একজন পথচারী ও আমিত্ব

এই শুয়ো……. একটা বাজে গালি দিয়ে তার সাথে আরও কিছু…. অকথ্য খিস্তি কেটে গাড়িটাকে এক পাশে সাইড করে রাখলাম। হাইওয়ে রাস্তা এবং যথেষ্ট ফাঁকা থাকার দরুন গাড়িতে মোটামুটি একটু স্পীড দিয়ে ফিরছি আমার গন্তব্য-স্থলে। হটাৎ একজন মাথা নিচু করে পথচারী কোন দিক বিদিক খেয়াল না করে রাস্তা পার হচ্ছে। আমি যথা সম্ভব হর্ন দিয়ে, হেডলাইটের লো-বিম, হাই-বিম দিয়ে সাবধান করতে চাইলাম কিন্তু অল্পের জন্য রক্ষা। কোনমতে গাড়ির ব্রেকটা জোড়ে চেপে পাশ কাটিয়ে রাস্তার এক পাশে দাড় করালাম। তারপর গাড়ির দরজা খুলে নিজেকে অর্ধেক বের করে চলে যাওয়া পথচারীকে গালির বাকী অংশটুকু ঝেড়ে নিজেকে একটু শান্ত করার চেষ্টা মাত্র।
ইদানীং স্বপ্নের সাথে আমার কেমন যেন একটা গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। কিছু কিছু স্বপ্নের রেষ থেকে যায়। আবার কিছু কিছু স্বপ্নের কোন কিছুই মনে করতে পারি না।
বয়স যত বাড়তে থাকে আর মৃত্যুর দরজা যত কাছে আসতে থাকে তখন কিছু কিছু ভাবনা হৃদয়ের ভিতরে প্রতিনিয়ত অদ্ভুত এক সেতু বন্ধন সৃষ্টি করে।
তারই প্রতিফলন হয়তো মাঝে মধ্যে স্বপ্নের মাঝে ফিরে আসে।
বেশ কিছু দিন যাবত এই স্বপ্নটা দেখছি। আমি গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজা অর্ধেক খুলে এক পা বাহিরে রেখে মাথা নিচু করে চলে যাওয়া মানুষটিকে চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করে গালি মারছি।
স্বপ্নের এই পর্যায় এসে আমার ঘুম ভেঙ্গে যাই। বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সমূহ একটা এক্সিডেন্ট হতে বেঁচে গেলাম। বিছানার পাশে রাখা বোতল হতে ঢকঢক করে পানি পান করে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেঁড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
মাঝে মাঝে মনে হয় “খোয়াবনামা” বইটি কিনে এনে দেখি আমার এই স্বপ্নের কোন বর্ণনা আছে কি না? সাধারণত মানুষের প্রতিনিয়ত জীবন ও জীবিকার টানে কিংবা কোন গভীর চিন্তার প্রতিফলন হল স্বপ্ন। কিন্তু আমার চলাফেরা বা চিন্তার মাঝে এই স্বপ্নের কোন ছিটেফোঁটা নেই। তবুও মানুষ তো আমি…………
জীবনের ব্যস্ততার সাথে এক সময় স্বপ্নের ঘোর কেটে যাই এমন কি ভুলেও যাই। সব কিছু তার নিজের গতিতে চলতে থাকে।
নাটক বা সিনেমার মত স্বপ্নের কোন এপিসোড বা পর্ব থাকে না। কিন্তু আমার এই স্বপ্নের যে এপিসোড বা পর্ব আছে। যা দ্বিতীয় পর্ব বা শেষ পর্ব বলা যেতে পারে।
সাধারণত হাইওয়ে রাস্তার আশেপাশে খুবই কম বসতি থাকে। সময়টা বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হবে হবে। চারিদিকে এখনও দিনের আলো স্পষ্ট। আমি গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে পথচারীর রাস্তা পার হওয়া অবধি তাকিয়ে দেখছি। প্রথমে উচ্চস্বরে পরে মনে মনে গালির রেষটা থামিয়ে একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি। দেখলাম যে পথচারী যার সাথে একটু আগে অ্যাকসিডেন্ট হতে যাচ্ছিল সেই লোকটির পরনে ময়লা ছেঁড়া লুঙ্গি, খালি পা, গায়ে ময়লা- তিল পরা তালি দেয়া একটা গেঞ্জি। অ্যাকসিডেন্ট হতে যাওয়া পথচারী লোকটি চোখের আড়াল হতে আবার ড্রাইভিং সিটে বসতে যাবো ঠিক এই সময় পিছন হতে একজন মানুষ ডাক দিল।
-“এই যে ভাই একটু শুনবেন”
আমি আবার পূর্বের মত বাহিরে বের হয়ে যে দিক হতে ডাকটা এসেছে সেই দিকে তাকালাম। কোন লোকজন বা কাউকে দেখতে পেলাম না। অনেক চেষ্টা করছি লোকটাকে দেখতে কিন্তু কেন জানি দেখতে পারছি না। অথচ লোকটার উপস্থিতি আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আমি বললাম কিছু কি বলবেন?
