পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ২

বিকাল ৩টা ২৬ মিনিট। মঙ্গলবার। ডিসেম্বর ১০, ২০১৩।

রাতে ঘুমানোর আগে দেখেছিলাম কাদের মোল্লা ফাঁসিতে ঝুলে যাচ্ছে। যতটুকু বুঝলাম সকালে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে সুসংবাদটি পেয়ে যাব। সকালে ঘুম থেকে উঠলাম দেখলাম বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় ঝুলে যাবে। হঠাৎ কেন জানি মনে হলো সবকিছু ঠিক মত হবে না। গত কয়েকদিন ধরে প্রচুর তুষারপাত হচ্ছে। লেক ইফেক্ট স্নো বলে সবাই এখানে। অপেক্ষাকৃত তাপমাত্রা কম কিন্তু তুষারপাত বেশী। আকাশ পরিষ্কার। বেশ উজ্জল চাঁদের মত একটা সূর্যও দেখলাম আকাশে। চারিদিকে সবকিছু বরফে ঢেকে সাদা। মচমচে শব্দ করে হাটঁছি। হঠাৎ আবার মাথায় এলো, বাংলাদেশ কি পারবে ঐতিহাসিক ভাবে এভাবে সাদা হয়ে যেতে? এতদূর থেকে দেশের অরাজক অবস্থা কতটা অরাজক তা বোঝার উপায় নেই। রাজিব ভাই (বকক) একবার বলেছিলেন বাঙলার মানুষ মাঠে নামবে না। প্রতিবাদ করবে না। জিজ্ঞাসা করেছিলাম ৭১ যুদ্ধ করেছে কিভাবে? হুজুগে? উত্তরটা কি দিয়েছিলেন মনে নাই, কিন্তু আমার এখন মনে হয়, দেশটা পেয়েছি হুজুগে। বন্দুকের ঘোড়া টিপে ধরলে, গ্রেনেডটা ছুড়ে মারলে, ঐ চারজন মুক্তিবাহিনীকে আজকে রাতটা লুকিয়ে রাখলে একটা মানচিত্র পাব, দেশটা স্বাধীন হবে, এটা বোঝার ক্ষমতা কয়জনের ছিল? বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন ৭ই মার্চের, সেই স্বাধীনতার ডাকের সাথে বাঙালী কতটা জোড়ালো ভাবে সাড়া দিয়েছিল? মনে থেকে? হুমড়ি খেয়ে জমিয়ে রাখা বরফের মাঝে পড়ে গেলাম। চিন্তার মাঝে খেয়ালই করিনি কোনদিকে কিভাবে হাঁটছি। উঠে দাড়িয়ে বরফ ঝেড়ে ফেলে দিলাম। এখন শুকনো বরফ পড়া শুরু হয়েছে। বালির সাথে তাপমাত্রা বাদে আর কোন পার্থক্য নেই। অফিসে এসে চলে যেতে হয়েছিল কলিগ জয়েশ বর্দির (ভারত)থিসিস ডিফেন্সে। আমারটিও এগিয়ে আসছে। তাই অভিজ্ঞতা অর্জন করছি ডিফেন্ড করতে কেমন লাগে ইত্যাদি। শেষ করে দৌড়ে অফিসে এলাম, কিন্তু মনে চাপা একটা ভয়। “কিছু একটা গন্ডগোল লাগবেই।” ল্যাপটপ খুলতেই মন খারাপ হয়ে গেল। মৃত্যুদন্ডাদেশ চেম্বার জজের কাছে আবেদন করে বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। কালকে একটি পেপার জমা দেয়ার শেষ তারিখ। মন খারাপ রাগে উন্নিত হবার আগেই বন্ধ করে দিলাম ফেইসবুক ও পত্রিকার অন্যান্য ট্যাবগুলো। পারছি না, বাঙলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারছি না। খুব মন খারাপ। উদ্ভট এক দেশের মানুষ আমরা।

