বিপদের বন্ধু বিপ্লব

অনেক দিন আগে একটা কবিতা খুব নাড়া দিয়েছিলো আমাকে। আবছা ভাবে একটু মনে আছে- “তোমাদের হিসেবী খাতায় বীর নেই, শহীদ রয়েছে শুধু” । জীবিতদের মূল্যায়নে বড্ড কৃপন আমরা। তাই কবির আক্ষেপ প্রকাশ কবিতায়। আমার খাতায় কিন্তু বীর আছে-

বিপদের বন্ধু বিপ্লব

কম কথা বলা বিপদের বন্ধু।
দিল খোলা আবু উলা
মোঃ হাসিনুল ইসলাম।

পরলোকগত বন্ধুদের স্মরণে “ক্যাপ্টেন কারজিয়াস” এবং “থ্রি কমরেডস” ভাগ্যক্রমে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। এক বড় ভাই আমার সংবেদনশীল মনের প্রশংসা করেছিলেন।মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীল নীতির কারণে পারস্পরিক দূরত্ব বৃদ্ধিতে কষ্টের ফল “ক্যাডেট বন্ধু”।এটা পড়লে ক্যাডেট ফ্রেন্ডশীপকে পিকনিক/গেটটুগেদার ফ্রেন্ডশীপ মনে হতে পারে।আর এই অধমকে আপনি গাড়ল কিংবা অকৃতজ্ঞ বলতে পারেন।তবে আমার দাবী হচ্ছে আমি অতটা অকৃতজ্ঞ নই।যার যা প্রাপ্য তাকে তাই দেয়া উচিত মনে করি।কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই এই পোষ্টের জন্ম।

আবু উলা মোঃ হাসিনুল ইসলাম,ক্যাডেট নম্বর ১০৯৫,খালিদ হাউস,২০তম ব্যাচ,রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ। এ বন্ধুটির ক্যাডেট নম্বর বেজোড় হওয়াতে আমার মত এ ফরমে ছিলো।ওর সাথে কলেজ লাইফে খুব খাতির ছিলো তা কিন্তু নয়।কিন্তু বিশেষ একটা কারণে সব সময় আমার মনের মধ্যে আছে।আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আব্দুল্লাহ ইউসুফ ইমাম ওরফে পলাশ ওরফে পিয়া ওরফে পলু মামা প্রায়ই বলতো- “ হারররর মুস্তাফিজ। তোর নাম টা মোটেও তোর সাথে মানায় না। তোর নাম হওয়া উচিত ছিলো হাসিন।”

রাজশাহীর ছেলে হাসিন-এর ডাক নাম বিপ্লব।আমার মতই নিরীহ।কেউ কেউ আমাকে ঘাউড়া বা মিচকে শয়তান বল্লেও বিপ্লবকে কেউ তা বলতে পারেনি।নামের শুরুতে “আবু উলা” বিস্ময়ের জন্ম দিলেও সমস্যা তৈরী করেনি।উপনাম সৃষ্টিতে ক্যাডেটরা বিশেষ পটু।তাই হাসিন>হায়াসিন্থ>কচুরীপানা।দুই একজন কচুরীপানার বলে খেপানর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে।ক্লাশ নাইনে হান্নান স্যার (বঙ্কিম) খোশ মেজাজে ছিলেন।হঠাৎ বল্লেন, “ হাশিইইন ইয ঠু মুশলিইইম। ছয়তান যাতে তার গোপনাঙ্গ দেখতে না পারে তাই সে পেশাব পায়খানা ত্যাগ করেনা”।কয়েকজন ফিসফিস করে বল্লো, তা হলে কি শুধু পাদে…? হাসিনের হাতের লেখা ছিলো ছাপার হরফ। খালিদ হাউসের দেয়াল পত্রিকা লেখতো বোধ হয়।ছবি ও ভালই আঁকতো।একজন সত্যিকারের ভদ্র ও ভালো মানুষ।

