টিটোর গপ্পোঃ আনারসের হাঁসি

আনারসের হাঁসি

১৯৭৮ সাল। মতি মিয়ার ছোট দুই ছেলে হাসান টিটো মান্নান সরকারের উঠানে খেলছিলো।খেলার সাথী টিটোর না পাতানো দোস্ত হুমায়ুন।রাবেয়ার ছেলেটার সাথে টিটোর দোস্ত পাতার কথা অনেকেই বলেছে । কিন্তু রাবেয়ার সামনে দাঁড়ানর কথা ভাবলেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে মতির।জফর সরকারের মেয়ে রাবেয়াকে সেই ছোট্ট বেলা থেকে ভালবেসেছে মতি।কয়েক বার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েও বিয়েটা হয়নি তাদের।বিয়েটা হলো বদর সরকারের সাথে। ধন সম্পদের জন্যই সেটা হলো কিনা আল্লাহ মালিক জানে। সেই দুঃখ মতি ভুলতে পারেনা কিছুতেই।ন্যাংটা কালের দোস্ত মান্নান সরকারের বাড়ি আর বদর সরকারের বাড়ির উঠান একটাই। না পাওয়ার যন্ত্রণা চেপে রেখে দোস্তের বাড়িতে যাওয়ার শক্তি নেই মতি মিয়ার।এদিকে বউ আশানারাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠাতে হবে।গলার কাছে ফুলে উঠেছে। টিউমার না কি জানি হয়েছে। গলা কেটে তার টিউমার সরাতে হবে।মেজ ছেলে শাজাহান ওর মাকে নিয়ে ঢাকা যাবার জন্য গোছগাছ করছে।কিন্তু সমস্যা হলো টাকা খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।ছোট ছেলেরা টাকা নিলো কি না কে জানে ? বরফ, দাঁতভাঙ্গা, বাদাম এসব খাওয়ার জন্য মাঝে মাঝেই টাকা চায়। না দিলে কিছু বলে না, শুধু মন খারাপ করে।তবু ছোট বাচ্চা নিতেও পারে ।অগত্যা শাজাহানকে পাঠানো হলো ।“এই হাসান টিটো তাড়াতাড়ি বাড়িত চ, আব্বা ডাকতিচে।” বাড়ি যাওয়ার পরেই ধমক শুরু। ট্যাকা কোতি  থুইচিস ? বার কর । শার্ট প্যান্টের পকেট, ভুট্টার খইয়ের মালা, রবিনসন বার্লির কৌটা কোথাও টাকা নেই। অবশেষে টাকা পাওয়া গেল তোষকের নীচে একটা চিনির টুকনের মধ্যে। মনে ছিলো না মতির ।

বড় ছেলে সেনাবাহিনীতে চাকরী করে কিন্তু কয়েক বার ওকেই টাকা পাঠাতে হয়েছে।কষ্ট কিছুতেই কমে না মতির।বড় ছেলেটাকে জমি বন্ধক রেখে পড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্মিতে ঢুকে যায়।খাবার খরচ কমানর নাম করে এমন এক মেয়েকে বিয়ে করেছে যে কি না বাপ ছেলের সম্পর্ক রাখতে দেয় না।উপায় নাই, তাই ওর কাছেই যেতে হবে । সিএমএইচে বড় ডাক্তার গলা কাটলে বৌটি হয়তো বেঁচে যাবে।পেট মোছা মেয়ে ডিম বুড়ি, আশানারা আর শাজাহান ঢাকায় গেলো। খরচ বাঁচাতে হাসান টিটো বাড়িতেই থাকলো।কিন্তু দুই দিন পর শাজাহান বাড়ি ফিরে আসে টিটোকে নেয়ার জন্য। ছোট ছেলের জন্য না কি মায়ের মন আনচান করছে। তা ছাড়া ডিম বুড়িকেও দেখে রাখার ব্যাপার আছে।

