ঢাকার শুনানি, ঢাকায় শুনানি (ছ)

মানুষজন ইদানিং বুঝে রসিকতা করে নাকি দৈব্যক্রমে ঘটে যায় সেটা চিন্তা করি। সেনানিবাস থেকে বাসে করে অফিস যাচ্ছি। ট্রাস্ট ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের এই রুটে ছাড়া নতুন বাস। জ্যামে আটকা পড়ে বিরক্ত কন্ডাক্টর ছেড়ে দিল ধুমধাড়াক্কা হিন্দী গান। মিনিট দুয়েক সহ্য করার পর পিছেন থেকে গোটা কয়েক যাত্রী বজ্রনিনাদে বকাঝকা শুরু করলেন, “ঐ শালা বান্দীর বাচ্চা হেল্পার, এইটা ইন্ডিয়া পাইছস? গান ছাড়লে বাংলা গান ছাড়!” ঘটনার আকস্মিকতায় কন্ডাক্টর তড়িঘড়ি করে গান বন্ধ করে বক্স থেকে আরেকটি সিডি বের করে ছেড়ে দিতেই হেসে দিলাম। “জানলা খোলা দেখে থমকে দাঁড়ালো, দুষ্ট হাওয়ায় উড়া এলোমেলো চুল…” কন্ডাক্টর সাহেব ভাষা পরিবর্তন করেছেন কিন্তু বর্ডারের এপারে ‘পুশব্যাক’ করতে পারেন নাই নাকি করতে চান নাই এটা বোঝা গেলনা। পিছের দেশ-কিংবা-ভাষা প্রেমিক ভদ্রলোকও এই সুক্ষ্ম কারচুপি ধরতে পারলেন কিনা সেটাও বোঝা গেলনা। ধরে নিলাম গণ পরিবহন বলে আর কথা বাড়ান নাই। ভাষা পরিবর্তনই সই। আমারও পছন্দের গান তাই চিন্তার গুণগুণকে পজ বাটন চেপে শুনতে লাগলাম, “…আমার কানে কিছু বলতে এলো সে হাতছানি তার অজানায় বহুদূর।”

কাঁচির কচকচানি, জটা বাঁধা চুলে চিরুনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। স্টার জলসায় দুষ্ট জাদুকর কিরণমালাকে চির জীবনের জন্য কাছে পেতে ফন্দী আটছে। আর তাতে ঘি ঢালছে সাসপেন্সের আবহ সঙ্গীত। ফ্যানের বাতাসও যেন কিরণমালাকে বিপদে ফেলতে শো শো শব্দে ঘুরে যাচ্ছে। এদিকে সস্তা তামাকে গড়া সিগারেট তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে আটকে পড়ে ধুঁকে মরছে। নাম তার সেভেন স্টার সেলুন। আমার ব্র্যান্ড লয়ালটি এ বছর ১৯তম বছরে পা দিল।

ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বামে রেখে সিলেট-মৌলভীবাজার মহাসড়কে যেন বাতাসের আগে ছুটছে আবুর প্রাইভেট কার। সকাল থেকে এখন পর্যন্ত তার গাড়ি চালনায় আমি রীতিমত বিরক্ত ও কিছুটা ভীত। মোশন সিকনেস কোন কালেই ছিল না অথচ আবুর এই উদ্ভট গাড়ি চালনায় ইতমধ্যেই মাথা ঝিমঝিম করছে। চা-বাগানের ভিতরের আঁকাবাঁকা রাস্তা নিয়ে তাকে এর মাঝেই দুইবার সতর্ক করেছেন সহযাত্রী/সহকর্মী আনোয়ার ভাই। কিন্তু কে শোনে কার কথা? খালি রাস্তা দেখলেই আবুর যেন নেশা পেয়ে বসে। হঠাৎ বেশ খানিকটা সোজা রাস্তা পেয়ে যথারীতি আবারো গাড়ির গতি শতকের ঘর ছাড়িয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে। প্রায় সোয়া কিঃমিঃ দূরে পুলিশ দেখতে পেলাম। হঠাৎ তাদের মাঝের একজনের হাত পিস্তল তাক করার মত আমাদের গাড়ির দিকে তাক করলো। যা ভাবছি হাতে কি আসলেই তাই? কিভাবে সম্ভব? প্রশ্নের উত্তর দিতেই যেন দেখলাম লাফ দিয়ে আরো দুইজন পুলিশ মাঝ রাস্তায় এসে আমাদের গাড়ি থামাতে সংকেত দিল। নেশায় পানি ঢেলে দেয়ায় কষে দুটো গালি দিয়ে আবু রাস্তার পাশে তার উড়োজাহাজ থামালো। ততক্ষণে সার্জেন্ট সাহেবের হাতের যন্ত্রটি দেখে নিশ্চিত হলাম। আসলে যা ভাবছিলাম তাই–গাড়ির গতি মাপার স্পীড গান। গাড়ির সামনে অর্থ মন্ত্রনালয় লেখা দেখেই কিনা (সাধারণত কিছুটা হলেও ম্যাজিকের কাজ করে) সার্জেন্ট সাহেব খুব ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “গাড়ি কত স্পীডে চালাচ্ছিলেন বলতে পারেন?”
আবুর আত্মবিশ্বাসী মিথ্যা জবাব, “আশি?”
সার্জেন্ট সাহেব এবার স্পীড গানের পেছনের পর্দায় সর্বশেষ রিডিং আবুর দিকে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে কত লেখা?”
স্পষ্ট বিস্ময়ে আবুর উত্তর, “একশো এগারো!”
এবার সার্জেন্ট সাহেবের তৃতীয় প্রশ্ন, “হাইওয়েতে সর্বোচ্চ কত গতিতে গাড়ি চালাতে পারবেন?”
আবুর নির্লিপ্ত জবাব, “একশো!….নব্বই-একশো!”
“হাইওয়েতে আপনার গাড়ির সর্বোচ্চ গতি হতে পারবে ৭৫ থেকে ৮০” সার্জেন্টের কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি।
“আপনার না হয় মরার খুব সখ কিন্তু পিছের সীটের যেই দুইজন আরোহী তাদেরও কি আপনার মত মরার সখ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করে দেখেছেন?”
আমি এবার ফিক করে হেসে দিলাম। কিন্তু বিমর্ষ আবু দুই দিকে মাথা নেড়ে ‘না’ উত্তর দিল।
“আপনার দায়িত্ব আপনার নিজের জীবনের পাশাপাশি আপনার যাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গাড়ি ঠিক মতন ঠিক গতিতে চালিয়ে যাবেন। যান।”
সার্জেন্ট সাহেবকে ধন্যবাদ দেয়ার আগেই উইথড্রল সিনড্রমে ভোগা আবু আবারো গাড়ি নিয়ে টান দিল। তবে ভয়ে আশি কিঃমিঃর বেশী তুললো না। বলতে চাই, ‘ধন্যবাদ মৌলভীবাজার হাইওয়ে পুলিশ।’

