পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ৭

জানুয়ারী ২৭, ২০১৪, রবিবার, রাত ১১টা ০৫ মিনিট
কয়দিন আগের হঠাৎ ভয়াবহ ঠান্ডা আবহাওয়াকে “পোলার ভরটেক্স” নামক কল্পকাহিনী টাইপের নাম দিয়ে খুব বিখ্যাত বানিয়ে ফেলা হলো। সবাই চিন্তিত শংকিত ইত্যাদি। এরমাঝে বিশ্ব উষ্ণায়ন বিরোধীরা (উদাঃ ফক্স নিউজের বিল ও’রাইলি) বলেই ফেললেন, “কিসের গ্লোবাল ওয়ার্মিং, আমিতো দেখছি গ্লোবাল কুলিং।” খুব হাসি পায় যখন কেউ গ্লোবাল ওয়ার্মিং শব্দটির আক্ষরিক অর্থের সাথে বিশ্ব আবহাওয়ার তুলনা ও অসঙ্গতি তুলে ধরে ও বলতে চায় কই পৃথিবীতো গরম হচ্ছে না। মার্কিন দেশে এই ধরনের বিনোদনদাতার সংখ্যা প্রচুর। যেটা বলছিলাম, পোলার ভরটেক্স নিয়ে মিডিয়া হাইপ শেষ হয়ে গিয়েছে। হয়তো মিডওয়েস্টে বড় ধরনের শৈত্যপ্রবাহ এই মৌসুমে আর হবেও না, কিন্তু আমরা? এই হতভাগ্য হো’টনবাসীদের কপালে এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পোলার ভরটেক্সের কেতাবী নাম অর্থাৎ severe wind chill advisory এলার্ট দেখে আমরা অভ্যস্ত। আজকে শেষ রাত নাগাদ তাপমাত্রা চলে যাবে হিমাঙ্কের নীচে ৩৫-৪০ ঘর পর্যন্ত। বাতাস বইবে ৩৫-৪০ কিমি/ঘন্টা বেগে। আগামীকাল দুপুর ২টার আগে কোন ক্লাশ নেই, কিন্তু সকালে লাইব্রেরীতে যেতে হবে। চিন্তা করতেই মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে। আমার মাস্তানি -১০ কিংবা ১৫ সেঃ পর্যন্ত। কিন্তু -৩০ এর ঘরে থাকা তাপমাত্রা একটা সমস্যা। তবে কপাল ভাল কয়দিন আগের তুষারঝড়টি আঘাত হানতে পারেনি। কিন্তু এই ধরনের বিভিন্ন সতর্কবার্তা চলতে থাকবে মার্চের শেষ পর্যন্ত। আশা করি এবার টিউলিপগুলোকে সময়মত ফোঁটার সুযোগ দিবে এই এলাকা।

জানুয়ারী ২৮, ২০১৪, মঙ্গলবার, দুপুর ২টা ১২ মিনিট
লাইব্রেরীর কফি শপে দাঁড়িয়ে জাগতিক চিন্তায় ডুবে আছি। হঠাৎ অনেকদিন পর দেখা হলে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে যেভাবে সম্বোধন করে সেভাবেই কাউন্টারের ওপার থেকে ভেসে আসলো, “মোকা?!!” ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে স্বর্ণকেশীকে অচেনা উচ্ছ্বাসে বলে উঠলাম, “heyyy!!??” তারপরে কাউন্টারের উপর তার এগিয়ে দেয়া কফি কাপের দিকে তাকিয়ে বললাম, “nevermind. btw my name is moka with a ‘k’ and hence that confusion.” বেশ জোরেই মনে হয় বলেছি কথাটা কারণ কফি শপে থাকা প্রায় সবাই হেসে দিল। স্বর্ণকেশীও বললো, “I was like….what’s with the ‘heyy’ for the drink?!” পিতৃ প্রদত্ত নাম বাঙলাদেশে বন্ধুদের মাঝে আপনা থেকেই মোকা হয়ে যায় বলে দেয়া লাগে না। তবে এখানে নিজ তাগিদেই বলেছি। কারণ সংযুক্ত ‘ব’ উচ্চারণ করতে শুধু মার্কিন নয় যেকোন বিদেশীর কষ্ট হয়। নামের সংক্ষিপ্ত রূপ বলে না দিলে ওরা শেষ পর্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার নাম উচ্চারণ করার চেষ্টা করে যাবে। তাই প্রফেসর থেকে ক্লাশমেট, বন্ধু সবাই মোকা ডাকছে এই ব্যাপারটা দেশের কেউ দেখলে নিশ্চিত অবাক হবে। যাই হোক, এই ধরনের পরিস্থিতি একমাত্র কফিশপের আশেপাশেই হওয়া সম্ভব। সাধারণত লাইব্রেরীর কফিশপে গেলে সতর্ক থাকি, কারণ ওরা সাধারণত পানীয়র নাম ডেকে খদ্দের খুঁজে বের করে। আজকে কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম। ইদানিং প্রচুর “কিছুটা অন্যমনস্ক” থাকা হয়।