বিকাল ৪টা বৃহস্পতিবার। ডিসেম্বর ১২, ২০১৩।

গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় ঘুমিয়ে সকালে ৬টায় উঠলাম। কিছু বুঝলাম না, কি হলো কিভাবে হলো। ফেবুতে উঁকি দিতেই চোখমুখ হ্যাজাক বাতির মত জ্বলে উঠলো। কষাই লটকে যাচ্ছে তাহলে? সকালের নাস্তা খেয়ে আবার ঘুমিয়েছি। সোয়া এগারোটার দিকে উঠতেই দেখি লটকে গিয়েছে বাঙলাদেশ স্থানীয় সময় রাত দশটায়। হুংকার ও চিৎকারের মাঝামাঝি কিছু একটা দিয়ে উঠলাম। তারপরে কফি বানাতে চলে গেলাম। পড়াশোনার গুষ্টি কিলাই। দুদিন আগে ফেবুতে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, “রূঢ সত্য হলো, টিকিটাও ছুঁতে পারবে না। বরং বাড়ি যাও।” কাপুরুষের মত সেই স্ট্যাটাসটা ডিলিট করার প্রচন্ড ইচ্ছা দমিয়ে ভাবলাম, যা আসার আসুক। ভয় পাবার কিছু নেই। আমি কে তা আমি জানি। বন্ধু সজীব বললো “মুড়ি খেতে।” ছোটভাই জিহাদও জানান দিয়ে গেল যে সে মনে রেখেছিল। কিছু মনে করিনি কিন্তু গায়ে বিঁধছিল কথাগুলো। গত দুইবছর এই সাড়ে সাত হাজার মাইল দূরে থেকে অনেক সুযোগ হারিয়েছি। সেই সময়কার উত্তাল শাহবাগে বন্ধুবান্ধবের ছবি দেখলে হতাশ লাগে। বড়জোর বাঁশের কেল্লা টাইপের ফটোশপ করে ছবি বানানো যাবে কিন্তু সেই একাত্মতা, সেই দৃপ্ত স্বরে স্লোগান? কত সহজে জনতার দাবীকে নাস্তিকতার ধোয়ায় আর রাজনৈতিক কালি মাখিয়ে দূরে ঠেলে দিল। বিদেশে থাকলে এই ভেড়ার পালে গা ভাসানো খুব সহজ। গত পরশু আবারো যখন কষাই কাদেরের ফাঁসির আদেশ ১০ ঘন্টার জন্য থমকে গেল তখন আসলেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। এক্স-ক্যাডেট ডিবেট ফোরাম নামক গ্রুপে দেখলাম কেউ একজন চেম্বার জজ সায়েদ মাহমুদুল হোসেনকে তুলোধুনো করছেন। আইনের বিভিন্ন সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা গুলো এখনো জনসাধারণের জানার সীমার বাইরে — এই ক্রান্তিলগ্নে এসে ব্যাপারটা আবারো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। চেম্বার জজ, বাসাবাড়িতে বসে থাকা কোন জজ নন। অবকাশকালীন সময়ে পুরো কোর্ট অবকাশে যায় না। নিজেদের ছুটি ভাগ করে নিয়ে স্বল্প সংখ্যক জজ স্বল্প পরিসরে এজলাসে বসে থাকেন আবার নিজের চেম্বারে বসেও কিছু বিষয় শুনে থাকেন। সুপ্রিম কোর্ট আপীল বিভাগের জজদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিশদ ভাবে দ্য সুপ্রীম কোর্ট অফ বাঙলাদেশ (আপীলেট ডিভিশান) রুলস, ১৯৮৮ এতে বলা আছে। খবরে আরো দেখলাম সংবাদ মাধ্যমকে বিচারবিভাগ সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশের আগে সতর্ক হতে অনুরোধ করেছেন প্রধান বিচারপতি। খুবই যৌক্তিক একটি অনুরোধ। কারণ পাঠক কিন্তু আমরা, সাধারণ মানুষ। চেম্বারে বৈঠক, চেম্বারে শুনানী এই দুটো কথার মাঝে আকাশপাতাল তফাৎ এবং এর যথেচ্ছ ব্যবহারে ভয়াবহ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে। আপাদত থিসিস প্রপোজাল লেখায় ফেরত যাই। এডভাইজার প্রচন্ড চটে আছেন। আগামীকাল কিছু একটা দিতেই হবে।

