পথের ক্লান্তি ভুলে – ১ম পর্ব

২১ ডিসেম্বর ২০১৪ – আজ তবে বিদায় জানাও।

সকালে উঠেই বাথরুমে গিয়ে আয়নায় তাকিয়ে বিষন্ন এক টুকরো হাসি দিলাম। সকাল আটটা বাজে। এই এলাকায় আছি আর মাত্র তিনটি ঘন্টা। হাতমুখ ধুয়ে সকালের নাস্তা সেড়ে গোছানোর বাকি কাজটুকু শুরু করলাম। সময় কোনদিক দিয়ে পার হয়ে গেল টের পেলাম না। ঠিক বেলা ১১টার সময় ক্ষুদেবার্তা এলো, “I’m coming to pick you up. My friend needs more time.” তারপর হঠাৎ করেই বাসার নিচে চলে এল ছেলেটি। নিজেই আমার ভারী স্যুটকেস তুলে গাড়িতে নিয়ে তুললো। গত কয়দিন ধরে শুনছি চৌরাসিয়া। বিদায়ের মূহুর্তটাকে আরো নির্মমভাবে উপস্থাপন করতেই যেন শুরু হলো হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ফিচারিং কেন ল’বার-এর “মুভমেন্ট-২।” এই কাজটুকুর নাম মুভমেন্ট-২ নাম না দিয়ে যদি “আজ তবে বিদায় জানাও” কিংবা “রিক্ততায় নির্বাসন” এরকম কিছু হতো তাহলে ভাল হতো। তারপর হঠাৎ করেই শব্দ করে ল্যাপটপটি বন্ধ করে ফেললাম। আর সহ্য হচ্ছিল না। শেষ ব্যাগটি এক টানে কাঁধে তুলে নিয়ে চারপাশে আরো একবার তাকালাম। নাহ খারাপ লাগছে না। ঠিক যেমনটি হয়েছিল ২০০৪ সালের ২১ জুন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ প্রাঙ্গনে। আমার কষ্টগুলো প্রথমে পেটে সপ্তাহখানেকের মত ঘুরপাক খায়। এরপর হঠাৎ করে কোন একাকী মূহুর্তে একফোঁটা চোখের জলের মত ঝড়ে পড়তে শুরু করে। সেটা কবে শুরু হয় দেখার বিষয়। আপাতত সময় নষ্ট না করে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম। যাত্রা শুরু হোক।

ছেলেটির নাম কুশ শাহ। প্রথম প্রজন্ম মার্কিন-ভারতীয়। সম্ভবত গুজরাটের ছেলে। শিকাগোতেই জন্ম ও বেড়ে উঠা। সেই হিসেবে ধরে নিচ্ছি পিতামাতা এই দেশে আছেন নূন্যতম ২২ বছর ধরে। আমরা ফেরত গেলাম আমাদের দ্বিতীয় সহযাত্রীকে তুলে আনতে। সবকিছু সেড়ে যাত্রা শুরু করতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। ইউ,এস হাইওয়ে ৪১ দিয়ে না গিয়ে আমরা উইসকন্সিন দিয়ে নিচে নেমে শিকাগো যাব। সম্ভবত সময় বাঁচানোর জন্য। যেভাবেই হোক গত আড়াই বছরে এই এলাকার বাইরে সড়কপথে বেশী ভ্রমণ করা হয়নি। শিকাগোতে আমার ভ্রমণের ইতিহাস শুধুমাত্র আকাশ পথে। থামার সুযোগ হয়নি। এবারেই যাচ্ছি বেশখানিকটা সময় নিয়ে তাও গাড়িতে চড়ে। গাড়ি ছেড়ে দেয়ার এক ঘন্টার মাথায় মোটামুটি আন্দাজ করতে পারলাম উত্তরেরও উত্তরে বাস করতাম। গাড়ি চালাচ্ছে কুশ এবং বেশখানিকটা বিরক্তিকর সহযাত্রী পার্শোয়া। বিরক্তিকর বললাম কারণ বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়া ছেলের মুখ থেকে হাইস্কুলের ছেলেদের মত কুল সাজার জন্য পাল্লা দিয়ে বানিয়ে বলা গপ্পো শোনাটা বিরক্তিকর বটে। আমার এক বন্ধু ছিল এরকম। তবে নাভিশ্বাস উঠে আসার আগেই পৌঁছে গেলাম শিকাগোতে কুশদের বাসায়। উত্তর-শিকাগোর বেশ সাজানো গোছানো এলাকায় কুশদের বাসা। বাসায় ঢুকতে বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে উঠলো। ফুটবল মাঠের মত বড় দোতালা বাড়ি। বেইজমেন্ট ধরলে তিনতলা। বড় ফায়ারপ্লেস, উচু নকশা করা ছাদ, বাঁকানো সিড়ি। নির্লজ্জের মত ডানে বায়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। বেইজমেন্টে গিয়ে আরো একবার খাবি খেলাম। এখানে আরেকটি জগত। প্রমাণ সাইজের টেলিভিশন, আরামদায়ক চেয়ার, মিনিবার, ওয়ার্কস্টেশান, কি নেই এখানে। কুশের বাবার সাথে পরিচতি পর্ব সেড়ে চেয়ারগুলোর একটিতে গিয়ে বসলাম। গতকাল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হেরে যাওয়া টেস্টের হাইলাইটস দেখছেন আর টুকটাক প্রশ্ন করছেন আমাকে। আমি বসে আছি সঞ্জয়দার অপেক্ষায়। মিশিগান টেকের সাবেক ছাত্র। এখন আছেন ফোর্ড মোটোরসের সাথে। উনি এসে আমাকে নিয়ে যাবেন।