জানুয়ারী ২৯, ২০১৪, বিকাল ৪টা ৪৫ মিনিট
গুগল ক্রোম ব্রাউজারের ট্যাবে অনেক কিছু বুকমার্ক করে রাখা। কমবেশী সবারই থাকে। কিছু অপ্রয়োজনীয় বুকমার্ক ফেলে দিচ্ছিলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ফোল্ডার। লেখা ‘তাওহীদ।’ ২০১২ এর কোন এক রাতে হঠাৎ মনে পড়ে গিয়েছিল ছেলেটার নাম। সিসিবিতে ওকে উৎসর্গ করে একটা লিখা দিয়েছিলাম। আজকে আবারো মনে পড়লো। ৫ ডিসেম্বর, ২০০৫ ডেইলী স্টারের এই সংবাদটির লিংক মাহমুদের (মকক, ৯৮-০৪) কাছ থেকে সংগ্রহ করে রেখে দিয়েছি। ৮টি বছর পার হয়ে গিয়েছে। গত ডিসেম্বর মনেই ছিল না। থাকে না। মানুষ বলেই হয়তো থাকে না। হয়তো রাকিবের (মকক, ৯৮-০৪) মনে থাকে; মুহিব ভাইয়ের (মকক, ৯৩-৯৯) মনে থাকে; চাচা-চাচীর মনে থাকে। আমারও মনে পড়ে হঠাৎ করেই। যখন মনে পড়ে তখন আমি দাগ কেটে যাওয়া কিছু একটা লিখে দায়িত্ব শেষ করি। ক্ষণিক সত্যের আগে ও পরে বাকি ৩৬৫ দিন মিথ্যে। গুগল ক্রোম প্রতিদিন খোলা হলেও স্ক্রীনে ভাসতে থাকা নামটি আমাকে বিচলিত করে না। আজকেও করতো না। দুঃখের হয়তো চৌম্বকত্ব আছে। ক্ষেত্র তৈরী হলে বাকি মন খারাপেরা দুই মেরুতে অবস্থান নেয় আর মাঝে আমি বসে থাকি। মন কিছুটা খারাপ তাই তাওহীদ এসে বসে পড়লো উত্তর মেরুতে। আগামী অনির্দিষ্টকালের জন্য ভুলে যাবার আগে, ভাল থাকিস তাওহীদ।

