২৭ জুন, ২০১৩, রোজ বৃহস্পতিবার, বেলা বারোটা বিশ মিনিট

একটু দেরিতে ঘুমালেও সকাল সাতটায় ঘুম ভেঙে গেল আজকে। বেশ খানিকটা বিয়ার পান করলে এরকম হয় দেখেছি। গতকাল রাতটা ঘুমানোর আগে স্থানীয় বিয়ার প্রস্তুতকারক/পানশালা কিউইনা ব্রিউইং কোম্পানির বিয়ার পান করে কাটিয়েছি। সবাইকে এটাকে কেবিসি বলেই জানে। কমদামে উন্নত মানের বিয়ার প্রস্তুতকারক হিসেবে খুব দ্রুত নাম কামিয়েছে এই কম্পানিটি। যাক মাথা ব্যথা চলে গিয়েছে। গতকাল বৃষ্টিতে ভেজার কারণে বেশ মাথা ধরেছিল। প্রায় দেড় বছর পরে বৃষ্টিতে ভিজলাম। দেশে থাকলে সুযোগ পেলে ছাদে গিয়ে ভিজে নিতাম। চুপচাপ বৃষ্টির মাঝে বসে থাকার মাঝে অন্যরকম এক মাদকতা আছে। অনেক ধরণের শব্দ কানে বাজে। মাটিতে পড়া বৃষ্টির শব্দ, মাথায় পড়া বৃষ্টির শব্দ, হালকা মেঘের গর্জন। সব মিলিয়ে একটা পূর্ণাঙ পরিবেশ। মার্কিনি বৃষ্টি দেশের বৃষ্টির ধারে কাছেও যেতে পারে না। কিন্তু গত ক’দিন ধরেই প্রায় মূষলধারায় বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। এই সুযোগ নেবার লোভ সামলাতে পারলাম না। পকেটে মুঠোফোনের তোয়াক্কা না করে উদাস চিত্তে রওনা দিলাম অফিস থেকে বাসার উদ্দেশ্যে। এখানকার মানুষজন বৃষ্টি দেখলে হয় খুব বিরক্ত হয় অথবা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করে না। উপভোগ করার উদ্দেশ্যে এখানে ভিজে না। রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসার সময় শুনতে পাচ্ছিলাম পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ি থেকে মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছে মানুষজন। বরফের মাঝে অর্ধনগ্ন হয়ে দৌড়ে বেড়ানোর মত পাগলামি এরা দেখে ও করে অভ্যস্ত কিন্তু বৃষ্টিতে ইচ্ছা করে দাঁড়িয়ে ভেজা পাগল দেখে এরা মোটেও অভ্যস্ত নয়। বৃষ্টির পানিতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো। বেশ ভারী বৃষ্টি। অঞ্জনের “ঝাপসা চোখে দেখা এই শহর” কথাটা কি চোখের পানি বুঝিয়েছিল না বৃষ্টির পানি চিন্তা করতে করতে বাসায় এসে পড়লাম। বাসায় এসে ভেজা অবস্থায় হাফ গ্যালনের রিফিলেবল বোতলটা নিয়ে হাঁটা দিয়েছিলাম কেবিসির উদ্দেশ্যে। কাকভেজা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে অনেকে করুণার দৃষ্টি নিয়ে তাকালেও আমার নির্লিপ্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওরা পাগল দেখা মাত্রই বুঝতে পারে। সুন্দরী বারটেন্ডার বোতলটা নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল, “গট ইউ অন দ্য ওয়ে হাহ?” হেসে উত্তর দিলাম, “গট মাইসেলফ ইনটু ইট!” কি বলবে বুঝে পেলোনা। দাম মিটিয়ে দিয়ে আবার বৃষ্টির মাঝে বের হয়ে বাসায় এলাম।