ক্লাশ টুয়েলভে এক বিকেলে গেমস টাইমে বাস্কেট গ্রাউন্ডে আমরা কয়েকজন মকরা গল্প করছিলাম।মনে আছে হাসিন একটা গল্প বলে ভাল হবার চেষ্টা করছিলো অর্থাৎ ওর গুডবয় ইমেজ ভাঙ্গার চেষ্টা করছিলো।সেটা এরকম- মাদ্রাসা পড়ুয়া ভীষন ভদ্র একছেলে বিয়ে করেছে। কখনও মেয়েদের দিকে তাকায়নি।সবাই চিন্তিত, বাসর রাতে ছেলেটা কী করবে ? বাসর ঘরের দরজা বন্ধ করার পর উৎসাহী কয়েকজন ঘন্টা খানেক আড়ি পেতে ব্যর্থ হয়।কিন্তু সকাল বেলা সবাই অবাক।বাসর ঘরের দরজা খোলা, কেউ নেই্ । তবে কি পুকুরে গেছে গোসল করতে ? তা ও তো না! তার পর দেখা গেল বিছানা রক্তে ভর্তি।বর কনে দুই জনই লজ্জা পেয়ে হাওয়া।

ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হবার পর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সয়েল সাইন্সে ভর্তি হয়।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন ২য় বর্ষে আমার প্রাইমারীর বন্ধু ইব্রাহিম খলিল মিঠু জানালো একজন এক্স ক্যাডেট ওর সাথে ইংরেজীতে পড়ছে।আলাপ করতে গিয়ে দেখি বিপ্লব।প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ছেড়ে ছাগোল মার্কা সার্টিফিকেট নিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন ? ব্যাপক গোলাগুলি আর এরশাদ ভ্যাকেশনের ধকল সহ্য করতে না পেরে স্বেচ্ছায় অবনমন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করার পর অনেকে বল্লো ঢাকায় গিয়ে কোচিং এবং বিভিন্ন ধান্দায় নিয়োজিত থাকতে। তা হলে দ্রুত বেকারত্বের সমাপ্তি ঘটবে।হঠাৎ করে ঢাকায় গিয়েই সব করা তো মুশকিল। প্রথমে মেসে সিট দরকার । তারপর টিউশনী। যারা আগে থেকেই আছে তারা সহযোগিতা করতে পারে।টাকা নয় ঐ দুটি ব্যাপারে সহযোগিতা চাই আমার। এজন্য ঢাকা শহরে অবস্থানকারী প্রায় ১০/১৫ জন বন্ধুর কাছে চিঠি লিখলাম। – আমি ঢাকায় গিয়ে চাকরির পড়াশুনা কোচিং ইত্যাদি করতে চাই , কে কি সহযোগিতা করতে পারো জানালে খুশি হবো।কেউ আমার চিঠির জবাব দেয়নি।

অনেক দিন পর, কর্মজীবন কিংবা  ছা পোষা জীবনও বলতে পারেন।রাজশাহী আরপিএটিসিতে কম্পিউটার ও ইংলিশ ট্রেনিংএ  হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।বিচিত্র রকমের প্রশিক্ষক ও প্রশিক্ষনার্থী।এদের মধ্যে তরুণ প্রশিক্ষক হাসিনুল ইসলাম বেশ সুনাম অর্জন করলেন।বন্ধু গর্বে আমার বুকটা ফুলে উঠলো।আমার ভাইঝি তখন রাজশাহী কলেজে  ইংরেজীতে পড়ছিলো।কথা বলার সময় কি বলা উচিত বা অনুচিত অনেক সময় বুঝতে পারে না। একদিন হঠাৎ বল্লো – ‘চাচা আপনার বন্ধু আমাদের স্যার।আমরা মেয়েরা নিজেদের মধ্যে স্যারকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করি।পুরুষ মানুষ কেন এত সুন্দর হবে ?এত ভদ্রই বা কেন হবে ? কেউ কেউ লেডিস স্যার বলে।কিন্তু স্যার খুব ভালো মানুষ। আমরাই পাঁজি বদমাশ।”