জানুয়ারী ৩০, ২০১৪, (আসলে ৩১ জানুয়ারী কারণ সময় রাত ১২টা ০১ মিনিট), শুক্রবার
আজকে (গতকাল) সন্ধ্যায় মিটিং ছিল। মিশিগান টেকের মত বড়সড় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষুদে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ। নিজেদের আগে সংখ্যালঘু ভাবতাম। পরে দেখলাম সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল এজুকেশান প্রোগ্রাম অর্থাৎ (ভবিষ্যত) প্রকৌশলী পিটিয়ে মানুষ বানানোর দায়িত্বটি আমাদের ঘাড়ে। ছোট হতে পারি কিন্তু দায়িত্ব বৃহৎ ও মহান। তাই বলা বাদ দিয়েছি। স্নাতকোত্তর ছাত্রদের যেইসব সংগঠন থাকে আমাদেরও সেরকম একটা সংগঠন আছে। জন্মগত বছর। নামটা অনেক বড়। আমরা ছোট করে ডাকি SSGSS = Social Science Graduate Student Society. নতুন যাত্রা শুরু করা এই সংগঠনে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করে জয় ছিনিয়ে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এডহক কমিটিতে আইনী মসলায় অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বলেছিলাম, সবাই খুব সমীহের সাথে মাথা নেড়েছিল। আমার উদ্দেশ্য হাসিল। সিভিতে লিখবার মত বেশ গালভরা একটি নামঃ ভাইস প্রেসিডেন্ট (২০১৩-২০১৪) – সোশ্যাল সায়েন্স গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট সোসাইটি। যাই হোক মূল বিষয়বস্তু থেকে ছিটকে যাচ্ছি। আজকে সেই সংগঠনের এই সেমিস্টারের প্রথম মিটিং ছিল। এতকিছু বললাম ভূমিকা হিসাবে। কারণ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবারের উইন্টার কারনিভালে বরফের ভাস্কর্য বানানোর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবো। উইন্টার কারনিভাল ও বরফের ভাস্কর্য এই দুটি বিষয় নিয়ে বকবক করার জন্য উপরের হাবিজাবি অনেক কথা বললাম। কিন্তু ভূমিকা শেষ করার পর মূল বক্তব্যে যাবার শক্তি ফুরিয়ে গিয়েছে। আপাতত রান্না করে শক্তি সঞ্চয় করি গিয়ে। আজকে মাছ রাঁধবো। স্মেলট মাছের দোপেঁয়াজা।

জানুয়ারী ৩১, ২০১৪, শুক্রবার, রাত ৯টা
গ্লোবাল ইস্যুজ কোর্সের ছাত্রদের প্রথম এসাইনমেন্ট দেখছি। এবারে কাগজপত্রের বালাই নেই। ছাপা কিংবা হাতে লেখা কোনটাই নয়। সবকিছু ক্যানভাস নামক একটা একাডেমিক নেটওয়ার্ক সল্যুশানের মাধ্যমে হচ্ছে। এসাইনমেন্টের নম্বর বন্টন পর্যন্ত করা আছে। আমার কাজ হলো পড়ে যাওয়ার আর ঘরে ঘরে নম্বর বসানো, সাথে কিছু মন্তব্য। শেষ হলে নিজেই যোগ হয়ে চলে যাচ্ছে নম্বরপত্রে। ঝামেলা মুক্ত অভিজ্ঞতা। গ্লোবাল ইস্যুজ বিষয়টি সাধারণত প্রথমবর্ষের ছাত্রদের দেয়া হয়। আমেরিকান ছাত্রদের বিশ্ব সম্পর্কে খুবই স্বল্প পরিমাণ জ্ঞান থাকার সমস্যা, ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা অনেকদিনের। গ্লোবাল ইস্যুজের মত বিষয়গুলো পড়িয়ে কলেজে পড়তে আসা এই নতুন ছাত্রদের বিশ্ব সম্পর্কে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয় গোটা আমেরিকাতেই। একজনের লেখা পড়তে গিয়ে একটু সন্দেহ হলো কিন্তু পড়া চালিয়ে গেলাম। এক পর্যায়ে চিন্তা করে দেখলাম যা দেখছি তা ঠিক দেখছি কিনা। তিন পাতা পড়ার পরে বুঝলাম যা দেখেছি, ঠিকই দেখেছি। কোন মূদ্রণ ভুল বা অসাবধানতা নয়। “আফ্রিকা” একটি “দেশ।” এই দেশের মানুষ খেতে পায় না। কিন্তু প্রচুর মাদক সেবন করে। আর আছে দূর্নীতি। বিরক্ত হতে গিয়েও নিজেকে শান্ত করলাম। এই কোর্সের উদ্দেশ্যই হলো বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া। উত্তেজিত হবার কি দরকার?