ঢাকা দেখার জন্য টিটোর মন ভিষন ছটফট করছিলো।আর কতক্ষণ, জিজ্ঞেস করতে করতে বিরক্ত করে ফেলছিলো ভাইকে।বাস থেকে নেমে ফেরীতে উঠে অন্য রকম জালানো শুরু করলো। সিটে বসে না থেকে দাঁড়িয়ে থাকে। শেষ পর্যন্ত দুইটা বন রুটি নিয়ে জালানো থামলো।ফেরী থেকে নেমে আবার বাস।বাসের মধ্যে থেকে অবাক চোখে টিটো দেখে রাস্তার বাতি গুলো। কলাগাছের ভাদালের মত জিনিস থেকে আলো বের হচ্ছে। কিছু কিছু ভাদাল পিট পিট করে জ্বলছে আর নিভছে। আরেকটা জিনিস দেখে মজা পেলো টিটো।বাসের মধ্যে একটা লোক টাকা নিচ্ছে। কয়েকজন দুই টাকা দিয়ে আট টাকা ফেরত পেলো। আমার কাছে দুই টাকা থাকলে আমিও আট টাকা পেতাম- ভাবলো টিটো।বাস থেকে নেমে তিন চাকার গাড়ীতে চড়ে বড় ভাইয়ের বাসা।একটা পাঁচ তালার চার তালায়।মেজর ভাইয়ের এক বাচ্চা নিমা । আর আছেন ভাবী , তার ভাই বাবু , বাবুর বৌ আর , ভাইয়ের শালী ডিনু আর এক কামের ছুঁড়ি।

মেজর ভাইয়ের বাসায় টিটোর অবাক আর কষ্টর অনেক কিছুই ছিলো।প্রথম জিনিস টা হলো কারেন্ট। কারেন্টে আলো জলে , চরকি ঘুরায় বাতাস করে। বেশি মজার জিনিস টেবিলে রাখা একটা কাঠের বাক্সো যার সামনের দিকে কাঁচ।ওটাও কারেন্টে চলে। ভিতরে মানুষের ছবি গান এসব দেখা যায়।ওর ভিতর ছোট ছোট মানুষ, পাখি, ইঁদুর এসব থাকে। কারেন্টে চলা বায়োস্কোপ। চার কোনা বোতাম টিপলে ঐ সব জিনিস দেখা যায় কিন্তু সব সাদা কালো।বোতাম টিপলে সাদা আলো হয়ে সব চলে যায় তার পর অন্ধকার।সাদা চিনামাটির চাড়ির সাথে লাগানো নল দিয়ে পানি বের হয়। খড়ি ছাড়া ভাত তরকারি রান্না হয়।তিন দিন খুব কষ্ট হল টিটোর ।পায়খানা করার জায়গা খুজে পায়না। বাড়িতে থাকতে তাল পাতা না হলে বুনের ঘেরা দেয়া জায়গায় কাজ সারতো।এখানে টয়লেট নামের ছোট ঘরে নাকি গোসল পেশাব পায়খানা করা মুখ ধোয়া সবই করে।বাড়িতে নিমের ডাল না হলে আটি শওড়ার দাঁতন করে মুখ ধোয়া হত। এখানে একটা সাদা মলম দিয়ে দাত মাজা । দাঁত মাজা পাউডারও নাই।যাই হোক টয়লেটে মলত্যাগের জায়গা না পেয়ে খুব কষ্টে আছে টিটো।৩য় দিনে শুকুর ভাই আসলেন দেখা করতে।বল্লেন টিটো ভাই কুনো অসুবিদা নাইতো ? ভাই হাগার জাগা নাই। উনি বল্লেন টয়লেট আছে তো চল । এই চিনা মাটির এই চাড়ির নাম কমোড। একেনে কাম সারো।ভাই এত সাদা একেনে ? বিশ্বাসই হতে চায়না। তিন দিনের কষ্ট দূর হলো। ডিম বুড়ি আর টিটো কামের ছুঁড়ির বাথরুম ব্যবহার করবে।এত গেল এক ঝামেলা । আরেক ঝামেলা নিমি। বড় বড় নখ দিয়ে যখন তখন গালে হাতে আঁচড়ায়। সকাল বেলা আর এক কষ্ট। কোন দিন গমের রুটি আর পটল খায়নি টিটো। মেজর ভাই জোর করে মুখের মধ্যে পটল ঢুকায়। বাবু ভাইয়েরা ডিম ভাজি আরও মজার তরকারি খায়। আর সুযোগ পেলেই টিটোর নুনুতে হাত দিয়ে বলে এটা কি ? নুনু । না, এটা কাকা, বল কাকা।নুনু বলে গাঁয়ের চাষারা , তুমি কি চাষা ?

