পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ৫

ভোর ৩টা ১৭ মিনিট (জানুয়ারী ৯, ২০১৪) – নির্ঘুম রাতের অভিশাপ
রাত একটার দিকেই শুয়ে পড়লাম। রাত জেগে থাকার বাজে অভ্যাসটা ছেড়ে আসতে চাই। সামনের সোমবার থেকে সেমিস্টার শুরু হয়ে যাচ্ছে। ইদানিং ঘুমানোর সময় মেডিটেশান কিংবা ঘুম সহায়ক সঙ্গীতের ট্র্যাক ইউটিউবে ছেড়ে ঘুমাতে চেষ্টা করি। কিন্তু আমার সঙ্গীতপিপাসু মস্তিষ্ককে ঘুম পাড়াতে ব্যর্থ হচ্ছে হাল্কা পিয়ানোর কাজগুলো। না ঘুমিয়ে বরং মন দিয়ে শুনছি। এত সুন্দর পিয়ানোর কাজ শুনতে গিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া অপরাধ। আজকে চেষ্টা করলাম এমনেই ঘুমাতে। অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। ঘুম সহজে আসতে চাইছে না। তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চাই কারণ রাত তিনটার দিকে বরফ পরিষ্কার করার দল আসবে বাসার সামনের রাস্তায়। দানব আকৃতির দুটো গাড়ির চলাচলের শব্দে ঘুমানো আর হবেই না।

চিন্তা করছি এই কয়দিন রাজনৈতিক ডায়েরী লেখা বন্ধ রাখবো। সবকিছুতে রাজনীতি আর রাজনৈতিক সমালোচনা টেনে আনি। এই কয়দিন লেখা থেকে সুশীলবকাশ। শব্দটি মাত্র বানালাম। লেখা বা কথায় স্পষ্ট রাজনৈতিক প্রসঙ্গ টেনে আনা বন্ধ করে সুশীল সমাজের মত সতর্কভাবে শান্তিপূর্ণ অবকাশ যাপনের চেষ্টার নাম ‘সুশীলবকাশ।’ তবে দেশের জন্য চিন্তিত হওয়া বহাল থাকবে। আর যদি কেউ আলোচনায় বা তর্কে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে তাহলে মিঠা হাসি দিয়ে মাথার গীয়ার নিউট্রালে বসিয়ে বসে থাকতে হবে। আলু পত্রিকা নিয়ে বেশ ঝাঁকাঝাঁকি হচ্ছে। নাহ এই ব্যাপারেও কিছু বলবো না। ২৯ বছরের ঐতিহ্য ভেঙ্গে ‘দৈনিক সংবাদ’ বন্ধ করে আলু পত্রিকা রাখা শুরু হয়েছিল ২০০৮ সালের কোন এক মাসে। খুব মন খারাপ হয়েছিল। পাটের সুঁতোয় বেধে ছুঁড়ে দেয়া যেই সংবাদপত্র গাজীপুর সেনানিবাসের ডুপ্লেক্স বাসার পোর্চের উপর দাঁড়িয়ে ক্যাচ ধরার চেষ্টা করে কেটেছে শৈশব হঠাৎ সেই সংবাদপত্র পরিবর্তন করা আমার কাছে স্বজন হারানোর মত বেদনাদায়ক ছিল। আলু পত্রিকাকে কোনদিন গ্রহণ করতে পারিনি। আমি বিখ্যাত চাই না। পরিচিত মুখ চাই। যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।

