চলচ্চিত্রের সীমাবদ্ধতা

লেখকআবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

সাহিত্য সঙ্গীত চিত্রকলার মতো শিল্পগুলোর প্রধান নিরাপত্তা এখানে যে, এগুলোকে সময়ের ক্ষুধার্ত থাবা থেকে বাঁচিয়ে রাখার সহজ উপায় আছে। এ-সব শিল্পের মধ্যে মানুষের জীবিত হৃদয়, যৌবনের মত নিটোল রঙিন শরীরে ও শারীরিক সজীবতায় শতাব্দীর সজড় বার্ধক্য অমান্য করে বাঁচে। সাহিত্যকে জীবিত অক্ষরে, সঙ্গীতকে সাংকেতিক চিহ্নে, চিত্রকে আঁক-আঁচরের অমর ঘরে দীর্ঘায়ু দেয়া সম্ভব।

কিন্তু চলচ্চিত্র দীর্ঘায়ুবঞ্চিত, নানা কারণে। এক যুগের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকে পরের যুগের সাধারণ দর্শকের সুমুখে উপস্থাপিত করার খুব সহজ উপায় এখনো জানা যায় নি। চলচ্চিত্রের দৈহিক আধার যে-সব উপাদানে গঠিত, বৈজ্ঞানিক কারণে সে-সবের আয়ুষ্কাল বেশ কিছুটা সীমিত হওয়ায় শতাব্দী দূরের কথা, কয়েক দশকের জীবনকালও অল্প ছবির ভাগ্যে জোটে। [গত চল্লিশ বছরের প্রযুক্তির বিকাশের প্রেক্ষাপটে ব্যাপারটি এখন আর সত্য নয়– লেখক, পরবর্তীতে সংযুক্ত]

দ্বিতীয়ত, চলচ্চিত্রকে জড়িয়ে একটা বিরাট সমকালীনতার ব্যাপার আছে যা শ্রেষ্ঠতম চলচ্চিত্রকেও পরের যুগের আয়ু থেকে বঞ্চিত করে। এ-জন্যেই চলচ্চিত্রের দ্যুতি, বৈভব এবং সমকালীন ঔজ্জ্বল্য তুল্য হয়ে দাঁড়ায় সেই সুন্দরী শ্রেষ্ঠার জ্বালাময় যৌবনরাশির সঙ্গে, যার প্রথম যৌবনের ধ্বংসকারী রূপলাবণ্য পরবর্তী জীবনের প্রকট বৈকল্যের দ্বারা উপহাস্য। ফলে অধিকাংশ চলচ্চিত্রের অবস্থাই রবীন্দ্রনাথ বর্ণিত সেই দুর্দশাগ্রস্ত গ্রন্থের দুর্ভাগ্যে এসে দাঁড়ায়, যে গ্রন্থ এক সময় অভাবনীয় সৃষ্টি হিসেবে লোকসমাজে সম্মান পায়, বহু হাতে বিবর্তিত বহু কণ্ঠে উচ্চারিত এবং বহুরসনায় আলোচিত হয়, অথচ যার সম্বন্ধে পরের যুগের আগন্তুক মানুষেরা গভীর অনুধাবন সত্ত্বেও-

“… ভেবে নাহি পায়
এই লেখা একদিন কোন গুণে করেছিল জয়
সেদিনের অসংখ্য হৃদয়।”

