পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ১১ [শেষ পর্ব]

১৯ মার্চ, ২০১৪, বুধবার, বিকাল কিংবা সন্ধ্যা ৬টা ১৯ মিনিট
ডে লাইট সেভিং চালু হয়ে গিয়েছে এই মাসের ৯ তারিখ থেকে। কিঞ্চিত বিরক্তিকর একটি ব্যাপার। সামনে আসছে ম্যারাথন লম্বা দিন। এখনি সূর্য ডুবছে ৮টা ০৫ মিনিটে। এটা গড়াতে গড়াতে ৯টা ৫০মিনিট পর্যন্ত যাবে। টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছি আর এক চিলতে রোদ এসে গায়ে পড়ছেঃ এরকম উদ্ভট অনুভূতি খুব কমই হয়েছে জীবনে। ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানা নেই তবে এখানের গ্রীষ্মকালে রাতে ঘুমাতে বেশ দেরী হয়েছে গতবার। এর সাথে সূর্য ডোবার সম্পর্ক রয়েছে কিনা কে জানে। কোথায় জানি পড়েছিলাম আমাদের দেহঘড়ি সূর্যের উঠানামার সাথে দেহে এনজাইম নিঃসৃত করে। যাই হোক। থিসিস লেখা ছাড়া আর কোন কাজ থাকবে না। আশা করি এবারের ও অদূর ভবিষ্যতের জন্য শেষ মার্কিন গ্রীষ্মকালটি বেশ ভালই কাটবে ধরে নেয়া যায়। এদিকে মোমবাতির শেষটুকুর মত আবারো জ্বলে উঠেছে আবহাওয়া। গলে যাওয়া বরফের সাথে পাল্লা দিয়ে উপর থেকে কিছু পড়ছে। কিন্তু তাপমাত্রা স্থায়ী ভাবেই শূণ্যের এপারে চলে এসেছে। এরমানে বসন্ত এলো বলে। যদিও মাঠঘাটের বরফের স্তুপ গলে যেতে বেশখানিকটা সময় লাগবে তবে কাদামাটি ফুঁড়ে টিউলিপ ফোঁটা এখন সময়ের ব্যাপার। ৫-৬ মাস সাদা দেখার পর হঠাৎ টকটকে লাল কিংবা হলুদ চোখে পড়লেই মন চঞ্চল হয়ে উঠে। খুব আনন্দদায়ক এক অনুভূতি। কিছুদিন পরেই চারিদিক রঙে ছেয়ে যাবে। তখন ভাল লাগাটা থাকবে তবে প্রচ্ছন্নভাবে। ব্যাপারটির সাথে চোখের অভ্যাস হওয়া জড়িত।

২১ মার্চ ২০১৪, রাত ৮টা
ইদানিং চেষ্টা করি দৈনন্দিন জীবনে ঘটে য়াওয়া ঘটনাগুলো ফেবুর পাতায় না লিখে এখানে লিখে রাখতে। তারপরেও ফেবুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার লোভে কিছু কথা সেখানে লিখেই ফেলি। যে ঘটনাটি ভেবেছিলাম এখানেই লিখবো সেটা এখন হবে পুনরাবৃত্তি কারণ ঘটনা ঘটার দুই ঘন্টার মাথায় ফেবুতে লিখে অনেক লাইক ও কমেন্ট কামিয়েছি। দিল খুশ হুয়া। এখানকার পাঠকদের বেশীরভাগই পড়ে ফেলেছেন কিন্তু বিস্তারিত লিখিনাই। এখানে বিস্তারিত লিখে রাখি।