মৌলভীবাজার গিয়েছিলেম অফিসের কাজে। অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়তে ব্যক্তিগত জমি অধিঃগ্রহণ করছে বাঙলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (ইংরেজীতে Bangladesh Economic Zones Authority [BEZA] সেই থেকে সংক্ষেপে নাম বেজা)। সে জন্য ঋণ দিচ্ছে আমাদের কোম্পানি। ফেরত আসার পথে এ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার (রেভিন্যিউ) জনাব প্রকাশ কান্তি চৌধুরী যোগ দিলেন আমাদের সাথে। একই সময়ে ঢাকা যাবেন তাই প্রস্তাব দিতে কিছুটা সঙ্কোচের পর রাজি হয়ে গেলেন। প্রচন্ড পড়ুয়া ও মেধাবী একজন মানুষ এটা বুঝতে ঘন্টাখানেক ব্যয় করা লাগলো। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়নে। এরপরে ২০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে। স্ত্রীও ২২তম ক্যাডারে মৌলভীবাজার ডিগ্রী কলেজের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক। বর্তমানে উনারা দুইজনই পিএইচডি করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। প্রকাশ সাহেবের বিষয়টি বেশ মজাদার, এথনিক/এথনো টুরিজম। এই ধারণাটি উনি পেয়েছেন ফিলিপাইন ও ভারতের চেন্নাই থেকে। সিলেটের খাসিয়া সম্প্রদায়ের একটি পুঞ্জীকে (গ্রাম) উনার থিসিসের আওতায় সাজিয়ে গুছিয়ে পর্যটন উপযোগী করে তুলছেন তিনি। তৈরী হয়ে গেলে আগ্রহীরা চাইলে সেই এথনো ট্যুরিজমের গ্রামে গিয়ে ঠিক খাসিয়া সম্প্রদায় যেভাবে বসবাস করে ঠিক সেভাবেই দিন যাপন করতে পারবেন। উনার পিএইচডির বিষয়াবলীর কথা জানতে পেরে সরকার তাকে মোটামুটি চলনসই একটি স্কলারশিপও দিয়েছে। প্রজেক্ট নিয়ে কথা বলতে বলতে উনার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠছিল ব্যাপারটি দেখে খুব ভাল লাগছিল। সন্ধ্যা ৭-৮টা পর্যন্ত অফিসের কাজ করে গিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা কিভাবে থাকে জিজ্ঞাসা করতেই উত্তর দিলেন, ‘সিগারেটও অভ্যাস, পড়াও অভ্যাস। যার যেটা ভাল লাগে। আমার পড়তে ভাল লাগে…মোটামুটি যেকোন কিছুই আমার পড়তে ভাল লাগে।” উত্তর শুনে আমি চিন্তায় ডুবে গেলাম, “বাঙলাদেশের আমলাতন্ত্রে এদের মত মানুষের সংখ্যা কত?” মৌলভীবাজার থেকে যাত্রাবাড়ি এসে পৌঁছলাম ঠিক তিন ঘন্টায়। নাহ বিমানের পাইলট আবুর কৃতিত্ব এখানে খুবই কম। রাস্তা ফাঁকা ছিল। কিন্তু যাত্রাবাড়ি থেকে বাসায় ফিরতে লাগলো ঠিক সাড়ে তিন ঘন্টা। মাঝেমাঝে মনে হয় কোন চাকুরীতে কেউ আমাকে ধমক দিয়ে বলতো, “আপনার এত বড় সাহস? কালকে থেকে আপনার পোস্টিং তেঁতুলিয়া।” আমি উত্তর দিতাম, “প্রাণে বাঁচায় দিলেন স্যার।”

এই জাদুর শহর বড় অসহনীয় শহর হয়ে গিয়েছে। জনারণ্যে, দাবদাহে, ধুলো-ময়লায়, যানযটে। প্রতিদিনের শ্রম-ঘন্টাগুলো বিনে পয়সায় বিন্দুবিন্দু ঘাম হয়ে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। সাইরেন বাজানো ভিআইপির গাড়ির চাকার নিচে তেঁতে উঠছে পিচ গলা রাজপথ। তার চাইতেও দ্বিগুণ তেঁতে উঠছে রাজপথে অপেক্ষমান মানুষেরা।

৩,৩৫৩ বার দেখা হয়েছে

২৪ টি মন্তব্য : “ঢাকার শুনানি, ঢাকায় শুনানি (ছ)”

  1. ইশহাদ (১৯৯৯-২০০৫)

    ১।
    পুলিশ কি সচরাচর এত রসিক হয় নাকি সংলাপ বসিয়ে দিয়েছেন? (মাস্ফ্যু ভাই দেইখেন না, পিলিজ)

    ২।
    প্রকাশ কান্তি চৌধুরীকে :hatsoff: । এমন মানুষ আরও বাড়ুক নানান স্তরে এটুকুই আশা। একদিন হয়ত হবে।



     

    এমন মানব জনম, আর কি হবে? মন যা কর, ত্বরায় কর এ ভবে...

