বাস্কেটবল বিশ্বকাপ?! এইটা আবার কি?! খায় না গায়ে মাখে!? আচ্ছা না ভাই ফাইজলামি না এইবার সিরিয়াস।

FIBA_Basketball_World_Cup_Logo
সাতটি গুলির ঘা এখনো শুকোয়নি। এখনো সেদিনের কথা মনে করলে বুক ফেটে কান্না আসে। গলায় এসে আটকে যায় কান্না। রাতে ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায়। ওরা ছিনিয়েই নিল। কত উল্লাস, কত সেলফি। আচ্ছা রসিকতা করা বাদ দেই। বিশ্বকাপের কথা বলি ভাই। বলছিলাম ব্রাজিলের সাত গোলের কথা। ডয়েচল্যান্ডের কষা ফুটবল সৈনিকেরা এরপর ঠান্ডা পানি ঢাললো আর্জেন্টিনার গরম স্বপ্নে। কথাগুলো বলছি ভিন্ন একটি কারণে। প্রতি চার বছর অন্তর সারা বিশ্ব এক মাসের জন্য মাতে ফুটবল উন্মাদনায় এর ঠিক এক মাসের মাথায় আরেকটি খেলা বিশ্বকাপের আয়োজন করে যেটাকে দুটি পয়সা পাত্তা দেয়ার প্রয়োজন সাধারণ জনগণ মনে করে না। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম খেলাধুলা ডট কমে সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটি চোথা লিখেছি। ভাবলাম চোথার সাথে আরো এক চামচ গুগল সার্চ ও এক কাপ রস মিশিয়ে একটি চোথা+ সিসিবিতে নামিয়ে ফেলি।

আগামীকাল শনিবার (৩০ আগস্ট) স্পেনে শুরু হতে যাচ্ছে ফিবা বিশ্বকাপ বাস্কেটবল। “বাস্কেটবলেরও বিশ্বকাপ হয় নাকি?”–এই প্রশ্ন মাথায় আসা শুরু করার আগেই বলে দেই, হ্যাঁ, ফুটবল, ক্রিকেট কিংবা অলিম্পিকের মতই প্রতি চার বছর পরপর বাস্কেটবল বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। আপনি যদি বাস্কেটবলের অন্ধভক্ত না হয়ে থাকেন তাই এই ব্যাপারে উচ্ছ্বাস প্রকাশ দূরে থাক, এই বিশ্বকাপের ব্যাপারে না জানাটাও দোষের কিছু নয়। কারণ দোষটা আপনার নয়। দোষটা বরং আয়োজকদের, বাস্কেটবল কর্তৃপক্ষ ফিবার। কারণ গুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

বাস্কেটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করা হয় বিখ্যাত আমেরিকান ফুটবল (ওরফে নকল ফুটবল) ও ফুটবল (সকার!!) লীগের আগ দিয়ে

বিশ্বকাপ বাস্কেটবলের মত একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট শুরু হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এনএফএল বা ন্যাশনাল ফুটবল লীগ শুরু হবার পাশাপাশি। এনএফএল নিয়ে মার্কিনিদের উন্মাদনা কারো অজানা নয়। আমেরিকার সবচাইতে জনপ্রিয় টুর্নামেন্টের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাস্কেটবল টুর্নামেন্ট আয়োজন করলে ফুটবল পাগল মার্কিনিরা বাস্কেটবলের দিকে ঘুরেও তাকাবে না। এছাড়া তাদের বাস্কেটবলের আলাদা সীজন তো আছেই। আচ্ছা মার্কিনিরা না হয় বাদ গেল কিন্তু সারা বিশ্বতো আর আমেরিকার ফুটবল সীজন দেখছে না। কিন্তু এখানেও ঝামেলা রয়েছে। এইতো সপ্তাহখানেক হলো সারা বিশ্বের (আসল) ফুটবল পাগলেরা টেলিভিশনের পর্দায় দৃষ্টি সেঁটে বসে গিয়েছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ, বুন্দেস লীগা, লা লীগা, সিরি এ ইত্যাদি নিয়ে তালিকাটি অনেক বড়। একদিকে ইউরোপের ফুটবল সীজন অপরদিকে আমেরিকার ফুটবল সীজন এই দুই মানিকের চিপায় বাস্কেটবল বিশ্বকাপের দর্শক চেষ্টা করলে হাতেও গুণে ফেলা যাবে।

অনেকে বলতে পারেন বিশ্বকাপ ফুটবলের সাথে যাতে না পড়ে সে জন্যই ঠেলে এটাকে গ্রীষ্মের শেষে নিয়ে আসা। কিন্তু সেখানেই দ্বিতীয় সমস্যার উৎপত্তি।