গতকাল স্মেল্ট মাছ আবারো রান্না করলাম। তবে এবার টমেটো দিয়ে দেশী কায়দায় দোপেয়াজা। কিন্তু খাই নাই রেখে দিয়েছি। কেন জানি মনে হলো ঝোল, মসলার স্বাদ ঠিক মত পেতে হলে সময় দিতে হবে। আজকে একটা উদ্ভট অভিজ্ঞতা হলো। এর আগে ছোট একটি ঘটনা বলে নেই। প্রথম যেদিন টেক্সাসে এসে নামলাম তারপরের দিন গোসল করে খেয়েদেয়ে রেডি হচ্ছি বের হবো। বন্ধু বলল পারলে আবার গোসলটা করে নিতে। কারণ জিজ্ঞাস করতে বললো এখানে মার্কিনিরা আমাদের মসলার গন্ধ সহ্য করতে পারেনা। কেমন করে জানি তাকায়। গোসল আর করা হয়নি তবে বন্ধু সতর্কতা সরূপ গায়ে সুগন্ধির শিশি ঢেলে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে এই এলাকায় এরকম ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয়নি। বরং “ইন্ডিয়ান ফুড” শুনলেই চেখে দেখার জন্য হামলে পড়ে। কথাগুলো বললাম কারণ আজকে বাসে করে কিছু কেনাকাটা করতে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে আরো ৭/৮ জন ছাত্র উঠলো। অবশ্যই চেহারা দেখে ও তাদের মাঝে চলতে থাকা কথায় আন্দাজ করলাম ভারতীয়। বাসের দরজা বন্ধ হবার পর প্রথম যে গন্ধটা নাকে আসলো সেটা হলো কষানো মসলার গন্ধ। প্রথমে পাত্তা না দিলেও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা এই ছোট বাসটিতে এই গন্ধটা বেশ বাজে ভাবে ধাক্কা দিতে লাগলো। ধূমপান করিনা প্রায় মাস চারেক বা তার বেশী, দেশী কায়দায় রান্নাটাও ইদানিং করা হচ্ছে না। যস্মিন দেশে যদাচারে বিশ্বাসী আমার মসলা বলতে এখন ব্ল্যাক পেপার আর চিলি পেস্ট। মায়ের দেয়া হলুদ মরিচ জিরার গুঁড়ো ডিপ ফ্রিজারে পরে আছে। মাঝে মধ্যে মন খারাপ হলে বের করি। এখন বুঝতে পারলাম ওদের নাকে আমাদের এলাকার মসলা এত জোরে ধাক্কা দেয় কেন। রীতিমত দম আটকে আসছিল। তার আগেই গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম।

সকাল ১০টা ১৮মিনিট, শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী, ২০১৪ – অর্থ আনে সুখ। অর্থ আনে সমৃদ্ধি।
প্রচন্ড ঠান্ডায় সকালে ঘুম ভাঙলো। পুরো ঘর যেন জমে গিয়েছে। সাধারণত আমার ঘর গরম থাকে। বাড়িওয়ালা এইটা নিশ্চিত করে যে বাঙলাদেশ থেকে আসা এই দুই ছেলের আর যেই কষ্টই হোক না কেন ঠান্ডার কষ্ট যেন না হয়। আমি আবার প্রচন্ড ঠান্ডায় হালকা কাপড়চোপড় পরে ঘুরে বেড়ানোর জন্য এখানে বিখ্যাত। কিন্তু আজকে কাঁথার তলা থেকে অল্প একটু হাত বের করে মুঠোফোনটা হাতে নিয়েই আবার কাঁথার নীচে চলে এলাম। ফেবুতে ছবি দেখছি। ইসিএফের মুড়ি চানাচুর পার্টি। দূরদূরান্ত ও আনাচে কানাচে থেকে মুড়ি চানাচুর খেতে আর গল্প করতে এক্সক্যাডেটরা জমা হতে কার্পণ্য করে না। প্রায় ১৭০ জনের মত হাজির হয়েছে আজকে। চমতকার উপস্থিতি। আজকে শুক্রবার। হুম! ওয়েলসফার্গোর ওয়েবসাইটে গেলাম। আজকে বেতন দিবে। চলতি হিসাবে জমাকৃত টাকার অংকটা দেখা মাত্র মাথায় Eye Of The Tiger বেজে উঠলো। ট্যাক্স ও ইন্সুরেন্সের বকেয়া প্রিমিয়াম কাটা বন্ধ হয়েছে। খুশীতে কাঁথা ছুড়ে ফেলে দাঁড়িয়ে পড়লাম। টাকার গরম সে বড়ই গরম। Eye Of The Tiger.

