কেন আমি ঋণী?

ক্যাডেট কলেজের কাছে ঋণের কথাই বলছি। গত কয়েক দিন ধরে ভেবে বেশ কিছু কারণ বের করলাম যার জন্য আমার আজীবন ঋণী থাকা উচিত, ক্যাডেট কলেজের কাছে। ব্যাপারগুলো মোটেই হালকা নয়। ভেবে দেখলাম, ক্যাডেট কলেজে না গেলে আমার জীবন একেবারে অন্যরকম হয়ে যেতে পারত এবং সেই জীবন আমার পছন্দ হতো না। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, আমার যে সেই জীবন পছন্দ হচ্ছেনা তা তখন আমি বুঝতেও পারতাম না। কারণ অন্য কোন জীবনের সাথে আমার পরিচয়ও ঘটতো না। সেক্ষেত্রে পরিবারকেন্দ্রিক বিশুদ্ধ সামাজিক জীব হওয়ার ভান করতে হতো, যা এখন আর করতে হয়না।

যাহোক, কাজের কথায় আসা যাক। জীবনের প্রথম ৯ বছর কেটেছে ভালুকার (ময়মনসিংহের উপজেলা) একটি গ্রামে। গ্রামের নাম সাতেঙ্গা। আমাদের গ্রামে ঐ বয়সের ছেলেমেয়েদের জীবন কাটতো খুব সহজ রুটিন মেনে। মাদ্রাসা আর স্কুলে যেতে হলেও পড়াশোনায় খুব একটা মন ছিল না কারো; বর্ষাকালে সবাই মুখিয়ে থাকতো পুকুর বা নদীর জন্য। পুকুর এবং নদী দুটাই আমাদের বাড়ির খুব কাছে ছিল। একবার পুকুরে নামার পর আর কারো হুশ থাকতো না। ৬ বছর বয়সী এমন কাওকে খুঁজে পাওয়া যেতো না যে সাঁতার জানেনা। নদীতে যেতাম মূলত ভাসমান কলাগাছ ধরার জন্য। সেগুলো একসাথে করে ভেলা বানাতাম নিজেরাই। মাঠ শুকনো পেলে হা-ডু-ডু বা দাড়িয়াবান্ধা খেলা জমতো। দাড়িয়াবান্ধা হালকা পাড়লেও আমি কাবাডি খুব একটা পাড়তাম না। শীতকালে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলাও হতো প্রচুর। একটু বড়রা খেলতো ভলিবল। সবই হতো হয় স্কুল মাঠে নয় মাদ্রাসার মাঠে। তবে আমার বর্ণনা নিজের কাছেই খানিকটা অতিরঞ্জিত মনে হচ্ছে। শুধু আমার জন্য, অন্যদের জীবন এর চেয়েও অনেক বর্ণীল ছিল। কিন্তু আমি এ ধরণের অভিজ্ঞতার ক্ষুদ্র অংশীদার কেবল। কারণ, আমাকে সারাটা সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হতো। কখন আব্বু এসে পড়বে! উল্লেখ্য, আব্বু ভালুকা সদরের একটা স্কুলে পড়াতো। প্রতিদিন আসতে আসতে বিকেল বা মাঝে মাঝে অনেক রাতও হয়ে যেতো। আমার কাহিনী সবার কাছেই এতটা পরিচিত ছিল যে, আব্বু হাটা পথে বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে থাকতেই এ কান ও কান হয়ে আমার কাছে খবর পৌঁছে যেতো। এক দৌঁড়ে বাড়ি চলে যেতাম। হাত-মুখ ধুয়ে এমন একটা মেকআপ করতে হতো যেন সারাদিন ঘরের ভিতর ছিলাম এবং স্কুল থেকে এসেই পড়তে বসেছি। এখনও পড়ছি।