এক বনে দুই বাঘ ও একই গ্রীষ্মে ফুটবল-বাস্কেটবল বিশ্বকাপ একই কথা

ব্যাপারটা জলবৎ তরলং। যেই গ্রীষ্মে বিশ্বকাপ ফুটবলের মত “আসল” বিশ্বকাপ হচ্ছে, সেই গ্রীষ্মের শেষে বাস্কেটবল বিশ্বকাপকে ঠেসে জায়গা দিলে ক্রীড়াভক্তদের নজর কাড়া যাবে না। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক আসরে বিশ্বকাপ বলতে ফুটবলের উপর কিছু নেই। প্রতিযোগিতায় কাছাকাছি আছে ক্রিকেট কিন্তু সেটা হাতে গোনা কয়েকটা দেশ। বিশ্বকাপ ফুটবলের দুঃখের কিংবা সুখের স্মৃতি র‌োমন্থন করতে করতে ওরা যখন ইপিএল, লা লীগার দলের খেলোয়ার বদলের খবর নিয়ে মত্ত তখন বাস্কেটবল কেন আরেকটি বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করলেও আদতে কোন লাভ হবে না। এমন কি আমার মত অধম, পাপী যে কিনা লীগ পর্যায়ের ফুটবল অনুসরণ করে না সেও ভুলে গিয়েছিল বাস্কেটবলের বিশ্বকাপ শুরু হতে যাচ্ছে। কারণ, তার দৃষ্টি সেঁটে আছে ইউ,এস ওপেনে (উল্লেখ্য, ওখানে যা হরিলুট হচ্ছে দাদা, সে নিয়ে আরেক মহাকাব্য লিখে ফেলা যাবে।) শুভ সংবাদ হলো ফিবার অবশেষে বোধদয় হয়েছে। তারা বাস্কেটবল বিশ্বকাপকে ভিন্ন বছরে নিয়ে যাবার চিন্তাভাবনা ইতমধ্যেই করা শুরু করেছে।

এন,বি,এ এর ব্র্যান্ড ইমেজের অনুপস্থিতি

ফিবা বিশ্বকাপ বাস্কেটবলের সমস্ত আয়োজন ও প্রচারণায় এন,বি,এ এর কোন অস্তিত্ব নেই। অথচ ফিবার অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ের এন,বি,এ সম্পৃক্ততা রয়েছে। এই মাসের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দলের পল জর্জ অনুশীলনের সময় বাস্কেট বোর্ডের সাপোর্টিং ফ্রেমের সাথে সংঘর্ষে পা ভেঙে সরাসরি কোর্টের বাইরে। অনেকের মতে সাপোর্টিং ফ্রেমটি বাস্কেটের বেশী কাছে ছিল বলেই এই দুর্ঘটনা ঘটে। কোর্টের খুটিনাটি বিষয় গুল‌োর মান নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত দায়িত্বগুলো যদি ফিবা ঘোষণাপূর্বক এন,বি,এ এর হাতে তুলে দেয় তাহলে কিন্তু এসব প্রশ্নের অবতারণা হয় না। এন,বি,এ আমেরিকার জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান হলেও এর ব্র্যান্ড ইমেজ এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এন,বি,এ এর বিভিন্ন দলে খেলতে আসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত খেলোয়াররা। এই শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজকে ফিবা কাজে না লাগিয়ে অপচয় করছে।

স্টেডিয়ামে দলের সমর্থকদের জন্য সংরক্ষিত আসন থাকেনা

বিশ্বাস করতে কষ্ট হতে পারে তবে ফিবা বিশ্বকাপের খেলাগুলোতে দুই দেশের সমর্থনে দর্শকরা পুরো স্টেডিয়াম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ফলে খেলাতে ভক্তদের নিজ দলের সমর্থনে যে উন্মাদনা তার পুরোটাই মাটি হয়ে যায়। বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেটের খেলাগুলোতে, এমনকি জাতীয় পর্যায়ের খেলাগুলোতে যেখানে নিজ দলের সমর্থকদের জন্য সংরক্ষিত আসন বা এলাকা থাকে সেখানে ফিবা এই ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ এখনো কেন নিচ্ছেনা তা বিশেষ বোধগম্য নয়। চিন্তা করুন প্রত্যেক বাস্কেটের পিছনে দুই দেশের সমর্থকদের জন্য সংরক্ষিত এলাকা। চিন্তা করুন স্পেনের মার্ক গাসোল এক অসাধারণ থ্রি-শ্যুট নিয়ে এসে নিজের কোর্টের পিছনে উৎসাহ দিতে থাকা ভক্তদের সাথে উদযাপন করছে–যেমনটা ফুটবলে মেসি, নেইমার, রোনাল্দোরা করে থাকে। আসলে মাঠ কেন্দ্রীক বিশ্বের যেকোন খেলাতেই এটা হয়ে থাকে।