সন্ধা ৭টা ৩০ মিনিট। শুক্রবার। ডিসেম্বর ১৩, ২০১৩।

মেজাজ যাচ্ছেতাই পর্যায়ের খিচড়ে গিয়েছিল গতকাল। নিজের বন্ধু তালিকা চেষ্টা করি ছাগুমুক্ত রাখতে। হয় ব্লক নাহয় আনফলো। যাতে ফীড নোংরা না হয়। চিপা দিয়ে ডিপার্টমেন্টের একবড় ভাইয়ের স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। পিএইচডি করছেন বাঙলাদেশের শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রির উপর। পঞ্চাশের দশকের মিশরের সাথে তুলনা করে যা বললেন তা অনেকটা এরকম, ‘হাসানুল বান্না, কাদের মোল্লাদের রক্ত বৃথা যাবে না। মুর্সিরা প্রস্তুত হচ্ছে। হান্টিংটন ও ফুকুয়ামার থিওরী একদিন ঠিকই সত্য হবে।’ কথাগুলো পড়ে হাত কাঁপা শুরু হয়েছিল রাগে। চমৎকার, মিশিগান টেকনোলোজিকাল ইউনিভার্সিটি আরেকজন উৎকৃষ্ট মানের জ্ঞানপাপী তৈরী করছে। ইহুদি-নাসারাদের দেশে ওদের টাকায় বেতনে পড়ে মুসলিম ব্রাদারহুডের স্বপ্ন দেখতে গিয়ে এক মূহুর্তের জন্য কি চিন্তা করে না যে এত বড় ভন্ডামী আর দ্বৈতসত্বা বিরাজ করছে আমার মাঝে? খোদাভিরু এই মানুষটার কাছে খোদা কি এই চায়? উত্তর জানা নেই তবে আপাদত প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। ব্যক্তিগত আক্রোশ প্রকাশ পেয়ে গেল কিন্তু এই লোক দেশে ফেরত গেলে বিপদ।

আজব এক জায়গা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বিজ্ঞাপনের খাতিরে ওদের কম্পানিগুলো যে পরিমাণ খরচ করে থাকে তার সাথে বিশ্বের কোন দেশ পাল্লা দিয়ে পারবে বলে আমার মনে হয় না। বাসার ঠিকানা বরাবর ক্রেডিট কার্ডের অফার লেটার, এলাকার বাজারের নতুন মূল্য হ্রাস, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, ইত্যাদি নানাবিধ চিঠি পত্র আসতেই থাকে। মুঠোফোনে টেলিমার্কেটিং এর কথা নাহয় আর নাই বা বললাম। “ডোন্ট রিসিভ” নামক নম্বর তালিকা ১০ ছাড়িয়েছে বহুদিন। বিশেষ করে উৎসবের আশেপাশের সময়গুলোতে মাথা খারাপ করে ফেলবে। প্রতিদিন দেশ থেকে চিঠি আসবে এই আসায় উঁকি দেই সিড়ি ঘরে। নতুন বিজ্ঞাপনের কাগজের স্তুপ পড়ে থাকতে দেখি। দেশে থাকলে এই কাগজ বেচে বড়লোক হয়ে যেতাম নিশ্চিত।

সেমিস্টারের শেষ ক্লাশ ছিল আজকে। আগামী সপ্তাহ পরীক্ষা সপ্তাহ। তারপরে ছুটি শুরু হয়ে যাবে। যদিও আমার নিস্তার নেই। ছোটখাট মজার কাহিনীর একটি ছিল ক্লাশে চেলসির (আমার টিএ প্রফেসর) সমাপনী ভাষণ। সবকিছু শেষ করার আগে বলে উঠলো, ‘those who have been noticing that the mid section of my body is increasing everyday…its not a beer-belly or I’m not eating too much. Yes, I am pregnant and hopefully if everything goes well, we will have a baby by the end of March.’ পুরো ক্লাশ কনগ্র্যাচুলেশান বলে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো। মেয়ে হবে তার। দ্বিতীয় মজার কাহিনী একই দিনে কিন্তু উনাকে নিয়ে। ক্যাম্পাসে দেখা হলো ডিপার্টমেন্টের লিবিয়ান বন্ধু হামজার সাথে। কথা প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো, ‘মোকা তোমার টিএ প্রফেসরের নামকি?’ বললাম, ‘চেলসি শেলী।’ বলল‌, ‘বুঝি নাই। চালসি,চ্যালসি?’ সাদা বোর্ডে মার্কার দিয়ে লিখলাম, ‘Chelsea F.C’ বললাম ‘কিভাবে উচ্চারণ কর?’ মুখে হাসি খেলে উঠলো হামজার, ‘ওও আচ্ছা ফুটবল ক্লাব চেলসি। তাই বলো।’ চেলসিকে পরের দিন এই কথা বলার পরে সে জানালো তানজানিয়ার ভেতরের দিকের এক গ্রামে গবেষণার কাজে যখন গিয়েছিল, ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে কথা চালানোর মাঝে ওর নাম শোনা মাত্রই শুদ্ধ উচ্চারণে ওরা নাকি বলে উঠেছিল, “Chelsea, the football club!?” ফুটবল শুধু খেলা নয়, এটি যোগাযোগের মাধ্যম। ডিপার্টমেন্টের আরেক প্রফেসর ডঃ রেবেকা গ্রাফও অন্তঃসত্বা। অন্তঃসত্বা শব্দটি লিখতে গিয়ে মনে হলো, আমি এতদিন সন্তান-সম্ভবা ও অন্তঃসত্বা শব্দ দুটোকে প্রায় সমার্থক ভাবতাম। মনে হয় সেটা ভুল। সন্তান-সম্ভবা তিনি যিনি শীঘ্রই সন্তান কামনা করছেন। ভুল বললাম নাকি?