বিকাল ৩টা ১৯ মিনিট
চুলে নারিকেল তেল গরম করে দিলাম। দেশে থাকতে চুলে তেল দিয়ে গোসল করাতে রীতিমত যুদ্ধ করত মা। এখানে নিজেই দেই। একটি এলাকা এত শুষ্ক হতে পারে সেটা এখানে না থাকলে ও না ভুগলে বোঝা সম্ভব না। ভেজা চুপচুপে জ্যাকেট হ্যাঙারে ঝুলিয়ে দিলে এক রাতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। কি ভয়াবহ! চুলের ব্যাপারে একটি মজার ঘটনা মনে পড়লো। ৪/৫ বছর আগের কাহিনী। আমার নানা তখন প্যারালাইজড — শয্যাশায়ী কিন্তু কথা বলতে পারেন। জ্যৈষ্ঠতার তালিকায় একাদশতম (শেষ সংখ্যা ১৩) সন্তান তুহিন মামা ঘরে আসলেন। দুই বিছানায় আমরা মামা, খালা ভাগ্নে মিলিয়ে অনেকেই বসা। আড্ডা চলছে। তুহিন মামা সম্প্রতি চুলে রঙ করিয়েছেন। রঙটা মরচে পড়া লাল। উনার তামাটে রঙের ত্বকের সাথে মানিয়েছে ভাল। নানার পাশে বসতেই নানা হাত উচিয়ে মামার চুল ধরার চেষ্টা করলেন। ঘুরে তাকাতেই নানা বললেন, “কিরে চুলত ত্যাল দ্যাশ না ক্যারে? মইরচার মত রঙ ধরসে!” শুনে সবাই হেসে দিল। এরপরে নানাকে অনেক সময় নিয়ে বোঝানো হলো চুলে রঙ করা যায়, মানুষ চুলে রঙ করে। বিস্ময়ে হতবাক নানার কুঞ্চিত দৃষ্টি ছিল দেখার মত।

ভোর ৪টা ১০মিনিট, রবিবার, ১২ জানুয়ারি, ২০১৪ – শেষ রাতের অঙ্ক
দম আটকে আসছে। বেশ কয়েকবার ঢোক গিললাম কাজ হচ্ছে না। চারিদিকে আঁকড়ে ধরা অন্ধকার। মুঠোফোন কেঁপে উঠতেই চোখ খুললাম। সময় দেখে বুঝলাম অন্ধকারটুকু স্বপ্ন ছিল তবে আসলেই ঢোক গিলে শান্তি পাচ্ছি না। ঘটনা হলো রাতে খাবার পরে পানি পান করা হয়নি। এদিকে ঘরের হিউমিডিফায়ারও চালানো হয়নি। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ফলাফলঃ ৩ গ্লাস পানি গলা দিয়ে ঢালার পরেও অস্বস্তি কাটছেনা। হিউমিডিফায়ারের পানি ফুরিয়ে গিয়েছে। সেটায় পানি ভরে আবার চালু করলাম। তাপমাত্রা গত ৩/৪ দিন হিমাঙ্কের নিচে যৌবন পার করে চলে যাবার পর আজকে হঠাৎ নবজাতক। ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিচতলায় বাড়িওয়ালার অফিসে। সপ্তাহান্ত দেখে সেখানেও পরিবর্তন আনা হয়নি। ফলাফলঃ থাকার ঘরটি বড়সড় একটি ওভেন হয়ে গিয়েছে। জানালা খুলে দিলাম। গতকয়েক দিনের -৩৩°সেঃ এর পরে আজকের -২°সেঃ এর বাতাস খুবই প্রাণবন্ত ও আরামদায়ক। বুকভরে লম্বা দম নিলাম। নাহ! জীবনযাত্রায় এত যান্ত্রিকতা পোষাচ্ছেনা। দেশে যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