গ্রামের এমন কোন বাচ্চা নেই যে বাবার হাতে নিয়মিত মার খায়নি। কিন্তু আমার ব্যাপারটা ব্যতিক্রম বলে আমি দাবী করি। আব্বুর ভয় দেখানোর গুণ এবং আমার ভয় পাওয়ার গুণ, দুটিই ছিল প্রখর। এমনভাবে দুটি মিলে গিয়েছিল যে, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলাম আমি। ক্লাস এইটের আগে কখনও মনে হয় আব্বুর মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলিনি। আধা মাইল আগে থাকতে মাঝে মাঝেই খবর পেতাম না। মার খাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতো তখনই। তবে এটা মুখ্য নয়, মুখ্য ছিল আব্বুর ভয়ংকর দর্শন অবয়ব। তারপরও আবার খেলতে যেতাম। একটা না হলে আরেকটা যেন হয়না। মহা দুষ্টচক্র। ক্লাস ফোরে অনেকটা অলৌকিকভাবেই আমাকে ময়মনসিংহ শহরে নানার বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হল। শহরের একটি স্কুলে পড়তাম। বাবা-মা গ্রামেই থাকতো। আমি হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। তখন থেকেই আমার বাড়ি বা বাবা-মা ভাই-বোনের জন্য কখনও খারাপ লাগতো না। বরং কোন ঈদে বাড়িতে গেলেই খালা-মামাদের জন্য খারাপ লাগতো। তখনও আব্বুকে মাত্রাতিরিক্ত ভয় পেতাম। কোন কোন শুক্রবারে আব্বু নানার বাসায় আসতো। এজন্য শুক্রবারে কলিং বেলের শব্দ শুনলেই আমার পুরো মুখ সাদা হয়ে যেতো। নানুকে না নিয়ে কখনও আব্বুর সামনে যাইনি। এমনও দিন গেছে আব্বু এসে চলে গিয়েছে, কিন্তু আমি দেখা করিনি। লুকিয়ে ছিলাম। ক্লাস ফোর থেকে সিক্স পর্যন্ত এভাবেই বেঁচে ছিলাম। পেয়েছিলাম স্বাধীনতার স্বাদ।

আব্বুই আমাকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করানোর যাবতীয় পরিকল্পনা করে তার বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল। অবচেতন মনে তিনি হয়তো বুঝতে পারছিলেন আমাদের পরিবারে আমার থাকাটা সুখকর হবেনা বা অপ্রত্যাশিত নানা ফলাফল দেখা দিতে পারে, চেতনায় যদিও তিনি তা কখনই ভাবতে পারতেন না। ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হলাম ক্লাস সেভেনে। ক্লাস এইটের প্রথম মাসে পদার্পণ করতেই আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই ময়মনসিংহ শহরে এসে পড়লো। কলেজে বছরে যে কয় দিন ছুটি থাকতো তখনই আমাকে নিজের বাসায় থাকতে হতো। মজার ব্যাপার হলো নানার বাসা থেকে আধা মাইল দূরে হওয়া সত্ত্বেও আমি প্রথমে নিজের বাসায় যেতে চাইনি। বোঝাই যাচ্ছে ক্যাডেট কলেজ আমাকে কতটা বাঁচিয়ে দিয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়টা যেখানে বাসায় বাবার কড়া শাসনে থাকতে হতো সেখানে থাকলাম ক্যাডেট কলেজে। ক্লাস সেভেন থেকে ইন্টারমিডিয়েট। এই একটি কারণেই যে আমার কতটা ঋণ জমা হয়ে গেছে তা কেবল আমিই বুঝি। বলে বোঝানোর ক্ষমতা আমার নেই। এই একটি কারণকে ঘিরেই জমা হয়েছে আরও অসংখ্য কারণ। সে কারণ গল্প শোনায়, অন্ধকার থেকে উঠে আসা একটি ছেলের বিশ্ব আবিষ্কারের গল্প।

