যেখানটায় সূর্য উঁকি দেয় না

মিরপুর থেকে কুড়িল বিশ্বরোডের জার্নিটা মিনিট বিশেকের বেশি স্থায়ী হয় না। রেল ক্রসিঙের জায়গাটায় দারুণ ভিড়। গরম বেশি পড়ায় বিভিন্ন ফলের রসের দোকান গজিয়ে একেবারে ব্যাড়াছ্যাড়া অবস্থা। মানুষ হা করে ছুটছে ছায়ার আশায়। যত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যায় ততই মঙ্গল। আমিও ছুটছি। ১২ টার দিকে স্ট্যাটিস্টিকস ফাইনাল। তবে কিছু একটার দিকে চোখ আটকে গেল। খুবই সাধারণ একটা দৃশ্য। আমি শতভাগ নিশ্চিত এই একই ফরম্যাটের জিনিস আমরা সবাই বিভিন্ন জায়গায় হরহামেশাই দেখি। জিনিসটা আর কিছুই না। দুটো পা নেই, দুটো হাত নেই, টায়ারের কাটা অংশ দিয়ে হাঁটু আর কনুই ঢাকা। পিচের উপর ছেঁচড়িয়ে অথবা গড়িয়ে চলাফেরা করে। একজন মানুষ। জিনিস বলে ভুল করলাম কি ? মনে হয় না। ব্যবসার নিমিত্তে কাস্টমাইজড জীবদেহকে আমরা জিনিস বলতেই পারি।

 

যা বলছিলাম। ওই লোকটা ভিক্ষাই করছিল। এই ফরম্যাটের আর সবাই যা করে। শুধু তার স্পেশাল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অদ্ভুতভাবে কাটা বাম হাতটা কাঁপানো। ফ্রিকুয়েন্সি অনেক হাই। কিন্তু সে জানে না, তার এই কুৎসিত স্পন্দন দেখে অনেকেই যে আরেকটু দূর দিয়ে যাচ্ছে। আমি অনেকদূর গিয়েও লোকটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যারা পড়ছেন নিশ্চয়ই ভাবছেন এই তো আরেকটা নিজের যা আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়া টাইপের লিখা। নাহ, এবেলা আর তা লিখছি না।

 

আমার ভাবনা জুড়ে তখন একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছিল তখন। ঠিক কিভাবে এই একই বৈশিষ্ট্যওয়ালা ভিক্ষুক এতো জায়গায় দেখা যায়? ঠিক এই লোকটির মতোই ভিক্ষুক আমি আমার নিজ জেলায় বহুত দেখেছি। ফার্মগেটে একটা রাউন্ড দিলে এইরকম চার পাঁচজন মিলবে। কিন্তু কেন ? এদের কি জন্মই এভাবে হয়েছে ? অনেকের কাছে শুনি ছোট থাকতেই নাকি ব্যবসা করার স্বার্থে রাস্তার অনাথ বাচ্চাদের এই ফরম্যাটে প্রতিবন্ধী বানিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এইটা আমার বিশ্বাস হতে চায় না। যাই হোক না কেন, আমরা সভ্য জাতি এবং দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যথেষ্ট শক্তিশালী। আজকাল ধনীর দুলালী অথবা দুলালদের অথবা প্রভাবশালীর স্মার্টফোনটি হারিয়ে গেলে যেখানে একদিনের মাথায় তা উদ্ধার সম্ভব হয়, সেখানে এই ধরণের চক্র কোনভাবেই সারভাইভ করতে না পারাই তো যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়। এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি নিজেকে গরম গরম পরোটা আর ডালভাজির সামনে আবিষ্কার করি। আমার মতো এইরকম অনেক আজাইরা ভাবুকও হয়তো ঠিক একইভাবে একইজিনিস ভাবতে ভাবতে নিজেকে পরোটার সামনে আবিষ্কার করে। গোগ্রাসে গিলতে গিলতে সেও এই চরমভাবে নিগৃহীত ও নির্যাতিত গড়িয়ে চলা জিনিসটির প্রতি জন্ম নেয়া ক্ষণিকের অনুভূতিটুকু গলাধঃকরণ করে।

 