রাত ১২টা ১০ মিনিট, সোমবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৪ – হামারা পাকিস্তান। পেয়ারা পাকিস্তান।
ই-আলুর খবরে দেখলাম হামারা পাকিস্তান ক্রিকেট দল অনুষ্ঠিতব্য এশিয়া কাপ ও টি-২০ বিশ্বকাপে বাঙলাদেশে খেলতে আশার শর্ত সরূপ সার্বক্ষণিক বাঙলাদেশ সেনাবাহিনীর কমান্ডোর নিরাপত্তা চেয়েছে। কপাল ভাল আলু পত্রিকা এটা কাভার স্টরি বানায় নাই। আমি তো ভেবেছিলাম মূল শিরোনাম হিসেবে থাকবে। যাকগে। আলুর কথা বাদ। হামারা পাকিস্তানের কথায় আসি। প্রথমে মনে মনে কষে দুই চারটি গালি দিলাম। হামারা পাকিস্তান এতটাই ভয়ে আছে যে কাপড় জামা ভিজিয়ে ফেলার উপক্রম। মজার ব্যাপার হলো ত্রাস সৃষ্টি করছে তাদের নিষ্পাপ সহকারী কাদের মোল্লার কোমলমতি ছাত্র শিবির ও তাদের ‘সাথীরা!’ ওদের বরং দাবী করা উচিত তাদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ছাত্রশিবিরের ছাত্রদের যেন রাখা হয়।
“এই মোকা খেলার সাথে রাজনীতি মেশাচ্ছ কেন? ছিহ! লোকে মন্দ বলবে।”
আমি (জিভে কামড় দিয়ে, কানে ধরে)- “এই যাচ্ছলে। মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেল বস। আর হবে না। ওরাও তো মানুষ (এর মর্যাদা চায়)”
“আবার বাজে বকছো?”
“আর হবে না। এইযে নাকে খত দিলাম। হামারা পাকিস্তান। পেয়ারা পাকিস্তান। তয় বস কমান্ডো যদি দিতেই হয় সেইখানে কিন্তু কাবযাব টেকাটুকার ধান্দা করন যায়।”
“কিরকম?”
“এই মনে করেন পেয়ারা পাকিস্তান কমান্ডো প্রটেকশান চাইতেছে। যেহেতু স্পেশাল সার্ভিস। তার মানে ভ্যালু এডেড সার্ভিস। কমান্ডো না হয় দিলাম মাগার হামারা পাকিস্তান সরকার কমান্ডো ডেপ্লয়মেন্টের পুরা খরচ দিবে। কি কন?”
“চুপ কর বেয়াদব। মাথায় খালি চিপা বুদ্ধি। ওরা আমাদের অতিথি। ওদের খেদমতে প্রয়োজনে জান দিয়ে দিতে হবে। যেমনটি দিয়েছিলাম একাত্তরে।”
“জ্বী বস। আপনে যেটা বলেন সেটাই।”

পুনশ্চঃ বর্তমান সরকারের মদদপুষ্ট বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেংকারী নিয়ে কিছুদিন আগে একটু রব উঠেছিল। সেটা স্বভাবতই চাপা পড়ে যায়। বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচারের একটা অভিযোগ শুনতে পাচ্ছি ইদানিং। ঘটনা এরকম ঘটে থাকলে আরো লেখা আসা উচিৎ। সত্য উদঘাটন দরকার আছে। জানি সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তা থাকলে সত্য সাধারণত মাটির নিচেই তাকতে ভালবাসে। তবে defense.pk নামক পেয়ারা পাকিস্তানি সাইটে এই নিয়ে মনগড়া লেখা পেয়ে ক্রোধে-আবেগে ফেটে চৌচির হয়ে ফেবুতে শেয়ার দিয়ে নিজের মেরুদন্ডহীনতা প্রমাণ করতে দেখলে তখন ঘুরে ফিরে মনে হয় নয় মাস নয়, নয়টি বছর দরকার ছিল।

