বিশেষ দিনে- অগোছালো কিছু অনুভূতি

রাতে বাসায় ফিরেই বললাম চলো কনসার্ট দেখে আসি। আমার সহধর্মিণী বলল, না অনেক রাত হয়েছে, তা ছাড়া রাতে কারোরই খাওয়া দাওয়া করা হয়নি। বাসায় আমার পরিবার ছাড়াও আমার সহধর্মিণীর আপন বড় বোন, বোন জামাই ও তাদের বড় কন্যা মানে ভাগ্নি রয়েছে।

ভাগ্নি সবে ভার্সিটিতে ঢুকেছে আর আমার ছেলে ডিজিটাল যুগের স্ট্যান্ডার্ড থ্রিতে। কনসার্ট শুনে দুই জনেই সুর মিলায়ে চোখের পলকের মধ্যে রেডি হয়ে আমার সামনে। অগত্যা বড়দের বা আমার মিসেসের আর কি করা । সবাই রেডি হয়ে নামতে নামতে রাত তখন প্রায় এগারটা ছুঁই ছুঁই। এক দিকে সবাই খালি পেটে আবার এত রাতে কনসার্ট দেখার অযথা আহ্লাদ পূরণ।গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে কনসার্ট ততক্ষণে বাক্স বন্দী। সবার পেটের ক্ষুধা মনে হয় নতুন করে জানান দিচ্ছে, পারলে আমাকে খেয়ে ফেলার অবস্থা।

গাড়ি বাসার কাছে আসার আগে আমি আবার নতুন প্রস্তাব দিলাম। বললাম- সবাই কে আমি পুরাতন ঢাকার চানখারপুলের গরম গরম তিহারি খাওয়াব। আজকে বৃহস্পতিবার আগামী কাল সবার ছুটি। আমার ছেলে আর ভাগ্নি আরও এক ডিগ্রী বেশী লাফ দিয়ে সবাইকে দলে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশি উৎসাহ দিতে লাগল। ইতিমধ্যে আমি বাসার নীচে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্ক করে নামা মাত্রই আমার মিসেস বলল চল যাই তিহারি খেতে। তবে ওরা বাসাই গিয়ে মোবাইল আর পার্টসটা নিয়ে আসুক।

ঘড়ির কাটাই ঠিক এগারটা বেজে বিশ মিনিটে ক্যান্টনমেন্ট হতে চানখারপুলের গরম তিহারি খাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা করলাম। এক দিকে লাগাতার অবরোধ ছিল, আর অন্যদিকে আজ বৃহস্পতিবার এবং পরের দিন ছুটি বলে অবরোধ থাকবে না। তাই হয়তো রাস্তায় ভালো একটা জ্যাম হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। সবাই এক সাথে যাওয়ার লোভ এই জ্যাম কোন ব্যাপারই মনে হবে না। ভাগ্য সহায় ছিলও, পথে কোন জ্যাম না থাকার দরুন খুব অল্প সময়য়ের মধ্যে আমরা গন্তব্যে পৌঁছায়ে গেলাম।

খাওয়া ধাওয়া শেষে আবাসস্থলের উদ্দেশ্য রওনা কিন্তু পথিমধ্যে ভাগ্নি বলল “হাতির ঝিল” দেখতে যাবে। সোনারগাঁ হোটেল হতে ডানে টার্ন নিয়ে হাতির ঝিল দিকে চললাম। যেহেতু সবার পেট ঠাণ্ডা আর কালকে ছুটি তাই সময়ের নেই কোন তাড়া, নেই কোন পিছুটান। হাতির ঝিলের রাস্তায় ঢুকে গাড়ির গতি একদম কমিয়ে দিলাম। আমার ছেলে আর ভাগ্নি কোন একটা ব্রিজে গাড়ীটা পার্ক করতে বলল। অনেক রাত কোলাহল আর গাড়ির শব্দ হতে মুক্ত। চমৎকার হাওয়া, বিভিন্ন রঙয়ের আলোয় উজ্জ্বলিত পরিবেশ। এক কথায় মন ভালো করার অতীব সুন্দর সময়ক্ষন।
ব্রিজের এক পাশে গাড়ীটা পার্ক করলাম। রাত ১২ টা পার হয়েছে অনেক সময় অতিক্রান্ত এর মধ্যে অনেকে ফোন করে আমাকে আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেছে। সবাই গাড়ি হতে নেমে রাতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে নানা রঙয়ের আলোর সৌন্দর্যের দৃশ্য অবলোকন করছে।

