দৌড়…

১৭ জুন ছিল ৩৬ মির্জাপুরের তথা ইনটেক ১৯৯৮ এর জন্মদিন। ফেইসবুকে আড্ডার মাঝে অনেক স্মৃতিচারণ করা হয়েছে গতকাল। মাহমুদের (১৯২১) অনেক স্মৃতি খুব বিশদ ভাবে মনে থাকে। হয়তো বাকিদেরও মনে থাকে কিন্তু সবাই সব সময় মুখ খুলে না। মাহমুদ সুযোগ পেলেই পুরনো স্মৃতি নিয়ে ঘেঁটে বেড়ায়। কিছু স্মৃতি রোমন্থনের আশায় সবার পোস্ট ও স্ট্যাটাস ঘেঁটে দেখছিলাম। শাহরিয়ারের স্ট্যাটাসটা পড়ে ভালো লাগলো। অনেক কথা অনেক সময় গুছিয়ে বলা হয় না। ভাবনা আর কলমের মাঝে বন্ধুত্ব বরাবরের মত কিছুটা শীতল। ভুলেই গিয়েছিলাম সেই বিখ্যাত ফুটবল ম্যাচের কথা। সত্যি কথা বলতে কোন ক্লাসের কাহিনী এখনো সেটা মনে নেই। মাহমুদ মনে করিয়ে দিল সেই আন্তঃ হাউজ প্রতিযোগিতায় আন্ডার -ডগ নজরুল হাউজের উত্থান। রাজীব এর কথায় মনে পড়লো শেষ মিনিটে আন্দালিবের সেই যুগান্তকারী গোলে ড্র হল সোহরাওয়ার্দি হাউজের সাথে। সাইডলাইনে উৎকণ্ঠার সাথে বসে থেকে গোল হবার পর যখন বাঁশি ও দিয়ে ফেললো তখনো হতহম্ভ হয়ে বসে ছিলাম।

খেলাধুলায় দুর্বল আমি অনেক কষ্টে বাস্কেটবলের অ-আ-ক-খ শিখেছিলাম আল-আমিন ভাইয়ের (৩২মকক) কাছে। সেখান থেকে উন্নতি বেশী একটা হয়নি। গেমস টাইমটা পার করার মত খেলা জানতাম। মাঝে মধ্যে ভলিবল গ্রাউন্ডে গিয়ে চলতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কোক বাজি ধরা ম্যাচ ভণ্ডুল করার অপচেষ্টা করতাম আর গণধোলাই দেয়ার আগেই জুনিয়র বেল দিলে হাউজে দৌড়। হঠাৎ চিন্তা করে দেখলাম কবে কিভাবে এথলেটিক্সের সাথে জড়িয়েছি মনে করতে পারছি না। আমাদের ব্যাচের নজরুল হাউজের দৌড়ঝাঁপ দল শুরু থেকেই দুর্বল প্রজাতির। আমার মনে হয় ৪০০, ৮০০, ১৫০০, ৩০০০ মিটার গুলোতে হাসানুজ্জামান ছাড়া আর বাকিরা “অংশগ্রহণই মূল কথা” নীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম।