প্রতিদিন টিটো দেখে গাড়ী নিয়ে ঘোষ দুধ বিক্রি করতে আসে।প্যাঁক প্যাঁক শব্দের বাঁশি বাজলে কামের ছুঁড়িটা দুধ নিতে ছুটে যায়।এক দিন একটা গাড়ী টুংটুং শব্দ করতে করতে যাচ্ছিলো । ডুগডুগি নাই বোধ হয়। শাজাহান ভাই বল্লো তোরা বরফ খাবি ? ডিমবুড়ি আর টিটো কি খুশি! কৌটার মধ্যে বরফ , সাথে ছুটুনি চামুচ। এক্কেরে দুদ বরফ। গাঁয়ের বরফ তো পানি বরফ ! আহ্ । বরফের কৌটা আর চামচ ওরা রেখে দেয় মায়ের ব্যাগে।

হাসপাতালে মায়ের গলা কেটে টিউমার বের করা হলে কয়েক দিন পর বাড়ি ফেরা। তার আগে টিটোর বিচার।বড় ভাই বাসায় ফিরতেই ডিম বুড়ি বিচার দেয়- ভাই টিটো ভাই আমাক মারিচে । এই টিটো তোর এত্ত বড় সাহস ? বল কেন মারছিস ? আনারসের ম্যুসলি । মানে আনারসের ম্যুসলির জন্য মারছিস । ঠাস ঠাস ।অঝোরে কাঁদতে থাকে টিটো।সেই দিন মেজর ভাই আনারস আনছিলো।দুপুর বেলা দুই ভাইবোন ছোট ছোট দুই তিন টুকরা আনারস পায়।আরও খেতে ইচ্ছা কিন্তু কে দিবে ? ছোট্ট ডিম বুড়ি এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে রান্না ঘরের মেঝেতে আনারসের ভিতরের ম্যুসলি দেখে মুখে পুরে দেয়। বেশ মজা পেয়ে ভাইকে খবর দেয়। তারপর কে বেশী খাবে তাই নিয়ে ভাইবোনের মারামারি।সন্ধায় টিটোর বিচার।

২০০০ সাল ।ট্রেনে চড়ে সিলেট থেকে বাড়ি যাচ্ছে টিটো।শ্রীমঙ্গলে বেশ ভালো দেখে চার হালি আনারস কেনে।ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে নেমে ডিওএইচএসে দেখা করতে যায় ভাই ভাবীর সাথে।আরে টিটো মিয়া ! তুমি চাকরী পাইছ । খুব খুশী হইছি। এত বছর যোগাযোগ  করনি কেন ? আমরা কি মানুষ না ? খুব খুশ হইছি ভাই। সিলেট থেকে আনারস নিয়াসছো আমাদের জন্য।ব্রিগেডিয়ার সাহেব দেখ। ছোট ভাইকে দেখে শেখো। তুমিতো একখান মাত্র আনারস ঝুলাতে ঝুলাতে বাসায় আস। ভাবী মাকে দেখার জন্য মন কেমন করছে । বাসের টিকিট কেটে রাখসি । এখনই যেতে হবে , না হলে হরতালে আটকা পড়তে পারি।আনারস গুলো ড্রইং রুমে রেখে দ্রুত বের হয়ে আসে টিটো।টিটোর চোখ অনেক দিন পর জলে ভিজে ঘোলাটে হয়ে যায়।কিন্তু আনারসের অসংখ্য মুখের হাঁসি ঠিকই দেখতে পায় সে ।

১,৮০৭ বার দেখা হয়েছে

১৬ টি মন্তব্য : “টিটোর গপ্পোঃ আনারসের হাঁসি”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    হাসিতে চন্দ্রবিন্দু নেই।
    আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম সিসিবির বেশির ভাগ লেখকেরই এ সমস্যা আছে -- যে কোন শব্দে হুট করে একটা চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে দেয়া। যেমনঃ হাঁড়, বাঁচাল, পঁচন, কুঁড়িয়ে।
    এবং এঁরা সবাই আমার প্রিয় ব্লগার। তাই আমার কষ্ট হয়। আপনার পোস্টে মন্তব্য করতে এসে প্রসংগটা উত্থাপন করলাম মোস্তাফিজ ভাই, রাগ করবেন না আশা করি।

    খুব হৃদয়গ্রাহী লেখা। একটু তাড়াহুড়োর ছাপ টের পেলাম।
    আপনার জীবনের কথা আরো বলুন। আপনার লেখায় শেকড়ের ছোঁয়া আছে -- উপন্যাসের লাইনে ভাবতে পারেন। সিরিয়াসলি।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।