হটাত আমার ছেলে কাছে এসে বলল “বাবা চোখ বন্ধ কর, আমি না বললে চোখ খুলবে না।“ গাড়ির দরজা খুলার, বন্ধ হওয়ার শব্দ আর কিছু ফিসফাস কথা শুনতে পাচ্ছি। “বাবা চোখ খোল“ আমার ছেলে বলল। গাড়ির সামনে বনেট কাভারের উপর কেকটা রাখা উপরে লেখা
“ Happy Birthday BABA”

http://www.cadetcollegeblog.com/wp-content/uploads/2015/02/cake1.jpg

মোমবাতির আদলে একটা লম্বা স্টীকের মত কেকের মধ্যে ঢুকান। বাবা নাইফটা ধরো। আবার একটু জোড়ে বলল কারণ টা বুঝতে পারলাম হয়তো আমার জড়তা বা কিছুটা লজ্জার এক ইতস্তঃবোধ করার জন্য। এটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক কারণ
একে-তো আমি একটা বড় ফ্যামিলিতে বড় হয়েছি। আর সেই সময়ে এই ধরনের কোন কিছু রেওয়াজ ছিল কি না? আমার সঠিক মনে নেই বা মনে করতেও পারি না। অতি উৎসাহে কখনও বা মাকে কিংবা বাবাকে আমার জন্মদিনের দিনক্ষণ জানতে চেয়েছি? তখন বাবা বা মা বাংলা সময় সাথে ঐ সময়ে ঘটে যাওয়া কিছু remarkable ঘটনা মিলায়ে আমার জন্মের একটা দিনক্ষণ বলত। আমি যেহেতু নয় ভাই বোনের সবার ছোট। আমার বড় হওয়াটা হয়েছে বড় ভাই বোনদের কোলে কোলে। তাই এ ধরনের উৎযাপন নামক কোন কিছু না থাকলেও তারিখ বা দিনক্ষণ তাদের মনে ছিল।

“জন্মদিন” এখন এটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। যুগের সাথে তাল মিলায়ে চলা বলে কথা। যাই হোক-
আমার সহধর্মিণী, ছেলে আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আমার সাথে হাত মিলিয়ে নাইফ দিয়ে কেক কাটার জন্য রেডি। এই সময় লম্বা স্টীকের মত মোমবাতির মত জিনিশটার মাথায় আগুন ধরিয়ে দিল। হটাত সুন্দর একটা আলোর বিচ্ছুরণ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। অল্প সময়ের এই আলোর বিচ্ছুরণ, সাথে কেক কাটা আর মোবাইল ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলো কেমন যেন এক ভালোলাগা, ভালোবাসার অব্যক্ত অনুভূতি আমাকে ছুঁয়ে দিল। সব অনুভূতি মুখে বা লেখার মধ্যে প্রকাশ করা কারোর পক্ষে সম্ভব না। এই ধরনের অনুভূতি শুধু, শুধুই উপলব্ধি করা যাই কিন্তু বলে বা লিখে প্রকাশ করা যাই না। কেমন যেন বেশী ভালোলাগার অনুভূতিটা না চাইলেও চোখ দিয়ে পানি হয়ে বের হয়ে আসে। সবার অলক্ষ্যে চোখের পানিটা মুছে ফেলি কেউ যেন আবার দেখে না ফেলে। তখন শরীর নামের মেশিনে “এই আবেগি নিউরন” থাকে সব শাসনের ঊর্ধ্বে।
এরপর যথারীতি কেক কাটা ও খাওয়া দাওয়া। উল্লেখ্য, আমার মিসেস, ভাগ্নি, ছেলে বিকালে আমার অজান্তে এই সব রেডি করে রেখেছিল। হয়তো তাদের ইচ্ছা ছিল বাসাতে রাত ১২ টার পরে একটা surprise দিবে। কিন্তু হটাত আমার উল্টা পাল্টা প্ল্যানের সাথে তারা নিজেদের মানিয়ে নিয়ে, মোবাইল বা পার্টস নেয়ার কথা বলে বাসা হতে এই সকল বন্দোবস্ত আমার অগোচরে গাড়িতে নিয়েছিল।

