কারওয়ান বাজারে একটি ঘটনাবহুল রাত

কলেজে থাকতে ফিজিক্সের জনৈক ম্যাডাম একটা অংক করা নিয়ে বলেছিলেন, “সামনে দিয়াই পারো না, আবার পেছন দিয়া…………”

বহুদিন পর আবার সেই কথা মনে পড়ল, সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশে, এবং পরিবেশটা রসিকতার ছিল না।

ডিপার্টমেন্টে সন্ধ্যাভর আড্ডা শেষে বাসায় যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম; এমন সময়, এক বন্ধু বলল, “অমুক ভাই তো অমুক কে নিয়ে অমুক দিন থেকে অমুক দিন পর্যন্ত লাইনে দাঁড়ায় বিশ্বকাপের অমুক, অমুক আর অমুক ম্যাচের টিকেট পাইছে, আর আমরা বসে বসে কি অমুক তমুক ভাজছি??? কি করছি আমরা? বাংলাদেশে বিশ্বকাপ, তারপরও দেখবো না?? টাইগারদের উৎসাহ দিতে মাঠে থাকবো না?? অমুক ভাই পারল আর আমরা পারবো না??……………” ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম কিল ভুতও দিতে পারে না, সুতরাং কোন কথা নয়, ছয় জন রওনা হলাম কারওয়ান বাজার সিটি ব্যাংকের দিকে। বাসে যাবার পথে লোকজন সন্দেহের দৃষ্টি দেয়, একজন তো জিজ্ঞাসাই করে বসল, ” ভাইজানরা কি বিয়া খাইতে যান?” সবকিছু বললাম পরিষ্কার করে। জানালাম, টিকেট না নিয়ে ফিরছি না বাসায়। বাস থেকে নামার পথে একজন বলে, “ভাই খাবার নিচ্ছেন? অহানে কিন্তু খাবার নাইক্যা” মনে মনে বললাম তুই বাড়ী গিয়ে খাবার খা বেকুব, আমরা যাচ্ছি টিকেটের জিহাদে, বিশ্বকাপ বলে কথা, দুই চার দিন দানাপানি না পড়লেও চলবে।

সিটি ব্যাংকের সামনে গিয়ে দেখা গেল, কোন লাইনের লেশ মাত্র নেই। তাহলে কি টিকেট শেষ হয়ে গেল? নাহ এ তো হতে পারে না, আবার মনে হল, কেউ না থাকুক, আমরাই লাইনে দাড়িয়ে যাই। কিছু চিন্তা করবার আগেই খাকি পোশাক পরা প্রায় সাড়ে ছয় ফুট লম্বা এক লোক এসে বলল, “এহানে কুন লাইন নাই, সবকয়ডি সর।” অনেক দিন পর অচেনা কারো মুখে তুই তোকারি শুনে অদ্ভুত লাগলো, কিছু উত্তর দেবার আগেই পেছনে বসে থাকা পুলিশ ডাণ্ডা দিয়ে একই কথা বুঝিয়ে দিল। সার্ক ফোয়ারা মোড়ে এসে দেখি, “ইশকুল খুইলাছে রে, মাউলা, ইশকুল খুইলাছে।” প্রায় ‘শ খানেক মানুষ জানুয়ারির তীব্র শীত আর ফুটপাতের ধুলোময়লা ও শক্ত ইটের উঁচুনিচু যায়গা উপেক্ষা করেই বসে এবং শুয়ে আছে। কোন প্রকার দেরী না করেই আমরা সেই লাইনের শেষে জায়গা করে নিলাম। কিছুক্ষণ পর একদল লোক তাদের নিজেদের “ভলান্টিয়ার” দাবী করে আমাদের সিরিয়াল নিয়ে গেল। আমার নম্বর ১০৫। অগত্যা, বসে থাকা ছাড়া আর কোন কাজ নেই। শততম সিরিয়ালে থাকা ভদ্রলোকটিকে দেখা গেল একটু বেশিই উত্তেজিত। কথা বলে জানা গেল, তিনি টানা দুইরাত এখানে, এখনো টিকেট পাননি। হঠাৎ পাশ দিয়ে যেতে থাকা এক রিকশা যাত্রী তাকে কেন, কিসের লাইন ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করতেই তিনি ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, “খিচুড়ির লাইন, সামনে ল্যাটকাইন্যা খিচুড়ি দেয়, বাসায় গিয়া তুইও বউ বাচ্চা নিয়া লাইনে আয়া পড়; হালা মশকারির আর জায়গা পাওনা!”