১০০ ও ২০০ মিটারে ছিলাম আমি আর তাওহীদ। হাঁপানির রোগে ভোগা আমার দৌড়বিদ হওয়াটা এখনো আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তাওহীদ ভালো দৌড়াতো। আমার সন্দেহ হয় সে ছেড়ে দিত আমাকে। ৪র্থ থেকে ৫ম বা ৬ষ্ঠ হওয়া তেমন কিছু না তারপরেও মনে হয় সে কাজটা করতো। নজরুল হাউজের বাকি উদীয়মান ঊসাইন বোল্টেরা যে আসলে আমাদের মতই টানটান ধনুকের ছিলায় বসানো তাল পাতার তীর ছিল সেটা নিশ্চিত ভাবে বলে দেয়া যায়। দৌড়ের রাজত্বে রাজা ছিলো সোহরাওয়ার্দী হাউজ। মাহমুদ, ওয়ালিউল্লাহ, শফিকুল্লাহ, আমিন এদের কাছে কোন কিছুতে পাত্তা পেতাম না। বড় ভাইরা নামও দিয়েছিল “জংলী গ্রুপ।” সৌভাগ্যবশত জুনিয়ার গ্রুপ লিডিং এ থাকাকালীন ২০০ মিটার দৌড়ের ফিনিশিং লাইনের ১০ মিটার আগে আমিনের অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস আমাকে এনে দিয়েছিল কলেজ জীবনের প্রথম ও শেষ মেডেল। সোহরাওয়ার্দী হাউজের তাবুর পাশের কাঁঠাল গাছের নিচে বসে কাঁদতে থাকা আমিনকে দেখার পর থেকে অজানা এক অপরাধবোধ তাড়া করেছে বহু বছর। সম্ভবত ইন্টারমিডিয়েট গ্রুপের লিডিং এ দৌড়ের জগতে নতুন হুমকি সৃষ্টিতে এবং আমার ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ হবার ব্যবস্থা পাকা করতে ফজলুল হক হাউজের ইমরান এর আবির্ভাব। ১০০ মিটারে মাহমুদের নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী ইমরান বাকি বছর গুলো কাটিয়েছে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবেই। ফেইসবুকে মাহমুদ জানালো, কলেজ লিডিং এ নিজের হাউজের সাকিফের (৩৭মকক) কাছে হার মানতে হয় দুর্ধর্ষ এই দৌড়বিদের।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফলস্‌ স্টার্ট মানে তোমার আর না দৌঁড়ালেও চলবে। কিন্তু কলেজের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। এডজুট্যান্ট স্যার অনেক হুমকি ধামকি আর মুখে শব্দ করে দুই একটা ফলস্‌ স্টার্ট করিয়ে আমাদের ৬ জনকে মানসিক ভাবে ক্লান্ত করার চেষ্টা করতেন। তারপরেও এয়ারগানের শব্দ শোনার সাথে সাথে আর যেকোন কারো আগেই স্টার্টিং মার্ক থেকে বের হয়ে যেতাম আমি। ততক্ষণে তাওহীদ আমারো এক কদম আগে। মানে সে আরো আগে বের হয়েছে। সব সময় ফলস্‌ স্টার্ট না করলেও সবার আগে বের হওয়া কে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি আর তাওহীদ। ৫০ মিটার পর্যন্ত আমরা থাকতাম ব্যাপক ব্যবধানে প্রথম ও দ্বিতীয়। ৫০ মিটারের পরেই হার মেনে যেতাম ইমরান, মাহমুদ, ওয়ালি, ইমতিয়াজের টপ স্পীডের কাছে। কথাটা ইংরেজীতে খুব ভালো শোনায়ঃ Only acceleration might give you initial success but in the end, on a straight line, top speed does matter. সব সময় হাসি ঠাট্টা করতাম যে কলেজে ৫০ মিটার দৌড় থাকলে সেই ইভেন্টে নজরুল হাউজকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

আন্তঃহাউজ বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় হাউজ গুলোর মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব বলতে কি বোঝায় সেটা হয়তো নতুন করে বোঝানো লাগবে না। যুদ্ধের উত্তেজনা ঠিকমত পেয়েছি সেই সপ্তম শ্রেণীতে যেবার নজরুল হাউজ এথলেটিক্স ট্রফি ছিনিয়ে নেয় ফজলুল হক হাউজের কাছ থেকে। এরপরের বছর থেকে যেদিন মাঠে নেমেছি সবকিছু কেমন যেন ঘোলাটে লাগতো। ৫ম/৬ষ্ঠ হওয়াটা সুখকর কোন অনুভূতি ছিলনা কিন্তু আমার দুটো ইভেন্টে বিশেষ করে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে মনে হতো একই নাটকের একই অঙ্কের পূনঃপ্রচার যেটার মধ্য দিয়ে আরো একবার আমার যেতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা চলচিত্রের স্লো-মোশন অংশের মত। সবকিছুই চলছে আপন গতিতে কিন্তু আমার অনেকগুলো ভাবনা সেই ১২ দশমিক ৭৫ সেকেন্ডের মাঝে জায়গা করে নিত। ৫০ মিটার পার হবার পর পায়ের শব্দে বুঝে যেতাম কে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। “…এটা মাহমুদ ছিলো, ঐ পাশের জন ওয়ালি হবে। আর ভারী পায়ের শব্দটা নিশ্চিত ইমরানের…।” ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করার পর বিজয়ী হাউজের বিজোয়োল্লাসের মধ্য দিয়ে হেঁটে তাবুর কাছে ফেরত আসতে আসতে হয়তো কোন জুনিয়রের হতাশ চোখের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে ঐ কাঁঠাল গাছের তলায় বসে শরীর জুড়াতাম শীতল বাতাসে। কোন চিন্তা নেই, কোন ভাবনা নেই, শুধু ঘাসের দিকে ঘোলাটে দৃষ্টি আর হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক করে নিয়ে আসার বোবা লড়াই।

