মণ্ডল থেকে সরকারঃ ৩য় পর্ব

ব্রিটিশ আমলে ফিরিঙ্গি ঠেঙ্গান রিয়াছত উল্লাহ সরকার। ছেফাত উল্লাহ সরকার, গ্রামঃ মাড়িয়া, থানাঃ বাগাতিপাড়া, মহকুমাঃ নাটোর, জেলাঃ রাজসাহীর ২য় পুত্র তিনি।দেখতে রাজপুত্রের মতই ছিলেন তিনি।সোনার মত গায়ের রং। বাঘের মত চেহারা।মতির মত চোখ। অসুরের মত শক্তি। দারুণ মেজাজী।দোর্দন্ড প্রতাপ। দুহাতে রোজগার করেছেন, দেদার খরচ করেছেন।অত্যন্ত অতিথি বৎসল।রাজকীয় চালচলন। তাই সংসারে শ্রীবৃদ্ধি ঘটেনি। সব সময় ইয়ার বন্ধু পরিবেষ্টিত থেকেছেন। সুতরাং এজাতীয় কিছু দোষে দুষ্টও ছিলেন।একটু খোলাসা করেই বলি।তখনকার সম্ভ্রান্ত লোকদের মত পান করার অভ্যাস ছিল। তরল এবং বায়বীয়। সুরা পান লোকে তেমন খারাপ মনে করতো না।সন্ধ্যা বেলা সামর্থ অনুযায়ী লোকে হুকা (তামাক), ভাং কিংবা গাঁজা খেত।

সবকিছু ছাপিয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরোপকারী এবং দরদী মনের মানুষ।কেউ কোন আপদ বিপদে পড়লে তাঁর সাহায্য চাইলে সেটা তাঁর নিজের সমস্যা হয়ে দাঁড়াত।টাকা পয়সা শক্তি সামর্থ জনবল সবকিছু দিয়ে সে কাজ উদ্ধার করে তবে ছাড়তেন।সরকারকে অভাবের কথা জানিয়ে মিষ্টি খাইয়ে টাকায় এক বিঘা জমি লিখে নিয়েছে অনেকেই। তার বদান্যতায় উপকৃত হয়েছে অনেকেই।

রিয়াছত উল্লাহ সরকার স্বদেশী করতেন।ইংরেজদের সাথে তাঁর বেশ কয়েক দফা লড়াই-জঙ্গ-মামলা-মোকদ্দমা হয়।অত্যন্ত দুঃসাহসী নির্ভিক এই মানুষটি নিজের জন্য পরের জন্য ইংরেজদের সাথে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন।খুব মজলিশি লোক ছিলেন তিনি।কত গায়ক কত ফকির নানা রকমের ছিন্নমূল মানুষ সেখানে একবার আস্তানা গেড়ে বসেছে তো যেন আর ওঠার কথা ভুলে গেছে।তার পরিষদে হিন্দু মুসলমান জাতি ধর্ম কোন ভেদাভেদ ছিল না। ভক্ত নামের এক চৌকিদার সার্বক্ষনিক ঐ বাড়িতেই থাকতো। পথের ফকির থেকে আরম্ভ করে সমাজের গণ্যমান্যরা , সরকারী আমলারা পর্যন্ত তার বাড়ির দানা পানি খেয়ে ধন্য হয়েছে।

রিয়াছত উল্লাহ সরকারের স্ত্রীর নাম গোলেজান।তার দুই সন্তান।মোঃ মতিউর রহমান সরকার আর রওশন আরা রাণী। এক দিন, গালিমপুর গ্রামের এক বধূ নূরজাহান গোয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবছিলো।ঘোড়া দাবড়ে বাড়ি ফিরছিলো রিয়াছত। নূরজাহান মানে নাকি জগতের আলো ! সেই আলোয় চোখ ঝলসে যায় রিয়াছতের। জমিদারী স্টাইলে তাকে তুলে নিয়ে আসে। হতভাগা সোয়ামী তার বউকে ফেরত পায়নি।নায়েব রিয়াছত উল্লাহর সাথে জঙ্গে নামার সাহস কোথায় পাবে সে ? হ্যাঁ , রিয়াছত উল্লাহ নায়েব ছিলো বটে তবে অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করেনি।নূরজাহান ছিলো ব্যতিক্রম। নূরজাহান সুন্দরীকে সবাই সরকারনী বলতো।সরকারনীকে সরকার খুব ভালোবাসতো।সরকারনীর আগমনে দুয়োরানীতে পরিণত হয় গোলেজান।তাকে অবশ্য বেশী দিন কষ্ট করতে হয়নি।মতি আর রাণীকে ছোট রেখেই সব কিছুর উর্ধ্বে চলে যায় গোলে।সরকারনী নিঃসন্তান ছিলো। সে ভালোবাসতো রাণীকে।তাই রাণীর স্বামী আসাদুজ্জামান মুন্সী (পুন্নু মিয়া)কে ঘরজামাই রাখা হয়।