সন্ধ্যা ৭টা, মঙ্গলবার, ১৩ জানুয়ারী, ২০১৪ – অপেক্ষা
অপেক্ষায় কখনোই কেন জানি ক্লান্তি আসেনাই আমার। অপেক্ষার মূহুর্তগুলো আমার কাছে অমূল্য। আশেপাশের চলমান জীবনের মাঝে বসে থেকে সবাইকে দেখার মাঝে অদ্ভূত আনন্দ পাই। অপেক্ষা করেছি স্টেশানে, আদালত চত্বরে, এজলাশে, রেস্তোয়ায়, পানশালায়। এখন অপেক্ষা করছি ওয়ালমার্টে। বাসের অপেক্ষায়। খুচরো বাজার করতে গিয়েছিলাম। পিতামাতার কাঁধে চড়ে আসছে চার শিশু। অতিশীপর বৃদ্ধ প্রাণপনে ঠেলছেন শপিং কার্ট কিন্তু অগ্রগতি নগন্য। কিছুটা বিচলিত চোখে অপেক্ষারত কিশোরী মেয়েটা সুন্দর। বোধ করি মার্কিনী নয়। হতে পারে ইউরোপ। চোখাচোখি হতে চোখ এড়িয়ে দ্রুত চলে যায় গত সেমিস্টারের আমার এক ছাত্র। ৭০ জনের মাঝে বেশ কিছু নাম (বেশীরভাগ মেয়ে) মুখস্থ করেছিলাম। মনে হচ্ছে সেই তালিকায় নেই, তবে চেহারা পরিচিত। মায়ের পাশে পাশে চলতে থাকা এক শিশু সোজা চলে এল আমার কাছে। দেখি মুখে হুইসেল টাইপের কিছু। বাজিয়ে শোনানো শুরু করা মাত্রই হতচকিত মা দুঃখ প্রকাশ করতে করতে টানতে টানতে নিয়ে গেল তাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করার সুযোগটা পাওয়া গেলনা। বাসায় এসেছি। মাত্র খেয়াল হলো, একটা মুরগী কিনেছিলাম। সেটা ফেলে এসেছি। আজকে হাল ছেড়ে দিলাম। ভাল লাগছে না। মুরগী গোল্লায় যাক! দেশ বিদেশ যেকোন জায়গায় অপেক্ষার প্রিয় জায়গা হলো বন্দরগুলো। কিছু না কিছু ঘটছেই। বিদায়, মান-অভিমান, দুর্ঘটনা – বেশীর ভাগই ছোট, চোখের পানি, ছুটোছুটি অনেক কিছু। দেশে থাকতে মূল অপেক্ষা করা লাগতো দুটি সময়ে। রবিবার সকালে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশানে নরসিংদী হয়ে কিশোরগঞ্জগামী এগারোসিন্দুর প্রভাতী ট্রেনের অপেক্ষায়। কালে ভদ্রে ঠিক সময়ে (সকাল ৮টা ৩৬মিনিট) আসা এই ট্রেনটি বেশীর ভাগ সময়েই আমাকে বসিয়ে রেখেছে। কপাল খারাপ থাকলে কখনো ১ঘণ্টা। সম্ভাব্য সময় সহকারী স্টেশান মাস্টারের কাছে জিজ্ঞাসা করে সেই আন্দাজে ২-৩টি ধূম্র শলাকা কিনে দাঁড়াতাম কোলাহল থেকে একটু দূরে। আইনজীবি হয়ে পাবলিক প্লেসে ধূমপান করে আইনভঙ্গ করেছি দিনের পর দিন। শলাকায় মৃদু টান পড়তো আর দেখতাম মানুষ। হরেক রকম মানুষ। একই ভাবে বৃহস্পতিবার নরসিংদী স্টেশানে চলতো অপেক্ষার পালা। কখন মৌচাক সদৃশ এগারো সিন্দুর গোধূলী আসবে। সেখানে অবশ্য ধূমপানের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা লাগতো, কারণ প্রচুর সিনিয়ার আইনজীবি বৃহস্পতিবার কোর্ট শেষে ঢাকা যেতেন। সেই সাথে বিভিন্ন আদালতের বিচারকরা তো আছেনই। সামনে পড়ে গেলে ভয়াবহ বেয়াদবি হবে। অপেক্ষাকৃত ছোট আইনজীবি সমিতি হওয়ায় মোটামুটি সবাই মুখ চেনা। অন্তত কে কার জুনিয়ার সেটা সবাই জানতো। তাই বেশ আড়ালে থাকা একটি চায়ের দোকানের নিয়মিত খদ্দের ছিলাম। গিয়ে বসলেই দোকানদার চাচা নিজেই আশেপাশে দেখে একশলাকা এগিয়ে দিয়ে চা বানানো শুরু করতেন। সেখানে বসে শুনতাম চা পান করতে আসা অন্যান্য মানুষের গল্প। স্থানীয় রাজনীতি, চাঞ্চল্যকর ঘটনা, মাঝে দুই একটা দেশ বিষয়ক চিন্তা, ধানের ফলন, ব্যবসায়ীক আলাপ। কালো কোট কালো টাইয়ের সেখানে বেশ সম্মান। অভ্যাস কিংবা বাধ্যতায় যেভাবেই হোক না কেন আলোচনার মাঝে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকা কথার বৈধতা পাবার চেষ্টা। বিমানবন্দরে অপেক্ষার সুযোগ বেশ কয়েকবার হয়েছে বেশ দীর্ঘসময় ধরে এবং সেটার আমেজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে কিছুটা একঘেয়ে। রেলস্টেশানের চেয়ে বেশী ব্যস্ত হওয়া সত্বেও কেন জানি তা চোখে পড়ে না।