অশুভ আগষ্টের একদিন টাইফয়েড আক্রান্ত হই। আমার ছোট ছেলেটা ঠান্ডা গরমের দ্রুত পরিবর্তন সহ্য করতে না পেরে ব্রংকিওলাইটিস আক্রান্ত হলো।ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করার সময় যেতে পারিনি।ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে এক চুতিয়া ( দুঃখিত এর চাইতে ভদ্র শব্দ ব্যবহার করতে পারলাম না) ডাক্তারের গবেষনার শিকার হয়ে শয্যাগত ছিলাম।যাই হোক, বউ বাচ্চা হাসপাতালে যাবার সময় একজন অরকা ডাক্তারের ফোন নাম্বার দিয়ে বল্লাম যে কোন সমস্যায় রিং করতে। সপ্তাহ খানেক পর ওরা  ফিরে আসে। ঠিক পরের দিন আমি মৃত্যুর প্রায় কাছে থেকে ফিরে আসি। ভাত খেতে বসে দেখি হাত পায়ে কেমন যানি হচ্ছে।শরীর অন্য রকম লাগছে। বুক ধড়ফড় করছে। ব্যাথাও হচ্ছিলো হয়তোবা।ভাত রেখে শুয়ে পড়লাম।লুঙ্গি টাইট হয়ে যাচ্ছে।পেট ফুলে উঠছে। ঢিলা করলেও সমানে পেট ফুলে উঠছে।গ্যাসের ওষুধ খেয়েও কিছু হয়না। এক সময় দেখি আমার চারপাশে অনেক লোক। হাতে পায়ে সরিষার তেল মালিশ চলছে। প্রেশার কমে গিয়ে নাকি হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ছেলে ফিরে আসার পরদিন আমি হাসপাতালে। জরুরী বিভাগে স্ট্রেচারে ঘন্টা দুয়েক পড়ে থাকার পর একটা পেয়িং বেডে বদলী।শ্বাস কষ্ট হচ্ছিলো।গ্যাস নীচে না নেমে উপরে উঠার চেষ্টা। স্বাভাবিক ভাবে পানি খেতে পারছিলাম না।মুখের মধ্যে পানি নিয়ে মুখ বন্ধ করে জোর করে পেটের মধ্যে পানি ঢুকাতে হচ্ছিলো।পাদের উপকারিতা ভালোভাবেই টের পেলাম সেদিন।শ্বাস কষ্টের কথা বলার পোনে এক ঘন্টা পর অক্সিজেন আসলো।এ দিকে সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালে একা অবিরাম লড়াইয়ের পর স্বামীর সম্ভাব্য মৃত্যু চিন্তায় বৌটি আমার মুর্চ্ছা যাচ্ছিলো। বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্য সান্তনা দিয়ে আমার কিচ্ছুটি হয়নি বুঝিয়ে ওকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।সহমরণে সন্তানদের সর্বনাশ কেউ ভেবেছেন ? ৩য় দিনে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই। আমার মেজ ভাই মোঃ আজিজুর রহমান শাজাহান ( যিনি আমাকে ক্যাডেট কলেজে এবং বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন) ভাইঝি তামান্না রহমান মুন্নী ও ভাতিজা নাহিদ আজিজ অনঘ আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছে।অক্সিজেনের অপেক্ষায় থাকাকালেই কলেজ ফেলে ছুটে এসেছে প্রিয় বন্ধু বলাই কুমার মন্ডল।সহকর্মী বন্ধু আসাদুজ্জামান সরদার মিঠু আমার মনটাকে চাঙ্গা রাখার জন্য অনেক খানি সময় দিত সন্ধ্যার পর।সেরে ওঠার পর হুইস্কি  এন্ড বারকিকিউ এমনকি শেয়ারে পরকীয়া প্রেমের পরিকল্পনা পর্যন্ত করা হলো।মিঠু খুব ফুর্তিবাজ ছেলে।“দুনিয়াটা মস্ত বড়/খাওদাও ফুর্তিকর/আগামীকাল বাঁচবে কিনা বলতে পারো” টাইপ। আমার উল্টা তবে আমি ওকে খুব পছন্দ করি।হাসপাতালে প্রতিদিনই বিপ্লবের সাথে দেখা বা কথা হয়েছে।দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে “লেট অল অফ আস প্রোসপার টুগেদার” বলে যারা সুন্দর পিকনিক,গেটটুগেদার বা রিইউনিয়নে হৃদয়স্পর্শী ভাষন দেন কিংবা স্বেচ্ছায় রক্তদান শিবির ইত্যাকার মহান অনুষ্ঠানের সফল আয়োজন করে থাকেন তাঁদের কারো ফোন ধরার অবকাশ হয়নি।বউয়ের ভাইরাই আমাকে দেখতে আসেনি/ কথা বলেনি ।এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বাসায় ফিরে আসার পর গিন্নী বল্লো তোমার ক্যাডেটদের এবং সহকর্মীদের গল্প অনেক শুনেছিলাম। এদের মধ্যে ভালো মানুষ দুইজন। হাসিন ভাই ( বিপ্লব) আর তৌহিদুজ্জামান ভাই (আমার সহকর্মী)। প্রতিদিন উনাদের সহযোগিতা না পেলে কী যে হতো আল্লাহ্‌ই জানেন।বিশেষ করে হাসিন ভাই অনেক হেল্প করেছেন।কথা কম বলেন কিন্তু অসাধারণ মানুষ। হাসিনের তখনকার ঋন ( আর্থিক) শোধ করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। অনেক কষ্টে টাকা ফেরত নিতে রাজি করিয়েছি।

