শেষ সিগারেট

ছুটে চলা ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিলাম আর দুরন্ত বাতাসে বুজে এলো দুটি চোখ। ডোবায় আধখানা চাঁদের টলমলে প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো মুখ। চাঁদ ও বৃষ্টির এই উদ্ভট সহাবস্থানের কোন ব্যাখ্যা দাড়া করানোর চেষ্টা না করে মাথা ভেতরে এনে জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় সহযাত্রীর প্রশ্ন, “বৃষ্টি পড়ছে?” উত্তর দিলাম, “চাঁদের আলো বৃষ্টি দুটোই পড়ছে।” ইয়ার্কি করছি কিনা সেটা বোঝার জন্যে সহযাত্রীর চোখ মূহুর্তের জন্যে সরু হয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে এলো। মুচকি হেসে জানালার মোটা গ্লাসের উপর বৃষ্টির ঝাপটা দেখতে বসলাম। চোখ বুজে আসছিল ঘুমে। দুটো চোখ অনেক দিন হলো নৈশ প্রহরীর চাকুরী নিয়েছে! বুজে থাকা রক্ত বর্ণ চোখ আস্তে আস্তে খুলে ডানে তাকালাম। সহযাত্রী সংবাদপত্রের মধ্যে ডুবে আছেন। বৃষ্টির ঝাপটা আর আধো আলোর মাঝে এক দমে পার হয়ে যাওয়া স্টেশানটা দেখে মনে হলো আড়িখোলা পার হলাম। ঘোড়াশাল পৌঁছাতে বেশী দেরী নেই। উঠে দাড়াঁলাম। বগির শেষ প্রান্তে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পকেট হাঁতড়ে দুমড়ানো সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে খুলে দেখলাম একটি সিগারেট অবশিষ্ট আছে। ৪র্থ দেয়াশলাই এর কাঠি সাফল্যের মুখ দেখলো। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে আশেপাশে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীদের উপর চোখ বুলিয়ে নিলাম। দরজায় দাঁড়িয়ে অন্ধকার বৃষ্টি দেখি। আজকে মাথায় কোন ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে অপেক্ষার সময় পার করা খুব কষ্টকর হয়ে যায়। আমার খুব কাছের বন্ধু হলো আমার ভাবনাগুলো। ওরা না থাকা আমার অস্তিত্বের জন্যে হুমকি সরূপ। আচ্ছা আজকে নাহয় বাদ দিলাম।

মাকে বলেছি আজ ফিরতে নাও পারি। শুয়ে পড়ে যাতে। আচ্ছা যদি বাসায় না যাই তাহলে রাতের খাবারটা কোথায় খাওয়া হবে? সেই চিন্তা যদিও এখনও করার সময় আসেনি বা প্রয়োজন নেই বললেই চলে। মা বলছিল বেগুন ভর্তা আর টেংরা মাছের ঝোল রাতের আয়োজন। প্রিয় খাবারের লোভ দেখিয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে আসার অভ্যাসটা মায়ের অনেক পুরোনো এবং অব্যর্থ। তবে আজ হয়তো এর ব্যতিক্রম হবে। মহিলার একাকিত্বে আজ বাধা দিব না। আধপোঁড়া সিগারেট থেকে উড়ে আসা এক টুকরো ছাইয়ের কণাকে আরেক হাত দিয়ে ধরে ফেললাম। ধীরে ধীরে জ্বলে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। শেষ একটি টান দিয়ে আবারো ভাবলাম, আজকের দিনের এটাই শেষ সিগারেট।

দূরে সারি সারি বাতি গুলো পরিচিত ঠেকলো। সামনেই শীতলক্ষ্যা নদীর উপর ঘোড়াশাল রেল সেতু। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুরন্ত ট্রেন গমগম শব্দ করে সেতুতে উঠলো। শেষ একটি টান দিয়ে আবারো ভাবলাম, আজকের দিনের এটাই শেষ সিগারেট।

লোকজনের হইচই চিৎকার ট্রেনের শব্দকে ছাপিয়ে যাওয়ার আগেই খুব দ্রুত মিলিয়ে এলো। আধখানা টলমলে চাঁদের আলো খুব কাছে চলে এলে হঠাৎ মনে হলো, “আচ্ছা আমি তো সাঁতার শিখিনি।।”

[প্রয়াত বন্ধু তাওহীদ আল মাহমুদ (১৯৪৬, নজরুল হাউস, ৩৬তম ব্যাচ, মকক) এর স্মরণে]

১,৩৮৪ বার দেখা হয়েছে

১১ টি মন্তব্য : “শেষ সিগারেট”

  1. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    লেখাটা দারুন লাগলো মোকাব্বির, সেই সাথে অনেকদিন পরে এখানে তোমাকে দেখে ভাল লাগলো।


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
    • মোকাব্বির (৯৮-০৪)

      নূপুর ভাই ঠিক তাওহীদের কথা বলি নাই। ট্রেনে চড়তে স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করি এবং প্রচুর চড়াও হয় আবার সেই সাথে মাঝে মাঝেই মন খারাপ হয়। ওর চলে যাওয়াকে মনে করে আমার কিছু চিন্তা ভাবনার সংমিশ্রণেই এটা লেখা। 🙁

      গান-বাজনা আপাদত ঝিমিয়ে পড়েছে। আমেরিকা চলে যাচ্ছি আগস্ট মাসে। মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করতে। সেটার শেষ প্রস্তুতি চলছে।


      \\\তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা
      অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের ওপর।\\\

      জবাব দিন
  2. শাওন (৯৫-০১)

    তাওহিদকে নিয়ে লেখা এটা ভাবতেই বেশী ভালো লাগছে...হয়তো ও এমন টা করতে বেশী পছন্দ করত ...।


    ধন্যবাদান্তে,
    মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান শাওন
    প্রাক্তন ক্যাডেট , সিলেট ক্যাডেট কলেজ, ১৯৯৫-২০০১

    ["যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায় ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি"]

    জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মোকাব্বির (১৯৯৮-২০০৪)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।