দুপুর ১টা ৫০ মিনিট, মঙ্গলবার, ১৪ জানুয়ারী, ২০১৪ – খেলাধুলাঃ আন্তর্জাতিক
আজকে গ্লোবাল ইস্যুজ বিষয়ের প্রথম ক্লাস ছিল। ওয়ার্লড কালচার নামক ৪.০ ক্রেডিট কোর্সের কাটাছেঁড়া ও গবেষণার পর ৩.০ ক্রেডিটের এই কোর্সের নাম রাখা হলো গ্ল‌োবাল ইস্যুজ। আগের বিষয়টিতে সবচেয়ে বড় যেই সমস্যাটি ছিল সেটি হলো শিক্ষকদের পড়ানোর মাঝে অসঙ্গতি। একজন প্রত্নতত্ববিদ, নৃতত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী, ভূগোলবিদের পড়ানোর মাঝে পার্থক্য থাকবেই। তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিতে এই বিশ্ব ভিন্নরকম। বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনারেল এডুকেশানের অন্তর্গত কোর্স হওয়া সত্বেও এই বিষয়টি পড়ানোর ক্ষেত্রে কোন নীতিমালা ছিল না। যে যার মত পড়িয়ে গিয়েছেন। ফলাফলঃ নতুন ছাত্ররা আসার কয়েকদিন পরেই জানতে পারে কোন শিক্ষক কম কড়া, কে প্রচুর পড়তে দেয় ইত্যাদি। তাই লাগাম টেনে ধরে গত তিনচার মাসের ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং ও চিন্তাভাবনার পর গ্লোবাল ইস্যুজ বিষয়টির যাত্রা শুরু হয় গত সেমিস্টারে। প্রতি সেমিস্টারে চলা ৮টি সেকশানের প্রায় সবকিছু এখন এক। পরীক্ষা পদ্ধতি, গ্রেডিং। এমন কি পড়ানোর বিষয়। কারণ এই একটি বিষয় যারা পড়াচ্ছেন তারা প্রতি সেমিস্টার শুরু হবার আগে তো অবশ্যই, সেমিস্টারের মাঝেও একবার করে মিটিং করে আলোচনা করছেন যে কে কি পড়াবেন। এইবারের শিক্ষকের নাম ক্যারী হেনকুইনেট (Kari Henquinet) পূর্বপুরুষ সম্ভবত ফরাসী ও বেলজিয়ান মিশ্রণ। কথার মাঝে আমরা দুই টিচিং এ্যাসিস্ট্যান্ট নিজেদের পরিচয় দেয়ার সুযোগ পেলাম। নাম পরিচয় দেশ বলার পরে সবসময় নিজের আইনজীবি পরিচয়টা দিতে আমি ভালবাসি। এইদেশে আইনজীবি পরিচয় দিলে মানুষজন চমকে যায়। ৯০ জন ছাত্রের মাঝে বেশ অনেক জোড়া অন্যমনষ্ক ছোখ দেখলাম ঘুরে আমার দিকে তাকালো।

