাই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ও মানবতাবোধের অধিকারী।
মিয়াজাকির নায়িকাদের সম্পর্কে জানতে হলে এই লেখাটা পড়ে দেখা যেতে পারে: Miyazaki’s Heroines by Freda Freiberg

শিশু ও শৈশব

এই থিম সম্পর্কে তো না বললেও চলে। মিয়াজাকির একটা উক্তিই বোধহয় যথেষ্ট:

শিশুদের আত্মা হচ্ছে পূর্ববর্তী প্রজন্মের ঐতিহাসিক স্মৃতির ভাণ্ডার।

সত্যিই তো। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মানুষ ২ লক্ষ বছরে যা অর্জন করেছে তার সবই তো সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটির স্লেটে লেখা থাকে। শিশুরাই তো মানবতার উত্তরাধিকার।

মিয়াজাকি অনেক সিনেমাতেই শৈশব নিয়ে কাজ করেছেন। বাস্তব পৃথিবীতেই একটা কাল্পনিক জগৎ তৈরির ধারণা মিয়াজাকির সৃষ্টি না হলেও, এটা যে সবচেয়ে ভালভাবে তিনিই প্রয়োগ করতে পেরেছেন তাতে সন্দেহ নেই। মিয়াজাকির এই থিমের সাথে তাই অনায়াসেই জে এম ব্যারির তুলনা চলে। ব্যারির পিটার প্যান নাটকটি দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ড সিনেমায় তার কিছুটা স্বাদ পেয়েছিলাম। বাস্তবের মধ্যে যে কাল্পনিক জগৎ উৎকৃষ্ট সাহিত্যে সেই জগতের সন্ধান কেবল শিশুরাই পায়। এই থিম এখন বিশ্ব ফ্যান্টাসিতে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু এ জনপ্রিয়করণে মিয়াজাকির ভূমিকা অনন্য। শৈশব ছেড়ে উঠে আসার থিমও তিনি ব্যবহার করেছেন। সিনেমা ও সাহিত্যে এই ধারাকে বলে বিল্ডুংস্রোমান। স্পিরিটেড অ্যাওয়েতে বিল্ডুংস্রোমান এর কিছু উদাহরণ আছে।

শৈশব নিয়ে মিয়াজাকির এক ধরণের মোহ আছে। তিনি শৈশবকে দেখেন স্বর্গ হিসেবে, কারণ শৈশবে মানুষ বাবা-মা র অধীনে থাকে, আশপাশের কোন সমস্যাই তাকে স্পর্শ করে না। তবে আধুনিক বিশ্বে শিশুর জীবন নিয়ে তিনি চিন্তিত। জন্মের পরপরই যেভাবে ভার্চুয়াল জগৎ শিশুকে চেপে ধরে, তাতে ভবিষ্যতে শিশুর সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক টুটে যায় কি-না কে জানে। মিয়াজাকির মত আমিও মনে করি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পর্ক হচ্ছে একটি শিশুর সাথে প্রকৃতির সম্পর্ক। মিয়াজাকি তাই বর্তমানের শিশুদের নিয়েই কাজ করতে চান। চরিত্রগুলো বানান শিশুদের সাথে তার বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে।

মিয়াজাকির যে পাঁচটি সিনেমা দেখেছি

Nausicaä of the Valley of the Wind (১৯৮৪)

Nausicaä of the Valley of the Wind (১৯৮৪)

ভ্যালি অফ উইন্ড-এর রাজকন্যা নাউসিকা, তার গ্লাইডার নিয়ে এক মহান যুদ্ধে যোগ দিয়েছে- পৃথিবী রক্ষার যুদ্ধ। অনেকদিন আগে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা পৃথিবীতে আজ কীটপতঙ্গের রাজত্ব। এই কীটদেরও নাউসিকা ভালোবাসে। তাদের সাথে সন্ধি করে নতুন পৃথিবী বানাতে চায়।
Laputa: Castle in the Sky (১৯৮৬)

Laputa: Castle in the Sky (১৯৮৬)

আকাশ থেকে এক পরী নেমে আসে। পাৎসু তাকে রক্ষা করে, জানতে পারে তার নাম সেইতা, এখানে আসার কারণও জানা হয়ে যায়। সেইতার লক্ষ্যের সাথে পাৎসুর উড়ন্ত দুর্গ সন্ধানের স্বপ্ন মিলে যায়। দুজনের যাত্রাপথ হয় এক। এই রোমাঞ্চকর অভিযানই সিনেমা। পথে তারা মিলে এক অদ্ভুত পাইরেট (আকাশদস্যু!) গ্যাং এর সাথে।
My Neighbor Totoro (১৯৮৮)

My Neighbor Totoro (১৯৮৮)