ফেব্রুয়ারী ৫, ২০১৪, বুধবার, দুপুর ১২টা ২৮ মিনিট
প্রেমিকার কাছে লিখা আমার চিঠিগুলোর মত একঘেঁয়ে চিঠি মনে হয় কোন প্রেমিক প্রেমিকা লিখে নাই। সিসিবির দিনলিপির পাশাপাশি একটি হাতে লেখা অংশও তারকাছে নিয়মিত বিরতিতে আমি পৌঁছে দেই। আজকেও লিখলাম। যা লিখলাম তা আবার এখানে লিখবো। আজকে থেকে শুরু হচ্ছে উইন্টার কারনিভাল। আজকে বিকাল ৪টা থেকে শুরু হয়ে রবিবার পর্যন্ত চলবে এই উৎসব। শরীরের উষ্ণতম অংশকে পরাস্ত করার মত ঠান্ডা যে উপভোগ করার মত কিছু হতে পারে সেটা মিশিগান টেকে না আসলে বুঝতে পারতাম না। অবশ্য আমি সবসময় চিন্তা করি যস্মীন দেশে যদাচার। এছাড়া শারীরিক একটা সমস্যার কারণে শীতটা ভাল লাগে। তাই আমার কাছে উইন্টার কারনিভাল অনেক আনন্দের একটা উৎসব। আসল কথা হলো শীতপ্রধান এলাকায় ঠান্ডা নিয়েই মাতামাতি হবেই। এদিকে আটলান্টায় ২ ইঞ্চি তুষারপাতের কারণে সারা রাজ্যে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হবে। যতদূর জানি বরফের ভাস্কর্য বানানোর উৎসব অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উদযাপন করা হলেও ব্যাপারটাকে কারনিভাল হিসাবে ঘোষনা করে কারনিভালের মত আবহ ও গুরুত্ব দিয়ে বুধবার বিকাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ দিয়ে সবাই মাঠে নেমে যাওয়ার মত কাহিনী আমেরিকায় মনে হয় একমাত্র আমরাই করে থাকি। সাড়ে চার দিন ব্যাপী এই উৎসবে প্রতিদিনই কিছু না কিছু থাকে। বিস্তারিত জানতে পারবেন এখানে।

তবে এবার আমি উইন্টার কারনিভাল নিয়ে একটু বেশী আগ্রহী কারণ বরফের ভাস্কর্য বানানোর প্রতিযোগীতায় আমরা সমাজবিজ্ঞান বিভাগ এই প্রথমবারের মত নাম লিখিয়েছি। এবারের ভাস্কর্যের মূল থীম হলো, “your childhood movie.” এনভায়রনমেন্টাল এ্যান্ড এনার্জি পলিসি (ই,ই,পি) ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্কিয়োলজী (আই,এ) নিয়েই মূলত আমাদের বিভাগ; সেটা মাথায় রেখেই আমরা বানাচ্ছি WALL.E. প্রতিযোগীতাটি দুই ক্যাটাগরীতে হয়। প্রথমটি বড়দাগে বড় ভাস্কর্য যেগুলো বানানো শুরু হয় কার্নিভালের দুই সপ্তাহ আগে থেকে কারণ সেগুলো লাইফ সাইজের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। দ্বিতীয় ক্যাটাগরী হলো “অল-নাইটার।” বুধবার বিকাল ৪টা থেকে শুরু করে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টার মাঝে শেষ করতে হবে। লোকবল ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অনেকে বিভিন্ন আকার-আকৃতি ও জটিল নকশা দাঁড়া করানোর চেষ্টা করে। আমাদের ই,ই,পি ও আই,এ এই দুটি বিষয়ের সুবিধা হলো দুটোই মাল্টিডিসিপ্লিনারী বিষয়। অর্থাৎ ডিপার্টমেন্ট ঝাড়া দিলে বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক বা কাজ করে অভিজ্ঞ লোক খুব সহজেই পেয়ে যাই। এবারের কার্নিভালে ভাস্কর্য বানানোর বুদ্ধিটা আসলে দিয়েছিল জন আর্নল্ড — ১০ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন স্থপতি। অটোক্যাডে ওয়াল-ই এর থ্রি-ডি মডেলিং, কাজ করবার জন্য ছাপানো নকশা তৈরী হয়ে গেল দুই দিনেই। আরেক ছাত্র ড্যানিয়েল তার বন্ধুর সুবাদে ছাঁচ বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ব্যবস্থা করে দিল। বেঁচে গেল ৮০-৯০ ডলারের খরচ। ছাঁচ বানাতে একে একে এগিয়ে এল পুরকৌশল, কেমিকৌশলের ছাত্র যথাক্রমে এডওয়ার্ড ও হামজা। কাটাকাটি, ড্রিলিংএ হাত দিল পেশায় কার্পেন্টার ম্যাক । ফ্যাকাল্টিরা শুনে তো অবাক। এই আধাপাগল গ্রাজুয়েট ছাত্ররা আসলেই এবার ভাস্কর্য বানাতে বদ্ধ পরিকর। ওরাও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, সামগ্রী দিয়ে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিল। বিকাল চারটায় কাজ শুরু হবে। আমি এরমাঝে বাসায় গিয়ে খেয়েদেয়ে গোসল করে আসি। শিফট হিসাবে দুই ঘন্টা করে প্রায় ৮-১০ ঘন্টা এই ঠান্ডায় বাইরে থাকা লাগবে। পানিরোধী হলেও জামাকাপড় বরফে মেখে যাবে। তাই পর্যাপ্ত প্রস্তুতিটা অনেক বড় ব্যাপার। কাজ শেষ করে কালকে এই কাহিনীর বাকিটুকু লিখবো।

৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা ২০মিনিট
ঘুম ভেঙ্গেছে ঘন্টাখানেক আগে। চোখ খুলেই বুঝতে পারলাম শরীরের অনেক অংশ ব্যথায় নাড়ানো যাচ্ছে না। ভোর চারটার সময় যখন বিছানায় শুইছিলাম তখনই আগামী কয়েকদিনের গীঁটে গীঁটে ব্যথার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। অনেক কষ্টে উঠে বসলাম। এক হিসাবে চিন্তা করে ভাল লাগছে। কারণ অনুভূতিটা পুরানো ও স্মৃতিবহুল। এক মাসের ছুটি কাটিয়ে প্রথমদিন পিটির পরের এক-দেড় সপ্তাহ এরকম ব্যথা করে নাই এরকম ক্যাডেট খুঁজে পাওয়া যাবে না। গতকাল বিকাল পাঁচটায় আমরা অল-নাইটার বরফের ভাস্কর্য বানানোর প্রতিযোগীতায় নামি। আমি ও স্থপতি জন চার ফুট বাই চার ফুট কাঠের চারটি পাটাতন (যেগুলো জোড়া দিয়ে ছাঁচ হিসাবে ব্যবহৃত হবে) ল্যাব থেকে সামনে নিয়ে আসি। বেশ ভারী এই পাটাতন গুলো হাতে কিভাবে বহন করবে এই নিয়ে ওরা যখন চিন্তা করছে তখন তাদের আমি দেখালাম কিভাবে আমাদের দেশের শ্রমিকেরা ভারি বস্তা মাথায় নিয়ে দুইহাতে ধরে হেঁটে চলে যায়। আমার দেখাদেখি ওরাও মাথায় নিয়ে মহাখুশী আর অবাক যে এভাবেও ভারী জিনিস শুধু একহাতের উপর চাপ না দিয়ে পুরো দেহের উপর ছেড়ে দিয়ে বহন করা যায়।