বলতে চাই চলচ্চিত্র বহুলভাবে যুগের জিনিস- যুগের উদ্দেশ্যে ও জন্যে। ফলে যুগান্তরে তার রক্তাক্ত মৃত্যু প্রায় অপ্রতিরোধ্য। এই জন্যেই সাহিত্য সঙ্গীত বা চিত্রশিল্পের মতো চলচ্চিত্রে মহত্তম শিল্পকর্ম- ক্লাসিক- দুর্লভ। বহুযুগের সশ্রদ্ধ সমর্থনে লালিত, বর্ধিত ও অভ্রান্ত, ঢের শতাব্দীর পরীক্ষোত্তীর্ণ কোনো শ্রেষ্ঠতম শিল্পকীর্তি কোন ঈর্ষিত ভবিষ্যৎ পাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ থাকা অমূলক নয়। তাছাড়া শতাব্দীবাহী অগন্য সহৃদয় অনুভব, বীক্ষণ ও প্রতিফলনে সমৃদ্ধ, কালান্তরের মানপ্রবাহের বিস্ময় শ্রদ্ধা ও অভিভূতিতে ঐশ্বর্যবান হয়ে লোকশ্রুত কোনো বৃক্ষের বৃদ্ধি চলচ্চিত্রের পক্ষে কঠিন। বললে হয়ত ভুল হবে না যে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রেরও প্রধান উপজীব্য সমকালীনতার আলো। ফলে, পরের যুগে, সমকাল-বর্জিত, তা অনেকাংশে জ্যোতিহীন হয়ে বৈভব হারাতে আরম্ভ করে। চলচ্চিত্রের আবেদন প্রধানত যুগসীমিত বলে অতীতের কোনো আলোড়নকারী শিল্পকীর্তিকে যেমন প্রায়শ আমরা আমাদের সুমুখে প্রদর্শিত হতে দেখি না, তেমনি আবার পরের যুগের দর্শকদের সামনে আমাদের যুগের শ্রেষ্ঠ চিত্রের প্রদর্শনও বিঘ্নিত। আমাদের জীবনের চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠতম নিদর্শন প্রায়শই আমাদের জীবৎকালে নির্মিত চলচ্চিত্রের অসাধারণ স্রষ্টা পরবর্তীযুগে বেঁচে থাকেন রটিত লোকশ্রুতিতে, জনতার প্রবাদে কিংবা বিমুগ্ধ সমালোচকের সশ্রদ্ধ শব্দরাশির মধ্যে।

চলচ্চিত্রের পক্ষে সমকালকে অতিক্রম করতে না পারার আরো একটি কারণ আছে। মহৎ শিল্পের কাছে যা প্রত্যাশিত তা হল যে, তা প্রত্যক্ষ জীবনের সঙ্গে খানিকটা আব্রু বজায় রেখে চলে। উপস্থিত বাস্তবের রোমোশ অত্যাচার শিল্প থেকে সেই কমনীয় রহস্যকে বিস্রস্ত করে- সেই মধুর গোপনীয়তাকে- যার মনোরম আশ্চর্যের রাস্তায় বিবৃত বাস্তবকে অলৌকিক বিস্ময়ে শিউরে উঠতে দেখি। শিল্পে বাস্তবের অসঙ্কোচ বিবৃতি অযাচিত; আমরা প্রত্যক্ষের ইঙ্গিত আশ্রয় করে জীবনের বিস্মিত, সূক্ষ্ণ, অস্পষ্ট বোধসমূহের নিমগ্ন জগতে চলে যেতে চাই।

কিন্তু চলচ্চিত্রে, খানিকটা উপন্যাসের মতো, প্রত্যক্ষ বাস্তবের অত্যাচারী উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে বেশি। অন্তত, কবিতার জনহীন প্রতীকধর্মিতার ঘরে আটকে না গিয়ে যদি তাকে উপন্যাসের মতো জনবহুল রাস্তার বাসিন্দা হতে হয়। মনে রাখতে হবে চলচ্চিত্র মূলত দেখার জগৎ। খানিকটা শোনারও। এই জগৎ পুরোপুরি ইন্দ্রিয় নির্ভর। চলচ্চিত্রের পৃথিবী তাই স্পষ্ট ও নির্বস্ত্র। এজন্যে রহস্যময় শিল্পের জগৎ, যা প্রধানত অস্পষ্ট ও ইঙ্গিতময়- এখানে কৃপণ পরিসর মেনে নেয়। ধরা যাক সুদূর পাড়াগাঁর একটি দৃশ্য যার প্রকৃতিতে শীত বিদায় নিচ্ছে- খয়েরি ঘরবাড়ি, ধান কেটে-নেওয়া মাঠ খড়, শীত, শুকনো ডোবা, গোলপাতার ঘর, নোংরা রোগা প্যাকাটে মানুষ- এ-সব কোন ছবিতে দেখানো হলো। ছবিতে এই আনুপূর্বিক দৃশ্যটা যদি বাস্তবতাকে স্বীকৃতি দিয়ে সংগৃহীত হয়, তবে নিশ্চয়ই এমন কিছু হবে, যেখানে উপস্থিত প্রত্যক্ষের সরব চিৎকার দাঁত বের করে কল্পনা, প্রতীক ও অনুভবের জগতকে সংকুচিত করবে। দ্বিতীয়ত এই জীবন প্রকটভাবে প্রত্যক্ষ ও বাস্তব হওয়ায় এত বেশি যুগ ও সমকালীনতার শিকার হয়ে দাঁড়াবে যে পরের যুগের দর্শকদের ভিন্নতর রুচি ও বাস্তবতার সন্তুষ্ট জোগান দেওয়া তার পক্ষে খানিকটা কঠিনই হবে।