ঢাকা শহরের সব ট্রাকই মনে হয় রাতে অই ফুটপাতের সামনে দিয়ে গেল, আর তাদের আসা যাওয়া টের পাওয়া যাচ্ছিল প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাসে। ঘুম তো দুরের কথা, মাইনাস করার জন্য যে একটু সামনে যাবো, সেই চিন্তাও মাথাতে নেই। একটু পর পর লোকজন এসে সিরিয়াল এর খোজ খবর নিয়ে যাচ্ছে। “চইলা গেলা তো খাইলা ধরা” টাইপ অবস্থা। যাই হোক, কোন রকম প্রক্সির ব্যবস্থা করে আরেক জনকে সাথে নিয়ে এগোলাম সামনে। বসুন্ধরা সিটির সামনে গিয়ে অবাক, এখনে আরেক দফা লাইন। তাও প্রায় আমাদের লাইনের সমানই বড়। মনে মনে কাল সকালের দৃশ্য কল্প তৈরি হয়ে গেল, এই লাইন বনাম অই লাইনের ভয়াবহ মারামারি, চুলোচুলি, সাথে পুলিশের ধাওয়া …উফ, আর ভাবা যাচ্ছে না। ফিরে গিয়ে ‘ভলান্টিয়ারদের’ বলার সাথে সাথে তারা সমাধান করার পদক্ষেপ নিয়ে নিলো, সবার কাছে দশ বিশ টাকা চাওয়া হল, সকলের মিলিত টাকা পুলিশকে দিলেই নাকি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এতদূর যখন এসেছি, বিশ টাকা আর এমন কি? দিলাম, এবং মজার ব্যাপার, সঙ্গে সঙ্গেই ফলাফল পাওয়া গেল। মুখ বেজার করে অই লাইনের লোকরা তাড়া খেয়ে আমাদের পেছনে এসে দাঁড়ালো। একটু খারাপ লাগলো, কিন্তু খুশিটা তার চাইতে অনেক অনেক বেশি। বড়োই খারাপ আমরা।

কোন প্রস্তুতি ছাড়াই এই শীতের রাত কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে কাটিয়ে দিলাম। রাত চারটার দিকে পুলিশ বাহিনী এসে আমাদের বলল সিরিয়াল অনুসারে দাড়াতে, কাঁধে হাত দিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম, যাতে মাঝখানে কেউ ঢুকতে না পারে। এরপর আমাদেরকে আস্তে আস্তে আমাদের জান্নাত সিটি ব্যাংকের কাছে নিয়ে যেতে থাকা হল। একটু আগে তাও যা ফুটপাত ছিলো, এখন রাস্তা বাদে আর কোন উপায় নেই। রাত ৪ টা থেকে ভোর সাড়ে ৬টা পর্যন্ত রাস্তায় বসে ঘুমের অভিনয় করলাম। অভিনয় ভাঙ্গল হাঁটুতে বাড়ি খেয়ে। জনৈক পুলিশ বললেন “উইঠা খারা।” কোন ভাবেই মাথায় ঢুকলো না, কেন এরা আমাদের সাথে তুই তোকারি করছে। শত হোক, আমরা বিশ্বকাপের টিকিট কাটতে এসেছি, জেলের হাজতি তো আর না! উঠে পড়লেও দাঁড়াবার ক্ষমতা তখন আর নেই। মনে হচ্ছিল, সারা ঢাকা কেউ সেন্ট্রাল এসি করে রেখেছে। ভয়াবহ শীত আর বাতাস। তারপরও, বিশ্বকাপের টিকেট বলে কথা!