জমিজমার খাজনা পরিশোধ না করায় লস্করপুর অর্থাৎ পুঠিয়ার জমিদার জমি নিলামে উঠায়।রিয়াছত এবং মাহতাব সরকারের জমি ধরে নেন মতিউর রহমান। সরকারনীর প্রতি অত্যধিক আসক্তি কিংবা পুত্র কন্যার সমতা যে কারণেই হোক রিয়াছত তার নিলামিত সম্পত্তির অর্ধেক রাণীকে দেয়।মা মরা মতি কিছুই বলতে পারেনি বাপকে।

মাড়িয়া গ্রামের জফর উদ্দীন সরকার ছিলেন রিয়াছত সরকারের প্রাণের বন্ধু । মামলা-মোকদ্দমা- সালিশ দরবার পর্যন্ত এক সংগে করতেন তারা। জফর সরকারের সুন্দরী এক কন্যা ছিলো, রাবেয়া।মতি তাকে খুব পছন্দ করতো। একসাথে স্কুলে যেত খেলতো।ছোট থেকে বড় করে তুলেছিলো।ইচ্ছা ছিলো সারাজীবন এক সাথে থাকবে। একই গ্রামের বদর সরকার বেশ ধনী লোক।রাবেয়ার দিকে তার চোখ পড়ে।জফর সরকারের মুরুব্বিদের উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে নিজের দিকে টেনে নেয়।নানান ফন্দি ফিকির করে তারা।বার বার বিয়ের তারিখ পাল্টাতে থাকে।সব শেষে বলা হয় বিয়ের প্রস্তাবের দিন জফর সরকারের গায়ে শকুনের গু পড়ছিলো।খুবই অশুভ লক্ষণ। তাই এই বিয়ে হবে না।রাবেয়ার বিয়ে হয় বদর সরকারের সাথে। এই ঘটনায় মতিউর রহমান সরকারের হৃদয়ে চিরস্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি হয়।

 আব্দুলপুর রেল স্টেশনে রিয়াছত উল্লাহ সরকার এবং আরও অনেকে (১৯৩৫ সাল)

dada

মণ্ডল থেকে সরকারঃ ১ম পর্ব

মণ্ডল থেকে সরকারঃ ২য় পর্ব

মণ্ডল থেকে সরকারঃ ৩য় পর্ব

মণ্ডল থেকে সরকারঃ ৪র্থ পর্ব

মণ্ডল থেকে সরকারঃ ৫ম পর্ব

 

২,৩৮৩ বার দেখা হয়েছে

১৪ টি মন্তব্য : “মণ্ডল থেকে সরকারঃ ৩য় পর্ব”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    আচ্ছা ভাই বেয়াদবি না নিলে কিছু কথা। 🙁 কথাগুলো বলছি কারণ পড়তে গেলে ভুলে যাচ্ছি এটা একজনের জীবনের কাহিনী। এখানে কাহিনীর ফাঁক, অসম্পূর্থ তথ্য থাকবেই। তারপরেও পড়া শুরু করলে গল্পের মত ভাবা শুরু করি। ট্রানজিশান গুলো একটু ফাঁকা লাগছে। তথ্য না থাকার সম্ভাবনাই বেশী তারপরেও যদি সম্ভব হয় কাহিনীর ট্রানজিশান গুলা আরেকটু স্মুথ করেন! মধুর মত গিলছি। ট্রানজিশানগুলো ঠিক থাকলে মধু দেয়া শরবতের মত গিলবো! 😀


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. সামিউল(২০০৪-১০)

    অনেক ভাল লাগছে ভাই। পরের পরব গুলো তারাতারি নামিয়ে ফেলেন।

    আর মোকাব্বির ভাইয়ের মত আমারো মত একই, যেখানে গ্যাপ থাকবে নিজের মত করে জুড়ে দিয়েন।
    ঐতিহাসিক লেখা হলেও এখানে আপনার লেখার স্বাধীনতা দাবি করছি।

    😛


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।