যাই হোক সকালে খাবার মত কিছু পেলাম না। ভার্সিটি এসেই নাস্তা সেরে নিলাম। অফিসে ঢুকেই ফেইসবুক ও সিসিবি। ফেইসবুকে দেখি বেশ কয়েকটা মেসেজ। ফেইসবুক ওয়াল বন্ধ করে এত ঢং করার কি আছে সেটা নিয়ে একটা অভিযোগ আর গোটা কয়েক শুভেচ্ছা। উত্তর দিলাম। কিছুক্ষণ পরেই তুর্কি বন্ধু উৎকু ফোন দিয়ে জানালো ১২ জুলাই রিভার ক্রুজে যাচ্ছে সবাই। টিকেট কিনতে চাইলে যেন লাইব্রেরীর সামনে আসি। বের হয়ে হাটা দিলাম লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে। হঠাত দেখি দূর থেকে কে জানি সিটি দিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখি ওরা সবাই বসে আছে। উৎকু, আসমা, হাইপিং, ইয়েজেরসা, হোয়া, সানাইত্‌স। কাছে যেতে সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সুর করে গাওয়া শুরু করল অতি পরিচিত গান, “হ্যাপি বার্থ-ডে টু ইউ।” লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। এর মাঝে উৎকু পাশের বাগান থেকে (নিষেধ থাকা সত্বেও) ফুল ছিঁড়ে উপহার দিল। হঠাৎ করে ভালই লাগলো। এভাবে সুর করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা আসলে শেষ কবে পেয়েছি মনে নাই। ফেইসবুকের কল্যানে মানুষকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। সেই সাথে বেড়েছে বিড়ম্বনা। কে কে আমার জন্মদিন মনে রাখলো এই সস্তা মানসিকতা নয় বরং ওয়ালে শ-খানেক শুভেচ্ছা বার্তার হামলা ঠেকাতে জন্মদিন বরাবরের মত লুকিয়ে রাখি। সেই সাথে ওয়াল বন্ধও করে রাখি। হয়তো সার্বজনীন একটা স্ট্যাটাস আপডেট করে সবাইকে ধন্যবাদ দিলেই হয়ে যায় কিন্তু আমার সেই ব্যাপারেও এলার্জি। আমি বিশ্বাস করি শুভেচ্ছা জানালে সেটা ব্যক্তিগত ধন্যবাদ পাবার দাবিদার। সেটা করার মত মানসিক ও শারিরীক শক্তি আমার থাকে না। তাই দায়িত্ব এড়াতে সব লুকিয়ে রাখি। ব্যাচের বন্ধুগুলো ফেইসবুক গ্রুপে গালাগালি করে। কিছু বন্ধু/বান্ধবী মেসেজে। আর কিছু ফোন দিয়ে। সবাইকে ঠিক বোঝাতে পারি না কেন এই কাজ করি প্রতিবার।

বাসায় জন্মদিন পালন মানে মা ভাল-মন্দ রান্না করবে। সেটা সবাই মিলে খাব। ছোট একটা কেকও হয়তো আনা হবে। মায়ের হাতে ভাল মন্দ খাওয়াটাই আমার প্রতিবারের মূল আকর্ষণ থাকে। এখানের ঠিক রাত বারোটায় মাকে ফোন করার পর প্রথমেই বলল, “শুভ জন্মদিন।” জোরে হেসে দিলাম। এই আয়রন লেডি শুভ জন্মদিন বলে অভ্যস্ত নয়, আমি শুনে অভ্যস্ত নই। ধন্যবাদ দেয়ার পর মা বললো, “তোমার এবারের জন্মদিন কিন্তু স্পেশাল।” কারণ জিজ্ঞাসা করতে মনে করিয়ে দিল ১৯৮৫ সালের ২৭ জুন ছিল বৃহস্পতিবার। দুপুর ১২টা ২০মিনিটে আমার জন্ম। মনে আছে মা থ্রী-ইডিয়ট্‌সের শেষেরটুক দেখে বলেছিলো, “আরে এটাতো তোমার মত কাহিনী।” জিজ্ঞাসা করলে বলেছিল, ২৭ তারিখ সকালে প্রসব বেদনা উঠার পরে মাকে যশোর সি,এম,এইচে নিয়ে যায়। হঠাৎ আমার হৃদস্পন্দন খুঁজে না পাওয়ায় অফিসে ফোন করে বাবাকে ডেকে নিয়ে আসা হয়, অপারেশান করার অনুমতি পত্রে সই করানোর জন্য। বাবা ও মায়ের ষড়যন্ত্র অনুসারে বাবা অনুমতি পত্র আর আমার বড় ভাইকে নিয়ে অফিসে পালিয়ে যায়। কোন ভাবেই স্ত্রীর পেট কেটে বাচ্চা বের করে আনতে দিবেন না। এদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে এক পর্যায়ে অনুমতি পত্র ছাড়াই মাকে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়। এনেস্থেশিয়া দিতে যাবে এমন সময় বিদ্যুৎ বিভ্রাট। জেনারেটারের ব্যবস্থা ছিলো না। আর ঠিক তখনই আমার স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন আবার ফেরত আসা শুরু করে। তার ঘন্টাখানেক পরেই ১২টা ২০মিনিটে পৃথিবীতে অবতরণ। সেদিনের পর থেকে এই ঘটনা অনেকবার শুনেছি। জিজ্ঞাসা করে করে শুনতে ভাল লাগে। গতকালও আবার শুনলাম। যেহেতু মায়ের হাতে ভালমন্দ খাবার উপায় নেই। এবার জন্মদিন লুকানোতে আরো কড়াকড়ি। আর এখন বলে দিচ্ছি। ব্যাপারনা। দু-চারটা শুভেচ্ছা যদি পাওয়া যায় সামলে নেয়া যাবে। বাসায় এসে ঘরে ঢুকতেই দেখি বেশ বড় বইয়ের আকারের একটা প্যাকেট। আমাজন থেকে এসেছে। খুলে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। বড় ভাইয়ের উপহার। আমার সব সময়ের সবচেয়ে প্রিয় ব্যান্ড গান্‌স এন্ড রোজেস এর গানের স্টাফ নোটেশান সমগ্র। এই ধরণের বই গুলোর পিডিএফ ভার্সন আমার কাছে আছে কিন্তু রঙীন মলাটে বাধাই করা দামি কাগজের বই এর সখ আমার বহুদিনের। ভার্সিটির প্রথম বর্ষে কাউসার ভাই নামের এক বড় ভাইয়ের কাছে গীটার শেখার সময় এধরনের বই দেখেছিলাম। উলটে পালটে দেখতে দেখতে অনেক্ষণ আনমনে হেসে ভাইয়াকে ফোন করে ধন্যবাদ দিলাম। এই মানুষটা যতটা না বড় ভাই তারচেয়ে বেশী কাছের বন্ধুর মত। কোন সুতোয় টান দিলে আমার গোমড়া মুখের দুপাটি দাঁত বের হয়ে আসবে তা নিশ্চিত ভাবে জানে।