গত দুই বছরে প্রতি সেমিস্টারে ঠিকই ৭০ ডলার করে চাঁদা দিচ্ছি মিশিগান টেকের বিভিন্ন সেবা গ্রহণের জন্য। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই করে থাকে। কিন্তু আমার মত জাত অলস, টাকা ঢালার পরেও স্টুডেন্ট ডেভেলপমেন্ট সেন্টার (এসডিসি) বা মিশিগান টেকের জিমনেশিয়াম (ও হাবিজাবি) মুখো হয় নাই। লিবিয়ার বন্ধু হামজার অত্যধিক গুঁতাগুঁতিতে সিদ্ধান্ত নিলাম এত টাকা যখন দিচ্ছি যাবার আগে একটু সুইমিং পুলে জলকেলী না করলেই নয়। বলাবাহুল্য সাঁতার পারি না। শুক্রবার সময় মত এসডিসি পৌঁছে গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চলে গেলাম সুইমিং পুল/লকার রুম এর দরজার সামনে। মাথায় তখন থিসিসের মেথডোলজী সাজানো নিয়ে বিস্তর চিন্তাভাবনা চলছে। দরজা খুলতেই লকারের সারি। প্রথম সারি পার হয়ে বামে মোড় নিতেই চক্ষু চড়কগাছ। চারিদিকে দিগম্বরের হাঁটবাজার। বসে আছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে, গান গাইছে, চিৎকার করছে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ভড়কে গেলাম। অনেকটা দৌঁড়েই লকার রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগলো তবে সামলে নিলাম। দুই বছর হয়েছে এই দেশে এসেছি। মোটামুটি সব ধরণের কালচারাল শক সামলে নেবার চমৎকার অভ্যাস যেন আমার আগে থেকেই তৈরী ছিল। পোষাকের ব্যবধান, ট্রাফিক আইন, নিয়ামানুবর্তিতা, চিন্তাভাবনা সবকিছুই খুব সুন্দর করে সামলে নিয়েছি। লকার রুমের এই দিগম্বর পদচারণার ব্যাপারটিও মাথায় ছিল, কিন্তু কোন অদ্ভূত কারণে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। নূপুরদা বলছিলেন, এটাতে ভয় পাবার কিছু নাই বড়জোর অস্বস্তি হতে পারে। সেটাই হবার কথা কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম। যাই হোক পড়ে হামজাসহ অন্যান্যদের খুঁজে বের করে সবার সাথে সিনা টানটান করে, সামনের দিকে তাকিয়ে (প্রায়) মার্চ করতে করতে দিগম্বর বাজার পার হয়ে সুইমিং পুলে চলে গেলাম। পানিতে ঝাঁপ দিয়ে কিছুক্ষণ হাপুসহুপুস করার পরে চশমাবিহীন চোখ কুঁচকে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি আমার টিএ প্রফেসর ক্যারী হেনকুইনেট উনার তিন কন্যাকে সাঁতার শেখাতে পুলে নামছেন। এই দেখে দুবলা দমের আমি একদমে পানির তলায় টুপ করে ডুবে গিয়ে কোন মতে খাবি খেতে খেতে একটু দূরে গিয়ে মাথা জাগালাম। চশমা না থাকায় আমি উনাকে দেখছি না কিন্তু উনি আমাকে হয়তো ঠিকই দেখছেন। নাহ। এই কালচারাল শকটিও মাথায় ছিলনা। আজকের দিনটা যাচ্ছেই বিস্ময়ের উপর দিয়ে। জলকেলীর পর স’না রুমে গিয়ে বসেছিলাম বেশ খানিকক্ষণ। গরম তাওয়ার মত এই ঘরে মানুষ কেন বসে থাকে, এই নিয়ে খেয়ালে-বেখেয়ালে প্রায়শই চিন্তা করতাম। আজকে গিয়ে বসার পরে মনে হলো ব্যাপারটা মন্দ নয়। প্রথমে কিছুক্ষণ দম নিতে অস্বস্তি হয় তারপরে স্বাভাবিক হয়ে এলে বসে থাকতে ভালই লাগে। মাঝে বন্ধুর সাথে টুকটাক কথা। স’নার সবচেয়ে ভাল অনুভূতি হলো বের হয়ে গোসল করার পরে। বেশ তরতাজা একটা অনুভূতি হয় এবং ভয়ানক খিদে পায়।

২৩ মার্চ ২০১৪, বিকাল ৫টা ২৬ মিনিট – এই পর্বের ইতি টানতে হচ্ছে
দেখতে না দেখতে ১১ পিস হাতিঘোড়া দিনলিপি লিখে ফেললাম। এই পর্বটির ইতি টানতে চাই তিনটি কারণেঃ
ক) বরফের দেশে বরফ চলে যাবার উপক্রম। সামনে আসছে গ্রীষ্মকাল,
খ) থিসিসের কাজটুকু শেষ করার জন্য যথেষ্ট সময় নাই। এই অজুহাতে লেখা বন্ধ করতে চাইছি, এবং
গ) নতুন পর্ব শুরু করতে চাই। গ্রীষ্মের শেষে দেশে ফেরত যাবার আগে উতাহ এর সল্ট লেক সিটি যাব বন্ধু ফয়সালের নিমন্ত্রণে। সপ্তাহ দুয়েক থাকার ইচ্ছা আছে সেখানে। আর যাব ঠিক করেছি ট্রেনে। ৩৯ ঘন্টার এক সম্ভাব্য ট্রেন ভ্রমণ, সল্ট লেক সিটিতে কাটানো দিনগুলো নিয়ে নতুন একটি ছোট সিরিজ লিখবো।