আসলে সকল ধরণের অনুভূতিই পাচ্য বস্তু। শুধু কতোটুকু সময় লাগে তা হজম হতে সেটাই দেখার বিষয়। আমাদের জীবনের অন্য সব লক্ষ্যের মধ্যে একটা বড় লক্ষই হচ্ছে ভুলে যাওয়া। হিউম্যান রেইসের সারভাইভালের জন্য তা বেশ দরকারিও বটে। শুধু মাঝে মাঝে মনে হয় কিছু কেউ কেন করে না ? এই যে অলিতে গলিতে অর্শগজ, ভগন্দর, ফিস্টুলা, ক্যান্সার এইসবের দেদারসে চিকিৎসা চলছে এইগুলা কি নিমেষে গুঁড়িয়ে দেয়া যায় না ? কি লাগে ? হাইকোর্টের একটা রুল অথবা সংসদে একটা বিল পাসই তো লাগে তাইনা ? হয়তো ঠিক জানিনা তবে প্রক্রিয়াটা তেমন কঠিন নয় এইটুকু বুঝি। এইসবের দ্বারা আক্রান্ত মানুষগুলির আকাশটা সাদাকালো। বৃষ্টি হলে অথবা ঠাণ্ডা বাতাস বইলে এদের চোখে স্বপ্নালু রঙ জলরং হয়ে মিশে যায় না। এদের আকাশের বাতাসের রঙটাও ধূসর। এইসব অসংখ্য ধূসর আকাশ কোনদিন হয়তো আমাদের রঙিন ফ্রেমবন্দী আকাশটাকেও গ্রাস করে নিবে। এইটা আমার কল্পনা। যেই অন্ধকার জীবনের জন্য আমরাও আংশিক দায়ী, তার কিছুটা অন্ধকার তো আমাদেরও প্রাপ্য।

১,৬৯৫ বার দেখা হয়েছে

১৩ টি মন্তব্য : “যেখানটায় সূর্য উঁকি দেয় না”

  1. সামিউল(২০০৪-১০)
    দ্বারা আক্রান্ত মানুষগুলির আকাশটা সাদাকালো। বৃষ্টি হলে অথবা ঠাণ্ডা বাতাস বইলে এদের চোখে স্বপ্নালু রঙ জলরং হয়ে মিশে যায় না। এদের আকাশের বাতাসের রঙটাও ধূসর।

    কী আর করা ভাই; রাস্তাঘাটে এদের দেখি। তখন খুব মন খারাপ লাগে। হয়তো দুই-চার টাকা দেই, আবার ভুলে যাই। এদের কেউ মনে রাখে না। 🙁


    ... কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে!

    জবাব দিন
  2. আহসান আকাশ (৯৬-০২)

    ভিক্ষা এখন একটা বেশ ব্যবসা সফল ব্যাপার, বড় বড় সিন্ডিকেট এর পিছনে গড়ে উঠছে আর তার স্বীকার হচ্ছে এরকম বহু হতভাগা মানুষ।

    লেখা ভাল হয়েছে :thumbup:


    আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার
    আমি সব দেখে শুনে, ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার ৷

    জবাব দিন
  3. মাহমুদুল (২০০০-০৬)

    এমন অনেক চক্র আছে। কেন কামরাঙ্গীর চরের সেই শিশুর কথা মনে নেই? ব্লেড দিয়ে জননেন্দ্রীয় কেটে, সারা শরীরের চামড়া ব্লেড দিয়ে চিড়ে ১৪ দিন একটা কলস জাতীয় পাত্রে আলোহীনভাবে রেখে দিয়েছিল। এমন অনেক আছে। বেশ ভালো ব্যবসা ভিক্ষাবৃত্তি। অবশ্য সবাই যে ব্যবসা হিসেবেই নিয়েছে তা নয়।


    মানুষ* হতে চাই। *শর্ত প্রযোজ্য

    জবাব দিন
    • মহিউদ্দিন (২০০২-২০০৮)

      কষ্ট লাগে ভাই। মানুষের মৌলিক চাহিদা আছে ছোটবেলা শিখেছি। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এইসব। আধুনিক যুগে সেই লিস্টে যৌনতাও বিদ্যমান। কিন্তু এইসব মানুষগুলার ক্ষেত্রে মৌলিক চাহিদা শুধু খাদ্যে এসে আটকে আছে। থাকবে। কিচ্ছু করার নাই।


      Prisoner of Own Mind

      জবাব দিন

মওন্তব্য করুন : মুয়াজ (২০০৭-২০১৩)

জবাব দিতে না চাইলে এখানে ক্লিক করুন।

দয়া করে বাংলায় মন্তব্য করুন। ইংরেজীতে প্রদানকৃত মন্তব্য প্রকাশ অথবা প্রদর্শনের নিশ্চয়তা আপনাকে দেয়া হচ্ছেনা।