৩,১৮০ বার দেখা হয়েছে

৩৮ টি মন্তব্য : “২৭ জুন, ২০১৩, রোজ বৃহস্পতিবার, বেলা বারোটা বিশ মিনিট”

  1. রকিব (০১-০৭)

    শুভ জন্মদিন ভাই। বয়স বাড়তেছে তাহলে :grr:
    এক কালে সিসিবিতে জন্মদিন প্রিফেক্ট ছিলেন একজন- :just: মাস্ফ্যুদা; লোকটা অবশ্য আজকাল এমুখো হবার সময় পান না। নীল-খাকি ইউনিফর্মে আইন রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালনে ব্যস্ত।
    যাউজ্ঞা। আমার তরফ থেকে একটা স্টেক কিনে খেয়ে নিয়েন।


    আমি তবু বলি:
    এখনো যে কটা দিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি ..

    জবাব দিন
  2. রেজা শাওন (০১-০৭)

    শুভ জন্মদিন প্রিয় মোকাব্বির ভাই। দেশে ফেরেন, বিয়ে করেন- আপাতত এর চেয়ে কাজের শুভ কামনা আর কি'ই বা হতে পারে? সেটাই করলাম।

    অনাগত দিন চমৎকার কাটুক ভাই।

    পুনশ্চঃ যদি আমার মোটিভেশন লেটার'টা একটু ঠিকঠাক করে দিতেন, খুব ভাল হত।

    জবাব দিন
  3. মনজুর (৮৯-৯৫)

    বয়সে বড় হওয়ার সুযোগে একটু জ্ঞান দেই 😛
    মানুষ তোমাকে ব্যাপক ভালোবাসে, সেটা তুমিও জানও। ভালবাসাটা কখনো কখনো অত্যাচারের পর্যায়ে চলে যায়- সেটা সত্যি, তারপরও তা অমূল্য- সবার ভাগ্যে এটা জোটে না। সো টেইক ইট 🙂
    লেখা পড়তে ভালও লাগছে। :thumbup: :thumbup:

    জবাব দিন
  4. কাইয়ূম (১৯৯২-১৯৯৮)

    আগামী বছরের জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিলাম মোকাব্বির। 😛
    তোমার লেখা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। সিসিবিতে নিয়মিত লিখছো দেখে ভালো লাগলো, আশা করি কন্টিনিউ করে যাবা। :clap:


    সংসারে প্রবল বৈরাগ্য!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।