লাইব্রেরীতে বসে আছি গত দেড় ঘন্টা ধরে। টুকিটাকি দেশের খবর পড়ছিলাম। বাঙলাদেশের নতুন সরকারের সাথে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত, রাশিয়া এবং চায়না। শেষ দেশটি চমকে দেবার মত হলেও আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও মূল্লুক দখলের খেলা যদি আমলে নেই তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার আদরের ছোট ভাই ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তীব্র সমালোচনার পর সাইনো-বাঙলা সম্পর্ক অটুট রাখতে চীনা প্রধানমন্ত্রীর বাঙলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করাটা খুব একটা চমকে দেবার বিষয় নয়। নাহ নিজেকে দাবার ঘুঁটি ভেবে মন খারাপ করছি না। বরং উপভোগ করছি প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচনের মাধ্যমে পুনরায় সরকার গঠনের পরেও সেদিকে আঙুল না তুলে বরং সেটাকে ঘিরে বাঙলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ হয় উঠাকে। তবে আন্তর্জাতিক খেলাধুলা হিসাবে এশিয়া কাপ ও টি২০ বিশ্বকাপ নিয়ে চিন্তিত আমি। ছোট একটি দুর্ঘটনা ঘটলে পালটে যেতে পারে বাঙলাদেশের ক্রিকেটের বহমান ধারা। ভয়টা সেখানেই, নিজের নাক কেটে পরের (পড়ুন ‘নিজের’) যাত্রা ভঙ্গ করতে ওস্তাদ আমরা। নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদরের মাঝেও শিবিরের কোমলমতি সাথীরা দূরে কোথাও কিন্তু শ্রবণসীমা ও মিডিয়ার সামনে দু-চারটে ককটেল ও পেট্রোল বোমার বিস্ফোরন ঘটাতে পারলেই কিন্তু সব শেষ। ভয়টা ওখানেই।

২,২৭৩ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ৫”

  1. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    বাঙলাদেশের নতুন সরকারের সাথে পূর্ণ উদ্যমে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত, রাশিয়া এবং চায়না।

    :-B


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      তোমার দিনলিপি আরো বেশী লেখা উচিৎ। রিফ্লেকশানের সুযোগ আরো বেশী। আমি তো হাবিজাবি একটা কিছু লিখে পাতা ভরায় ফালাই। তবে দিনলিপি লেখার সবচাইতে কার্যকরী পন্থা হইলো। যখন যেই ভাবনা মাথায় আসতেসে, নগদে লেখতে হবে যদি না ক্লাশ কিংবা ট্রেইনিং এ থাকো। আমি মোবাইলে এভারনোট ব্যবহার করি। মাথায় কিছু আইলেই মারো এন্ট্রি।


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    দিনলিপি (জয়, জিন্দাবাদ, দীর্ঘজীবী, চিরজীবী হউক ইত্যাদি, ইত্যাদি)


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. নূপুর কান্তি দাশ (৮৪-৯০)

    পড়েছিলাম আগেই, তবে টুকরো টুকরো ভাবে।
    মাঝে মধ্যে আমি এসব জিনিস মন খারাপের সময়ে জন্যে রেখে দেই -- এসব রসদ বেশ কাজে দ্যায় তখন।
    সুশীল আর অরাজনৈতিক হবার ইচ্ছে কেন হল হঠাৎ? অবশ্য মাঝে মাঝে ভিন্নতার খাতিরে পদক্ষেপটা ভালো।
    এবারে শীতটাও পড়েছে জাঁকিয়ে। হেসেখেলে -২০ সেলসিয়াস নেমে যাচ্ছে।
    দেশের জন্যে আর মন খারাপ করেনা - বরফের নীচে হারিয়ে গেছে, গ্রীষ্মকালে যদি ফিরে পাওয়া যায়।

    জবাব দিন
  4. মোকাব্বির (৯৮-০৪)

    রাজনীতি কোন ছেলেখেলা নয়। politics is not a playboy তাই ভাবলাম আগে বুড়ো হই তারপরে খেলা যাবে। আসল কথা হলো গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাতে চাই। রাজনীতিবিদদের ঘৃণা করুন রাজনীতিকে নয় - এই মূলনীতিতে বিশ্বাসী হয়েও মাঝে মাঝে বালুর মাঝে মুখ লুকিয়ে উটপাখি হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছা করে!


    \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
    অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

    জবাব দিন
  5. তাওসীফ হামীম (০২-০৬)

    মোকা ভাই ঘুম সহায়ক ট্রাকগুলো একটু সেন্ড দিয়েন তো ফেবুতে। সামনে ছুটির দিন আসছে।
    আর লেখা তো সব সময়ের মতো এ ক্লাস। 🙂


    চাঁদ ও আকাশের মতো আমরাও মিশে গিয়েছিলাম সবুজ গহীন অরণ্যে।

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোস্তাফিজ (১৯৮৩-১৯৮৯)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।