স্বপ্ন সন্ত্রাস – ২

ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ জাহাঙ্গীর গেট সংলগ্ন শাহীন কলেজে ভর্তি পরীক্ষা। মধ্যাহ্নভোজের বিরতির আগের পরীক্ষাটিতে কিছু একটা গোলমাল করে এসেছি। শুনে বাসায় সবার মুখ কালো। বিরতির পরের দুটো পরীক্ষা দিয়ে মনে হচ্ছে সম্ভব…দেখা যাক। সংবাদপত্রে রোল নম্বর দেখে মায়ের মুখে হাসি দেখেছিলাম কি? মনে নেই। শুক্রবার আসা হলো মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ প্রাঙ্গনে। মৌখিক পরীক্ষা। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হলো আমাদের ১০-১৫ জনকে। সেনাবাহিনীর মেডিকেল কোরের একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট হাতে ছোট টেস্টটিউব ধরিয়ে দিয়ে কর্কশ গলায় বলল, “টয়লেটে গিয়ে পেশাব করে ভরে নিয়ে আস।” চলচিত্রে দেখেছি প্রচন্ড ভয়ে মানুষজন প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলে। আমার উল্টোটা হলো। যতই চেষ্টা করি “পেশাব” এর দেখা মিলে না। তারপর হঠাৎ হাতে গরম পানির স্পর্শে বাস্তবে ফিরে এলাম। সুযোগ পেলেই চিন্তায় হারিয়ে যেতে বড় ভালো লাগে এবং সেটা “পেশাব” সহায়ক। জুমআর নামাজ পড়তে একটু পরে ক্যাডেটরা দলে দলে আসতে লাগলো। বড় ভাইয়ের সাথে কথা হল‌ো মিনিট পাঁচেক। কি বলেছিল? একসময় আমার ডাক পড়লো ডাক্তারের রুমে। ঢুকতেই দেখি হাসপাতালের সেই মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট প্রায় আধা মানুষ সমান এক ছুরিতে ধার দিচ্ছে। জানালার ভারি পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা শেষ বিকেলের রোদে ছুরির শীতল চকচকে পৃষ্ঠের উপর হাত বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসতেই….

চোখ খুলে উঠে বসলাম। অন্ধকার ঘরে হাতঘড়ি খুঁজতে গিয়ে চ‌োখ ধাঁধানো আলোয় চমকে উঠলাম। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় দুই কানে আঙুল চেপে ধরার প্রায় সাথে সাথে নিস্তব্ধতা গলা টিপে ধরলো বজ্রপাত। হঠাৎ বজ্রপাতের শব্দ ভয় পাই সেই ছোটবেলা থেকেই। এখনো সামলে উঠতে পারিনি। কান হতে আঙুল সরাতেই বুঝলাম একেবারে নিস্তব্ধ নয়। বাইরে মূষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ ঠান্ডা বাতাস। অথচ ঘেমে গিয়েছি। সাভার স্মৃতিসৌধ ঘুরে ফেরত আসার পরে মূষলধারায় বজ্রসহ বৃষ্টি নেমেছিল। রান্নায় ব্যস্ত মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে জামা কাপড় খুলে দোতালার পেছনের বারান্দায় গিয়েছিলাম বৃষ্টিতে ভিজবো বলে। গুটিগুটি পায়ে ঠান্ডা পানিতে পা রাখতেই সেই অন্ধ করে দেয়া আলো আর বিকট শব্দে বজ্রপাত। এরপরের চিৎকারটা মা ঠিকই শুনতে পেয়েছিল….”কি ব্যাপার ঘুমাও নাই?” আরো একবার চমকে উঠে পিছে তাকিয়ে দেখি দরজায় মা দাড়িয়ে আছে। এভাবে অন্ধকারে হঠাৎ কথা বলার জন্য বিরক্তি প্রকাশ করলাম। ঘরের অন্ধকার ও হঠাৎ বজ্রপাতের আলোর সাথে চোখ সয়ে আসার পরে সামনের বিছানায় তাকিয়ে তৃতীয়বারের মত চমকে উঠলাম। বাবা বিছানায় বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গলা ছেড়ে চিৎকার দিতে গিয়ে দম আটকে এল….

