একটি নিয়ন সাইন ও কিছু কথা

একটি নিয়ন সাইন ও কিছু কথা

নিয়ন সাইন

দোস্ত “ উত্তরা এয়ারপোর্ট গোল চক্করের সাথে পুলিশ বক্সের পাশে গাড়ীটা পার্ক করিস। আমি ঐখানে চলে আসবো।“
গাড়ীটা পার্ক করতেই জেনারেটর এর বিকট শব্দের উৎস খোঁজার জন্য এদিক ওদিক তাকালাম। ফুটপাথের মধ্যে দেখতে পেলাম জেনারেটরটি। একটু হলেও আমাকে নাড়া দিল। জেনারেটরটি বিশাল এক নিয়ন সাইনের পাশে এবং খোলা আকাশের নীচে রাখা।
পাঠকদের জায়গাটার সম্পর্কে একটু ধারনা দিয়ে রাখি-
এয়ারপোর্ট হতে বের হয়ে সোজা গোলচক্কর- বামে উত্তরার রাস্তা- সোজা হাজি ক্যাম্প- ডানে খিলক্ষেত,বিশ্ব রোড,ক্যান্টনমেন্ট হাইওয়ে।
গোলচক্কর ডানে খিল-ক্ষেত,বিশ্ব রোড,ক্যান্টনমেন্ট হাইওয়ে রাস্তায় ঘুরতেই বাম কর্নারে পুলিশ বক্স। পুলিশ বক্স হতে ১৫-২০ গজের মধ্যে এই নিয়ন সাইন পোস্টটি।