সাতসুকি ও মেই দুই বোন, সাতসুকি বড়, মেই ছোট তবে দুজনই তাদের শৈশবে, সাতসুকি সবে বড় হতে শুরু করেছে। মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বাবা তাদের নিয়ে চলে এসেছেন গ্রামের বাড়িতে। এই বাড়িতেই এক অদ্ভুত ঐন্দ্রজালিক জগতের দেখা পায় দুই বোন, যে জগৎ বড়রা দেখতে পারে না। তারা মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পায় এই অদ্ভুত বিশ্বের মধ্য দিয়েই।
Princess Mononoke (১৯৯৭)

Princess Mononoke (১৯৯৭)

দেবতা থেকে অসুর হয়ে যাওয়া এক দানবের অভিশাপে অভিশপ্ত আশিতাকা রিডেম্পশনের জন্য পথে বেরোয়। কিন্তু তার সেই রিডেম্পশন ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে মানবতার রিডেম্পশন। কারণ মানুষ মিনিটের মধ্যে এমন একটি বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে দিতে চাচ্ছে যা গড়ে উঠতে লক্ষ বছর লেগেছে। নেকড়েদের রাজকন্যা মোনোনোকির হাত ধরেই আশিতাকা খুঁজে রিডেম্পশনের পথ। অনেকের মতে এটাই মিয়াজাকির সেরা সিনেমা।
Spirited Away (২০০১)

Spirited Away (২০০১)

চিহিরো বাবা-মার সাথে নতুন এক শহরে থাকতে এসেছে। নিজেদের বাসা খুঁজতে গিয়ে তারা সবাই আত্মার জগতে হারিয়ে যায়। বয়সের স্রোতে পঙ্কিল হয়ে যাওয়া বাবা-মা পরিণত হয় শুকরে। চিহিরো ভাল-মন্দের অদ্ভুত সমাবেশের মধ্যেই মুক্তির সাধ নিয়ে বেঁচে থাকে। নদীর আত্মা হাকু তাকে সাহায্য করে, সাহায্য করে আরও অনেকে, কেউ করে শত্রুতা।

তথ্যসূত্র এবং ছবি: উইকিপিডিয়া এবং সেন্সেস অফ সিনেমা

২৯ টি মন্তব্য : “হায়াও মিয়াজাকির বিশ্ব”

  1. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    এনিমেশন দেখার অভ্যাস নাই, তাই মিয়াজাকির কোন সিনেমা দেখা হয় নায়। ইনফ্যাক্ট আমি এই প্রথম তার নাম শুনলাম। তবে পোস্ট পড়ে তার চিন্তা ভাবনা খুব পছন্দ হয়েছে।

    এনিমেশন বানানো ফিচার ফিল্ম বানানো থেকেও কঠিন কাজ বলে মনে হয় আমার। সেটা যারা চমৎভাবে করতে পারেন তাদের প্রতি সম্মান জানাতেই হয়।

    লেখা খুবই ভালো হয়েছে।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)
      এনিমেশন বানানো ফিচার ফিল্ম বানানো থেকেও কঠিন কাজ বলে মনে হয় আমার।

      এক্কেরে ঠিক। আমারও সমসময় এমন মনে হয়েছে।
      এনিমেশনে আর্টের সদ্ব্যবহারের একটা বিশাল সুযোগ আছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একটা কথা বলছিলেন না, সিনেমার ক্যামেরা হল সর্বগ্রাসী, শিল্পে যেভাবে সংযম ও রূচিবোধের মাধ্যমে কাটছাট করতে হয় ক্যামেরা তা পারে না? এই দিক দিয়ে মাঝেমধ্যে মনে হয় এনিমেশন এগিয়ে। কারণ সেখানে চিত্রকলার প্রয়োগ করা যায় সহজেই, সেটা সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতাও পায়।

      মিয়াজাকির মানুষগুলো বেশি অদ্ভুত। প্রতিটি চরিত্রেই চেহারাই যেন তার পুরো জীবনের প্রতিচ্ছবি। শুনেছি মিয়াজাকি নিজেই ছবিগুলো আঁকার নির্দেশনা দেন। তবে চিত্রকলার কথা বললে ইসাও তাকাহাতার "গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইস" এবং "অনলি ইয়েস্টারডে" ও কম না। প্রত্যেকটা দৃশ্য একেকটা ওয়ার্ক অফ আর্ট।

      এত কষ্ট করে এনিমেশন তৈরি করতে হয়, তার উপর প্রথাগত অভিনেতা-অভিনেত্রী নির্বাচন, তাদের কাস্টিং, চিত্রনাট্য সব তো আছেই। অনেক কষ্টের কাজ। মার্কিন এনিমেশন বোধহয় এত কষ্ট করতে চায় না বলেই জাপান থেকে পিছিয়ে আছে। তবে ওয়াল্ট ডিজনি ও পিক্সার কিছু ভাল আউটপুট দিয়েছে। হলিউডও খুব দ্রুত এনিমেশন শিল্প এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

      জবাব দিন
      • কামরুল হাসান (৯৪-০০)
        মার্কিন এনিমেশন বোধহয় এত কষ্ট করতে চায় না বলেই জাপান থেকে পিছিয়ে আছে।

        আসলে প্রযুক্তি দিয়ে ওরা সব জয় করতে চায়, কিন্তু সিনেমায় যে প্রযুক্তির সাথে সাথে হৃদয়ও লাগে সেটা তাদের কে বুঝাবে!