যে-কোন মহৎ শিল্প আসলে এক ধরণের সংকলন। বিবৃত জীবন থেকে শিল্প প্রয়োজনবোধে বেছে নেয়, সংগ্রহ করে, সংকলন করে; গ্রহণ করে সেটুকু, যেটুকু বিস্তৃত ও বিশদ জীবনের ইশারা শুধু- যে ইশারার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জীবনের বাস্তব জীবনের সুবিশাল জগৎ। চলচ্চিত্রে জীবনের বাস্তবতার সংকলন সীমাবদ্ধ। চলচ্চিত্রের লিপিকার- ক্যামেরা- বাছাইয়ে অনেকটাই অপারগ। তার সর্বদর্শী, সর্বগামী, সর্ব আহরণকারী লোভী ও অক্ষম দৃষ্টি প্রত্যাখ্যানে পারঙ্মুখ। ফলে, চলচ্চিত্রের বাস্তব অনেকটাই জীবনের অসংকলিত বাস্তব। এই বাস্তব শিল্পের শত্রু; এ কারণে চলচ্চিত্রে জীবনের ইঙ্গিতময়তা সংকুচিত ও রহস্যের পদচারণা তুলনামূলকভাবে বিরল।

চলচ্চিত্রের বাস্তব প্রতীকী হয়ে ওঠার পথে বাধা পায় বলে এই বাস্তব স্বল্পায়ু। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগের বাংলা চলচ্চিত্রের কথা ধরা যাক। যেখানে একজন বাস্তব যুবকের সৌখিন মধ্যবিত্ত চেহারা এরকম:

যে শান্তিপুরী ধুতি পরে, তার গায়ে গিলেকরা মিহি পাঞ্জাবি, কাঁধে গরদের চাদর, সে সযত্নকর্তিত গোঁফে যত্নবান, গায়ে গন্ধ মাখে, ধুতির কোঁচা পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে উৎসাহী, সে মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি কাটে, পায়ে ব্যতিক্রমহীন পাম্পসু চাপায় ও রুচিহীনভাবে (আমাদের চোখে) চুল কাটে। বলাবাহুল্য সেখানের সৌখিন যুবকের এই লোভনীয় বর্ণনা চল্লিশের যুগ পার হয়ে আমাদের যুগে আসার আগেই উদ্ভট ও হাস্যকর হয়ে গেছে। (অনুভব করা যায়, একালের কোনো উচ্ছ্বল বঙ্গললনা অন্তত সসাগ্রহে তার গলায় মালা পরাতে চাইবে না; বরং হয়ত আত্ম-অবমাননা অনুভব করবে। অথচ ঐ বাস্তব বর্ণনা এমন এক নায়কেন যে ছিল তার সময়কার সবচেয়ে আধুনিক, সবচেয়ে সুবেশ, সবচেয়ে মার্জিত, সবচেয়ে সুষম ও সুদর্শন; জনমনবন্দিত, আলোড়নকারী, প্রশংসিত এবং চটুল ললনাকুলের গোপন কামনার ঈর্ষাজনক মধ্যমণি।) সাহিত্যে? না, সাহিত্যে এমন হবার পথ নেই। চলচ্চিত্রের নায়কের মতো সাহিত্যের নায়ককে আমরা সবখানি দেখি না। সাহিত্যে তার খানিকটা দেখা যায়, বাকিটুকু আমাদের কল্পনার জিনিস। ফলে পরের যুগের নতুন পরিবেশে যখন আমাদের নায়কের ধারণা বদলে যায়, আমাদের মনের চাহিদা নতুন ধাঁচ ও চেহারার নতুন নায়ক খোঁজে, তখন আমরা অনায়াসে আমাদের মনের সেই পুরনো নায়ককে কিছুটা বদলে শুধরে নতুন করে নিতে পারি। ধরা যাক শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’। উপন্যাসটা জুড়ে দেবদাস নামের একজন নায়কের নান ক্রিয়াকলাপ রয়েছে। কিন্তু তাকে আমরা দেখতে পাই না। ফলে কল্পনায় তাকে তৈরি করে নিই। এ কারণে একজন মানুষ যখনই উপন্যাসটা পড়ে তখনই তার মনে একজন নতুন দেবদাসের জন্ম হয় যে অন্য পাঠকদের দেবদাস থেকে আলাদা। ফলে পৃথিবীতে যত মানুষ যতকাল এই উপন্যাস পড়বে, ততকাল ততগুলো দেবদাসের জন্ম হবে। যে ঠিক বাস্তবের নয়, কল্পনা দিয়ে যাকে আমরা তৈরি করেছি, কল্পনায় তাকে খানিকটা নতুন করে গড়ে তোলা কঠিন নয়। এইজন্যে তিরিশ বছর কিংবা তিরিশ হাজার বছর আগের সাহিত্যের নায়ক বা পাত্রপাত্রী আমাদের কাছে পুরনো হয় না। কিন্তু চলচ্চিত্রের নায়কের খুব অল্প অংশই আমাদের কল্পনার সম্পদ। সে এতবেশি বাস্তব প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট যে তার যুগ অবসিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সে-ও অনেকটা আমাদের কাছে খানিকটা অবাঞ্ছিত হয়ে যায়। যায় এ জন্য যে এ নায়ক আমাদের মনের তৈরি নয়। আমাদের চোখের সামনে পরিচালকের চাপিয়ে দেয়া। আমাদের কল্পনার স্বাধীনতা সেখানে কম। পরের যুগের মানুষের পরিবর্তিত প্রত্যাশা তাই তাকে নতুন করে পায় না। ফলে এক যুগের জনপ্রিয়তম নায়ক তার অসামান্য দেহশ্রী, অনবদ্য কণ্ঠস্বর ও অলৌকিক অভিনয়ক্ষমতা নিয়েও পরের যুগের দর্শকদের কাছে অপরিচিত ঠেকে। এটা কেবল নায়ক নয়, প্রায় পুরো চলচ্চিত্র সম্বন্ধেই কমবেশি সত্যি। কিন্তু চিত্রশিল্পে? সাহিত্যে? সঙ্গীতে? এরা যেহেতু জীবনের বিশদ উপস্থাপন নয়- বরং মূলত ইঙ্গিত এবং প্রত্যক্ষের অনাবশ্যক বোঝায় আকণ্ঠ নয়- তাই বাস্তবের ব্যাপক অত্যাচারের কবলমুক্ত এদের নিরবলম্ব শরীর আক্রমণকারী সময়ের ঢেউ অনায়াসে পার হয়ে যায়।

এতগুলো কথা বলতে হল এজন্যে যে সম্প্রতি চলচ্চিত্রকে সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পের পাশে স্থান দিয়ে সমমানের একটি মহৎ শিল্পমাধ্যম বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা চারদিকে চলছে।