১। আমাদের বাসায় অনেক বই ছিল। কিন্তু সুপাঠ্য একটিও নয়। ক্যাডেট কলেজে যাওয়ার আগে কোন গল্পের বই পড়িনি। পড়লেও খুচরা কিছু পড়ে থাকতে পারি, মনে নেই। পৃথিবীতে গল্প বলে কিছু একটা আছে তা অবশ্য গ্রামে থাকতেই বুঝেছিলাম। ছয়-সাত বছর বয়সে ছোট চাচা আমাদের ইংরেজি রেপিড রিডার বই থেকে গল্প পড়ে তা বাংলায় শোনাতেন। খুব মজা পেতাম, বিনিময়ে তার মাথা থেকে পাকা চুল ছিড়ে দিতে হতো বা পা টিপে দিতে হতো। কিন্তু কলেজে গিয়ে পেলাম বিশাল লাইব্রেরি। বই পড়ার অভ্যাস হল সেখান থেকেই। এই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলেই তো আবিষ্কারের সব হয়ে যায়। আর কি লাগে? বুদ্ধিজীবীরা বলেন, একটি নতুন বই পড়লে একটি নতুন চোখ গজায়। জীবনে যত গল্পের বই বা নন-ফিকশন পড়েছি তার অধিকাংশই কলেজ লাইব্রেরি থেকে নেয়া। জীবনে আর কখনও গ্রামের জীবনের স্বাদ পাওয়া যাবেনা বলে বিশ্বাস যেমন করি, তেমনই বিশ্বাস করি, কলেজ লাইব্রেরিতে বসে পড়ার স্বাদ আর কখনও পাব না।

২। আমার মনে হয়, আমার মনের ভিতরে অনেক কষ্ট বা কথা আছে যা কাউকে বলা সম্ভব না। ক্যাডেট কলেজে গিয়ে নতুন শিখলাম, নিজের মনে যা আছে তা অন্যকে বলতেই হবে এমন কোন কথা নেই। না বলে বরং আরও সুখে থাকা যায়। নিজের মনের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে থাকলে যে জগতের সাথে পরিচয় হয় তা অনেক মজার। শীর্ষেন্দুর “পার্থিব” পড়েছিলাম ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে। কৃষ্ণজীবনের মনের ঘরের সাথে পরিচিত হয়ে তাই বিস্ময় বোধ করেছিলাম। আমিতো এরকম ঘরে অনেক দিন থেকেই বাস করছি। জীবনের যে বিকৃতিগুলো আমাকে ভোগায় সেগুলোর সাথেও সেখানে বসে মোকাবেলা করা যায়।

৩। নিজের সম্বন্ধে নির্বিকার থাকতে শুরু করলাম। কিন্তু আরও অবাক হয়ে দেখলাম অন্যদের সম্বন্ধেও নির্বিকার থাকা যায়। সেটা আরও মজার। নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে সবাইকে দেখতে পারার মজার সাথে নিজেরটার তুলনা পাই কোথায়। বিষয়টা নৃতত্ত্বের মৌল নীতির মত। নৃতত্ত্ব কি? তাও বুঝেছিলাম ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে, এক বৃহস্পতিবারে একজন গেস্ট স্পিকারের বক্তৃতা থেকে। “আমি পান খাই আর তুমি পান খাওনা; এ নিয়েই নৃতত্ত্ব”। দেখলাম, আমি এই নীতি আগে থেকেই মেনে চলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কেবল জানতাম না কি করছি। কি করছি তা বুঝতে পারার মজাও তখন পেলাম।

অসংখ্য কারণ থেকে কেবল তিনটি লিখলাম: অসীমের পথে জ্ঞানানুসন্ধান, আত্মকেন্দ্রিকের মনের ঘর এবং উদারনৈতিক নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি; এই তিনটিই আমার জীবন চলার পাথেয়। তিনটিই অর্জন করেছি ক্যাডেট কলেজ থেকে। অন্যরা যে এগুলোই অর্জন করেছে তা সত্য নয়। আমি কেবল আমারটাই জানি। আমার জীবনের আরেকটি চালিকা শক্তি আছে: সত্যের পথে সংগ্রাম। কিন্তু এই পাথেয়টি থেকে ইদানিং আমি বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছি। তাই সে জটিলতায় গেলাম না। যে ঋণ করে এসেছি তা পুষিয়ে দেবার ধৃষ্টতা করা যায়না। তবে এই চালিকাশক্তি আমাকে কোথায় নিয়ে যায় তা-ই এখন দেখার বিষয়।

৩,৮৭৮ বার দেখা হয়েছে

২০ টি মন্তব্য : “কেন আমি ঋণী?”