জোড়া দিয়ে বর্গাকৃতির বাক্স বানিয়ে ভেতরে চলে গেলাম আমি আর জন। আমার হাতে স্প্রিংকলার লাগানো পানির পাইপ। বাইরে থেকে দুইজন দুই পাশ থেকে বরফ ঢালছে ভেতরে আর আমরা পানি ছেটাচ্ছি ও আমাদের বুটজুতো দিয়ে পিষে যাচ্ছি। -১৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় নরম বরফে পানি ঢেলে পিষতে থাকলে কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা জমে গিয়ে শক্ত বরফের চার ফুট বাই চার ফুট চাঁইয়ে রূপ নিবে। পাশে প্লাস্টিকের একটা চৌবাচ্চায় একই ভাবে তৈরী করা হচ্ছে ওয়াল-ই এর মাথার ছাঁচ। সেখানে কাজ করছে ক্যারল। ইতমধ্যে শিক্ষকদের মাঝে রিশেল, অড্রি, স্টিভ এসে উৎসাহ ও হট চকোলেট দিয়ে গেল। হাতমোজা পড়া হাতদিয়ে নাকের পানি মুছতে গিয়ে ব্যথায় ককিয়ে উঠলাম। হাতমোজায় লেগে থাকা পানি জমে গিয়ে ধারালো শিরিষ কাগজের মত হয়ে গিয়েছে খেয়ালই করি নাই। পাশে হঠাত এক বড় বুলডোজার এসে হাজির হলো। জানালা খুলে চালক জিজ্ঞাসা করল‌ো, “do you guys need some soft snow?” নিঃসন্দেহে এরকম কথা মিশিগান টেকে উইন্টার কারনিভালের সময় ছাড়া আর কখনো কোথাও শুনতে পাবার কথা নয়। বরফের চাঁই বানিয়ে জমতে দিয়ে চলে গেলাম পিছনে যেখানে বারবিকিউর প্রস্তুতি চলছে। খেয়েদেয়ে ঘন্টা দুয়েক পরে ফেরত আসলাম। জমে যাওয়া বরফের ওজন কি পরিমান ভয়াবহ হতে পারে সেটা গতকাল বুঝেছি। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার অনেক কারণ থাকলেও হিমশৈলের সাথে সংঘর্ষটাই সব সর্বনাশের কারণ। প্লাস্টিকের চৌবাচ্চাটি উল্টিয়ে সেখান থেকে বরফের টুকরোটি বের করে আনতে দম বেরিয়ে গেল ৫ জন তরতাজা যুবকের। যখন জন জানানো মাথাটি কেটে তৈরী করার পর সেটা চারফুট উঁচুতে উঠাতে হবে তখন চোখে অন্ধকার দেখলাম। যাই হোক এরপরে বাকি কাজ বেশ দ্রুতই এগিয়ে চললো, কারণ পুরো ডিজাইনের বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি মাপসহ প্রিন্ট করে নিয়েছিলাম। গজফিতায় মেপে দাগ কেটে করাত, ছোট কুড়াল দিয়ে খুব সাবধানে কেটে বের করে নিয়ে আসছিলাম লি, জন, আমি, লিওনর, রোনেশা। প্রথম প্রথম পাশে দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছিলো তারা জিজ্ঞাসা করছিল কি বানাচ্ছি। এরপরে যখন ওয়াল-ই এর চলাফেরা করার জন্য নিচের ট্রেডটা কেটে বের করে আনলাম সবাই দূর থেকে দেখেই বলা শুরু করলো, “ইজ দ্যট ওয়াল-ই?” কি যে ভাল লাগছিল বলে বোঝানো যাবে না। ঠান্ডায় জমে যাওয়া এই কষ্ট অবশেষে ফল দিতে শুরু করেছে। ওদিকে আরেক টুকরো বরফে মাথার ছাঁচ বের করে আনছে এডওয়ার্ড। দুটো হাঁত বেশ জটিল তাই সেটা ছেড়ে দেয়া হয়েছে হামজার তত্বাবধানে অ্যামান্ডা ও ম্যাগীর কাছে। এই প্রথম দেখলাম একজন প্রত্নতত্ববিদ ও একজন স্থপতির হাতের সাথে একজন আইনজীবী বা একজন প্রকৌশলীর হাতের পার্থক্য। বড় দাগে ছাঁচগুলো বানিয়ে আমি লি (প্রত্নতত্ববিদ) ও জনের (স্থপতি) হাতে ছেড়ে দিচ্ছিলাম। সেখান থেকে ওরা এত সুন্দর করে বের করে আনছিল সে এক দেখবার মত বিষয়।