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      পেশার সাথে যদি রসিকতা ভুলে যায় তবে কি চলবে? আমরাও ধরে বসে থাকি পুলিশ মানেই কষা, খিটখিটে ঘুষখোর। সেটা ভাবলেই কি চলবে? যখন আসলেই সে ঐ জীবন মৃত্যু নিয়ে কথাটা বললো তখন শুনে আমারো বিশ্বাস হয় নাই। কিন্তু ভালও লেগেছে। এই একই কথাটা চাইলে সে খুব বাজে ভাবে বলতে পারতো বলে নাই। তখনো সেটা নিয়ে লিখতাম। হয়তো আরো প্রতিবাদী, বজ্রকন্ঠে। 🙂


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. কৌশিক(২০০৪-২০১০)
    এই জাদুর শহর বড় অসহনীয় শহর হয়ে গিয়েছে। .... সাইরেন বাজানো ভিআইপির গাড়ির চাকার নিচে তেঁতে উঠছে পিচ গলা রাজপথ। তার চাইতেও দ্বিগুণ তেঁতে উঠছে রাজপথে অপেক্ষমান মানুষেরা।

    :clap: :clap: :clap: (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  3. সাবিনা চৌধুরী (৮৩-৮৮)

    এদেশে আসার পনের দিন পর আমি ড্রাইভারস লাইসেন্স পেয়েছিলাম। চালক হিসেবে আমি প্রথম সারির হলেও গড়ে চার বছরে একটি করে স্পিডিং টিকিট খাই লোকাল রাস্তায়। স্থানীয় রাস্তায় পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মাইল পার আওয়ারে গাড়ি চালাতে মাঝেমধ্যে বিরক্ত হই। চকিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে ছুটে পার পেয়ে গেলেও একবার ধরা তো পড়তেই হয়। চোর ধরা পড়লে পুলিশ একটা বাড়তি কথাও বলেনা; হয় জরিমানা পাঠিয়ে দাও সরকারী তহবিলে নয়তো কোর্টে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ কর।

    অটঃ তবুত্ত স্বপ্নের বীজকণায় সতত প্রাণের ছবি আঁকি একাকী!

    বহুদিন পর ব্লগে এলে মোকা। ভাল আছো আশাকরি।

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      আসছি ঠিকই কিন্তু পড়া হচ্ছে না। লিখা তো হচ্ছেই না। সেদিন কিছুটা অবসর পেয়ে বেশ খানিকটা লিখে এটা দাড়া করালাম। যেই পরিমান শ্রমঘন্টা নষ্ট করি তার পরে আর সময়, শক্তি, ইচ্ছা কিছুই বাকি থাকে না। ভাল আছি কিনা ঠিক নিশ্চিত নই। সম্ভবত ভাল নেই।


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  4. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    তোমার এই সিরিজটা পেলে দিনটাই আলোকিত হয়ে উঠে।
    মোকা, স্বার্থপরের মত বলি, এখানে আমাদের ৫০ মাইলের মধ্যে অন্তত চলে আসো।
    একটু আনন্দ-ফূর্তি করি জীবনে।

    জবাব দিন
  5. খায়রুল আহসান (৬৭-৭৩)

    এ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার (রেভিন্যিউ) জনাব প্রকাশ কান্তি চৌধুরীর কথা জেনে খুব ভালো লাগলো। তার গবেষণার বিষয়টিও চমকপ্রদ।
    লেখা বরাবরের মতই আকর্ষণীয়, উপভোগ্য।
    সিসিবি পিকনিকের পাকা খবর কবে নাগাদ পাওয়া যাবে?

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।