রাতের ঘুমটা ঘুমানোর চেষ্টা করলাম রোদ ওঠার পর অন্যের কাঁধে মাথা রেখে। মাঝখানে দেখি আরেক লাইন, একটু পরে অবশ্য বুঝলাম, টিকেট নয়, এটা বিশেষ লাইনে দাঁড়ানো মহিলাদের অভিভাবকদের বিশেষ লাইন। রাতে তো তাও নড়াচড়া করা যাচ্ছিলো, দিনের বেলা কেউ লাইন থেকে বের হওয়া মানেই তার বিশ্বকাপ এখানেই শেষ। এমনকি কেউ পরনের জ্যাকেট ও খুলছে না, কারণ কিছুক্ষণ আগেই একজনকে বের করে দেয়া হয়েছে, কারণ তার পেছনে থাকা সবাই দাবী করেছে, সে লাইনে ছিল না! আসল ব্যাপার হল, সে জ্যাকেট আর মাফলার খুলে ফেলায় কেউ তাকে চিনতে পারে নি। আর অন্য কোন কিছু না করলেও, ঠেঙ্গিয়ে লাইন থেকে বের করে দেবার ক্ষেত্রে দেখলাম পুলিশের বহুগুণ আগ্রহ! সকাল দশটার সময় টিকেট দেয়া শুরু করার আলামত দেখা গেল। এবং আশ্চর্যের সাথে লক্ষ্য করা গেল, ‘ভলান্টিয়ার’ নামক ব্যক্তিবৃন্দ সকলের আগে টিকেট নিয়ে বীর দর্পে বিজয়ের হাসি দিয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করলেন। আর আপত্তি করলাম না, মাত্র তো সিরিয়াল নাম্বার ৩৭, টিকেট তো পাবই! একটু পরেই বুঝতে পারলাম, কেন, এখানে লোকজন দিনের পর দিন দাঁড়িয়ে টিকেট পাচ্ছেন না, সম্ভবত প্রতি ঘণ্টায় চার থেকে পাঁচ জন লোক নেয়া হচ্ছে, এবং তারা যে কোথায় যাচ্ছে, টিকেট পাচ্ছে কি না, কিছুই বোঝা গেল না। অনেকে বলছেন, সার্ভার ডাউন, অনেকে বলছেন টিকেট শেষ, একজন বলে, “বুঝেন নাই, ভিত্রে নিয়া মার্ডার করতেছে।” অন্য সময় হলে একটা হাসি দেয়া যেত, কিন্তু এখন ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেয়াও যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখা গেল, মহিলাদের লাইনে বেদম চুলোচুলি, কারণ কিছু না, একজনকে সন্দেহ করা হয়েছে, সে লাইনে ‘অবৈধ’ ভাবে ঢুকেছে। আর ছেলেদের নজর একদমই সেদিকে নেই, তারা ব্যস্ত মোবাইলে, চুলোচুলি রেকর্ড করায়!

দুপুরের দিকে আমাদের ছয় জনের দল কমে চার জন হয়ে গেল, কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র আমরা নই! (অন্তত তখন না) বিকেলের দিকে এক বন্ধু পূর্বজন্মের কোন পুণ্যের উপহার সরূপ খাবার নিয়ে এলো, মুখে দিয়ে মনে হল, অমৃত। আহ, কতদিন পর খাবার! খাবার খেয়ে শক্তি পেলাম ঠিকই, কিন্তু তখন আর শক্তির দরকার নেই। সামনে দশ বারো জনের মত থাকা অবস্থায় টিকেট দেয়া বন্ধ হয়ে গেল। পুলিশের তত্ত্বাবধানে দেখলাম, আমাদের নাম নোট করা হল। মনে করলাম, যাক বাচা গেল, কালকে আবার এসে সিরিয়াল দিলেই পাওয়া যাবে টিকেট। অন্তত আজকে আর রাতে দাড়াতে হবে না। মনে একটা খুশি খুশি ভাব, অজান্তেই চিন্তা করে ফেললাম, দেখছি বাংলাদেশ সাউথ আফ্রিকা ম্যাচ, গ্যালারী তে বন্ধুদের সাথে ব্যাপক চিল্লাচিল্লি, এইতো, তামিমের দুর্দান্ত ছয়, ওয়াও কি শর্ট! বাংলাদেশ তো মনে হয় জিতেই গেল!