জীবনের এই চলমান সমুদ্রে, সমুদ্র বলা ঠিক হবে না নদী বলাটা আমার কাছে অনেক যুক্তিযুক্ত মনে হয়। ছোট এই চলার পথে খণ্ড খণ্ড কিছু কষ্টের চিত্র থেকে বেশি থাকে জীবন এ্যালবামে ভরা অনেক বিভিন্ন সাইজের ভালোলাগা মিষ্টি মিষ্টি অনেক ছবি।
বড় ইচ্ছা জাগে এই সময়কে যদি অনন্তকাল ধরে রাখা যেত।
বড় ইচ্ছা জাগে মৃত্যুকে জয় করে এইভাবে জীবনটা কাটাই দিতে।
আগেই বলেছি, আমার মাথার বা শরীরের ভিতরে যে আবেগি নিউরনগুলো আছে তা মাঝে মাঝে থাকে আমার শাসনের বাহিরে। যত চেষ্টা করি কন্ট্রোল করতে ততই বুক ভারি হতে থাকে, গলার কাছে দলা হয়ে থাকে এক অব্যক্ত ভালোলাগার কষ্ট। বুকের উপর চেপে থাকা ভারি বাতাস আর গলার কাছে দলা বাঁধা কষ্টের সব কিছু কমে আসে যখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা পানি হয়ে চোখ দিয়ে ঝরে পড়ে।
এই রকম ভালোলাগার অনুভূতিগুলো কেন চোখের অশ্রু হবে?? আমরা সবাই কম বেশী চোখের পানি বা অশ্রু শুধু কষ্টের সাথে দেখতে অভ্যস্ত। আর পুরুষ মানুষের জন্য কান্না/চোখের পানি তা তো বলা চলে হারাম বা মোটেও প্রযোজ্য না।

ভালোলাগার যে অনুভূতিগুলো তার কোন সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। আসলে আমার অতি প্রিয় মানুষের কাছে আমি আমার ভালোলাগা বা খারাপ-লাগার অনুভূতিগুলো না পারি মুখে বলতে,না পারি কোন অঙ্গ বা ভঙ্গীর মাধ্যমে বুঝাতে। যা আমার একটা বড় দুর্বলতা। তাই হয়তো এই লেখার মাধ্যমে যদি তাদের কে সামান্য বুঝাতে পারি যে you people are really very very special to me. তখনই হয়তো পাবে আমার এই লেখার সার্থকতা।“এত ভালোবাসা ও সম্মান ধরে রাখার ক্ষমতা আমার আদৌ আছে কি?” নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করি। তাইতো মাঝে মাঝে বড় ভয় হয় যেন তা হারিয়ে না ফেলি।
আমি আমার এই অনুভূতিটি লেখার চেষ্টা করছি মাত্র কিন্তু কেন যেন আবার সেই নিউরনগুলো ঝামেলা করছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে বের হবে হবে করছে। কি আর করার আছে।একটাই জায়গাই আছে সবার অগোচরের – প্রসাধনী মানে টয়লেট। লিখতে লিখতে আবার এত ভালোলাগা, ভালোবাসার ভার আর আমার ছোট্ট হৃদয় নিতে পারছে না।
সবাইকে আবারও অনেক শুভেচ্ছা।

১,১৩০ বার দেখা হয়েছে

১টি মন্তব্য “বিশেষ দিনে- অগোছালো কিছু অনুভূতি”

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।