আমার কল্পনা শক্তি অনেক প্রখর। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। যেকোন স্মৃতিকে কোন নীরব, অনুকূল পরিবেশে চোখ বন্ধ করে প্রায় ত্রিমাত্রিক ভাবে টেনে আনতে পারি এবং উপভোগ করতে পারি। গতকাল থেকে কলেজের স্মৃতি গুলো মনে করছিলাম। সপ্তম-অষ্টম-নবম শ্রেণীর বেশীরভাগ স্মৃতি মনে আসছে না। বেশ অসহায় লাগা শুরু হলো। ১৫ বছরে এতটা জং ধরেছে ভাবিনি। আজকে সকালে অফিসে আসার পথে হেঁটে এসে একটা জায়গায় থেমে গেলাম। অনেক্ষণ ধরে গাড়ি আসছে না রাস্তায়। আবার সবকিছু যেন স্লো-মোশন হওয়া শুরু করলো। সেই শীতের ঠান্ডা বাতাস আর বুনো ফুলের গন্ধ। মা কে বলেছি কষ্ট করে আসা লাগবে না। দুই দিন পর বাসায় এমনেও যাব। দুপুরে আরেকটু কম খেলেও চলতো। ওয়ার্ম আপটা ঠিক যুতসই হয় নাই। এবারের স্পাইক জুতোটা যাচ্ছেতাই। ঘোষণা কেন্দ্রের দিকে হেঁটে যেতে যেতে মাইকে ইংরেজীর আজিজুল হক স্যার বলে উঠলেন, “…this is the final call for hundred meter sprint senior group. Competitors from different houses are….”

২,১০০ বার দেখা হয়েছে

২৩ টি মন্তব্য : “দৌড়…”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)

    লেখাটা পড়ে খুব ভাল লাগলো ভাই। কলেজের অ্যাথলেটিক্স এর কথা মনে গেল।

    আমি কোনদিনও কোন রকম খেলায় ভাল ছিলাম না। অ্যাথলেটিক্স তো অনেক দূরের কথা।
    আমাদের ব্যাচের দৌড়বিদদের( আরমান, সাগর, নাইম, ইকবাল, নাহিদ) দৌড় গুলো এখনো চোখে ভেসে ওঠে।


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. ফারহান ( ২০০৪-২০১০ )

    ভাই এখন দেইখেন নজরুল হাউস কি জিনিস... নজরুল হাউস এর এ্যাথলেটিক্স এর এক বিপ্লবীয় পরিবর্তন এনেছিলেন আমাদের অল্টারনেট সিনিয়র(০২-০৮) রা লিডিং থাকাকালে ... মাহবুব ভাই, মোরসালিন ভাই সহ তাদের ব্যাচের সবার উৎসাহে ইন্টার গ্রুপ এর আন্ডারডগ নজরুল হাউসের আমাদের ব্যাচ টা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়... হ্যাটস অফ টু নজরুলিয়ান (০২-০৮) :boss: :boss: ::salute::

    জবাব দিন
  3. দিবস (২০০২-২০০৮)

    অ্যাথলেটিক্স এর সময় প্রাইজ দিতে দিতে সন্ধ্যা,এরপর হাউসে যাওয়া, ঠান্ডা পানিতে শাওয়ারের নীচে দাঁড়ায় গোসল করা। ছবি দেখা। আর ফাইনালের আগের রাতে আলপনা করা,লাইটিং পেপার দিয়ে টিউব লাইট মোড়ানো। এই সব কিছুরই ১টা গন্ধ এসে লাগে নাকে।

    “…this is the final call for hundred meter sprint senior group. Competitors from different houses are….”