খেদকর হলেও এ-কথা মেনে নেওয়া ভালো যে, কিছু কিছু শিল্প কিছু কিছু শিল্পের তুলনায় খানিকটা সীমাবদ্ধ। বাগ্মিতা কিংবা অভিনয় নিঃসন্দেহে শিল্প, অন্তত শিল্পপ্রতিভাসাপেক্ষ ব্যাপার। তবু সঙ্গীত কবিতা চিত্রশিল্প কিংবা নাট্য রচনার চাইতে এরা শিল্প হিসেবে দীন। কেন দীন, সে বিতর্কে যাওয়া এ মুহূর্তে অর্থহীন। এটা সবাই আমরা অনুভব করি। আসলে এই শিল্পগুলোর এমন কিছু সীমাবদ্ধতা আছে যার ফলে উপস্থিত বাস্তবতার উষ্ণ আঁচে তা আমাদের জীবনকে তাতিয়ে তুললেও কল্পনা এবং প্রতীকের জগতে এরা আমাদের পুরোপুরি মুক্তি দেয় না। চলচ্চিত্র- সঙ্গীত চিত্রশিল্প ও সাহিত্যের তুলনায়- কিছুটা বেশি সীমাবদ্ধতায় ভোগে বলেই মনে হয়।

*****

লেখাটি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের “রচনা সমগ্র ১” থেকে নেয়া। প্রবন্ধের শেষে লিখেছেন:
লেখাটির বেশ কিছু বক্তব্যের সঙ্গে এখন আমি একমত না হলেও কিছু বক্তব্যকে এখনো সঠিক মনে করি। তাই লেখাটিকে রেখে দেয়া হল।

*****

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাহিত্য সমালোচনা খুব ভাল লাগছে। তার লেখা মোটেই জলবৎ তরলং নয়। তিনি দুর্গম পাহাড়ী পথে হাটতে পছন্দ করেন, যে পথ খুব রহস্যময়। সাহিত্য সমালোচনার জন্য এই পথ অনুসরণ আমার কাছে আবশ্যিক মনে হয়েছে। চলচ্চিত্র বিষয়েও তার বক্তব্য গুরুত্বের দাবীদার, বিশেষত সেটা যখন চলচ্চিত্রের সাথে অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের তুলনা হয়ে উঠেছে। এই লেখার কিছু বক্তব্যের সাথে এখন পর্যন্ত দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই, কিছু বক্তব্য পরবর্তীতে সায়ীদ নিজেই বাতিল করে দিয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে এমন রচনা বাংলা সাহিত্যে বিরল, অনুপস্থিত বললেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

কপিরাইটের কথা মাথায় রেখেও লেখাটা এখানে দেয়ার কারণ সবার মতামত জানতে চাওয়া। এ নিয়ে কিছু কোয়ালিটি আলোচনা হতে পারে। আশাকরি অনেকেই অংশ নেবেন।

১৮ টি মন্তব্য : “চলচ্চিত্রের সীমাবদ্ধতা”

  1. রেশাদ (৮৯-৯৫)

    "চলচ্চিত্রের পক্ষে সমকালকে অতিক্রম করতে না পারার আরো একটি কারণ আছে"...

    আচ্ছা কোনো শিল্পকে কালোত্তীর্ণ হতে হবে এই কথা কে বলেছে? আর কেউ যদি বলেও থাকে সেটা ত বাইবেল না।
    আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে চলচ্চিত্র সমকালকে অতিক্রম করার কোনো প্রয়োজন নাই, বরং সমকাল ধরে রাখতে পারলে সেখানেই সার্থকতা।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      এক্ষেত্রে আমি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সাথে একমত। চলচ্চিত্রকে কালোত্তীর্ণ হতে হবে এমন কোন কথা নেই, তবে মহৎ শিল্প হতে হলে এর কোন বিকল্প নেই। আপনি গানের কথাই ধরেন। অনেক ব্যান্ডের গান আছে, মুক্তি পাওয়ার পর সবাই খুব হৈরৈ করল, কিন্তু মাস না ঘুরতেই লাপাত্তা। যে জিনিস প্রথমবার দেখলে ভাল লাগে, কিন্তু এরপর দেখার বা তা নিয়ে চিন্তা করার কোন ইচ্ছা জাগে না তা কখনও শিল্প হতে পারে না, তবে গ্রেট বিনোদন সামগ্রী হতে পারে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে যে জিনিস সবার ভাল লেগেছিল, সেটা যদি আজও ভাল না লাগে তবে বুঝতে হবে সেটার মধ্যে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। সেকালের দর্শক সব বিবেচনা বাদ দিয়ে কেবল হুজুগের বশে সেটা উপভোগ করেছিল। এই হুজুগ তো শিল্পের পথে বড় বাঁধা। সিনেমার কথাই ধরেন। প্রতি বছর শয়ে শয়ে সিনেমা রিলিজ পায়, কিন্তু ৫-৬ বছর পরই শতকরা ৯০ ভাগ সিনেমার কথা সবাই ভুলে যায়। বাকি ১০ ভাগই শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছায়। যে জিনিস মানুষের মনে দাগই কাটতে না পারল সেটা শিল্প হবে কিভাবে।