বিশ্বকাপ আয়োজকের ঘোষণা ও গ্রুপ তৈরীর ড্র হয় প্রায় নিভৃতে

যদি জিজ্ঞাসা করি এই বছর কোন দেশ বিশ্বকাপ বাস্কেটবল আয়োজন করছে, আপনি যদি সরকারী চাকুরীর জন্য প্রস্তুতি না নিতে থাকেন তবে সঠিক উত্তর দেয়াটা আপনার জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আমি নিজেই জানতাম না এবারের বিশ্বকাপ বাস্কেটবল আয়োজন করছে স্পেন। বেশ কয়েকবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ান স্পেন যে বাস্কেটবল খেলে এটাই ঠিক মত জানতাম না। হয়তো সেটা না জানাটা একটু স্থুল পর্যায়ের অজ্ঞতা তবে যা বলতে চাইছি সেটা হলো, বিশ্বকাপের আয়োজক, গ্রুপ গঠনের ড্র ইত্যাদি কখন কোথায় কিভাবে অনুষ্ঠিত হয় তা অন্তত সাধারণ জনতা হিসেবে আমরা বলতে পারছিনা এটা নিশ্চিত। অথচ বিশ্বকাপ ফুটবল দেখুন। একটি ড্র-কে কেন্দ্র করে যেই আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয় তার কোন তুলনা হয় না। কোন দেশ কার সাথে পড়ছে, কোন গ্রুপ হবে সামনের বিশ্বকাপের গ্রুপ অফ ডেথ এই নিয়ে চলতে থাকে কল্পনা জল্পনা। এছাড়া প্রত্যেকটি ড্র অনুষ্ঠানে থাকে বিশ্ব তারকাদের মেলা। ফুটবল তারকা থেকে শুরু করে অভিনেতা, সঙ্গীত শিল্পী কে থাকেনা ফুটবল বিশ্বকাপ ড্র অনুষ্ঠানে? এই একই অনুষ্ঠান চাইলেই বাস্কেটবল ড্রতে করাই যায়। এত লুকোচুরি কেন? নাকি টেকাটুকার অভাব?

অলিম্পিক বাস্কেটবলে পেশাদার বাস্কেটবল খেলোয়ারদের সুযোগ দেয়া

সবশেষে বললেও এটি সবচাইতে বড় সমস্যা। কিভাবে? যেদিন থেকে অলিম্পিকে বিভিন্ন দেশের পেশাদার ও তারকা খেলোয়ারদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া হলো সেদিন থেকেই বাস্কেটবলের ড্রিম টিম সংক্রান্ত যত কল্পনা জল্পনা সব জড়ো হলো অলিম্পিককে ঘিরে। একবার ড্রিম টিম নিয়ে উন্মাদনার পরে আবারো আরেকটি একই ধরনের আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে (বিশ্বকাপে!!) ড্রিম টিম নিয়ে মাতামাতি করতে বাস্কেটপ্রেমীরা খুব একটা আগ্রহী হবেন না এটাই স্বাভাবিক। শুধু বাস্কেটপ্রেমী কেন খেলোয়াররাই এ ব্যাপারে চাইলে অনীহা প্রকাশ করতে পারে। উদাহরণ সরূপ বলা যায় লেব্রন জেমসের কথা। তিনি চাইলেই এই বিশ্বকাপ বাস্কেটবল নাও খেলতে পারেন কারণ ইতমধ্যেই তিনি বেশ কয়েকবার অলিম্পিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে খেলেছেন এবং সোনা জিতেছেন। অলিম্পিকের মত একটি প্রতিযোগিতায় দেশের হয়ে সোনা জেতার পরে একই ধরনের আরেকটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের তেমন একটা আবেদন থাকে না। এক্ষেত্রে সমাধান কি হতে পারে? অলিম্পিকে ফুটবল ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে অনুর্ধ্ব-২৩ দল। অলিম্পিকেই যদি ব্রাজিল আর্জেন্টিনার মারামারি হয়ে যায় তাহলে বিশ্বকাপ রাখার দরকারটাই বা কি? একই নিয়ম বাস্কেটবলে প্রয়োগ করলেই সমাধান হয়ে যাচ্ছে। বরং অলিম্পিকের তরুণ দলটি ভাল করার মধ্য দিয়ে এন,বি,এ টুর্নামেন্টে কিংবা ফিবা বিশ্বকাপের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাবে এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে।

হয়তো এতসব কিছু সমাধান করাটা বেশ কষ্টসাধ্য। বিশেষ করে আর যে যাই করুক অলিম্পিক কমিটি তাদের বাস্কেটবলের ইভেন্টে পেশাদারদের বসিয়ে দিয়ে নবীন খেলোয়ারদের দিকে এত সহজে ফেরত যাবেন না। তবে যদি তা করা সম্ভব হতো, সাথে ভিন্ন বছরে ভিন্ন সময়ে আয়োজন করা যেত তবে বিশ্বকাপ বাস্কেটবল আরো আকর্ষনীয় হয়ে উঠতো, বাড়তো প্রচার ও দর্শক কাটতি।

১৩ টি মন্তব্য : “বাস্কেটবল বিশ্বকাপ?! এইটা আবার কি?! খায় না গায়ে মাখে!? আচ্ছা না ভাই ফাইজলামি না এইবার সিরিয়াস।”

মওন্তব্য করুন : রানা (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।