    নস্টালজিক করে দিলেন। 🙁

    স্মৃতি তুমি বেদনা 🙁 🙁 🙁


    হেরে যাব বলে তো স্বপ্ন দেখি নি

    জবাব দিন
  4. মুশফিকুর রহমান তুষার (২০০২-২০০৮)

    দৌড়ের কথা কইলেই মনে পড়ে বিসিসি/২৪ এর মিশকাত ভাই'র কথা। বর্তমান আন্তঃক্যাডেট কলেজ পর্যায়ে ৪০০ ও ৮০০ মিটারে রেকর্ডধারী। (৫০ সেকেন্ড ও ২ মি ৫ সেকেন্ড) ভাই যখন দৌড়াইতো বাকী সবাই শুধু 'স্পীকার' হয়ে থাকতো।
    ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় তিন হাউজের মধ্যে যে উত্তেজনা থাকে তা তো আর কওয়া লাগেনা। কিন্তু এই একজন যখন ৪০০ আর ৮০০ দিতো... তিনশ ক্যাডেটই চাইতো মিশকাত ভাই প্রথম হউক।

    আরেকটা খুব গর্বের স্মৃতি আছে! ২০০৭ এর আইসিসিএলএমএম এ গেছিলাম কুমিল্লা। লাইফের ফার্ষ্ট আইসিসি। ঘুরে ঘুরে কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ দেখতেছি। ফটো ডিসপ্লে বোর্ডের সামনে গিয়ে পুরো হাঁ হয়ে গেলাম। কুমিল্লার ডিসপ্লে বোর্ডের সবার ওপরে মিশকাত ভাই'র ছবি। অজানা অচেনা জায়গায় এই চমকের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কুমিল্লার কলেজ প্রিফেক্ট নাহিয়ান (এই শালা আরেকটা মাল) কে জিগাইলাম, 'মিশকাত ভাইর ছবি এখানে কেন?'
    নাহিয়ান এর জবাব ছিলো; "দোস্ত যারা এথলেটিক্স মিটে যায়নাই সবাই জানতে চায় কে এই মিশকাত ভাই? দেখতে কেমন? ৫০ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার কেমনে?...এইজন্য ছবি ঝুলায়ে দিছি"
    মিশকাত ভাইকে ::salute:: ::salute:: ::salute:: ::salute::


    ছোট হাতি

    জবাব দিন
  5. রাজীব (১৯৯০-১৯৯৬)
    সব সময় হাসি ঠাট্টা করতাম যে কলেজে ৫০ মিটার দৌড় থাকলে সেই ইভেন্টে নজরুল হাউজ ১-২ কেউ ঠেকাতে পারবে না।


    এখনো বিষের পেয়ালা ঠোঁটের সামনে তুলে ধরা হয় নি, তুমি কথা বলো। (১২০) - হুমায়ুন আজাদ

    জবাব দিন
  6. রাফায়েত (২০০২-২০০৮)

    ১। প্রাউড টু বি নজরুলিয়ান (০২-০৮)। ফারহান কে থ্যাঙ্কস আমাদের সম্পর্কে এত ভাল কথা বলার জন্যে। যদিও আমার ব্যাচের একমাত্র মেম্বার সম্ভবত আমিই এই ব্লগে!

    ২। মোরসালিন কে নিয়ে লেখা কই? দেখবার মন চায়!

    ৩। মোকা ভাই... আপ্নেরে ১০০+১ টা লাইক এই লেখা লেখার জন্যে!

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুসতাকীম (২০০২-২০০৮)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।