খুচরো বাজার করতে ওয়ালমার্ট যাচ্ছিলাম বিকালে। গাড়িতে তুর্কী বন্ধু উৎকুর সাথে দেখা। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো বাঙলাদেশে কি হচ্ছে? তোমরা নাকি কোন ইসলামি নেতাকে মেরে ফেলেছ? বললাম নাহ। যেই দলটিকে ইসলামী দল বলে চালানো হচ্ছে ওরা ধর্ম বেচে খায়। আর এই লোক ওয়ার ক্রিমিনাল — বলতেই থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানকে তোমাদের দেশের যারা সাহায্য করেছিল এ তাদের একজন নাকি?’ যতটুকু ধারণা করেছিলাম খুতবা দেয়া লাগবে, সেটা ‘হুম’ বলেই কাজ হয়ে গেল। ছোটভাই হুমায়ুন বলেছিল তুর্কি দুই ধরনের জনগণ আছে, কট্টরপন্থী শিবির-জামাতির তুর্কি সংষ্করণ ও ধর্ম-নিরপেক্ষ উদারপন্থী। যতটুকু বুঝলাম উৎকু দ্বিতীয় দলের।

পৃথিবীর সার্বজনীন সুন্দর ব্যাপার গুলোর মধ্যে একটি হলো ছোট শিশু। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়ানো বা মায়ের বহনকৃত ঝাঁপির মাঝে প্রায় সাড়া-শব্দহীন উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকা নবজাতক, অন্যরকম এক সৌন্দর্য্য। ছোট মামাতো ও ফুপাতো ভাই-বোন গুলো এই দুই বছরে হয়তো বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। বয়স বাড়ছে। ছোট শিশু দেখলে চেয়ে থাকি। পিতা পিতা ভাব, সন্তানের অভাব। শীতকালীন এক ছোট মাছ আবিষ্কার করেছি। নাম স্মেল্ট। দেখতে টেংরা ও গুত্তুম (ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক নাম বললাম) মাছের মিশেল। খেতে মলার মত। ভেজে দোপেয়াজা রান্না করলে থালার পর থালা ভাত সাবাড় করা সম্ভব। করেছিও গত এক সপ্তাহ ধরে। সেই উৎসাহে দ্বিতীয় চালান কিনতে এলাম। মার্কিনিরা কালে ভদ্রে এই মাছ খেয়ে থাকে। অন্যান্য রাঘব-বোয়ালদের (আক্ষরিক অর্থে) মত ওর এত চাহিদা নাই।