  1. আমি অনেক্ষণ ধরে চিন্তা করছি কি লিখা যায় কিন্তু কিছু আসলে মাথায় আসছে না। আমি যদি গুছায় কথা বলতে পারতাম তাইলে নিশ্চুই এখানে একটা সুন্দর কমেন্ট করতাম। তোমার লিখা গুলা always different হয়, এইটুকুই বলতে পারি।

    তোমার চিন্তাগুলো যেন সারাজীবনই এরকম থাকে।

    জবাব দিন
  2. আমার খুব কাছের যারা সবাই জানে, আমি সব কাজ তাড়াহুড়ো করে করি। জীবনের অন্যসব কিছুর মতো পড়ার সময়ও খালি চোখ বুলিয়ে যাই। কিন্তু জাফর ইকবাল স্যারের লেখা ক্ষেত্রে একটু ধীরে চলো নীতি মেনে চলি। এই লেখাটির একটা লাইন পড়েই মনে হলো এইটা সেই রকম একটা লেখা।
    লেখাটি পড়ে সবাই একটা কথাই আগে ভাববে। তা হলো, তারা মুহাম্মদকে আবিষ্কার করেছে। চির চুপচাপ মুহাম্মদের নিজের কিছু কথা তারা জানতে পেরেছে। আমি এইদিক দিয়ে সামান্য ভাগ্যবান। তাই লেখাটির নিয়ে মন্তব্য করার কাজটি আমিই সবচেয়ে ভালো পারার কথা। সবার আগে বলবো, এটি এই ব্লগের সবচেয়ে ভালো লেখা, এটি আমার জীবনে পড়া দ্বিতীয় ভালো লেখা (প্রথমটি মনে হয় রবীন্দ্রনাথের "স্ত্রী পত্র")।
    নাহহহ!!!!!!!!! অনেক কথা মাথায় আসছে। এই লেখাটি মন্তব্য করার সাধ্য আমার নেই। আমাদের এই ব্লগ সত্যি আজ ধন্য হলো। মুহাম্মদ এই লেখাটা আর কোথাও দিস না। এই লেখার দাম আমি কমাতে দেবনা.........

    জবাব দিন
  3. এই লেখাটি লিখতে পেরে আমার খুবই ভাল লাগছে। নিজেকে অনেক হালকা লাগছে। আর এই ঋণগুলার যে করে এসছি, তা এখন হারে হারে টের পাচ্ছি। আশা করি সবাই নিজ নিজ ঋণের কথাগুলো চিন্তা করবে।

    জবাব দিন
  4. দিহান আহসান
    এতো সুন্দর করে গুছিয়ে লিখা শুধু মুহাম্মদের পক্ষেই সম্ভব।

    :hatsoff: :boss:

    ভাইয়া, তোমাকে বুঝার চেষ্টা ছিল, এই লেখা থেকে আরো চেষ্টা করছি।লিখাটা পড়ে অনেক কিছু, অনেক কথা (মঈনের কাছে শোনা) মনে পড়ে গেল।
    ধন্যবাদ আবারো ...

    জবাব দিন
  5. নাজমুল (০২-০৮)

    এই লেখাটা আমি পরানের গহীন ভিতরে পড়েছিলাম সেখানে কমেন্টস করার জায়গা ছিলনা আজ খুজে পেলাম
    ধন্যবাদ মুহাম্মদ ভাই :clap:
    লেখাটা কতটুকু ভালো লেগেছে বলে বোঝাতে পারবোনা :boss: :boss:

    আমার জীবন যেমন ই হোক তার পুরো কৃতিত্ব ক্যাডেট কলেজের :boss: :boss: :boss:

    জবাব দিন
  6. রাশেদ (৯৯-০৫)

    কি আশ্চার্য, এই লেখাটা এতদিনেও আমার চোখে পরল না।

    মুহাম্মদ, এইটা আমার পড়া ব্লগের অন্যতম সেরা লেখা। হ্যাটস অফ টু ইউ ম্যান :hatsoff:


    মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রেশাদ (৮৯-৯৫)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।