ছবি

এই জায়গাতে জেনারেটরটি কেন চলছে বা কি কারণে তা মিলাতে পারছি না?
এয়ারপোর্ট – খিলক্ষেত হাইওয়ে রোড এবং এয়ারপোর্টের গোলচক্কর ব্যস্ততম ও ভিআইপি এলাকা। যে জায়গাতে সবসময়ে তীব্র আলো থাকে। ফুটপাথে বা আশে পাশে কোন দোকানের জন্যেই এই ব্যবস্থার প্রশ্নই উঠে না। তাই আলোর স্বল্পতার বা লোড সেডিংয়ের জন্য ছোট্ট জেনারেটর এই স্থানে রাখার কোন কারণ দেখছি না।
গাড়ীর মধ্যে বসে আমি যখন এই সব মিলাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই গাড়ীর কাঁচের উপর আমার বন্ধুর মৃদু টোকার আওয়াজ “এই দরজা খোল।“
দরজা খুলে গাড়ি স্টার্ট করলাম। যেহেতু আমার বন্ধু এই এলাকাতে থাকে তাই আমার কিছু সময়ের আগের চিন্তাটা ওকে বললাম। একটা হাসি দিয়ে তাচ্ছিল্যর সাথে এমন ভাবে বলল যে, এই দেশের সবাই জানে শুধু আমি জানি না। ওর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি জেনেও না জানার ভান করছি। আমি বললাম আসলেই দোস্ত আমি জানি না। আমার কথা বা গলার টোন শুনে ওর মনে হল আসলেই আমি জানি না।
আমার বন্ধু তখন বলা শুরু করল- তুই কি জেনারেটরের সাথে কোন নিয়ন সাইন পোস্ট দেখছিস?
আমি সংক্ষেপে বললাম- হ্যাঁ।
ও বলল- কিসের নিয়ন সাইন?
বললাম যে “ ক্লোজ-আপ এর অ্যাড”। বিশাল বড় একটা পোস্ট যেখানে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাদেরকে ঘিরে আছে একটা আলোর বৃত্ত। আর আছে ব্রান্ডের নাম-ক্লোজ-আপ টুথপেস্ট……। একটা আলোকময় সুন্দর ঝলমলে নিয়ন সাইন পোস্ট।
আমার বন্ধু বলল হ্যাঁ, তুই ঠিক বলেছিস। এই জেনারেটরটি সন্ধ্যা হতে সকাল বেলা অবধি প্রতিদিন চলে। এই নিয়ন সাইনটার যে উজ্জ্বল আলোর কারিশমা তা আসে এই জেনারেটর হতে। একটু অবাক হয়েছিস তা বুঝতে পারলাম। তাইতো এই নিয়ন সাইন শুরুর পর হতে এটা সবারই ডিসকাশনের পয়েন্ট ছিল। তুই যে জানিস না এই ভেবে একটু অবাক হয়েছিলাম।
আমি বললাম, ঢাকা শহরে বলা যাই সব নিয়ন সাইনই সরকারী বৈদ্যুতিক লাইনের সাথে যুক্ত। যথেষ্ট সন্দেহ আছে এর সঠিক নিয়ম বা নীতির মেনে চলার। আর সেখানে জেনারেটরের তেল খরচ করে অ্যাড। একটু হলেও তো অবাক হওয়ার ব্যাপার specially in context of Bangladesh। আরও কিছু বলতে যাওয়ার আগে আমাকে থামিয়ে দিল।
তোকে-তো এখনও বলে শেষ করিনি। এই ছোট জেনারেটর পাহারা দেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা প্রহরী থাকে। ঝড়, বৃষ্টি যাই হোক না কেন জেনারেটরটা এখানে থাকে। এটা দেখভাল করার জন্য এই ২৪ ঘণ্টার প্রহরী।
জেনারেটরের প্রতিদিনের খরচ, ২৪ ঘণ্টার প্রহরী, লিজের জন্য অগ্রিম টাকা আর তার সাথে তো আছেই বিশাল অংকের প্রতি মাসের ভাড়া। আমি অংকে একটু কাঁচা এ ছাড়াও সব ইনফরমেশন যেমন ভাড়া, অগ্রিম, জেনারেটরের প্রতি ঘণ্টার তেলের খরচ, প্রহরী বেতন ইত্যাদি, ইত্যাদি আমার জানা নেই। শুধু ডিজেলের দাম জানি ৭০ টাকা। তাই পাঠক যারা ইচ্ছুক তারা হিসাবটা একটু কষ্ট হলেও করে নিতে পারবেন।
যাই হোক ফিরে আসি গাড়ীর ভিতরে আমার বন্ধুর সাথে।
বন্ধুটি বলল, তুই যেন কি বলতে চেয়েছিলি বলে আমার দিকে তাকিয়ে তার কথার ইতি টানে এবং ছোট একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
এলোমেলো ভাবনা আর তার এই ছোট দীর্ঘশ্বাস কিছুটা হলেও আমাকে বিচলিত করে। কি বলব…
আমি বুঝতে পারি তার এই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার অন্তর্নিহিত কারণ। আমার এই বন্ধুটি বাংলাদেশের আর দশটি পরিবারের সেই চেনা-পরিচিত কাহিনীর মত। ভালো ছাত্র,বাবা প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক,সংসারের বড় ছেলে। তার ছোট আরও দুই বোন আর এক ভাই। বাবার স্বল্প আয় তাই নিজের পড়াশুনার খরচ টিউশনি করে তা মিটানো। ভার্সিটিতে ভালো একটা বিষয় নিয়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ। হঠাৎ বাবার অকাল মৃত্যু। অর্থের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ সেই সাথে সংসারের এই বোঝা। শেষ পর্যন্ত চাকুরীর জন্য দরজায় দরজায় ঘুরে ফেরা। উচ্চতর শিক্ষা নিতেতো পারলই না সেই সাথে সাথে নিজের মধ্যে লুকানো বাসনার যবনী-পাত।
চিন্তার লাগাম টেনে ধরার আগেই চোখের সামনে ভেসে উঠে কত কিছু-
এখনও পর্যন্ত যে দেশের অনেক এলাকাতে পৌছায়নি বৈদ্যুতিক লাইন বা আলোর ব্যবস্থা। হ্যারিকেনের আলোতে বেঁড়ে উঠে কত প্রতিভা কিন্তু অর্থের অভাবে ঝরে পড়ে এই সকল প্রতিভা।
যে দেশের মানুষের বেসিক মানে মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থানের নেই কোন নিশ্চয়তা। সেই দেশের এই ধরনের বিলাসিতার করার কতটুকুই বা যৌক্তিকতা আছে?
আবার যদি অন্যভাবে বলি তা হলে- এই অ্যাড এর সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে জানাই সাধুবাদ। কেননা বিদ্যুৎ সেক্টরের এই ধরনের নিয়ন সাইনের জন্য কি পরিমাণ খরচের সাথে চুরি বা দুর্নীতি লেগে আছেই প্রতিনিয়ত। তারা অন্তত এটা হতে বিরত। আর ২৪ ঘণ্টা প্রহরী নিয়োগে ফলে কিছু মানুষের অন্ন সংস্থান-তো হয়েছে সেটা যত কমই হোক না কেন। আর এলাকার সৌন্দর্য বর্ধন সে তো এমনি হয়ে উঠে।
যতবারই আমি এই রাস্তা দিয়ে গিয়েছি ততবারই দূর হতে উজ্জ্বল আলোকময় নিয়ন সাইনটি দেখেছি এবং আমার বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু আজ আমার বন্ধুর ছোট দীর্ঘশ্বাস তার সাথে সংশ্লিষ্ট ভাবনা উজ্জ্বল আলোকময় নিয়ন সাইনটির পিছনের কালো অন্ধকার যেন তা ছাপিয়ে আমাকে গ্রাস করলো।
আমি চুপ হয়ে গাড়ীর গানের ভলিউমটা বাড়িয়ে দেয়-জেমসের ” বিবাগী” গানটা ভেসে উঠে। আসলে আমরা বড়ই বিবাগী……

১,২৯৬ বার দেখা হয়েছে

৭ টি মন্তব্য : “একটি নিয়ন সাইন ও কিছু কথা”

  1. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    চমৎকার মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ দেখালেন। ভাল লাগলো। একভাবে চিন্তা করলে মন খারাপ হবে আরেক ভাবে চিন্তা করলে মনে হবে অন্তত মন্দের ভাল হলেও হচ্ছে। :hatsoff:


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  2. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    অনেকদিন পর মোকাররম ভাই।
    এবং যথারীতি একেবারে টু দ্যা পয়েন্ট।
    একেই সম্ভবত বলে বুলস আই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।