আগন্তুক মানুষটি বলল- না ভাই তেমন কিছু না। আপনি অল্পের জন্য অ্যাকসিডেন্ট হতে বেঁচে গিয়েছেন।আপনার তেমন কোন দোষ নেই। তবে যে লোকটিকে আপনি অনেক গালি দিলেন তাকে কি খেয়াল করেছেন? পৃথিবীর কোন কিছুতে কি তার সামান্যতম খেয়াল বা ভ্রুক্ষেপ আছে? আপনি অনেক দূর হতে হর্ন দিয়েছেন। হেড লাইটের হাই-বিম, লো-বিম দিয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারপরেও মাথা নিচু করে হেঁটে যাওয়া পথচারীর বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ ছিল না। এর কারণটা কি আপনি বুঝতে পারেন?
এই ধরনের পরিস্থিতি কি কারণে হতে পারে তা নিয়ে আমি আসলে চিন্তা করিনি বা চিন্তা করার ব্যাপারটা মাথায় আসেও না। বলা যেতে পারে এই ধরনের চিন্তা মাথার মধ্যে আনার কোন প্রয়োজন বোধ করিনি।
“ বাংলাদেশের কনটেক্সটে এই ধরনের চিত্র খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আর তখন সব দোষ পড়ে গাড়ির চালকের উপর”- কিছুটা ব্যঙ্গ স্বরে আমি কথার উত্তর দিলাম।
আবারও আগন্তুক মানুষটির মুখটা দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি কিন্তু দেখতে পারছি না।
আগন্তুক ব্যক্তিটি বলল- আপনার কথার যুক্তি আছে। তবে শুনুন বলেই,কথা বলা শুরু করল।
যে পথচারীকে আপনি দেখলেন এবং অনেক গালি দিলেন। অনেক দিন যাবত তার মা হাসপাতালে ভর্তি। সংসারে একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি হল ওই পথচারী। অল্প যা কিছু ছিল সঞ্চয় আর কিছু ভিটে মাটি তা সব বিক্রি করে মায়ের চিকিৎসা করিয়েছে। বেশ কিছুদিন যাবত তার নিজের শরীরও ভালো যাচ্ছে না বলে দিন মজুরের কাজটাও ঠিকমত করতে পারছে না। এই কিছুক্ষণ আগে বলে অদেখা আগন্তুক মানুষটি অল্প সময়ের জন্য থামল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেঁড়ে আবার বলতে শুরু করল-
জীর্ণ ও শীর্ণ ওই পথচারীর মা…… কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুবরণ করেছে।
তার কাছে নেই কোন টাকা-পয়সা। এই দিকে রাত হয়ে আসছে। একমাত্র অবলম্বন মাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাফন করাতে হবে। কাফনের কাপড় কিনতে হবে। মুসলিম রীতিতে মিলাদ, রুহুয়ের মাগফেরাতের জন্য দোয়া করতে হবে। দাফন করতে যত দেরি হবে তত বেশি মায়ের আত্মা কষ্ট পাবে তার সাথে তো গুনাহর পরিমাণ বাড়তে থাকবে। এই সব কিছুর সাথে জড়িত টাকা আর পয়সা। কোথা থেকে পাবে? কি করে মায়ের এই শেষ কাজটুকু সম্পন্ন করবে? বড় অসহায় হয়ে সে এখন ভীষণ দুশ্চিন্তার মধ্যে ডুবে আছে। পৃথিবীর তাবৎ কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। মাথা নিচু করে এই সামান্য হিসাব মিলাতে মিলাতে সে ওই ভাবে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল। তার আজ এই না পারার অক্ষমতার কারণে হয়তোবা এই মুহূর্তে তার কাছে বেঁচে থাকা আর না থাকার মধ্যে তেমন কোন ফারাক নেই।
আমি আরও কিছু শুনার জন্য বা কথার ইতি টানার জন্য আগন্তুক মানুষটিকে একবার চোখে দেখার জন্য আবারও খুঁজে বেড়াই। লোকটিকে দেখতে না পাওয়ার জন্য, না কি ওই পথচারীকে না বুঝে গালি দেবার জন্য? ঠিক কি কারণে তা বুঝতে পারছি না তবে কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগছে আর সেই সাথে মনের ভিতর ছটফট করছে।
আমার স্ত্রীর মৃদু ধাক্কা আর তারই সাথে ডাক দেওয়াতে ঘুম ভেঙ্গে ধড়ফড় করে উঠে বিছানায় বসে পরলাম।
হয়তো আমার এই অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী আমাকে জিজ্ঞাসা করল-“ কোন বাজে স্বপ্ন দেখেছি কি না?” না কি আমার শরীর খারাপ করেছে সেটা মনে করে কপালে হাত দিয়ে একবার পরখ করে দেখল।
আমার স্ত্রীর প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে কিছু সময় ঝিম মেরে শুয়ে থাকলাম। স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটেনি। মনে হল এটা স্বপ্ন আর বাস্তবের খুব কাছাকাছি একটা ঘটনা। বুকের মধ্যে হার্টের দ্রুত স্পন্দন নিজেই বুঝতে পারছি। চোখ বন্ধ করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করি আর ভাবতে থাকি।
আগন্তুক মানুষটি কে?