এই তো গত বছর হঠাৎ বেশ কিছু টাকা প্রয়োজন হয়েছিলো। ওকে বল্লাম। ও বল্লো দেখি । মাঝে মাঝে খোঁজ নিয়ে নিজেই বল্লো রেডি হয়েছে।কথা কম বলে কিন্তু ওর ক্ষমতার মধ্যে আমার যে উপকার করেছে তা কখনও ভুলবো না। অনলাইনে কাজ করে। মাঝে মাঝেই পরামর্শ দেয় কিভাবে কাজ পেতে বা করতে পারি।আল্লাহ এই স্বল্পবাক বন্ধুটিকে জীবনে সফলতার সাথে সুনাম ও শান্তিময় জীবন যাপন এবং সৎকর্মে নিয়োজিত রাখুন।আমি তার দীর্ঘ এবং পূণ্যময় সুখীজীবন কামনা করি।আমিন।

২,৭৮৪ বার দেখা হয়েছে

২১ টি মন্তব্য : “বিপদের বন্ধু বিপ্লব”

    • টিটো মোস্তাফিজ

      ধন্যবাদ ইফতেখার :teacup: তুমি সিসিবির সদস্য হওয়ায় অভিনন্দন :party: আশা করি মাঝে মাঝে লিখবে। হাসিনের ছবি ফেসবুকে আমার টাইম লাইনে পাবে।অনেক কষ্টে ওর একটা ছবি তুলেছিলাম। ব্লগ বা ফেসবুকে দিতে নিষেধ করেছিলো। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ছবিটা ফেসবুকে দিয়েছি। ওয়াদার বরখেলাপ হয়েছে অবশ্য 😛 :shy:


      পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

      জবাব দিন
  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    কি অসাধারণ কাহিনী!
    আপনার পেট ফুলে ওঠার কি কারণ ছিলো?
    intestine এর পেশী কি দুর্বল হয়ে পড়েছিল?

    বন্ধুর প্রতি আপনার ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার প্রকাশ একদম খাঁটি। :boss: :boss:

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।