      তবে সায়ীদের সাথে দ্বিমত হচ্ছে, চলচ্চিত্রেও এ ধরণের কালজয়ী শিল্পের উদাহরণ আছে। কম না বরং অনেক বেশিই আছে। বিদেশী চলচ্চিত্রের সাথে ভাল যোগাযোগ না থাকায়ই বোধহয় তিনি এ ধরণের মন্তব্য করেছেন। মুর্নাউয়ের "নসফেরাতু" (১৯২১) যেহেতু এখনও মরে যায়নি সেহেতু বলা যায় কোনদিন মরবে না।

      জবাব দিন
  2. টিটো রহমান (৯৪-০০)

    দীর্ঘদিন চল্চ্ছিত্র সংসদ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলাম। এ নিযে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা আছে পৃথিবী জুড়ে। কিন্তু সব বিতর্ক ছাপিয়েও চলচ্চিত্র আজ শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কারণ চলচ্চিত্র হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশারি মাধ্যম।

    সম্প্রতি চলচ্চিত্রকে সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পের পাশে স্থান দিয়ে সমমানের একটি মহৎ শিল্পমাধ্যম বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা চারদিকে চলছে।

    আপমার মনে হয় ভদ্রলোকের চলচ্চিত্র নিয়ে আরো পড়াশোনার দরকার আছে। অন্তত তার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নিয়মিত যে চলচ্ছিত্র প্রদর্শন হয় সেখানে উপস্থিতি দরকার আছে। তাঁর এই লেখাটা আগে পেলে চলচ্চিত্র নিযে বক্তৃতা দিতে তাকে কখনও ডাকতাম না। বক্তৃতায় তো সব সময়ই চলচ্চিত্রকে মহৎ মিল্প হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করতেন

    আর চলচ্চিত্রও যে কালকে অতিক্রম করতে পারে তার প্রমাণ হিসেবে অনেক চলচ্চিত্রেরই নাম নেয়া যায....উদাহরণ হিসেবে সিসিবিতে পথের পাঁচালী নিযে একটি পুরোনো লেখা দেয়ার ইচ্ছা পোষণ করছি...এছাড়া চার্র্লীর ছবি, আইজেন্স্টাইন এর ছবি এমনকি হিচককের ছবিও ভার উদাহরণ হতে পারে।

    দূর্ভাগ্য রবিগুরু কবি ঠাকুর স্রেফ ছায়াবাণী নামটা দেয়া ছাড়া ছলচ্চিত্রের জন্য বেশি কিছু করতে পারেন নি। তাহলে কিন্তু উনি একিছু না ভাবেই মেনে নিতেন...হ্য চরচ্চিত্রও একিটি মহৎ শিল্প


    আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই

    জবাব দিন
      • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

        ধন্যবাদ টিটো ভাই। এখানে সায়ীদ ভালই ভুল করেছেন। বক্তৃতায় তার ভিন্ন সুরের কথা জেনে আরও অবাক হলাম।
        আমি প্রথম থেকে তার লেখার বেশ কিছু দিক ভালই উপভোগ করছিলাম। কিন্তু শেষে এসে যখন "এতগুলো কথা বলতে হল এজন্যে যে সম্প্রতি চলচ্চিত্রকে সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পের পাশে স্থান দিয়ে সমমানের একটি মহৎ শিল্পমাধ্যম বলে আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা চারদিকে চলছে।"- এইটা বললেন তখন মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
        তারপরও তার কিছু উপমা ভাল আছে। আর শুধু দেবদাস এবং দেবদাস মার্কা সিনেমার উদাহরণ তিনি পুরো চলচ্চিত্র শিল্পের উপর প্রয়োগ না করলেও পারতেন। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন সময় এবং ভিন্ন রুচি হওয়ার পরও কেন সবাই অদ্রে হেপবার্নের প্রেমে পরে যায় সেটা উইলিয়াম ওয়াইলারকে জিজ্ঞেস করলেই সায়ীদ তার বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেন।

        এই লেখার পক্ষে-বিপক্ষে আরও মন্তব্যের আশা রাখি। আমার একটা সামগ্রিক ক্রিটিক্যাল রিভিউ দেয়ার ইচ্ছা আছে।

        জবাব দিন
  3. সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)

    আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ-এর বক্তব্য একপেশে মনে হচ্ছে। চলচ্চিত্র সম্পর্কে তার ধারণা সম্ভবত কম। টিটো এবং রেশাদের বক্তব্যের সঙ্গে অনেকাংশে একমত।


    "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

    জবাব দিন
    • রেশাদ (৮৯-৯৫)

      বস, আমার মন্তব্যে মাত্র একটা বক্তব্য ছিল, কোনটায় একমত আর কোনটায় দ্বিমত বুঝলামনা।
      আর একটা কথা, আমি কোথাও মন্তব্য করলে লেখক বাদ দিয়ে আর যাদের প্রতিমন্তব্যের জন্য অপেক্ষা করি আপনিও তাঁদের একজন।

      জবাব দিন
      • সানাউল্লাহ (৭৪ - ৮০)
        সমকাল ধরে রাখতে পারলে সেখানেই সার্থকতা

        রেশাদ : আসলে দুজনকে একসঙ্গে উদ্ধৃত করেছি বলে হয়তো তোমার এই প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তোমার উদ্ধৃত বক্তব্যের ব্যাপারে একমত। নিজের সময়টাকে ধরে রাখাটা যেকোনো শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আর কালজয়ী চলচ্চিত্র নেই? এটা কেমন কথা বললেন তিনি? সায়ীদ স্যারের লেখাটায় তেমন গভীরতা পাইনি।


        "মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ"

        জবাব দিন
  4. কামরুল হাসান (৯৪-০০)

    লেখক যেহেতু নিজেই বলে ফেলেছেন যে 'লেখাটির বেশ কিছু বক্তব্যের সঙ্গে এখন আমি একমত না' সেহেতু খুব বেশি সমালোচনা করার আসলে নেই।

    যে-কোন মহৎ শিল্প আসলে এক ধরণের সংকলন। বিবৃত জীবন থেকে শিল্প প্রয়োজনবোধে বেছে নেয়, সংগ্রহ করে, সংকলন করে; গ্রহণ করে সেটুকু, যেটুকু বিস্তৃত ও বিশদ জীবনের ইশারা শুধু- যে ইশারার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে জীবনের বাস্তব জীবনের সুবিশাল জগৎ।

    এইটুকুর সঙ্গে আমি ভালোভাবেই একমত। কিন্তু তারপরই উনি যখন বলা শুরু করেন -

    চলচ্চিত্রে জীবনের বাস্তবতার সংকলন সীমাবদ্ধ। চলচ্চিত্রের লিপিকার- ক্যামেরা- বাছাইয়ে অনেকটাই অপারগ। তার সর্বদর্শী, সর্বগামী, সর্ব আহরণকারী লোভী ও অক্ষম দৃষ্টি প্রত্যাখ্যানে পারঙ্মুখ। ফলে, চলচ্চিত্রের বাস্তব অনেকটাই জীবনের অসংকলিত বাস্তব। এই বাস্তব শিল্পের শত্রু; এ কারণে চলচ্চিত্রে জীবনের ইঙ্গিতময়তা সংকুচিত ও রহস্যের পদচারণা তুলনামূলকভাবে বিরল।