আমার বিবেক?
না কি আমার চলার পথে বুঝে না বুঝে কত মানুষকে অযথা দোষারোপ করি এমন কেউ বা কিছু?
না কি আমার ফেলে আসা দিনের এমন কোন কিছু যা আমাকে প্রতিনিয়ত ভুলের কাঠগড়ায় দাড় করাচ্ছে কিন্তু আমি বুঝেও বুঝতে পারছি না? না কি, বুঝেও না বোঝার ভান করছি।
না কি আমার ফেলে আসা এমন কোন নির্মম স্মৃতি যা আমি বারবার ভুলে থাকতে বা চিরতরে মুছে ফেলতে চাই। আর কোন এক কারণে ওই স্মৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট কেউ আমাকে বলছে “তুই বড় বেশী স্বার্থপর।“
এই সব চিন্তা করলে বুকের মাঝে আবার চিনচিন ব্যথাটা বেড়ে যাই। গলার কাছে কষ্টগুলো দলা হয়ে আটকে থাকে। আসলে এইসব প্রশ্নগুলোর কোন সদুত্তর আদৌ কি আমার জানা আছে?
আমি জানি না,
আমি জানতে চাইও না………
এই রহস্যময় পৃথিবীতে আমরা আসলেই কি সব জানতে চাই বা জানতে পারি……..??.।

১,২৮৬ বার দেখা হয়েছে

৪ টি মন্তব্য : “একজন পথচারী ও আমিত্ব”

  1. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    :boss: :boss:
    লেখা/ভাবনা ভাল লাগলো।
    কিছু বানান এদিক সেদিক আছে, শুধরে দিলে আরো ঝকঝকে হয়ে যাবে লেখাটা। 🙂
    যেমন : 'শুঁয়ো'তে চন্দ্রবিন্দু হবেনা।অবশ্য শুঁয়োপোকা বোঝাতে চাইলে অন্যকথা। 😀

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : জহির রায়হান

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।