তাই আপাদত লেখক হিসাবে ডুব দিচ্ছি।তবে পাঠক হিসাবে থাকছি। থিসিসের কাজ ঠিক মত গুছিয়ে নিতে পারলে এই বছরের মাঝামাঝি নাগাদ দেশে ফেরার সম্ভাবনা আছে। অনেক পরিকল্পনা, বাকেট লিস্ট বানিয়েছি। কতটুকু বাস্তবায়ন করা যায় তা সময় বলে দিবে। সকলের দোয়াপ্রার্থী। সময়ে অসময়ে আমার হাতিঘোড়া লেখাগুলো যারা পড়ে দেখেছেন তাদের ধন্যবাদ। আপনাদের অনেকের লেখা আমার জন্য খুবই জোরালো অনুপ্রেরণা ছিল এবং তা লিখে ব‌োঝানো সম্ভব নয়।

এরকম ঘটা করে নাটকীয় বিদায় বাণী কেন লিখলাম জানি না তবে লিখে আনন্দ পেলাম!

২,২৪১ বার দেখা হয়েছে

২৮ টি মন্তব্য : “পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ১১ [শেষ পর্ব]”

  1. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    প্রত্যেকটা লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়েছি ভাই। আইলসা ক্যাডেট তাই কমেন্ট করা হয় না। 😛

    সিরিজ টার মৃত্যুতে কষ্ট পাইলাম। 🙁 ভালা পাইতাম ।

    অন্য লেখার অপেক্ষায় বেশিদিন রাইখেন না ভাই 😀


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    আহ, সিরিজটা শেষ হয়ে গেল 🙁

    নতুন সিরিজের অপেক্ষায় থাকলাম 🙂


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      কিঞ্চিত ফাঁকা যাবে আহসান ভাই। তবে নীচের কমেন্টে নূপুরদা যেটা বললেন, যদি রং-বেরঙের টিউলিপ, এলো চুলের, স্মিত হাসির রমণীদের পুনরোন্মোচন দেখে নিজেকে আটকে রাখতে না পারি তাহলে দুই পর্বের প্যাকেজ ছেড়ে দিবই দিব! 😀


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  3. সামিউল(২০০৪-১০)

    এই সিরিজ শেষ হয়ে গেলো জেনে খুব খারাপ লাগছে;
    আবার নতুন সিরিজ আসবে জেনে আনন্দ লাগছে।

    মিশ্র অনুভূতি।

    দিগম্বর বাজার

    =)) 😀


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    যে ঘটনাটি ভেবেছিলাম এখানেই লিখবো সেটা এখন হবে পুনরাবৃত্তি কারণ ঘটনা ঘটার দুই ঘন্টার মাথায় ফেবুতে লিখে অনেক লাইক ও কমেন্ট কামিয়েছি। দিল খুশ হুয়া।

    :party:


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    তবে পাঠক হিসাবে থাকছি।

    :hatsoff:
    এট লিট সঙ্গে থাকা, সেটাও বা কম কি!


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. নাফিস (২০০৪-১০)

    মোকাব্বির ভাই, ইউটাহ র আর্চেস ন্যাশনাল পার্ক টা মিস দিয়েন না.. যাবেন দুই বার.. একবার দিনে রক গুলো দেখার জন্য আরেকবার মধ্যরাতে আকাশের তারা আর মিল্কিওয়ে দেখার জন্য। স্মরণীয় হয়ে থাকবে এটা, গ্যারান্টি দিলাম।
    আপনার সিরিজ তো তাও ফর্মালি বিদায় নিল , আমার টা থেমে গেছে কোন ঘোষণা না দিয়েই। গ্রীষ্মের তো অনেক দেরি এখনো। নতুন কিছু শুরু করেন।

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      সল্ট লেক থেকে ২২৯ মাইল দূরে আর্চেস। একটাই উপায় আছে হয় ছুটির দিনে। চাকুরীজীবি ফয়সাল নাহলে সময় করতে পারবে না। তোমাদের ছবি দেখে লোভও সামলাতে পারছি না! দেখা যাক! 😀


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  7. নাজমুল (০২-০৮)

    আমি ভুল করে ফেললাম, এই পর্বটা আগে পড়ে ফেলছি। যাইহোক আমারো ইচ্ছা আছে এরকম কিছু লেখা। অনেক বাজে কাহিনী শুনেছি অনেকের মুখে তিক্ত অভিজ্ঞতা, অনেকের আছে অসাধারণ অভিজ্ঞতা 😀

    জবাব দিন
  8. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    সিরিজ শেষ হচ্ছে দেখে দুঃখ না হয়ে আনন্দ হচ্ছে কারণ মোকার বরফের গল্প বলার দিন বিগত হতে চললো। এবার বসন্তের গল্প হবে, ফুলের গল্প হবে - ভারী আর পুরু আচ্ছাদনের আড়ালে চলে যাওয়া রমণীয় রমণীদের পুনরোন্মোচনের গল্প হবে।আমি আশাবাদী।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।