    এখানে আর দ্বিমত না করে পারা যায় না। চলচ্চিত্রে জীবনের বাস্তবতার সংকলন সীমাবদ্ধ নয় মোটেও। শুধুমাত্র 'পথের পাঁচালী'র কথাই যদি বলি রুঢ় থেক রুঢ়তর, কোমল থেকে কোমলতম বাস্তব উঠে এসেছে এই সিনেমায়। আমার ধারনা সত্যজিত এ প্রবন্ধ পড়লে নিশ্চিন্তে বলতেন ' আবু সায়ীদ সাহেব চলচ্চিত্র আসলে একেবারেই বুঝেন না।'

    টিভি, সিনেমা এই ধরনের ভিসুয়াল মিডিয়ার প্রতি সায়ীদ স্যারের একটু বিতৃষ্ণা আছে। অন্য এক জায়গায় পড়েছিলাম, তিনি বলছেন, 'টেলিভিশনের কল্যানে বাংলাদেশে এখন আর কোন কিশোর-কিশোরী নেই, সব যুবক-যুবতী হয়ে গেছে।' :))

    তবে প্রবন্ধ হিসেবে এটি বেশ সুখপাঠ্য। শব্দ চয়ন এবং ভাষার গাঁথুনি সব সময়ের মতো সবল।


    ---------------------------------------------------------------------------
    বালক জানে না তো কতোটা হেঁটে এলে
    ফেরার পথ নেই, থাকে না কোনো কালে।।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      এই বিষয়ে আমি আপনের সাথে পুরা একমত। "মিজঁসেন" (Mise en scène) সম্পর্কে সামান্য কিছু জানলেও সায়ীদ এভাবে বলতেন না।
      সিনেমার দৃশ্যে সুচিন্তিতভাবে যা কিছু নিয়ে আসা হয় তার সবকিছুকেই মিজঁসেন বলে। অর্থাৎ ডিরেক্টর তার দৃশ্যের একটি চামচ, একটা মাছি- সবকিছুই মিজঁসেন। অনেক ডিরেক্টররা এটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন। মঞ্চনাটকে যেমন মঞ্চের সবকিছু আগে থেকে নকশা করা থাকে তেমনি দৃশ্যের প্রতিটা বিষয় নকশা করা এবং সেগুলোর শৈল্পিক অর্থ থাকা উচিত।
      যেমন স্ট্যানলি কুবরিক এর "আইস ওয়াইড শাট" এ ঘরের একটা এয়ার কুলারও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আপাতদৃষ্টিতে এয়ার কুলার বোঝাই যায় না।

      বিশের দশকে জার্মানির সিনেমাতে মিজঁসেন করা হতো বিখ্যাত চিত্রশিল্পের আদলে।

      জবাব দিন
  5. মহিব (৯৯-০৫)

    সায়ীদ স্যার নিজেই বলেছেন এই লেখার অনেককিছুতে তিনি এখন একমত না - তবুও আমার কথা হলো- এই লেখায় তিনি যেসব আপেক্ষিক আলোচনা করেছেন তা অনেকাংশেই আমার কাছে ঠিক মনে হয়।
    আবার শুধু চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তিনি কিছু পরম সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যা আমার কাছে অপরিস্কার।

    জবাব দিন
    • মুহাম্মদ (৯৯-০৫)

      হ্যা, কিছু কিছু বিষয় আমারও ঠিক মনে হয়। তবে চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী।
      আমার মনে হয়েছে, স্ট্যানলি কুবরিক, আব্বাস কিয়ারোস্তামিদের সিনেমাকে কোনভাবেই সায়ীদের এই লেখা দিয়ে বিচার করা যাবে না। তবে অনেক সিনেমাই এটা দিয়ে বিচার করা যায়।

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মহিব (৯৯-০৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।