        ---------------------------------------------------------------------------
        বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
        ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

        জবাব দিন
        • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

          আমেরিকানদের হৃদয়ের ঘাটতি সম্পর্কে আগে অনেক কথা শুনতাম, শুনেই যেতাম, খুব একটা বুঝতাম না। কিন্তু এখন সবকিছু পরিষ্কার। গত বছর ভ্যাম্পায়ার নিয়ে অ্যামেরিকানরা একটা মুভি করেছে (টুইলাইট), আবার সুইডিশরাও একটা মুভি করেছে (লেট দ্য রাইট ওয়ান ইন)। ০ থেকে ৫ এর একটি স্কেলে হৃদয়হীনতাকে ০ এবং সবচেয়ে সংবেদনশীল হৃদয়কে ৫ বললে:
          টুইলাইট - ১
          লেট দ্য রাইট ওয়ান ইন - ৫

          আমেরিকার এই ট্রেন্ডে পরিবর্তন আসলে ভাল হয়, পুরো বিশ্বের জন্যই ভাল হয়। কারণ সারা বিশ্বের উপর আম্রিকার প্রভাবই তো এখন সবচেয়ে বেশি।

          জবাব দিন
  2. সামীউর (৯৭-০৩)

    ফাইনাল ফ্যান্টাসি আ্যডভেন্ট চিলড্রেন, আ্যনিম্যাট্রিক্স দেখসি, স্ট্রীট ফাইটার, সামুরাই শো-ডাউন, দ্যা লেজেন্ড অফ হাংরী উলফ ( কিং অফ ফাইটার এর টেরি বোগার্ড এর কাহিনী) এই গেম-বেসড এনিমে গুলা দেখসি, এনিম্যাক্স, ডিভিডি মিলায়।এফএফ টা অদ্ভুত ভালো লাগসে।
    আমার মনে হয় এনিমে গুলোতে জাপানী নিজস্ব মিথের ব্যবহার প্রচুর, অনেক গুলাই বুঝি না। তবে স্টোরিলাইন সুন্দর, আরো দেখার ইচ্ছা আসে। পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      হ্যা, ওদের নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যবহার অনেক। আমেরিকাও এখন মাঝেমধ্যে চীন-জাপানের কালচার ব্যবহারের চেষ্টা করে। যেমন "অ্যাভাটর: দ্য লাস্ট এয়ারবেন্ডার" সিরিজটা পুরাই করা হয়েছে এশীয় সংস্কৃতির আদলে। এই সংস্কৃতিটা বোধহয় এনিমেশনের সাথে বেশি যায়।
      আর কাহিইনীর ব্যাপারে তো কিছু বলার নাই। জাপানী ম্যাঙ্গায় কাহিনীর যে বৈচিত্র্য বাকি পুরো বিশ্ব মিলেও বোধহয় তার সাথে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।

      জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      লিংকটার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ আলীমুজ্জামান ভাই। সাইটটার খবর তো জানতামই না।
      দেখলাম, ১০ টার মধ্যে ৬ টাই মিয়াজাকির। ২ টা এনিমে সিরিজ। আর বাকি ২টা অন্য পরিচালকদের। দেখতে হবে।

      ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল: যুক্তরাষ্ট্রে মিয়াজাকির সবচেয়ে বিখ্যাত সিনেমা প্রিন্সেস মোনোনোকি। অথচ জাপানীদের সেরা ১০ এর লিস্টেই এটা নাই। এই দুই জাতির রুচি খুব কম সময়ই মিলে।

      জবাব দিন
  3. আসিফ (২০০১-'০৭)

    হায়াও মিয়াজাকি .............................. এনিম এর জীবন্ত কিংবদন্তি, বলতে গেলে তার হাত ধরেই আজকের বিশ্বখ্যাত জাপানি এনিম এর সুচনা আর পথ চলা, তার একেকটি এনিম এর 'DEPTH' বা গভীরতা এত বেশি যে মাঝে মাঝে নিজেকে খুব ই অসহায় মনে হয়, মনে হয় কাহিনীটা মনে হয় আমি আসলে পুরোপুরি ধরতেই পারি নাই, এর মাঝে আর অনেক কিছু বলা ছিল, কিন্তু আমি সেটাকে সঠিকভাবে ধরতে হয়ত পারি নাই !!আমি মিয়াজাকির সবগুলা এনিমে ই দেখেছি, অবিশ্বাস্য ...।। 😛 😛 😛 😛 😛 (সম্পাদিত)

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।