একটু পরেই সঞ্জয়দা ও বৌদি গাড়ি নিয়ে হাজির। দ্রুত বিদায় পর্ব শেষ করে রওনা দিলাম শিকাগো শহরের রাজপথ ধরে। উত্তর শিকাগো ও ক্রিসমাসের আগের দিকের রাত দেখে নাকি সুন্দর লাগছে। দক্ষিণ শিকাগোতে নাকি এত সুন্দর নয়। আমাকে নিয়ে দাদা-বৌদি ছুটলেন মাসের বাজার করতে। রথ দেখা ও কলা ‘কেনা’ হচ্ছে। “ফার্মার্স ফ্রেশ” নামক এই কাঁচা-পাকা বাজারের ঢুকে নিজেকেই নিজে বললাম, “সাদা অধ্যুষিত উত্তরের ছিমছাম গ্রাম হতে বারো রঙের মানুষের কসমোপলিটান মেগাসিটিতে আপনাকে স্বাগতম।” ঝিঙ্গার স্তুপের দিকে হা করে তাকিয়ে আছি বৌদি এসে বললেন, “কি ভাই ঝিঙ্গা দেখে অবাক হচ্ছেন নাকি?” “যেই গ্রামে ছিলাম ভাবী, অবাক না হয়ে উপায় আছে?” সঞ্জয়দার গুরুত্বপূর্ণ ফোন এসেছে। কাঁচাবাজারের বাছাইয়ের কাজটি উনিই করে থাকেন। তাই অগত্যা আমাকেই বললেন উনার সাথে বাছাবাছিতে হাত দিতে। ধনেপাতার মুঠো যেটাই বেছে দেই উনি বলেন, “না ভাই এটা এতো ফ্রেশ না। আরেকটা দেখেন।” ঠিক মিলে না তারপরেও ছোটবেলায় পড়া প্রবাদটি মনে করলাম, “ভিক্ষার চাল, কাড়া আর আকাড়া।” আমি তো সবই দেখি ফ্রেশ। আরো ঘন্টাখানেক কাঁচা বাজারের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়ানো বৌদির পিছে বাধ্যগত সহচরের মত আমি আর সঞ্জয়দা ঘুরলাম। “বুঝলা মোকাব্বির, আগে যে কি ভাল আছিলাম। এই বিয়াশাদী কইরা যে কি ফাপরে আছি। দেখসো তো কি হয়?” অগণিত আইলের মাঝে হারিয়ে যাওয়া স্ত্রীকে না পেয়ে সঞ্জয়দার অভিযোগ। আমি হাসবো কি হাসবো না এই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই হাওয়া থেকে বৌদি এসে বললেন, “চলো চলো। এখানে দাড়িয়ে কি করছো? দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

বিঃদ্রঃ এই পর্বটি ইতমধ্যেই আমার ব্যক্তিগত ব্লগে প্রকাশ করা শুরু করেছি।

৯৮৭ বার দেখা হয়েছে

২ টি মন্তব্য : “পথের ক্লান্তি ভুলে – ১ম পর্ব”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    বিরক্তিকর প্রাণি ভালো লাগে।
    আরো ভালো লাগে বদ, স্টুপিড, নীচ মানুষ দেখলে। নিজেরে দেবতা মনে হয়। 😀

    আমাদের লন্ডনে আমরাও ফ্রেশ জিনিস খাই।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।