চোখ খুলে উঠে বসলাম। অন্ধকারে মুঠোফোন খুঁজতে গিয়ে দেখি বেশ দূরে একটা সবুজ বিন্দু জ্বলছে নিভছে। হাতড়ে সেটার কাছে যাবার আগেই আবারো চোখ ঝলসে দিলো সাদা আলোয়। হামাগুড়ি দেয়া বন্ধ করে কানে আঙুল দেয়ার আগেই গোটা শহর যেন কেঁপে উঠলো বজ্রপাতের শব্দে। চিৎকার করে অভিশাপ দিতে মুখ খুলতেই দেখি গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। এটাও কি স্বপ্ন? না প্রভু দয়া করো। আর না। ঢোক গিলে আবার কথা বলার চেষ্টা করলাম। এবার শিরিষ কাগজ ঘষার মত শব্দ বের হলো গলা দিয়ে। দ্বিতীয় বজ্রপাতের আলোয় কানে হাত দিয়ে টেবিলের উপর জলের বোতলটা দেখতে পেলাম। হাত বাড়িয়ে নিয়ে এক ঢোক গিলতেই গলা জ্বলতে শুরু করলো সাথে মিষ্টি একটা স্বাদ। এটা কি ছিল? ছোট একটি বজ্রপাতের আলোয় হাতের বোতলের লেখা পড়লাম Nyquil….ফাক মাই লাইফ!! এবারে জুতসই চিৎকার বের হলো গলা দিয়ে। মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে পিছনের লেবেল পড়লাম। যাক, সম্ভবত অনুমোদিত সর্বোচ্চ মাত্রার নিচেই গিলেছি। তারপরেও এসিটোমিনোফেনের উপর ভরসা নাই। উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দুধ পান করলাম। দুটো রুটির টুকরো, কিছু ফেটা পনিরের টুকরো, আর রাতের রান্না করা মাংস মুখে পুরে চাবাতে চাবাতে ঘরে ফেরত এলাম। ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে রাত পোনে চারটা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। জানালা খুলে দিলাম। সামনের পোর্চটি বাড়িওয়ালা পানিরোধি রাবার দিয়ে মুড়ে দিয়েছে গত বছর। বৃষ্টির ফোঁটা তার উপর পড়ে উদ্ভট এক শব্দ করছে। বুক ভরে দম নিলাম। ঠান্ডা পরিস্কার বাতাস। যাক পুরোটাই স্বপ্ন ছিল। কিন্তু খুবই উদ্ভট স্বপ্ন। ইদানিং এইসব উদ্ভট স্বপ্ন খুব বিরক্ত করছে। সাধারণত মনে থাকে না। আজকেরটি এখনো পরিস্কার মনে আছে। আজকে সকালে উঠা দরকার ছিল। কিন্তু এরকম আবহাওয়ায় কে উঠতে চাইবে? আর তার উপর যতটুকু Nyquil পেটে গিয়েছে আরো এক দফা লম্বা ঘুম চেপে ধরা সময়ের ব্যাপার। তার আগ পর্যন্ত চলুক বৃষ্টির উদ্ভট শব্দ শোনা।

১,৭৬৫ বার দেখা হয়েছে

১৭ টি মন্তব্য : “স্বপ্ন সন্ত্রাস – ২”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    গতকাল, আজ এখানে বৃষ্টি।
    বাঙলাদেশের মতো সুন্দর না।
    তবে বৃষ্টিতে ভিজতে নয় দেখতে আর শুনতে ভালো লাগে।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    বহুদিন স্বপন দেখি না বা দেখলেও ঘুম ভাঙ্গার পর মনে পড়ে না 🙁


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      আমার ইদানিং কোন ঠিক ঠিকানা নাই। কোন কোন দিন একদম ক্লিয়ার মনে থাকে আর কোন কোন দিন লাফ দিয়ে ঘুম থেকে উঠি কিন্তু বলতেও পারি না কি দেখে লাফ দিলাম! 😕


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      ইংরেজী ভয়াবহ শব্দের বাঙলা লেখাটাই একটা ঝামেলা। এ্যাসিটোমিনোফেন!

      ইদানিং স্বপ্ন নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছি। কিছু স্বপ্ন পরিস্কার মনে থাকে আর কিছু বলতেও পারি না। গত মাসে তো নিজেকে আহতই করে ফেললাম। ঘুমের ঘোরে শক্ত ক‌োথাও লাথি দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙুল মচকে ফেললাম! কি স্বপ্ন দেখে করেছি কিছু মনে নেই। শুধু রাতে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠে ব্যথায় বুড়ো আঙ্গুল ধরে গোঙালাম। এর এক সপ্তাহ আগে নিজেকপ আবিষ্কার করেছিলাম সিড়িঘরে। ঠান্ডা ঘুম ভেঙ্গে যেতেই চোখ খুলে দেখি সিড়িঘরে বসে আছি। সামনেই দেড়তলা নিচ পর্যন্ত নেমে যাওয়া সিড়ি! বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো সেদিন। কোন ভাবেই মনে করতে পারলাম না কিভাবে বিছানা থেকে হেটে সদর দরজা খুলে সিড়ি ঘরে গিয়ে বসলাম! 🙁


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
        • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

          প্যারাসিটামল যে এ্যাসিটোমিনোফেন এটা জেনেছি অনেক পরে এসে গত বছর। ভরা পেটে কেন খেতে বলে এটা কখনো জিজ্ঞাসা করে দেখা হয় নাই। গুগল চাপতেই দেখি এই কাহিনী।

          হ্যা কলেজে থাকতে মজার মজার (অনেক সময় ভয়াবহ) কাজ করতাম। একবার দৌড় দিয়েছিলাম। তারপরে দোতালা থেকে এক লাফে আধা তলার সিড়ি পাড় হয়েছিলাম যেটা সজ্ঞানে করা সম্ভব নয়। পোলাপান বলসিল এই দৌড় ইন্টার হাউজে ১০০ মিটারে দিলে ইমরান মাহমুদদের বেইল নাই। হাহাহাহাহা! আর চিৎকার দিয়ে গলা ভেঙ্গে ফেলা হইতো প্রায় প্রতি টার্মে একবার। ব্যাচের পোলাপানরে হরর মুভির ফিল দিতাম! বেচারা সবচাইতে বড় ভিক্টিম ছিল যেগুলা রাত জেগে পড়তো! 😛

          স্ট্রেস বাড়তে থাকলে, ঘটনা গুলো ঘটা শুরু হয়। স্ট্রেস কমানোর চেষ্টা করি। যেটা খুবই ঝামেলার। ইদানিং থিসিসের কাজে স্ট্রেস বাড়ছে, আর বাড়ছে উদ্ভট স্বপ্ন দেখার হার। 😕


          \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
          অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

          জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।