রাত একটার দিকে ছোট একটা বিরতি নিয়ে ৫ জন তরুন-তরুনী সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে সেই মাথাটি চারফুট উঁচুতে তুলে ওয়াল-ইর ঘাড়ে বসাতে সক্ষম হলাম এরপরে এর পাশ দিয়ে যারাই যাচ্ছিল, কিউট, বিউটিফুল, শব্দগুলো উড়ে আসছিল, মানুষজন ছবি তুলছিল। এই অনুভূতি বলার মত না। হিমাংকের অনেক নীচে তাপমাত্রায় নরম বরফের সাথে পানি মেশালে তা চমৎকার আঠার মত কাজ করে। সেই পদ্ধতি অবলম্বন করে দুটো হাতও জুড়ে দিলো হামজা। এরপরে ইস্ত্রি দিয়ে (জ্বী ভুল বলছি না) পুরো ওয়াল-ইকে সুন্দর করে ডলে দেয়া হলো। ইস্ত্রি বা এসিটিলিন শিখা সাধারণত ব্যবহার করা হয় ভাস্কর্যের ধারালো ও খড়খড়ে অংশগুলো ভোঁতা করে দিতে ও চকচকে ভাব আনতে। রাত তিনটায় এরপর বেশ কয়েক দফায় গ্রুপে ছবি তুলে ক্লান্ত দেহে যে যার মত বাসায় ফেরত এলো। আমি জানি এই ঘটনা গুলো বাঙলাদেশ তো দূরে থাক আমেরিকার অর্ধেক মানুষের কাছে স্রেফ পাগলামি বই কিছু না। বরফ নিয়ে এই পর্যায়ের পাগলামি করা যেতে পারে সেটা সেটা ছবিতে দেখে নিতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন। আমাদের ওয়াল-ই ছবিটাও জুড়ে দিলাম ফেবু থেকে নিয়ে। এখানে পাবেন।

সন্ধা ৭টা ১০মিনিট (বৃহস্পতিবার)
অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম বাকিদের কাজ দেখতে। এবারে নিজেরা ভাস্কর্য বানিয়েছি দেখে খোলা মাঠে ডিজে পার্টি ও বিভিন্ন খেলায় অংশগ্রহণ করতে পারি নাই। সেটা নিয়ে অবশ্য বিন্দুমাত্র আফসোস নাই। অন্যদের ভাস্কর্য দেকায় যতটা না আনন্দ তার চেয়ে বেশী আনন্দ অন্যান্য দর্শকদের এই উৎসব উপভোগ করতে দেখে। প্রতিটা ভাস্কর্যের সামনে থামছে, ছবি তুলছে, আলোচনা করছে বিভিন্ন দিক নিয়ে। আর্ট এক্সিজিবিশানে যেরকম হয় ঠিক সেরকম। তিন ক্ষুদে সন্তানকে হাতে টানা স্লেজে টেনে বেড়াচ্ছে বাবা, মা ও ক্ষুদেদের সর্দার বড় বোন। বাসায় চলে যাচ্ছিলাম। আমাদের ওয়াল-ই এর সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম উইন্টার কারনিভাল নিয়ে। স্থানীয় এই দম্পতি নিজেরাও মিশিগান টেকের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী। একসময় নিজেরা বানিয়েছে, আনন্দ করেছে, কোন এক কারনিভালেই মেয়েটার সাথে পরিচয়, আর এখন প্রতিবছর অপেক্ষায় থাকে কবে স্বপরিবারে ঘুরতে যাবে। শুনেই ভাল লাগলো।

হঠাৎ মুরগীর ডানা চিবানোর সখ করলো দেখে স্থানীয় দোকান পিৎজা ওয়ার্কসে গিয়েছিলাম। অর্ডার নিতে থাকা মেয়েটিকে নাম “M O K A” বলতেই জিজ্ঞাসা করলো আমি গ্লোবাল ইস্যুজ কোর্সের টিএ কিনা। মাথা নাড়তেই হেসে জানালো সে ঐ সেকশানে আছে। ৯১ জন ছাত্র-ছাত্রীর ক্লাশে এখনো কারো চেহারা মুখস্থ করার চেষ্টাও করি নাই কারণ এবারে দরকার পড়ছে না। এই লেখাটা ছেড়ে দিতে হবে। বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। ইদানিং ব্যস্ততা বেড়ে যাচ্ছে। থিসিস নিয়ে দৌড়ঝাঁপ পুরোদ্যমে শুরু করেছি।

১,৪০০ বার দেখা হয়েছে

১২ টি মন্তব্য : “পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ৭”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দারুন লেখা। চলুক :hatsoff: ওয়াল ই কে ফেবুতে দেখলাম, পছন্দ হইছে :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপা। শীত তো মাত্র কেরামতি শুরু করলো। এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই সার্কাস চলবে আপা! এখানে আসার পর শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম নাম মোকা বলবো। সেই থেকে শুরু! 😀


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : শাহীন (৯৬-০২)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।