বেশিক্ষণ চিন্তা করা লাগলো না। একটু পর পুলিশ এসে বলল, কোন নাম নাই, কোন সিরিয়াল নাই, কালকে নতুন করে আবার সিরিয়াল। আমাদের মত দুই চার জন লোক কিছু একটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছিল, লাঠির বাড়ির সামনে কিছুই দাঁড়ালো না। আমদের মধ্যে অনেকেই বলল, আজকেও রাত কাটাবে, কিন্তু গিয়ে দেখা গেল, কালকের জন্য লাইন তৈরি। কর্তব্যরত লোকদের সাথে বহু ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে করতে আমরা স্থান ত্যাগ করলাম। একবন্ধু হঠাৎ করেই বলল, “দোস্ত, পিছন দিয়া কোন রাস্তা নাই?” কি আর করা, অগত্যা সাত বছর আগে কলেজের ম্যাডামের দেয়া সেই ডায়ালগটি আবার দিতে হল।

মহান এক দার্শনিক বলেছিলেন, “জীবনটা বিশ্বকাপের টিকেটের লাইনের মত, ব্যাপার না তুমি কতক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে, শেষে সবাই টিকেটটাই দেখবে।”

থাক, আর হেয়ালী করে লাভ নেই, কথাটা এই অধমেরই।

২,৮৬৪ বার দেখা হয়েছে

২৫ টি মন্তব্য : “কারওয়ান বাজারে একটি ঘটনাবহুল রাত”

  1. মামুন (২০০২-২০০৮)

    মামা, আমারে আগে কইতা, এইখানে অনলাইনে টিকেট পাওয়া যাইতেছিল। খেলা দেখতে পারবোনা বইলা কিনি নাই। এখন তো দেখতাছি, অনলাইনে টিকেট কাইটা সেইটা বাংলাদেশে ব্ল্যাক এ বিক্রি করলে, লাভের টাকা দিয়ে প্লেনের টিকেটটা কাটতে পারতাম।
    লেখা বরাবরের মতই পড়তে অসাধারন লাগছে। :clap:

    জবাব দিন
  2. রুম্মান (১৯৯৩-৯৯)

    ভি আই পি গ্যালারীতে খেলা দেখুম । টি ভি তে খেলা দেখার উপরে কুনো সিস্টেম আছে নি ( আংগুর ফল টক;টিকেটের চেষ্টা করিনাই এমুন কূনো জায়গা নাই)? মাশরাফির বোল্ড একবার মিস করলে কি আবার মাঠে কইরা দেখাইবো ? মাগার আমার ভি ভি আই পি গ্যালারীতে কম্বলের তলায় বইসা খেলা দেখুম ।


    আমার কি সমস্ত কিছুই হলো ভুল
    ভুল কথা, ভুল সম্মোধন
    ভুল পথ, ভুল বাড়ি, ভুল ঘোরাফেরা
    সারাটা জীবন ভুল চিঠি লেখা হলো শুধু,
    ভুল দরজায় হলো ব্যর্থ করাঘাত
    আমার কেবল হলো সমস্ত জীবন শুধু ভুল বই পড়া ।

    জবাব দিন
  3. Jishan (06-10)

    সাকিব ভাই,
    আপনার জন্য সমবেদনা কিন্তূ মজার জিনিস হইলো “আমি সামনে দিয়া পারি নাই , কিন্তূ পেছন দিয়া ঠিক দুই টা বাংলা - স. আফ্রিকা বাহির করতে পার্সী " 😀 😀 😀

    জবাব দিন
  4. তাসনিম (২০০২-২০০৮)

    আমি ২রাত ৩দিন লাইগ্যা থাইকা নেদারল্যান্ডের ম্যাচের টিকেট পাইসি... x-(
    এর উপর আবার চট্টগ্রামের ম্যাচ। x-(
    তাও তো ওয়ার্ল্ড কাপে মাঠে থাকতে পারমু... :tuski: :tuski: :tuski:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : নাজমুল (০২-০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।