শেষ পর্যায়ে এসে প্রায় সময়ই হতাশ হয়ে পড়ছি। এতদিন যাবত পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে মানুষজন কিভাবে থাকে জানি না। আমার পক্ষে এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। গত কয়েকদিন আগে বড় ভাই কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘দেশে ফেরত যাচ্ছিস ভাল কথা, বেশী আশা নিয়ে যাইস না। দুঃখ পাবি।’ শুনে মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিছু বলিনি। নিজে সবসময় সবাইকে যেই কথাটা বলি, “প্রত্যেকটা মানুষ ভিন্ন, তার চারপাশের পারিপার্শ্বিকতা ভিন্ন,” নিজের ক্ষেত্রে এই কথা বেমালুম ভুলে বসেই ছিলাম বই খাতা বন্ধ করে ঘন্টাখানেক। ব্যাপারটা কথা প্রসঙ্গে তন্বীই মনে করিয়ে দিল। ফিরে যেতে চাই। ফিরে হয়তো যাব। কোন কিছু দেবার আশায় নয়। আমি অথর্ব নাগরিক। বরং ঐ ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের আনাচে কানাচে আমার অনেক কিছু পাবার আছে। সেটার মর্ম শুধু আমি বুঝি।

বিকাল ৩টা ৩১ মিনিট। রবিবার। ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩
বিপুল উদ্যমে দৌঁড়াচ্ছি। সেমিস্টারের শেষে ডেডলাইন ধরার আরো একটি প্রচেষ্টা। এবার আরো একটু খারাপ অবস্থা। প্রতিবার চিন্তা করি এবার আর বসে থাকা নয়। প্রথম থেকেই পড়াশোনায় কোপ হবে। কিন্তু হয়ে উঠে না। এই ব্যাপারটা সার্বজনীন। অন্তত মার্কিনি ছাত্রছাত্রী ও তাদের শিক্ষকরা পর্যন্ত এই অভিযোগ নিয়মিত করে থাকেন। আগামীকাল বিজয় দিবস কিন্তু মন খারাপ হয়ে আছে। দেশের পরিস্থিতি ভাল না। কারো জীবনের নিশ্চয়তা নেই। চারিপাশে মানুষ পুড়ে, বোমার আঘাতে মারা যাচ্ছে। জামাত শিবিরের সংগঠিত আক্রমনে সবকিছু ছিন্নভিন্ন। এদিকে ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় সংখ্যাগরিষ্ঠের উপরের সংখ্যক আসন। বারো রকম মানুষ বলছে চব্বিশ রকমের কথা। নৃশংস রাজাকার কষাই কাদেরের ফাঁসি নিয়ে তরুন সমাজ বিভক্ত। নাহ, তাদের পরিবারের কেউ চোখের সামনে বেয়নেটের খোঁচা খায়নি। তাদের চোখের সামনে মাকে ধর্ষন করেনি। বাবাকে জবাই করেনি। বাঙালী বড় অদ্ভূত জাতি। নিজের ঘাড়ে কোপ না পড়লে বোবা গরু। এছাড়া আমি দোষ দিব আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে। যারা যুদ্ধ দেখেছেন, যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুভব করেছেন, তারা এগিয়ে আসেননি এদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে কি হয়েছিল। এদের কিছু ছিলেন সম্পূর্ণ বোবা গরু আর বাকিরা ব্যস্ত ছিলেন আখের গোছাতে। ফলাফল, চোখের সামনে। প্রশ্ন তুলছি মুক্তিযু্দ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, প্রশ্ন তুলছি রাজাকার, আল-বদরদের ভূমিকা নিয়ে। মাঝে সুযোগ পেয়ে আজ বিষধর গোখরা হলো জামাত-শিবির। নির্বাচন হোক আর না হোক, প্রস্তুতি চলছে। কাকার ইলেকশান ডিউটি পরেছে পাবনায়। এ নিয়ে রীতিমত চিন্তায় পড়ে গিয়েছে সবাই। অবশেষে এমন এক বাঙলাদেশ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি যেখানে রাস্তায় বের হলে চিন্তা করা লাগে, “আজকে বেঁচে ফিরলেই হয়।” সবকিছু ঝেড়ে ফেলে তাও স্বপ্ন দেখতে চাই সুন্দর একটি বাঙলাদেশের। জানি না কবে পাব। তবে আশা রইল। মুক্তির সংগ্রামে বিজয় আমাদের হবেই। জয় বাঙলা!

১,৫২৫ বার দেখা হয়েছে

১৮ টি মন্তব্য : “পুরোনো পাতায়ঃ বরফের দেশের গল্প ২”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    এত বস ভাবে ক্যামনে লেখেন ভাই। দিনলিপিও এত গুছায়া লেখা হয়??
    যত যাই হোক, পড়াশোনা শেষ করে দেশে চলে আসেন। আজীবন বিদেশে পড়ে থাকবেন নাকি?


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      ধন্যবাদ! দেশে আসছি। শেষ করেই দৌড় দিব। সাধারণত দিনের ঘটনা গুলো ড্রাফটে লিখে রাখি। কিছু পরিমার্জন, সংশোধন করে থাকি দেয়ার আগে। আইনী কপচানিটা শুরুতে ছিল না। দেয়ার আগে একটু ঘেঁটে বের করে নিয়েছি! 😛


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. নাফিস (২০০৪-১০)

    আপনি সত্যি কইরা কন তো কলেজে বাংলায় কি সবসময় এ প্লাস পাইতেন নাকি ? 😉
    এরকম গোছানো দিনলিপি খুব কমই পড়েছি। পড়ার সময় মনে হচ্ছিল , ইশ ! আমি যদি এভাবে লিখতে পারতাম ~x( এরকম সুন্দর দিনলিপি টাইপের লেখা বাংলাদেশের অন্য কোনো ব্লগে আসে না ! এগুলো পড়ার জন্যই সবার সিসিবি তে আসা উচিত ! (সম্পাদিত)

    জবাব দিন
  3. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    হাজার বছরে বাঙালির জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ৭১।
    আর সবচেয়ে ডাউন পয়েন্ট ৪৭।

    এই দুইয়ের টানাপোড়েনের কারণে আমরা-আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম ভুগে যাচ্ছি, যাবো।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  4. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

    একটু রাজনীতি কপচাই।
    ৪৭ এর সেক্যুলার ভারতে দেশ চালিয়েছে বিজেপি, আদভানী, বাল ঠাকরে এরা। চালাবে মোদী।
    আমি মোদীর ভাষণ শুনি আর দেখি গান্ধী, আজাদ, নেহেরু কান্দে।
    আমার পরিচিত এক ডাবল মাস্টার্স, ডক্টরেট করা ভারতীয় ছেলে মোদী প্রেমে অন্ধ।
    আর পাকিস্থান তো অলরেডি ব্যার্থ রাষ্ট্র।
    খারাপ শোনাতে পারে কিন্তু আমরা মুটামুটি ঔ ব্যার্থ রাষ্ট্রের সংজ্ঞার ১/২% এর আশেপাশেই রয়েছি আমরা।

    আরো একটু স্পেসিফিকালি বললে উপমহাদেশ বা পুরা সাউথ ইষ্টের রাষ্ট্রসমূহ হচ্ছে ব্যার্থ রাষ্ট্রসমূহের সমাহার।

    অথচ এই এলাকার ক্যাপাবিলিটি ছিলো আরেক আমেরিকা বা ই ইউ হবার।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  5. তাহমিনা শবনম (৮৪-৯০)

    কি যে হচ্ছে এখন আর কি যে হতে যাচ্ছে,জানিনা। আমি সত্যিই জানিনা !
    কোন উন্নত দেশে ইমিগ্রান্ট হবার জন্য কখনো আবেদন করিনি।
    চেয়েছি আমার বাচ্চারাও এখানেই বড় হোক।
    এখনো চাই ।আমি অনেক আশাবাদী একজন মানুষ।

    তুমি এত্ত সুন্দর লেখো কেম্নে !!!


    আমি চোখ মেললুম আকাশে
    জ্বলে উঠলো আলো পূবে পশ্চিমে

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      আমি ছিলাম (কিছুটা আছিও) নৈরাশ্যবাদের ঢেঁকি। তারপরেও মনে হয় পরিবর্তন আসবে। আজ না হোক কাল। দেখে হয়তো নাও যেতে পারি। আর কেউ যাতে দেখে যেতে পারে তার জন্য চেষ্টা করতে দোষ কি? পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপা! :hatsoff:


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  6. টিটো মোস্তাফিজ
    আমি ছিলাম (কিছুটা আছিও) নৈরাশ্যবাদের ঢেঁকি। তারপরেও মনে হয় পরিবর্তন আসবে। আজ না হোক কাল। দেখে হয়তো নাও যেতে পারি। আর কেউ যাতে দেখে যেতে পারে তার জন্য চেষ্টা করতে দোষ কি?

    :gulli2: :gulli2: :gulli2:


    পুরাদস্তুর বাঙ্গাল

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।